জলৌকা
অনেক অনেক বছর পরে, প্রাক-সন্ধ্যায় পৌঁছে, পৃথিবী হঠাৎ বদলে যাবে। তখন আকাশের দিকে তাকাতে ভালো লাগবে। ঘর ফিরতি লোকের মুখ দেখতে। সে মুখের গুনগুন গান, সে গানের স্বরলিপি লিখবে কোন্ ওস্তাদ? সব গাছের পাতা তখন মুখ একটু ঝুঁকিয়ে গাইছে ‘সন্ধ্যে হ’ল সন্ধ্যে হ’ল’… । আকাশের তখন রঙ বদলাচ্ছে ঘন ঘন। স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, সেখানে ঘরের সিঁড়িতে ব’সে হয়ত তখন গান গাইছেন, গীতশ্রী সন্ধ্যা। তাঁর ‘কেন, বলো কেন’ প্রশ্নে আকুল হচ্ছে তখন এই মর্তমাঠ। তখনই পৃথিবীর সব মানুষের গায়ে শিহরণ হয়। লক্ষ আলোকবছরে সেই একবার, একটিমাত্রবারই, রাতে ফিরে, বিছানায়, সব পুরুষ তার নারীর বুকে মুখ গুঁজে, সব নারী তার পুরুষের কণ্ঠার হাড়ে চিবুক রেখে বলবে …কি যে সুর শুনেছি সুর ভুলতে আজও পারিনি…। তখন সেই সন্ধ্যায় চৈতন্যভাগবত মালতীমাধব অভিজ্ঞানশকুন্তল সব নেমে আসবে এক এক ক’রে.. আর তার নিচে রাস্তার এ পাশ ও পাশ দিয়ে একসাথে হাঁটতে থাকবে তন্ময় তন্ময়ী… তন্ময়েন হৃদয়েন…। রাস্তার শেষ বাঁকটা ওরা দুজনেই দেখতে পাবে। দেখতে পাবে দূরে ঐ দূরে যেতে যেতে রাস্তাটা মন পালটে হঠাৎই ঘুরে গেছে ডানদিকে কিম্বা বাঁদিকে। কোনো একটা দিক যেন হলেই হ’ল। ওরা দুজনেই জানে এই রাস্তাটার এক জায়গায় পায়ের নিচে আকাশ আর ওপরে তাকালে দেখা যায় পিচকালো রাস্তা। সেখানে একটা বিল। বিলে পাখি আর পাখি। শ্বেতহাঁস। পানকৌড়ি। মাছগুলো জলের ওপর থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। দেখা যায় ওদের রূপোলি আঁশ। শেষরাতের বাজার ভাঙার আগে সব্জিওয়ালা যেভাবে সস্তায় সব দিয়ে যায় বোঝা হালকা ক’রে বাড়ি ফিরবে ব’লে; বিকেলের শেষ আলোটা যেটুকু আছে, যাবার আগে যেন সেইভাবে বিলিয়ে দিচ্ছে তখন সূর্যটা। আর সেই আলো এসে পড়েছে মাছের আঁশে, পাখির পালকে, সাপের চামড়ায়। সবাই তাতে চিকমিক করছে। কোনো পাখি তবু সেখানে মাছ ধরে না। কেন যে ধরে না। সেখানে তখন সাপেরা মিলছে সাপের সাথে। পাশেই শুয়ে মানুষ। তারা যে কোথায় থাকে। কোথা থেকে আসে। আর কোথায় চলে যায়। সবাই তখন মিলনের যৌথ নাট্যে। মানুষ জড়িয়ে আছে তার মানুষীকে। সাপ জড়িয়ে সাপিনীকে। কুকুর তার কুক্কুরীকে জড়িয়ে। তখন ওদের সবার সবার জাগল মনসিজ মুদিত নয়ান। সমুদ্রের তলাতেও তখন অক্টোপাস জড়িয়ে ধরেছে তার অক্টোপাসিনীকে। হাঙরী আদর করছে তার হাঙর সোনার বুকে। সাপের হিসহিস.. কুকুরের কুঁইকুঁই আর মানুষের আহহহ আআআহহহ আরো জোরে আরো জোরে আআআহহহ আরো জোরে করো আমাকে আহহহ মিলে যেন বিঠোভেন মোৎসার্ট জিমি হেন্ড্রিক্স নিখিল ব্যানার্জি। স্যাক্সোফোন সেতার ক্লারিনেট সব বাজছে তখন। তখন পৃথিবীতে আলিঙ্গনাবদ্ধ অপার অপেরা। সবার মৈথুনে পৃথিবী তখন অনিন্দিত হচ্ছে। পুং-স্ত্রীর মিলনরসে অনবগীত হচ্ছে মাটি। ঠিক সেই সময়ে হিরদয় লাগি ওদের শৈশব যৌবন দুহু মিলি গেল, তক্ষুনি, দুজনেরই। মেয়েটা বুঝবে ওর দিনে দিনে উন্নত পয়োধর পীন। ছেলেটার গায়ে তখন এই ভেবে ফুটে উঠবে শয়ে শয়ে পলাশলাল দাগ। মেয়েটার বুকে রাখা দুই আগ্নেয়পাহাড়ের চূড়াভাগ তীক্ষ্ণ তখন। ছেলেটার তলপেটের নিচে জলৌকা জাগ্রত। তখন ওদের চরণ চপল গতি লোচন লেল। কিন্তু সেই জায়গাটায় পৌঁছবার আগেই ওদের দুজনের বাড়ি এসে যাবে। আর বাড়ি ঢোকার আগে দুজনেরই মনে হবে, যদি গিয়ে দেখে বাড়ির সামনে জটলা, পাড়ার চেনা মুখ উৎকণ্ঠায় দাঁড়িয়ে ওদের গেটের বাইরে ! তখনই ওদের রক্তের ভেতরে একশো আটটা পাগলা ঘন্টি বাজতে থাকবে, আপাদ-মাথা রক্ত ছুটে চলবে, যেন দমকল। যেন পায়ে আগুন লেগেছে, তাই মাথার রক্ত নিচে নামছে তড়িঘড়ি আগুন নেভাতে। তখন ওরা দুজনেই দেখতে পাবে, রাস্তার ঠিক মাঝখানে, সব গাড়ি স্কুটার সাইকেল অটো ঠেলা লরি মানুষ আর মানুষ আর এত এত মানুষকে উপেক্ষা ক’রে, পলিটেকনিক আইটিআই সান্ধ্যকলেজ কলেজের সিলেবাস পরীক্ষাসূচি রেজ়াল্ট ও মনসা মন্দির উপেক্ষা ক’রে, একটা ঘোড়া রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। যেন জঙ্গলের দেবতা ওকে পাঠিয়েছে শহরকে নম্রতা শেখাতে। যেন ও এসেছে ঐ ঋক্ষমণ্ডল থেকে নেমে। ওর কাছে এসে যেন সব শব্দ এই এত এত শব্দ-শহর থেমে যাচ্ছে সম্ভ্রমে। পেল্লায় হাইরাইজ়ারগুলো যখন ওর চারপায়ের ক্ষুরের সামনে ‘ওহ লর্ড ইয়োর হাইনেস’ ব’লে নিজেদের ছাদ ও কার্নিশ নত করবে ভাবছে ঘোড়াটা যেন চিঁহিহিইই ক’রে ডেকে উঠবে ঠিক তক্ষুনি। যেন প্রস্তাব, এসো, উঠে বসো আমার পিঠে। কিন্তু ছেলেমেয়ে দুটোর সে সাহস কোনোদিনই হবে না। বাড়ি ফিরে যদি দেখে পাড়ার লোক উৎকণ্ঠিত দাঁড়িয়ে ওদের গেটে। যদি দেখে কেরোসিন, গন্ধ, পোড়া পোড়া, দলা, মাংস, স্তন পুড়ে নেমে এসেছে কুঁচকিতে। মা… মাগোওও…
তবু এই জোঁকটাকে ওরা মারতে চাইবে না। এই যে মনখারাপের জোঁক। ঐ ঘোড়াটার পিঠে চড়ে তো বসাই যায়। কিন্তু এই জোঁকটার তখন কি হবে? ওকে যে মারতে মন কিছুতেই চায় না। ওর গায়ে তো ওদেরই, ওদের দুজনেরই রক্ত। বইছে। বইবে। সেই জোঁক, জলৌকা, জলে ওক যার, জলে স্থান, জলে বাস। আর এই যে ওকঃ, ওকস্, আশ্রয়, সে-ঘরে ঢোকার আগেই ওদের ভয় শুরু হয়। হবেই। ওদের গৃহানুষঙ্গে ভয়। গুঞ্জরিয়া আসে ভয় গৃহানুপুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে। জোঁকের, ঐ জলৌকারও কি জলে ভয়? তাই সে কখনো কালো মেঘের সঙ্গে, কখনো রাস্তার ঐ বাঁকটার ডানদিকে কিম্বা বাঁদিকে টার্ন নিয়ে নেওয়ার খামখেয়ালি মনখারাপের সঙ্গে, কখনো ঐ ঘোড়াটার ঘাড় নিচু ক’রে রাস্তার মাঝখানে উদাসীন দাঁড়িয়ে থাকার সঙ্গে এসে বসে রক্তের প্রবাহিত এই কিলবিল ধারার ভেতর? রক্তের তর্পনে ওই জলৌকাকে রক্ত নিজেই কি ডেকে আনে? যেন জলৌকা সেই তর্পনের পুরোহিত। তাই এই খারাপমন, কামড়ে থাকে, থাক। অসুখ যেভাবে একা মানুষকে সঙ্গ দেয়, জ্বালিয়ে ভুগিয়ে ব্যথিয়ে, থাক সেভাবে এই জলৌকা, এই প্রাক-সন্ধ্যার ফুরোতে থাকা বিদায়ী আলোর কষ্টে, আলোর ফেয়ারওয়েলে দিন ফুরোনোর মালিন্যে থাক।