আলোচিত বইঃ পতনশীল নায়ক
প্রকাশকঃ কেমব্রিজ ইন্ডিয়া
প্রচ্ছদঃ অমিতাভ মৈত্র
মূল্যঃ ১০০ টাকা
আলোচক : অনুপম মুখোপাধ্যায়
আপাতত আমি আততায়ীর ভূমিকায়। দুটি হত্যা করতে চলেছি। এক, অমিতাভ মৈত্র রচিত গদ্যগ্রন্থ ‘পতনশীল নায়ক’। দুই, আমার সামনে মেলে ধরেছি যে সাদা পাতাটাকে। একবার ভাবুন পাঠক, যদি একজন জেমস জয়েস উদ্যত হতেন অমতাভ মৈত্রর এই গদ্য গ্রন্থটির আলোচনায়, কত সুখের মৃত্যু তার হোতো। আমার হাতে একটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই হবে না। চোখ বন্ধ করে চোখের বাইরে বইটির অভিশাপবাণী শুনতে পাচ্ছি। সাদা পাতাটি অবশ্য অনুগত মেষশাবকের মতো আমার কলমের সামনে গলা এগিয়ে দিচ্ছে। আমি তার যন্ত্রনার খেয়াল রাখছি। আরো খুনি হয়েও উঠছি।
অমিতাভ মৈত্র। এই লেখক বাংলা গদ্যে এই বইটির মাধ্যমে একটি আবহাওয়া যোগ করলেন। সেই আবহাওয়া কতোখানি ‘স্বাস্থ্যকর’ বলতে পারি না, সেই আবহাওয়ায় প্রবেশ করার মতো রোগা পাঠক কমই আছেন, শ্বাস নেওয়ার মতো ক্ষীণজীবী পাঠক আরো কম, সেখানে বন কেটে বসতি স্থাপন করার মতো হাঘরে পাঠক অঙ্গুলিমেয় বলেই মনে হয়। অমিতাভ মৈত্রর গদ্যের পাঠক একমাত্র লেখকরাই, তাও খুব সন্ধানী লেখকই তাঁর এই বইয়ের প্রতি সুবিচার করবেন। অমিতাভর স্বর্গীয় উৎকেন্দ্রিকতা আমাদের জনসাধারণ আজো সহ্য করার জন্য প্রস্তুত নন। তাঁর জায়মানতা , তাঁর একাকীত্ব , তাঁর আত্মবিষ , তাঁর অমৃত... বাংলা গদ্যের একটি বিচ্ছিন্ন ভূখন্ড... বাংলা গদ্যে উত্তমাশা অন্তরীপ... বার্থলোমিউ দিয়াজদের অপেক্ষায়... ২০১২র জুলাই মাসে ‘ কেমব্রিজ ইন্ডিয়া’ থেকে ১০০ টাকা বিনিময় মূল্যের দাবি নিয়ে প্রস্তুত হয়েছে। প্রকাশনা সংস্থাটির নামটি গালভরা। কিন্তু এই বইয়ের নির্মান বেশ সাধারণ ভাবেই হয়েছে, তৃপ্তির সুযোগ অল্প।
‘পতনশীল নায়ক’ গ্রন্থের নামকরণ খুব স্বস্তিকর নয়। এবং লেখকের সেটাই হয়তো কাম্য ছিল। প্রচ্ছদপট তিনি স্বয়ং একেছেন। প্রচ্ছদের ছবিটা আগ্রহোদ্দীপক। তার পাথর থেকে সিসিফাস পড়ে যাচ্ছে। সে দু-হাতে তার মুখ ঢেকে আছে। ঘোর কৃষ্ণবর্ণের প্রেক্ষাপটে তার শররীরে রং ধরেছে নীল এবং অগ্নিবর্ণ। পাথরটিও সেই দুটি রঙ থেকে বঞ্চিত হয় নি। এই সিসিফাস অমিতাভ মৈত্রর ব্যক্তিগত সিসিফাস। ‘পতনশীল নায়ক’ নামের গদ্যগ্রন্থটিকে আমি তার লেখকের আত্মপ্রতিকৃ্তি হিসাবে দেখতে পাচ্ছি। এই বইয়ে ২০টি গদ্য রয়েছে। এই গদ্যগুলিতে দান্তে, হেনরি মূর, কাফকা, সেজন, এডনা সেন্ট ভিনসেন্ট, ডি এইচ লরেন্স, তলস্তয়, রেমব্রান্ট, টার্ণার, স্যামুয়েল অনেকেই এসেছেন, কিন্তু এসেছেন অমিতাভর নিজস্ব আয়নায়। অমিতাভর নিজস্ব ধুলোয় তাদের আলো স্পষ্ট হয়েছে। তথ্যের অভ্রান্ততা বা তত্ত্বের প্রামাণ্যতা এখানে আদৌ প্রাসঙ্গিক নয়। এই বইয়ের প্রতিটি শব্দের মধ্যে অমিতাভর উপস্থিতি, খুব কম লেখকের ক্ষেত্রে এটা দেখা যায়। লেখক স্বয়ং এই বইয়ের প্রতিটি গদ্যের প্রকৃত বিষয়। যখন তিনি জিব্রান বা হ্যামারশল্ড কে নির্বাচন করেন মনে হয় তিনি নিজেরই আত্মারই এক অংশকে ছিঁড়ে এনে রক্তাক্ত দেখাচ্ছেন। জিব্রানকে নিয়ে এই গদ্য না লিখে তাঁর প্রাণ ছিল না। ফ্রিডার ছবিগুলো কি অমিতাভর হয়েই আঁকা নয়! তলস্তয়ের নেখলউদভ কি অমিতাভ স্বয়ং নন!
এবং এই কথাগুলি না বলে আমারও ত্রাণ ছিল না বইটি পাঠ করে না উঠে।
অমিতাভ মৈত্র অন্ধকারের রঙে আলো আঁকেন। পাপ এবং পতন তাঁর চিরকালীন আগ্রহের বিষয়। প্রথম গদ্যেই আমরা নরকের সম্মুখীন হই। ‘পাপ ও পতন দান্তে থেকে হেনরি মূর’ এই গদ্যে অমিতাভ মন্তব্য করেন, ‘কীভাবে একজনের দেখার চোখ অন্যজনের চোখের দেখা হয়ে যায় , কীভাবে একজনের হারিয়ে-যাওয়া মরে-যাওয়া কন্ঠস্বর বহুযুগের ওপার হতে অন্যকারোর গান হয়ে যায়।’ ক্রমজায়মানতা এবং বিষ অমিতাভ উচ্চারণ করেন একসাথে। অমিতাভ গদ্যের শেষে বলেন “ওয়েস্টল্যান্ডের শেষলাইনে যে শান্তিবারি ছড়িয়ে দিয়েছেন এলিয়ট মালটিচুড ২ নামের ছবিতে তারই উদ্ভাসন যেন একেছেন হেনরি মূর , যেখানে ওপরে অনন্ত অধিকার আকাশ আর সমুদ্রের মাঝে হালকা আলোর একচিলতে আভাস। সেই পরিব্যপ্ত আলো আঁধারের মাঝখানে মানুষের মূর্তি , মানুষের শরবিদ্ধ তবু অপরাজেয় মুখ। মানুষ পতনশীল। হ্যাঁ ঠিক আছে। তবু মানুষই নায়ক”। প্রায় অনুবাদের ভঙ্গিতে লেখা এই বাক্যগুলি বইটির নিউক্লিয়াস।
প্রথম গদ্যটি শুরু হোলো দান্তের নরক বর্ণনায় , শেষ হোলো হেনরি মূরের ছবিতে। মাঝে ব্যোদলেয়ার, এলিয়ট রদ্যা... ঠিক যেন আমরা অভ্যস্ত হতে থাকি অমিতাভ মৈত্রর চেতনাপ্রবাহে।
অমিতাভ মৈত্রের জগতে এক অর্থে কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নেই। বহু দূরের বস্তুকে আরেকটির সঙ্গে মিলিয়ে তাঁর উল্লাস। অনায়াসে মিলিয়ে দেন তলস্তয়ের সঙ্গে রেমব্রান্টকে। তলস্তয়ের “রেজারেকশন” উপন্যাসের সঙ্গে রেমব্রান্টের আত্মপ্রকৃতিগুলির মিলন...অকল্পনীয়। তলস্তয়ের ‘রেজারেকশন’ উপন্যাসের নায়ক নেখলিউদভ যে স্বয়ং তলস্তয় এবং চরিত্রটির আত্মাবিস্কার এবং আত্মখনন যে তাকে রেমব্রান্টের আয়নায় তুলে নিয়ে যায় , অমিতাভর গদ্য ‘নেখলিউদভ--- রেমব্রান্টের আত্মপ্রকৃতির আদল’ পড়ে ওঠার পর মেনে নিতে হয়। মেনে নিতে ইচ্ছে করে , মেনে নিই তাঁর সৃষ্টির ধারণাকে।
ফ্রিডা কাহালোকে নিয়ে দুটি গদ্য রাখা হয়েছে। মেক্সিকান এই মহিলা চিত্রকরের জীবন সম্পর্কে অদম্য আগ্রহ ও শ্রদ্ধা এ থেকে বুঝে নেওয়া যায়। গদ্যদুটিতে অমিতাভ ফ্রিডার প্রতি , তাঁর পঙ্গুত্ব ও জীবনলালসার প্রতি নিজের তুমুল পক্ষপাত একটুও আড়াল করেন না। ফ্রিডা নিজের রক্তাক্ত জীবনকে একের পর এক সাঙ্কেতিক আত্মপ্রতিকৃতির মাধ্যমে তুলে এনেছেন এবং আত্মপ্রতিকৃতি যেন অমিতাভর নিজস্ব চায়ের কাপ। ছবিতে, কবিতায়, উপন্যাসে আত্মপ্রতিকৃতি অমিতাভর হোলি গ্রেল।
অথচ ভিনসেন্ট ভ্যান ঘগের আত্মপ্রকৃতিগুলি নিয়ে তিনি লিখলেন না কেন! এই প্রশ্ন আমি অবশ্যই ভিনসেন্টের প্রতি আমার পক্ষপাতের কারণেই করছি।
‘কালো জিপসি , একটা সিংহ , একটা চাঁদ’ একটি গদ্যের এই নামকরণ আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল বালজাকের জগতে ... ‘প্যাশন ইন দা ডেজার্ট’। কিন্তু সেটা হল না। গদ্যটি সম্ভবত এই বই-এর সেরা গদ্য। স্পেস এবং আমাদের দেখার চো্খ নিয়ে লেখক খেলছেন। গদ্যের শুরুতেই অমিতাভ লেখেন “ স্পেস একধরণের বহুমুখী ভাষা। অথবা এমনও বলা যায় সব ধরণের ভাষাই আসলে স্পেস। এই স্পেসের কোনো ইন্দ্রিয়স্পর্শের বাস্তবতা নেই। যা আছে তা ভার্চুয়াল”।এরপর আসে চৈনিক চিত্রশিল্পের প্রসঙ্, আসেন সেজান এবং তার ছবির চলমানতার বিভ্রম, হাইকুর অতলস্পর্শী ব্যঞ্জনা শেষ হয় জিয়াকোমোত্তর ভাস্কর্যে স্পেসের ব্যবহার নিয়ে আলোচনায়। একই সঙ্গে টেকনিক্যাল আলোচনা। কিন্তু তা নয়। এ আসলে এক শিল্পপিপাসুর ব্যক্তিগত এবং গোপন উপভোগ, যা তীব্র এবং সুখদায়ক। চিত্ররসিক অমিতাভ আরেকটি গদ্যেও দেখা দেন-‘ছবির বাঘ , কবিতার বাঘ’। যেখানে শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং ব্লেকের কবিতা এসেছে। এসেছে যোগেন চৌধুরীর ছবির প্রসঙ্গ।
অনুবাদক অমিতাভ মৈত্রর দেখা মেলে জিব্রান, এডনা সেন্ট ভিনুসেন্ট মিলে, ড্যাগ হ্যামারশল্ড... এই কবিদের কবিতা যখন অনুবাদ করেন। বিশেষ প্রাপ্তি হিসেবে থাকে এঁদের জীবন এবঙ্গ কাজ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। অনুবাদগুলিকে অনুসর্জন বলাই সঙ্গত। এই কবিদের তিনি যে ফরমায়েশে নয় নিজের স্বভাবেই বেছে নিয়েছেন তা স্পষ্টই বোঝা যায়।
কবিতা বিষয়ক চিন্তাভাবনা উঠে এসেছে ‘নীল হাতের গল্প’ এবং ‘অন্ধকার আফ্রোদিতি’ এই দুটি গদ্যে। অসাধারণ একটি গদ্য ‘মরুভূমির নির্জনতা’। কবি অমিতাভ মৈত্রর অন্তর্জগত এই গদ্যগুলিতে পাওয়া যায়। গদ্যকারের সীমা লুপ্ত হয়ে যায়। ভাস্কর চক্রবর্তীকে নিয়ে লেখা গদ্য ‘সেই ধারালো ওষুধ, যাতে সব অসুখ সেরে যায়’। নিজের প্রশাসনিক জীবনের অভিজ্ঞতাগুলিকে লিপিবদ্ধ করেছের, নিজের জীবনকে রক্তাক্ত চামড়ার মতো মেলে ধরেছেন ‘আঁধারে যাহারা চলে সেই তারাদের দলে’ এবং ‘কালো জ্বলন্ত মোমবাতি’ এই দুটি গদ্যে। জীবনের রং যখন কালো হয়, তা সব রঙ শুষে নিয়েই হয়, এই গদ্যদুটি পড়ে মনে হয়েছে।
নিজের উৎকেন্দ্রিকতাকে অমিতাভ মৈত্র সানন্দে দেখান। নিজের উৎকেন্দ্রিকতায় তিনি যার পর নাই পুলকিত। লেখা তাঁর ফেটিশ হয়ে ওঠে মাঝেমধ্যেই। সব পাঠকের লেখক তাঁর তাই হওয়া হয় না।
এবার আমি এই হত্যালীলা শেষ করতেই পারি। চারটি ফুলস্কেপ কাগজের সবটুকু সম্ভাবনা নষ্ট করলাম, অমিতাভ মৈত্রর এই গদ্যগ্রন্থটি আলোচনা করার অজুহাতে। আমার সম্ভবত সনাতন বঙ্গীয় ক্ষমা আর প্রাপ্য নেই। অবশ্য একই সঙ্গে আমার এত চেষ্টার পরেও বইটি মরে নি। একটি বইয়ের কণ্ঠনালীর স্পর্শে ছুরি ভোতা হয়ে যাচ্ছে, আমন ঘটনা খুব বেশি ঘটেনি আমার জীবনে।
এটুকু তো বলতেই পারি আমার মতো আততায়ীর হাত থেকে যখন বেঁচে গেছে অমিতাভ মৈত্র প্রণীত ‘পতনশীল নায়ক’ সহজে মরবে না। আশঙ্কা হচ্ছে বইটি অমর প্রতিপন্ন হবে না তো?... অশ্বত্থামার মতো অলক্ষ্যে...