৩
কোনো চরিত্রই কাল্পনিক নয়
নীলাব্জ চক্রবর্তী
দ্বিতীয় পর্ব
৩
-
তুমি ন্যাপাভস্কি বলে কারো নাম শুনেছো নীলাব্জ?
অনেক পুরনো একটা প্রজেক্ট-এর সয়েল রিপোর্ট
আনতে গেছিলাম বসের ঘরে। পেয়েও গেলাম। একটা-দুটো কথা বলে বেরিয়ে আসব আসব আমি তখন হাত রেখেছি কাঁচের দরজায়। দাঁড়িয়ে গেলাম। ন্যাপাভস্কি! না! এরকম নাম...
চেনা চেনা ঠ্যাকে... কিন্তু, শুনিনি কখনো, আই অ্যাম সিওর। কাঁচের জানলা দিয়ে
ঝাঁ ঝাঁ করছে বাইরের ফেব্রুয়ারি। বাল। এটা ফেব্রুয়ারি!
এটা কলকাতা! এই ঝাঁ ঝাঁ-এর আবহে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দ্রুত আমি মস্কো ভাবতে থাকি...
গাঢ় তুষারপাত... ন্যাপাভস্কি নামের কেউ হেঁটে চলে ব্যাড়াচ্ছেন বোধহয়... অনির্বাণ
একটা ভিডিও ছেড়েছিলো ফেসবুকে... কাশ্মীরী বরফপতনের... আরও তিন-চারগুণ পুরু বরফ এখন মস্কোর
রাস্তায়? একটু শহরতলী? আজ শুক্রবার? ন্যাপাভস্কির দীর্ঘ ওভারকোটের পকেটে কী থাকতে
পারে? তিনি চার্চে যান পাথুরে রাস্তা পেরিয়ে পেরিয়ে? কোনো টেকনিক্যাল লোক?
ইনফ্লুয়েন্স লাইন ডায়াগ্রামের ওপর কেতাব-টেতাব লিখেছেন? আ... মনে হয় কোনো সয়েল
এক্সপার্ট...
-
না স্যার, ঠিক মনে করতে পারছি না। শুনিনি বোধহয়। কোনও রাশিয়ান অথর?
সয়েল মেকানিক্স-এর বই আছে?
-
অ্যাঁ! আরে না না। দাঁড়াও দাঁড়াও... তুমি যা ভাবছো তা
নয়। অবশ্য, তোমার শোনার কথাও না ওঁর নাম। ন্যাপাভস্কি ওঁর
সত্যিকারের নাম নয়। ওঁর সত্যিকারের নামটা, সত্যি বলতে গেলে আমি ভুলে গেছি। মানে, পদবীটা। ওঁকে আমরা সামনে
নৃপেনদা বলে ডাকতাম। নৃপেন্দ্রনাথ চৌধুরী না নৃপেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী...
কি যেন আসল নাম ওঁর। জমিদারের ছেলে ছিলেন জানো? ভালো ছাত্র ছিলেন। অভিজাত মানুষ। বাড়িঘর টাকাপয়সা সব
ছেড়েছুড়ে দিয়ে এম.এন.রায়ের চ্যালা হয়ে যান। স্বাধীনতা আন্দোলনে
ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিয়ে-থা চাকরি-বাকরি কিছুই করেননি কখনো। পরে শ্রমিক
আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। জেলে যান। বহুদিন জেলে ছিলেন। ওঁর সহকর্মীরা ওঁর
নামকরণ করেন ন্যাপাভস্কি। একদম অন্যরকম মানুষ ছিলেন। আমাদের সাথে একটা
যোগাযোগ তৈরি হয়ে গেছিলো ওঁর। শেষদিকটা মাথার
গোলমাল হয়ে যায়। তার সাথে নিদারুণ অর্থকষ্ট। আমাদের বাড়িতে এসে
চুপচাপ বসে থাকতেন। নৃপেনদা খেয়ে যান, বললেও সব সময় খেতেন না। একেকদিন বড়োজোর
বলতেন, তোমরা কি আমায় কিছু দিতে পারো? এই গোটা পঞ্চাশ টাকা? অসুবিধা হলে থাক। আরেকদিন না হয়...
-
বলেন কি? অতো বড়ো পরিবারের ছেলে... ওইভাবে
শেষজীবন...
-
ইয়েস। আর কত লোক রাজনীতি
করে কেরিয়ার করে ফেললেন... তাঁরা অনেকেই চিনতেন ন্যাপাভস্কিকে। কেউ কিচ্ছু করেননি
ওঁর জন্য কোনোদিন। তাঁদের কাছে গিয়ে উনিও কখনো... জানো, কাল স্বপ্নে দেখলাম
ওঁকে...
# * # *
তখনো জানতাম না একদিন পীত কোলাজে নীলাব্জ
বলে একটা হলদে বই হবে। চার ফর্মা। হলদে পার্চমেন্ট পাতা। তাতে একটা অংশ থাকবে পীত কোলাজের অংশ
নামে। সেখানে লেখা থাকবে
কৃতজ্ঞতা ঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি না থাকলে সহনীয় অবস্থায় লেখা হয়ে উঠতো না
এই আত্মকথন... আর হোটেলের চব্বিশ তলার জানলা থেকে তোলা চ্যাংচুং শহরের ছবিটা
ব্যবহার করে বানানো হবে নিভিয়াপাতার কভার। সে বইয়ের একদম শেষে লেখা থাকবে
গুডবাই বলতেই পর্দা ঠেলে
একেকটা আলোছায়া
শব্দগুলো ওয়ান-ওয়ে ধরে নিচ্ছে
কাঁচরঙা শহরে
এক বালিশ তুলো ছড়িয়ে পড়লো
ওইখানে রিউমার
না কি য্যানো একটা তৃতীয় শ্রেণীর ফিল্ম দেখতে দেখতে ভেবেছিলাম লাইনগুলো। আর ২৫ দিনের চ্যাংচুংবাসের পর ফিরে আসার দিন
সকালবেলা ছবি তুলে তুলে রেখে দেবো ওই ক’দিনের লেখালেখি। তখনো, সত্যিই জানতাম না, ওই লেখার খাতা আর ঋষিদার ছ’কাহন আটকাহন কবিতার প্রিন্ট আউট আর আর্যনীলদার মৌচাকের প্রকৃতি
বইটা ফেলে চলে আসব প্লেনের কোটরে... চায়না ইস্টার্ন... কানেক্টিং ফ্লাইট
ধরার তাড়ায়... সেইসব কাগজপত্র কাদের কখনো কোনও কাজে আসবে
না...
তো ওই চ্যাংচুং-এ আমি আর সৌম্যদা। সকাল আটটা থেকে অফিস। হোটেলেরই চার তলায়। দুপুরে দুঘন্টা ঘুমনোর ছুটি। তখন আমরা স্নান। বেলঘরিয়া থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া চিঁড়েভাজা আর হলদিরামের মুগডাল ভাজার প্যাকেট চললো ক’দিন। ভেবে নিতাম ড্রাই ডালভাত খাচ্ছি। সপ্তাখানেক এইভাবে। তারপর ফুরিয়ে গ্যালো। সকালে হোটেলের দোতলার ফ্রি ব্রেকফাস্টে মনোযোগ বাড়ালাম আমরা। আর সময়ও। আটটার বদলে সাড়ে আটটায়
ঢুকতে লাগলাম চারতলার কনফারেন্স হল-টার্ন্ড ইন্টু-অফিসরুমে। আমাদের চৈনিক কাউন্টার পার্ট চেন ক্সুই গুই কখনো
বলেনি কিছু... কিন্তু মুশকিল হতে থাকলো দুপুরে খাবো কী? তো আমরা ব্রেকফাস্ট টেবিল
থেকে একটা-দুটো আপেল রেখে দিতে শুরু করলাম ব্যাগে...
মুলতুবী হয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ আপেলদিবস
ছোটবেলার শীত
গুণছে
স্থানীয়
পশম
কোথাও একটা অবগত মুকুল
এইমাত্র তার দোটানা হারালো...
আর আস্তে আস্তে
চ্যাংচুং বিকেল হয়ে যায়। হাল্কা লালচে হয়ে আসে তার বাদামী বোঁটা। একটা অনিয়ন্ত্রিত
অনুৎসবের মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠে অচেনা শহরের পর্যায়সারণী। যখন প্রতিটি দিন-ই
ছিল মাতৃভাষার? একফোঁটা ইংরেজি বলতে চাইবে না কেউ। কারোর কোনও ধর্ম
নেই। না খ্রিস্তান না
বৌদ্ধ তারা। চিত্রিত হরফের মধ্যে ঘুরে ব্যাড়ানো একেকটা প্রায় সন্ধ্যেবেলা, মাঝেমাঝে
তার মলাট খুলে দ্যাখাতো চ্যাংচুং। আমাদের কোনও রিটার্ন টিকিট ছিলো না
তখনো... চারদিকে অলিতে গলিতে ঝাঁ চকচকে তিরিশ তলা হোটেল আর ব্যাঙ্ক... গলির মোড়ে
মোড়ে হাইরাইজগুলোতে অনেকখানি করে জায়গা নিয়ে দশহাত অন্তর অন্তর একটা করে পিজাহাট
আর কে.এফ.সি। হ্যাঁ। উদার চীন আর কম্যুনিস্ট চীন। পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না। তো?
ফুটপাথে স্পায়ের টুকরো
ডুবে
যাচ্ছে
জাহাজডেকের
গভীরতায়
খুলে যাচ্ছে
অ্যাসাইলামের দরজা
অনেক অনেকদিন পর
কেউ খুঁজে বার করছে
একটা
রক্তাক্ত বাইবেল
একটা
কোল্ড ব্লাডেড দিন...
প্রায় গোটা দেশ
ডিনার সেরে নিচ্ছে সন্ধ্যা সাড়ে ছটায়। তারপর রোজ হাঁটা। আমরাও। স্বল্পবাক সৌম্যদা
একটু একটু করে অনেক কথা বলে আজকাল। রায়গঞ্জ বদলি হয়ে
গেছিল বলে সাড়ে ন’বছরের নিশ্চিন্ত সরকারী ছেড়ে
দিয়েছিল সৌম্যদা। এখন কতদূরে বাড়ি থেকে... সুনামির এক বছর পর বইটা
থেকে এই লাইনগুলো পড়ে শোনাই সৌম্যদাকে... সরলরেখার ব্যাপারটা কিন্তু খুব সরল
কি / পেন্সিলকে আঙুল নিয়ন্ত্রণ করছে নাকি / ঐ কাঠের স্কেল / ততদূর ঠেলে দিচ্ছে /
যতদূর আমরা বদলি হলেও যাবো না
খাতার পর খাতা উল্টে
পোড়া জ্যামিতির ধোঁয়া উঠতে দেখি। অম্বুরি তামাকের
কথাও মনে হয়। ভোকাবুলারি জুড়ে পাঁচমিশালী বিকেলের আলোহাওয়া। সাদায়-কালোয়। খরচ হয়ে যায়
ব্যবহৃত হাততালির গন্ধ। কাদের সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্কে বেজেই চলে টেলিফোন...
ওয়ান্ডা প্লাজার সামনে বসে ছিলাম আমরা। অনেক দূর থেকে
দ্যাখা যায় এই ওয়ান্ডা প্লাজার মাথার আলোগুলোর জ্বলা-নেভা। ফিরে আসতে আসতে
আমার কাছে জমা হতে থাকে নোটবই ভরে তোলার হিজিবিজি...
ভুলে যাওয়া গানগুলো
বেরিয়ে পড়ছে
না লেখা জানলায়
একটা মেপল পাতা
গাঢ় হচ্ছে মারমালেড
বেসবল ক্যাম্পে
চাপা পড়ে রইলো
মৎস্যকন্যাদের
পবিত্র শীৎকার...
সৌম্যদা অল্প হাসে। বলে, কি রে! পার্টি
তথা সরকার তথা রাষ্ট্র এঁর দায়িত্ব নেয়নি? বৃদ্ধমানুষ ভিক্ষা করছেন বিকেলবেলা...
কেউ দেখলে আবার জেল-এ ধরে নিয়ে যাবেনা তো?
আমি, এক সামান্য
ভারতীয়, টোকেন হিসেবে এক
ইউয়ানের একটা নোট তাঁর হাতের তালুতে
রাখি...