• কবিতা সুর্মা


    কবি কবিতা আর কবিতার কাজল-লতা জুড়ে যে আলো-অন্ধকার তার নিজস্ব পুনর্লিখন।


    সম্পাদনায় - উমাপদ কর
  • ভাবনালেখা লেখাভাবনা


    কবিতা নিয়ে গদ্য। কবিতা এবং গদ্যের ভেদরেখাকে প্রশ্ন করতেই এই বিভাগটির অবতারণা। পাঠক এবং কবির ভেদরেখাকেও।


    সম্পাদনায় - অনিমিখ পাত্র
  • সাক্ষাৎকার


    এই বিভাগে পাবেন এক বা একাধিক কবির সাক্ষাৎকার। নিয়েছেন আরেক কবি, বা কবিতার মগ্ন পাঠক। বাঁধাগতের বাইরে কিছু কথাবার্তা, যা চিন্তাভাবনার দিগন্তকে ফুটো করে দিতে চায়।


    সম্পাদনায়ঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়
  • গল্পনা


    গল্প নয়। গল্পের সংজ্ঞাকে প্রশ্ন করতে চায় এই বিভাগ। প্রতিটি সংখ্যায় আপনারা পাবেন এমন এক পাঠবস্তু, যা প্রচলিতকে থামিয়ে দেয়, এবং নতুনের পথ দেখিয়ে দেয়।


    সম্পাদনায়ঃ অর্ক চট্টোপাধ্যায়
  • হারানো কবিতাগুলো - রমিতের জানালায়


    আমাদের পাঠকরা এই বিভাগটির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন বারবার। এক নিবিষ্ট খনকের মতো রমিত দে, বাংলা কবিতার বিস্মৃত ও অবহেলিত মণিমুক্তোগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে আনছেন, ও আমাদের গর্বিত করছেন।


    সম্পাদনায় - রমিত দে
  • কবিতা ভাষান


    ভাষা। সে কি কবিতার অন্তরায়, নাকি সহায়? ভাষান্তর। সে কি হয় কবিতার? কবিতা কি ভেসে যায় এক ভাষা থেকে আরেকে? জানতে হলে এই বিভাগটিতে আসতেই হবে আপনাকে।


    সম্পাদনায় - শৌভিক দে সরকার
  • অন্য ভাষার কবিতা


    আমরা বিশ্বাস করি, একটি ভাষার কবিতা সমৃদ্ধ হয় আরেক ভাষার কবিতায়। আমরা বিশ্বাস করি সৎ ও পরিশ্রমী অনুবাদ পারে আমাদের হীনমন্যতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরটি সম্পর্কে সজাগ করে দিতে।


    সম্পাদনায় - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
  • এ মাসের কবি


    মাসের ব্যাপারটা অজুহাত মাত্র। তারিখ কোনো বিষয়ই নয় এই বিভাগে। আসলে আমরা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কবিকে নিজেদের মনোভাব জানাতে চাই। একটা সংখ্যায় আমরা একজনকে একটু সিংহাসনে বসাতে চাই। আশা করি, কেউ কিছু মনে করবেন না।


    সম্পাদনায় - নীলাব্জ চক্রবর্তী
  • পাঠম্যানিয়ার পেরিস্কোপ


    সমালোচনা সাহিত্য এখন স্তুতি আর নিন্দার আখড়ায় পর্যবসিত। গোষ্ঠীবদ্ধতার চরমতম রূপ সেখানে চোখে পড়ে। গ্রন্থসমালোচনার এই বিভাগটিতে আমরা একটু সততার আশ্বাস পেতে চাই, পেতে চাই খোলা হাওয়ার আমেজ।


    সম্পাদনায় - সব্যসাচী হাজরা
  • দৃশ্যত


    ছবি আর কবিতার ভেদ কি মুছে ফেলতে চান, পাঠক? কিন্তু কেন? ওরা তো আলাদা হয়েই বেশ আছে। কবি কিছু নিচ্ছেন ক্যানভাস থেকে, শিল্পী কিছু নিচ্ছেন অক্ষরমালা থেকে। চক্ষুকর্ণের এই বিনিময়, আহা, শাশ্বত হোক।


    সম্পাদনায় - অমিত বিশ্বাস

অংশুমান

কবিতা দিয়ে যতটা হাঁটলাম



কো‌নো শিল্পের, কোনো মৌলিক ধারণা নেই।

ছোটবেলা থেকে যতটা বড় হলাম তাতে আমার এই ধারণাটাই স্পষ্ট হয়ে এলো। এটাও কি একটা মৌলিক ধারণা?

যাই হোক। আজ থেকে ১৫ বছর আগে মনে হতো কবিতা বুঝি। তখন আমার আসেপাশের বন্ধুরাও এই সাহসটা দেখাতে পারতো না। তারা শুনেছিলো যে কবিতা নাকি ঠিক বোঝা যায়না। রবি ঠাকুরের কবিতা বুঝতে গেলে নাকি বিশাল জ্ঞান থাকতে হয়। মোট কথা, এরকম শুনতে শুনতে বড় হয়েছি যে কবিতা বোঝা যায়না। কেউ কেউ বোঝে, তারা মানে বই লেখে। নোট লেখায়, ক্লাস নেয়। তারা জানে কবি কী বলতে চেয়েছেন। তারা কবিতার সাথে মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, প্রেম, প্রকৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, অসুখ, কল্পনা, ভ্রমণ ইত্যাদির সম্পর্ক স্পষ্ট দেখতে পায়। তাতে মনে হয়েছিল কবিতা কোনো শিল্প নয়, একপ্রকার এনকোডিং। গদ্য-গল্প তে যা সোজা সাপ্টা বলা থাকে কবিতা তার ছোট এনক্রিপ্টেড ভার্সন। কবিতা যে শিল্প সেটাই আমাদের পরিবেশের কারণে ছোটবেলায় জানা হয়ে ওঠেনি।

কো্নো শিল্পকে উপভোগ করতে গেলে তা কী করে করতে হয় জানা দরকার। যেমন কবিতা উপভোগ করতে গেলে কবিতা লিখতে জানতে হয়। যারা লেখেন না উপভোগ করতে জানেন তারা আসলে কবি মানসিকতার। একজন যথাযথ পাঠকের কবিতা লিখতে পারার কথা। কোনো কারণে তারা ডেলিভার করে ওঠেন না, হয়তো দরকারও পড়েনা বা আত্মবিশ্বাস নেই। যেমন গান সঠিক ভাবে উপভোগ করতে গেলে জানতে হয় সুর-তাল-লয়। যারা বোঝেনা কিন্তু উপভোগ করেন তাদের জান্তে-অজান্তেই মনের ভেতরে এগুলোর উপলব্ধি থাকে। যাকে চলতি কথায় আমরা বলি, লোকটার মিউজিকের সেন্স আছে। তাই কবিতা লিখতে চেষ্টা করতে লাগলাম। যাদের বেশির ভাগ প্রচেষ্টাটাই খরচ হয়েছিল অন্ত্যমিল খোঁজার উদ্দেশ্যে। যা বক্তব্য রাখবো বলে শুরু করতাম অন্ত্যমিলের চোটে সব পাল্টে অন্যকিছু দাঁড়াতো। গুরুর অভাব ছিল। আমি ছোটবেলায়, আমার আসেপাশে কাউকে কবিতা লিখতে দেখিনি। না সমবয়সী না গুরুজন।

কিছু বছর পর দেখলাম অন্ত্যমিল আছে বা নেই তা দিয়ে কিছু যায় আসেনা। গদ্যের ভাষা আর পদ্যের ভাষার পার্থক্য থাকলো কি না তাতেও কিছু যায় আসে না। বুঝলাম(?) কবিতা তাহলে অন্য কিছু। শুধুই তালে ছন্দে বলা রোম্যান্টিক কথা বা গল্প বলা নয়। গদ্যধর্মী কবিতা লিখতে শুরু করলাম। অদ্ভুত কঠিন সব শব্দ উঠে আসতে লাগলো। অন্য ভাষার শব্দ আমদানি করলাম। খানিকটা এইরকম ধরনের,

সে এক বিকেলের মন্দনপ্রভাব, বিড়ালভাব আশায় আছে দেয়ালার
স্বপ্নভর্তি ক্যারাভান নিয়ে সুরইয়া প্রবিষ্ট হতে চাও
তা অসাড়, বুঝি রহমতের প্রয়োজন বা দশহাত তোমাতে অভিমুখী

আমি নিজেও জানতাম অনেক এইধরনের কবিতায় আসলে কী লেখা আছে তা জানতে গেলে আমার ব্যাখ্যা ছাড়া কোন উপায় নেই। আসলে চিট করতাম। শিল্পী ছিলাম না। টেকনিশিয়ান হয়ে উঠছিলাম। এইবার অনেকে বললো কঠিন কবিতা লিখছিস মানে ফাটিয়ে দিচ্ছিস আর সমালোচকরা বললো শব্দ-চয়নের কথা, সহজবোধ্য হওয়ার কথা, পাঠকের সাথে কবিতার সম্পর্কের কথা। শুনলাম কবিতা যখন পাঠক পড়ে তখন কবিতাটা তার নিজের হয়ে যাওয়ার কথা। ঠিকই তো, যখন পছন্দের গান শুনি দেখি গানটা নিজের নিজের লাগে। মনে হয় আমিই গানটা প্রকাশ করছি।

তারপর ধীরে ধীরে বুঝলাম। শব্দচয়ন নয় শব্দপ্রয়োগটা আসল। প্রত্যেকটা শব্দেরই নিজস্বতা আছে। তার ঔজ্জ্বল্য প্রয়োগের যথাযথতার উপর নির্ভরশীল। সহজ হতে হবে এমন কোনো বিষয়েই আমার বিশ্বাস কোনদিন জন্মায়নি। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও যেমন মানুষ সমাধান করতে পেরে ওঠেনা বলে প্রকৃতির সরলরৈখিক ধর্ম ধরে নেয় তেমনি অনেকে চেষ্টা করে জটিল ব্যপারটাকেই ধরে নিয়ে এগোতে। তন্ত্রের সারল্য ধরে নিয় যারা এগোয় তাদেরকে অক্ষম বলবোনা কিন্তু তারা পুরোটা ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নন। আমাদের কল্পনার গতি, মস্তিষ্ক আর তার অভিগ্রহণ যে কোনোরকমেই সরল নয় সেটা বোধহয় অনেকেই ভেতর থেকে অনুভব করেন। নিজের কাছে নিজের কোনো কথাই জটিল নয়। এইসব জটিলতা পাঠকের সাপেক্ষে। যদি পাঠক না অনুভব করতে পারেন তাহলে সেটা তার কাছে কবিতা হয়ে উঠবে না। তাহলে কবি অক্ষম বা আগের-আমার-মত-টেকনিক্যাল-চিটার। অথবা পাঠকের কল্পনা ও অনুভব শক্তি সীমিত। সুতরাং কবির উচিত যে অনুভূতি লিখছে তার একটা সম্পূর্ণতা রাখা বা সম্পূর্ণতাকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন ফ্রেমে রাখা। ভাষা ও শব্দের প্রয়োগে পাঠকের কাছে বোধ্য হয়ে ওঠা। পাঠকের(বা অন্যান্য শিল্পের ক্ষেত্রে দর্শক বা শ্রোতা) উচিৎ নয় তাৎক্ষণিক বিচার বা স্বল্প অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বিচার করতে যাওয়া। শিল্প বিচার করার জিনিসও নয় অবশ্য। প্রচুর দেখে শুনে উপলব্ধি করে তারপর ঠাহর করা যায় কী অনুভব করছি। আমার যা করার ছিল করলাম। লেখাকে সেদিকে নিয়ে যেতে লাগলাম। বোধগম্য কথায় পাঠকের কাছে পৌঁছনো। চারিদিকে দেখলাম বাঘা বাঘা কবিরা এই কাজ আমার জন্মের দীর্ঘ আগে থেকে করে বসে আছে। আমার নতুন কিছু করার বা বলার খুঁজে পাচ্ছিনা। যা লিখছি তা অল্টারনেটিভ। কিন্তু দেখলাম কবিতা বুঝতে পারছে সবাই। কিন্তু অগ্রজদের কবিতার সৌন্দর্য্য ও মাহাত্ম ও বক্তব্যের তুলনায় তা নগণ্য।

শিক্ষা হল সুন্দর কবিতা লিখতে গেলে তাতে আভ্যন্তরীণ ছন্দ, রঙ, গন্ধ, স্পর্শ, ধ্বনি ও গতির মসৃণতা ইত্যাদির দিকে গভীর লক্ষ রাখতে হবে। তাই যদি না হতো তবে ভিভালদি কীকরে মিউজিকে ফোর সিজ্‌ন্‌স্‌ ধরতেন? ভাবতেই অবাক লাগে কতটা গভীরতা লাগে মিউজিকে সিজ্‌ন্ ধরতে। গল্পে, উপন্যাসে পরিবেশ পরিস্থিতি, মানে, এখন সন্ধে হচ্ছে, চাষীরা পাখিরা ঘরে ফিরছে, সূর্যের লালিমা আকাশে লেগে আছে ধূলোমেখে অথবা এখন অগাষ্টের বিকেল এমন ভ্যাপসা ভাব যে কাপ ধরলে হাতের চ্যাটচ্যাট কাপে লেগে যায় ইত্যাদি ব্যাকড্রপ তৈরী করা যায়। কবিতার মধ্যে এগলো অন্তর্নিহিত থাকতে হয়। অনেক কবিতার অবস্থানগত ব্যাকড্রপ থাকেনা, সেগুলো সময়হীন, স্থানহীন। ইমেজারি, অ্যালেগোরী ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে বক্তব্যকে এমন এক স্পর্শযন্ত্র করতে হবে যে যন্ত্র দিয়ে পাঠক আগে স্পর্শিত হননি। চেষ্টা করা স্বত্তেও এ জিনিস করে উঠতে পারলাম না। অনেক ভাবে ভেবে সমস্ত উপায় ব্যবহার করার চেষ্টা করলাম। ফলত দ্বিতীয় এক শিক্ষার দিকে এগিয়ে গেলাম। এটা জীবন শিক্ষা। প্রথম কবিতাজনিত প্রভাব জীবনের গতিপথ পাল্টাতে সাহায্য করলো। বুঝলাম মিসিং পদার্থটা হল বোধ, জীবনবোধ, সত্যতা। বুঝলাম যা দেখছি ও সরাসরি বুঝছি তাই আসল কথা নয়। আরো অন্যকিছু। অনেককিছু। চাক্ষুষ বিষয়ের থেকে বহুদূরে বিলীন হয়ে আছে সত্য। জীবনের সত্য আসলে আমাদের কাছে ঢাকা পড়ে থাকে যতদিন না সেই চাদর আসতে আসতে সরাতে চেষ্টা করি। সত্যি কথা বলতে এতদূর অবদি ভাবনার পথে আমি কোনো কবি সঙ্গ পেয়ে উঠিনি। কবিদের থেকে অনেক দূরে আমি কিন্তু কবিতার অনেক কাছে কাছে ঘুরে বেড়াই। যতদিন না নিজেকে বুঝে উঠতে পারছিলাম, জীবজগতের, মানুষের সত্য, তার ডায়ানামিক্সটাকে বুঝতে শুরু করছিলাম একটু একটু করে, ততদিন আর কবিতা আসেনি। ধীরে ধীরে দেখলাম বিভিন্ন বোধ জাগছে, দর্শন, ঘটনা ছবি কিছু মিলিয়ে খুব গভীরতা আসছে যা বুকের ভেতরটাকে ঠান্ডা করে দেয়। এক-একটা কথার পেছনে তার ভার তার নান্দনিকতা তার সমস্ত কনশাসনেসে তার ছড়িয়ে থাকা উপলব্ধি করতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল সত্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। বাস্তব সত্যকে টপকে আরো কোনো অতিসত্যের কাছে পৌঁছতে পারলেই শিল্পী হয়ে উঠবো।

সকাল হচ্ছে এমন একটা ছবি তুলতে বললে ফোটোগ্রাফার কুয়াশামাখা গঙ্গার ধারে উস্কোখুস্কো মানুষের হালকা সোনালী আলোয় জড়সড়ো স্নানকরার ছবি তুলতে পারেন অথবা কেউ তুলতে পারেন রাস্তায় শুয়ে থাকা বাচ্চা ছেলেটার মুখে রোদ এসে পড়াতে আড়মোড়া ভেঙে ওঠা। আরো অনেক কিছু ভাবেই যেমন সকাল তোলা যায়। তেমনি সাধারণ সূর্যের ওঠার ছবিও সকাল ওঠা বোঝাতে পারে। ওটা বাস্তবের রিপ্রোডাকশন। যে কোন গল্প নাটক সিনেমাও এরকম বাস্তবের রিপ্রোডাকশন হতে পারে। সেগুলো মনোরঞ্জন হতে পারে শিল্প নয়। শিল্প মানে মনোরঞ্জন হতে পারে কিন্তু আমার মনে হয়না মনোরঞ্জন মানেই শিল্প হবে। যদি কুশলীদের দিয়ে আমি একটা ঘটনা স্টেজে বা স্ক্রিনে দেখাতে পারি তা টেকনিক, সৃষ্টিশীলতা নয়। তবে সৃষ্টিশীল হতে গেলে টেকনিক জানা দরকার। যেমন অনেকে লার্নার হয় রিসার্চার হয়ে উঠতে পারেনা, নিজের ইউনিক কিছু অবদান রাখতে পারেনা তেমন। বিভিন্ন শিল্পীর বিভিন্ন ভাবে বর্ণনা করতে যাওয়ার উদ্দেশ্যই হলো অতিসত্যের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা, জীবনবোধ জাগানোর চেষ্টা আর সেই বোধ দিয়ে পাঠকের বা দর্শকের সাথে কমিউনিকেশনের চেষ্টা, তার কনশাসনেসকে ছোঁয়ার চেষ্টা। সকাল হলে কী হয় তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সকাল হওয়া। যেমন পাশপোর্ট সাইজ ছবি ফোটোগ্রাফ বটে কিন্তু তা শিল্প নয়।

তারপরেও যে কবিতা লিখলাম তা অনেককে ছুঁয়ে ফেললো বটে কিন্তু নতুন কিছু হলো না। সেই অল্টারনেটিভই থেকে গেল। ফ্রাসট্রেশন হলো। আবার বুঝতে গিয়ে দেখলাম বোধ ইত্যাদি থাকলেও সেটাকে কীভাবে বলছি সেই পদ্ধতিটা আরো বেশি ইম্পর্টেন্ট। অর্থাৎ উপস্থাপনা বা প্রেজেন্টেশন। এখানেই এমন এক নিজস্বতা কে কাজে লাগাতে হবে যা হবে সমসাময়িক ও অরিজিন্যাল। পৃথিবীর সবাই যেমন ইউনিক, তেমনি তার প্রভাব যখন কবিতায় পড়বে তা হয়ে উঠবে ইউনিক। কী সেই জিনিস যা আমি স্বাধীনভাবে অনুভব করছি, লক্ষ্য করছি, বোধ করছি? কোন সেই ভঙ্গিমা, দৃষ্টিকোন যা দিয়ে আমি ছাড়া কেউ দেখছেনা? কোন সেই অভিজ্ঞতা, ইতিহাস, অভিযোজন যা আবশ্যিকভাবেই আলাদা? শুরু হলো সেইসব খোঁজ। যা এখনো চলছে। এই সন্ধান স্বভাবতই চলমান।

কিন্তু আমার কবিতা পড়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গীতে জীবন কেউ দেখতেই বা যাবে কেন?!! পাঠক তো নিজের জীবনের সাথেই রিলেট করতে চাইবে। আসলেই রিলেটেড। যা আমি স্টেশনের এপার থেকে দেখেছি, তা কেউ ঐ পার থেকে দেখেছে। কেউ ফুটব্রিজ থেকে দেখেছে। কেউ স্টেশনের বাইরে চায়ের দোকানে গল্প শুনেছে। সে দূরের পাড়ার বন্ধুকে বলেছে। এখন ঐ ঘটনা আমার কাছে যা তার কাছে তা ভিজুয়্যালি আলাদা হবে। কারণ সে নিজের কল্পনা ব্যবহার করে মাথায় সাজিয়ে তুলবে পুরো বিষয়টা। আমদের চেতন চেতনার কন্টিনিউয়ামে ভাসমান। সবাই সংযুক্ত হয়ে পারি চেতনার সংযোগে। যদি আমি কবি হই আর ঐ দূর পাড়ার লোকটা হয় পাঠক তাহলে আমি তার দুরত্ব মেটাতে যেটা করতে পারি সেটা হল তার কল্পনাকে ম্যানিপুলেট করা, ট্র্যাক করে করে আমার অতিসত্যে পৌঁছে দেওয়া। আমার মতে একটা কবিতার সবথেকে বড় শক্তি এটাই। আর মারাত্মক কঠিন এই কাজটা করা।

এই কাজ যারা করে ফেলছেন তারা সত্যিই কবি হয়ে উঠছেন, শিল্পী হয়ে উঠছেন। অনেকেই ইউনিক হওয়ার রাস্তাতেই পড়ে থেকে যাচ্ছেন। নিজস্বতা খুঁজতে খুঁজতে হারিয়ে যাচ্ছেন। তবে পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে যা বোঝা যায় তা হলো নিজস্বতা অনেকেই আনতে পারেন তা সে বুঝেই হোক বা টেকনিক্যাল ফ্লুকে। পাঠকের কাছে পৌঁছনোর ধার অনেকেই ধারেন না। অনেকে আবার আশা করেন তিনি পাঠকের কাছে যাবেন না, পাঠককেই খেটে-খুটে তাকে বুঝতে হবে। ফলত নিজের সীমায় থাকার অভ্যেস তৈরি হল। বেশির ভাগ কবিই অনেক কবি-বন্ধু আছে বলে কবি হয়ে উঠেছেন। না হলে হতেন না। কবি হওয়ার জন্য কবি-বন্ধু তৈরী করেছেন। আমাদের ক্ষমতা এতই কম যে বন্ধু কবিতা লিখলে তাকে খারাপ বলতে পারিনা। উলটে বলি এবারে একটা বই কর, দেখ কী বলে লোকজন। বলতে পারে না তার কারণ অনেকে নিজেরাই জানেনা কতগুলো স্তর পেরোলে, কতটা জার্নি করলে কবিতার কাছে পৌছঁনো যায়। সত্যি কথা বলতে কি আমিও এইসব দোষগুণ কাটিয়ে খুব একটা বেরোতে পারিনি। কবে পারবো তাও জানিনা। কেন পারিনি সেই বিষয়ে ক'টা এক্সকিউজ যাক।

এই দ্বিধা, এই দোনো-মনা তৈরি হয় অনেকদিন আগে যখন থেকে অ্যাবস্ট্রাক্ট বলে কিছু বিষয় আছে এটা জানতে পারি। একটা পেইন্টিং দেখে কিছু বুঝতে পারছিনা সেটা অ্যাবস্ট্রাক্ট, বাংলা কথা হওয়া স্বত্তেও কবিতার টেক্সটের কোন মানে সোজাসুজি পাচ্ছিনা মানেই অ্যাব্স্ট্রাক্ট ইত্যাদি। ব্যাপারটা বুঝতে বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল। ধীরে ধীরে বুঝেছিলাম অ্যাবস্ট্রাক্ট কী বস্তু। কোনো শিল্প সম্পর্কে ত্বত্তে আমার বিশ্বাস নেই সেইসব পড়ে কিছু শেখার কিছু চেষ্টা করিনা। বুঝেছিলাম কোলাজ বলে কিছু হয়। ঘাঁটাঘাঁটি করে বুঝলাম কোলাজ, মন্টাজ, অ্যাবস্ট্রাকশন দিয়ে সত্যিই অনেক কিছু বলা যায় যা সোজা কথায় বলা চাপ। এবং এগুলোই প্রমাণ যে চিন্তাভাবনা ও তার প্রকাশ সরাসরি সরলরৈখিক নয়। এখান থেকেই উঠে আসবে অনন্যতা। আমাদের সাবকনশাস দৃশ্যকল্পনা, অ্যাসোসিয়েশন, প্যাটার্ন রেকগনিশন, স্মৃতি ইত্যাদিই সেই বিষয় যা আমাদের আলাদা করে। এইসবের ফলে যা দাঁড়ালো অনেকেই অপব্যবহার করতে লাগলেন এই সব মৌলের। আর আমার মধ্যে কবিতার কোন সাধারণ ও ঐক্যমত ধারণ ভেঙে গেল। অনেকে অনেক পদ্ধতিতে নতুন শব্দ তৈরি, যৌগিক শব্দ তৈরি, কম্প্লিটলি আনকোরিলেটেড শব্দ দিয়ে বাক্য তৈরি ইত্যাদিতে মেতে উঠলেন। কেউ কেউ এক্সপার্টও হয়ে উঠলেন। ফলত যখন কবির সাথে কথা হল তখন বুঝলাম কী অনুভূতি বলা হয়েছে। এরকম কবিতা আমিও লিখেছি যা আমাকে ব্যাখ্যা করতে না দিলে কারোর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তখন ঐ চেতাওনি আসে, কবিতা বোঝার জিনিস নয় অনুভব করার জিনিস। সুতরাং কবিতা বহুমাত্রিক এমন এক জিনিস যা পাঠককে নিজের কল্পনার, নিজের জানার মধ্যে দিয়ে কোথাও একটা নিয়ে যাবে। আমি বুঝলাম কোনদিকে নিয়ে যাবে সেটায় যদি কন্ট্রোল থাকে তবেই হয়তো সে জোরালো কবি। আমার এক বন্ধু বলেছিলো শুধু ওয়ার্ড জাগলারি করে আমি কবিতা লিখে পাঠিয়ে দেখেছি লোকে বলছে দারুন কবিতা হয়েছে। খুব বেশি উদাহারণের প্রয়োজন নেই যে কতরকম করে কবিতা আজকাল লেখা হয়। অ্যাবস্ট্রাকশনের ক্ষেত্রেও অনেকে নিজস্ব ভঙ্গি এনেছেন। ফলত আমার ধারণা আলগা হয়ে গেল কোনটা কবিতা আর কোনটা কবিতা নয় এটা বলার ক্ষেত্রে। তবে এটা বোধহয় ব্যর্থতা যে সঠিক কোন জায়গায় আমি কবিতার মধ্যে দিয়ে চলে গেলাম জানিনা, কিছু টুপটাপ কল্পনা, কিছু টুপটাপ ভিসুয়্যালাইজেশন হলো, যা পারলাম রিলেট করলাম। হয়তো কবির কাছে তার ডেফিনিট মানে আছে তার। যে কবিকে চিনিনা তার জীবনবোধ তো কবিতার মধ্যে দিয়ে পাওয়ার কথা। কিন্তু কবিতার তো ব্যাখা হয়না। কবিরাও নারাজ তা করতে। কবিতাটা বুঝিয়ে বলুন বললে কবি ক্ষেপে যান, কবিতাকে টেক্সট আর্ট বলে দিলে কবির কাছে গালাগালি মনে হয়। এখান থেকে যা ধারণা করলাম, কবি যদি বুঝিয়ে বলতে পারতেন তো তাই করতেন, ফোন করে বন্ধুকে শোনাতেন গল্প, তাহলে কবিতাটা লিখতেন না। নিজেকেও সেই আওতায় আমি আনা না আনার নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছইনি। কবিতা কবির একটা এক্সপ্রেশন, কবির গল্প নয়। ঐ এক্সপ্রেশন থেকে যা বোঝার বুঝতে হবে আর সেই বোঝা অবশ্যই কবির এক্সপ্রেশনের স্ট্রেংথের সাথে সমানুপাতিক হবে। অর্থাৎ কবিতা পাঠকের মনে আর একটা কবিতা তৈরি করবে। সুতরাং কবিতা আর বিচার করা যাবেনা, বিচার্য্য বিষয় হলো পাঠকের কতটা অনুভূতি জন্মাল, পাঠকের মাথায় কত সুন্দর(যদিও সৌন্দর্য্যও একটা ধারণা) একটা কবিতা তৈরি হল অতএব কবি কতটা শক্তিশালী অভিবক্তা। কবিতার সামাজিক কোন দায় নেই, দায় নিলে তা ভালোই, খারাপ বলবো না। কবিতা সময়কে ধরে রাখে তার শৈলী দিয়ে, ভাষার পরিবর্তন দিয়ে, প্রকাশভঙ্গিমার অভিনবত্ব দিয়ে। আর এই সব পরিবর্তনশীল মৌলগুলো প্রতিক্রিয়া স্বরূপ পাল্টে দিতে থাকে কবিতার ধারণা।

যে বা যারা প্রথম কবিতা লিখেছিল তারাও জানতোনা কবিতা কী, কেমন, কেন, কীভাবে? আজ যারা লেখে তারাও নিজেদের অভিগ্রহণ থেকেই কবিতাকে দেখে। কবিতার উদ্দেশ্য পাল্টে যায়। কবিতা বলতে কী বোঝায়? কবিতা দিয়ে কী বোঝায়? এর কোন নির্দিষ্ট সাংবিধানিক উত্তর হয় না। থাকলে তাকে আমি সন্দেহ করব। কবিতা একটা ধারণা। সব শিল্পই ধারণা। একটা টাইম ডিপেন্ডেন্ট যৌগিক ধারণা।

শিল্পের কোনো মৌলিক ধারণা হয় না।


(উপরিউক্ত কোন বক্তব্য বা ভাবনাগত মৌল চরম নয়। পরিবর্তনশীল ধারণার সময়সাপেক্ষ ও আংশিক বহিঃপ্রকাশ।)


- অংশুমান। সল্টলেক। কলকাতা। ৯৮৩৬৪২৩১৭২। ansuman.dolchhut@gmail.com

My Blogger Tricks