দুটি চিঠি
বারীন ঘোষাল
সহবাস শিবির
অতনু, তোর এই বইটা পড়তে পড়তে
একটা ঘোরের মধ্যে কাটল সময়। অনেক কথা মনে আসছে। জলের নৌকা আর নৌকার জল – এই দুটো
আলাদা অবস্থা। জল আর নৌকা কেউ কাউকে মনে রাখে না। মনে রাখে দুজন। কবি-যাত্রী নিজে
আর কবি-দর্শক যে পাঠকও। এক তুই আর এক আমি। ‘জলের শব্দ আকর্ষণ / করে না বলে / ভাবতে
পারি না / একা স্রোতকে’...... নব্বই দশকের এই প্রথম দিকের এই কবিতা থেকে
......‘পাড় খুলে নিলে / নদী এক উতল মাদুর’...... আজকের এই কবিতায় দীর্ঘ যাত্রাপথে
অনেক মূল্যবান সময় ব্যতীত, যার সাক্ষী আমি আর তুই, দুজনেই। সে সব তোর সমস্ত নিয়ে
আলোচনর সময় জানাব। কীভাবে তোর আরোহণ কোন চূড়ায়, কোন পথে তোর কবিতার ট্রেনিং, এই সব। তার আগে তোর
সাথে একলায় বসতে চাই। কথাবার্তা বলতে, যা একান্ত কথা। ‘সহবাস শিবির’ বইটার
পান্ডুলিপি আমার কাছে ছিল দীর্ঘদিন, আমি ভুমিকা লিখিনি, তুইও বলিসনি, পরবর্তী
সমস্ত আলোচনার স্বার্থে। তবে যেমন আশা করি, বইয়ের প্রথম কয়েকটি আর শেষ কবিতা চমৎকার হতে হবে, সেভাবেই সাজানো ‘সহবাস শিবির’। ভালো লেগেছে পড়তে ... ‘চাইছে মৃদু / এক জোতের
পূর্ণিমা / স্টেশনের দিয়া দিয়া শুনে’ ...... ভালো লাগছে কানে, সাবলীল,
সিনক্রনিক, এটাই সমসাময়িক কবিতার সাধারণ ভাষা। একেবারে শেষে ...... ‘এরপর একা
কার পায়ের শরম’ – তবুও ভাল লাগে। তবে, পূর্বাংশের গতিময় উচ্চারণ এখানে মন্দগতি
লিরিক হয়ে পড়ল কি? তাই তো হওয়া উচিত মনে হয়। ভাল লাগে, আমি তো ‘একাকার’ করে পড়লাম।
ভাল লাগছে। আমার, মানে পাঠকের স্বাধীনতা এটা। আর শরম এখানে রম রম বা, ‘ম ম’ করছে
মনে হল। শেষের কবিতাটায় ...... ‘আরো আরো অপরূপ
ব্যথার পার্বণে / কিভাবে আমাদের শীতকাল / এল আর গেল’ ...... কী ভাল লাগছে! এই
কবিতাটার মধ্যে রাখছি, দেখি এই
দুটো সেলফ-অ্যাক্টিভ ক্রিয়া বাদ সাধছে না মনে হল।
সহবাস
শিবির অন্তসলিল প্রেমের কবিতাগুচ্ছ। সপ্রাণ। সৎ। একনিষ্ঠ কবির বয়ান। দেখা হলে আরো। দেখাবো
কিভাবে দাগিয়ে পড়েছি বইটা।
বারীনদা।
ছায়ারোদের ব্রেইল
তোমার কবিতার বইটা পড়লাম মানিক। ২০০৯-১০, মাত্র দুবছরে
লেখা কবিতা আরো তিন বছর পর বই হয়ে বেরোল। তোমার প্রথম বই, বেশ ভাল হয়েছে। এই রেটে
আমার বয়সে তোমার বই কি রকম হবে ভাবতে পারি, যদিও দেখার জন্য বেঁচে থাকব না।
পরিশীলিত, অতিরেকহীন, নির্মেদ কবিতা লিখেছ তুমি। দিনহাটাতে বসেও একজন অসাধারণ
কবিতা লিখতে পারে। সেজন্য কলকাতার প্রয়োজন নেই। প্রচ্ছদটা খুব ভাল হয়েছে। আবহমান
বাংলা কবিতাধারায় তুমি একজন অগ্রবর্তী অভিযাত্রী। আমার অভিনন্দন।
-- ‘পাতাল ছুঁয়ে আমাদের না-থাকা’...... কেমন এক
লাইনেই পাতালের অস্তিত্ব অনস্তিত্ব জানিয়ে দিলে! -- ‘পাহাড় উঠলে / এখনো আমরা অবশ
হয়ে যাই’ – আরে! এটা তো আমারই কথা! দূরে কেন -- জামশেদপুরের পাশেই আছে পাহাড় –
শহরের বাইরে বেরোলেই পাগল পাগল লাগে। তোমার কবিতাই আমার কবিতা। তুমি লিখে ফেললে।
তাই তো এই আমরা অবশ হয়ে যাই কবিতাটা আমার এত ভাল লাগলো। ‘নিসর্গের জুতো’
এটা তো আগে ভাবাই যাইনি। আমরা জুতো পায়ে নিসর্গের কাছে যাই। তুমি নিসর্গের পায়ে
জুতো পরিয়ে তাকেই চলমান করলে, সিনারিও করে তুললে একটা আঁচড়ে। ভেসে যাওয়া গান আর
ভেঙে যাওয়া ভাটিয়ালি – এই দুই সমবোধকের মাঝে স্যান্ডুইচ করে দিলে – ‘খাঁচার ভিতর
পাখি / পাখির ভিতর খাঁচা’ – এই মুখমুখি উলটপুরাণ, জীবনের সমস্ত দর্শন! সাবাস
মানিক।
এভাবে আরো
অনেক কবিতা আমার ভাল লেগেছে। সেগুলো হল শিরোনামহীন, ঈশ্বরের নাভী, আলখাল্লা বাতাসে
সরে যায়, ঈশ্বরের চিঠি, আমরা অবশ হয়ে যাই, হাওয়ার চিরকুট, একটি তারার আমি,
ইত্যাদি।
ভাল লেখো,
সুন্দর লেখো, ভাল থেকো মানিক। শুভেচ্ছায় --
বারীনদা।
৭/৫/১৩