এ মাসের কবি
– জানুয়ারি ২০১৪
সোমনাথ সেন
তরুণ কবি সোমনাথ সেনের জন্ম ১৯৮৩ সালে বাঁকুড়ায়। শিবপুর বি ই কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় কবিতার সংস্পর্শে আসা, তারপর থেকে চাকরি সূত্রে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় । এই সময় থেকেই আন্তর্জালে ও বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালিখি শুরু। আসন্ন কলকাতা বইমেলায় ‘কৌরব’ প্রকাশনী থেকে সোমনাথের কবিতার প্রথম বই ‘পারদ শাসন’ প্রকাশ পেতে চলেছে। সেই টাটকা পান্ডুলিপি থেকে খানিকটা... এই পাতায়...
আত্মগোপনের পরিখা
***
শোয়ানো হল তাকে,
অল্পবিস্তর
নির্জনতা মুছে
ফেললে একটা শাসন আরও তীক্ষ্ণ হতে থাকে
একটু আগে হলে -
কোষের কথা বলতাম,
স্বাভাবিক বিভাজনের কথা
অথচ দ্যাখো, যেভাবে
মর্গের আশেপাশে ঘুরতে ঘুরতে জড়ো করে ফেলছি
জলাজমি, ফার্নের
আশ্রয়
আর -
একটা রসুন ক্ষেতের
পাশ কাটিয়ে
একটা জরুরি অবস্থা পেরিয়ে যাচ্ছে সারারাত
শুধু জানা ছিল না
কিভাবে এই অনুপ্রবেশ
কিভাবে বিন্যস্ত
মেদ ঝরিয়ে কমিয়ে ফেলছি বয়স
একেই বুঝি
স্নিগ্ধতা বলে –
কাম ক্রোধ বিস্ময়
থেকে একমাত্র পরিচারিকার দিকে
ছুটে চলা শব্দযান
***
শুধুমাত্র কাচ
নামানো ছিল বলে এতক্ষণ বুঝতে পারিনি নিষ্ক্রিয়তা
শূন্যতার শিহরন
নিয়ে এই উপদ্রব
এই কল্পবিজ্ঞানের
কোন রোজনামচা নেই – অথচ যা ছিল
স্নায়ুপ্রবাহে,
একটা অস্পষ্ট তাপের পর
ধীরে ধীরে গুটিয়ে
যাওয়া
এই মুহূর্তে একটা
জন্মান্তর ঘটে যায়
স্পর্শ, ওলটপালট
আঁশের সাথে যে মাংসল অবস্থা ছিল
শূন্যতার নভেম্বরে
একটা বিকেল
ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে
আর কোন কিছুই স্বাভাবিক থাকল না
ভেতরে ভেতরে বেড়ে
উঠল একটা উন্মুক্ত মুখ
খুব স্বাভাবিক
ভাবেই প্রতিবিম্বের দিকে একটু প্রবাহ বেড়ে যায়
ঘুমিয়ে পড়ার আগে
পারার মুখে চোখে
লেগে থাকে একটা লালচে দাগ
একটু পরিচর্যা
স্নায়ব অবস্থান
পালটে
এইসব ধীরে ধীরে
ঠেলে দিই সামান্য হিংস্রতার দিকে
***
এই অণুবীক্ষণে তোর
অবয়ব পরিস্ফুট হয়
আত্মগোপনের পরিখা
ঘিরে যা কিছু বল্গাহীন, যা কিছু স্পর্শযোগ্য
সেই মুহূর্তের
মধ্যে ভেসে ওঠে জলজ পরিধি
একমাত্র স্মৃতিই
পরিচয়পত্রের আড়াল নিয়ে পেরিয়ে যেতে থাকে এইসব
আমাদের প্রচেষ্টা
বাড়তে থাকে প্রিয় বলয়ের দিকে
যা কিছু মুখ ফিরিয়ে
নেওয়া আলোকপাত, সন্ধ্যার ডালপালা ঘিরে
শরীরের জ্যামিতি
খুলে যায়
আর, এক একটা আধেয়
থেকে নেমে আসে মধ্যাহ্ন বিরতি
জমানো শব্দের দিকে
গর্ভদশা কাটতে থাকলে
বিন্দু বিন্দু
স্থবিরতা পুনরায় হাতল আঁকড়ে ধরে
আর একটা হাইওয়ে ধরে
পেরিয়ে যায় একের পর এক
নিরুত্তাপ সুড়ঙ্গ
আমরা লীনতাপ পেরিয়ে
গিয়ে
অনুভূতির শীর্ষে
দাঁড়াই
***
ক্রমে ক্রমে যা
ভেসে উঠছে তা-ই একমাত্র দেহের পশম
তুমি জানতে এই একটু
মানবজন্মের চেয়ে কঠিন – পোশাকের নিরিখে নিরিখে
ছন্দ নেই, নিয়ম নেই
আমরা যা লিখে
রাখতাম, পেনের আগায় এক হয়ে আসা
নিরুত্তাপ জীবন
তবুও তো এক অভাবনীয়
কার্নিশের ওপর পাল তুলে দিলাম আমরা
প্রতিবেশীর কাপড়ে,
ব্লাউজে
যে রান্নাঘরের গন্ধ
জমাট বাঁধে
যে পিতৃপুরুষের
ভিটে-মাটি এক করে
আরও আরও এক
সমাজবদ্ধতার দিকে সরে এসেছি
কে জানত আমাদের
জানলায় এখনো লেগে আছে আচারের দাগ
লাটাই ও স্পর্শের মোমবাতি
***
একটা হলুদ সম্ভাবনা
একটা স্মৃতির জারণে ধাতুগুণ হারাতে থাকে
যেভাবে এই গভীর
উপত্যকার দেয়ালে, ঘাসবন ছাপিয়ে
নিরুদ্দেশ হয়ে আছে
কিছু স্তন্যপায়ী ভিড়
কিছু আনত কিশোরীর
মুখ
ঘরের অগ্রজ কোণে,
নেমে থাকা দু-একটা স্মৃতিকথা দেখে
ব্যাসার্ধ ভেঙে যায়
যে কোন দিকে
তাকালেই মনে হয়
শুধু ভাঁজ নিয়েই এত
নিবিড়তা
এত নদীপথের বিলীন
হয়ে যাওয়ার দৃশ্য
আর মধ্যবিত্তের
আঙুলে জমা হতে থাকা তামার আঙটি
শুধুমাত্র শোক বয়ে
আনে - সীমাহীনতার দিকে
এদিকে ভেঙে যাচ্ছে
একের পর এক প্রণালী
সমস্ত শিল্পের ওপর
অগভীর হয়ে আছে যোনির দাগ
অথচ স্বাভাবিক পরিচর্যার
বাইরেও যে বিশ্বাস ছিল
বিস্তর লুকিয়ে পড়ার
মধ্যে স্বেদবিন্দুর দাগ
বেশ ঝকঝকে – তুমি জানতে পারলে না এইসব মসৃণ বিকেল থেকে
সাবলীল বনের দিকে
ফিরতে থাকা
***
মধ্যবর্তী দূরত্ব
কমে এলে আমাদের করিডোর আবছা হতে থাকে
পরিচিত সীমানা
ছাড়িয়ে যেই
দু-একটা মানুষ
নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে আমাদের -
আমাদের সাময়িক বিষণ্ণতা
এইটুকু উপলব্ধি
নিয়ে আবাসিক চেতনা ফিরে আসে
বিমানের ছায়া বড় হতে থাকে
ঘুম ভেঙে যায় – নদীপথও
আপাত আড়াল থেকে
এতটা দূরভাষ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে
এতটা পাহাড় নিয়ে, জমতে থাকবে
বরফের চূড়া
মুখ ঘুরিয়ে ফেলি – স্বাভাবিক ভাবেই
এতটা শরীর দেখে
ফেলার পরও অস্বাভাবিকতা থেকে যায়
গুহার রঙে, আজ
বসন্তের শেষ
আর সামান্য এগিয়ে
আসতেই আমাদের ঘর দেখা যায়
অন্যান্য মানুষের
মাথার মত
ঘোলাটে জল নিয়ে বয়ে
যায় অস্থিরতা
বাঁকের জমাট গন্ধে
***
অক্ষরের স্তূপ থেকে
গেছে সিঁড়ির আড়ালে
অথচ কেউ নামছে না – গাছ বেয়ে, ডাল বেয়ে – পা-দানিটির দিকে
একটা সমাজ
একটু মাথা তুলে দাঁড়ানো
পর্যন্ত বেশ কুয়াশা ঢাকা
অল্প অল্প গতিপথ
যাদের ভালো লাগে
সারারাত নেমে এসে
দেখি – একটা অন্য সমাজের দিকে
নেমে পড়ছি
এক স্তূপ থেকে অন্য
স্তূপের ভেতর
সারা দেহ – আঘাতের সমস্ত চিহ্ন তুলে রেখে
একটা প্রিয় খেলা
মেয়েটির দিকে
***
সাবওয়ের ভেতর পড়ে
আছে একটা পরিত্যক্ত লাশ
সে এক অনুলিখন
ভেজা চুলের মুখ
দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়লে কেটে ফেলা প্রয়োজন
যেমন এক মানচিত্রের
সাথে খাপে খাপ মিলে যায়
আর এক মানচিত্র – সামান্য বিভেদ ছাড়াই
আর একটা পাথর
পেরিয়ে আসতে
মুখ থুবড়ে পড়া
মানুষের দিকে অবদমিত হতে থাকে ঝোপঝাড়
এরপরও যতটুকু ছিল
যাতায়াত
বিবর্তনের দিকে মুখ
ঘুরিয়ে দীর্ঘ বাইশ বছর, সাদা বুনটের মত
এক ভাবনা থেকে আর
এক ভাবনা
নদীতট – সমস্ত পলি ভেসে যায়
আমরা নদীর সামনে
সবচেয়ে ভারী অংশের দিকে মুখ তুলে দেখি
শুধু স্তনপানের
স্বচ্ছতা নিয়ে
সুন্দর হয়ে আসছে
পাপড়িগুলো – এক চতুষ্কোণ থেকে আরেক চতুষ্কোণে
***
দীর্ঘ অবসাদের পর
নেমে আসছে সকালবেলার স্মৃতি
এই এক জাতীয়তা
তারপর থেকে যতবার
আকাশের দিকে তাকাই
খাতার নিচ থেকে
ফুলে ওঠে বহুগামিতা
একটা চেতনাহীন
খসখসের কথাই ভাবো
প্রতিনিয়ত পদক্ষেপ থেকে, মিছিল থেকে বেরিয়ে আসছে
কিশোরীর নরম বিকার
আমাদের একেকটা
আত্মগোপন
গোড়ালি পর্যন্ত
নেমে এলে
সুদীর্ঘ হয় বরফপাত
***
একটা আনুমানিক রাত
পেরিয়ে আসে
ঘুমের মুখ থেকে যে
সকল স্কার্ফের ওপর জড়িয়ে বসছিল
ঘুড়ির চোখ – সেই বৃত্তের ধারণা বদলে যায়
দেখি, একমাত্র
মরুভূমি নিয়ে জন্মান্তর ঘটে গেছে একটা সম্পূর্ণ নদী
যদিও সেদিন পর্যন্ত
গ্রাম ছিল ভাঙা
দেয়ালের ওপর থেকে
মেয়েবেলার লাটাই – এও সম্ভবপর হল
যেদিন জামার বোমার
খুলতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম
রজঃস্রাবে ভেসে
যাচ্ছে সমস্ত শরীর
একটা অদৃশ্য মানুষে
ভর করে
এক একটা উনোন
জ্বালানো আর তারপর থেকে ক্রমাগত বিলাপে
ঢেকে গেল ঘরবাড়ী
উঠোন
ও চিরুনি তুলে
রাখার উপাখ্যান