শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৭৮ সালে, কলকাতায়। সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বেড়ে ওঠা। জীববিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রির পর কাজ করেছেন পুরুষ যৌনকর্মী সমীক্ষা থেকে রাষ্ট্রপ্রধানের অনুবাদক পর্যন্ত হরেক রকম। পরে পড়াশুনো করেছেন এস্পানিওল ভাষা। সেইসূত্রে পেয়েছেন স্পেনীয় সরকারের রুই দে ক্লাবিখো বৃত্তি। ২০০৮ সালে স্পেনীয় সরকার ও ফুন্দাসিওন আন্তোনিও মাচাদো আয়োজিত প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হিসেবে পেয়েছেন আন্তর্জাতিক আন্তোনিও মাচাদো কবিতাবৃত্তি (Beca Internacional Antonio Machado de Creación poética) যার ফলস্বরূপ স্পেনীয় রেসিডেন্সি প্রোগ্রামে লেখা হয়েছে কবিতার বই চিতাবাঘ শহর (কৌরব ২০০৯), পরে প্রকাশিত হয়েছে এই বইয়ের এস্পানিওল তর্জমা La ciudad leopardo (Olifante, 2010)। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থঃ দহনখাতা থেকে (প্রথম আলো, ২০০০), উজ্জীবন ( রোদ্দুর, ২০০১), জাদুপাহাড়ের গান (ভাষাবন্ধন, ২০০৬), বৌদ্ধলেখমালা ও অন্যান্য শ্রমণ (কৌরব, ২০১২), কাচের সর্বনাম (কৌরব, ২০১৪)। চিতাবাঘ শহরের দৌলতে ডাক পেয়েছেন স্পেনীয় কবিতা উৎসব এক্সপোয়েসিয়া (Expoesía) ও কলোম্বিয়ার মেদেয়িন আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবে (Festival internacional de Poesía de Medellín, 2012)। বৌদ্ধলেখমালা ও অন্যান্য শ্রমণ কাব্যগ্রন্থের জন্য ২০১৩ সালের যুব সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। পেশায় স্পেনীয় সরকারি ইন্সতিতুতো সেরবান্তেস (Instituto Cervantes), নয়াদিল্লিতে এস্পানিওল ভাষার শিক্ষক।
খাদ্যরসিক ও কট্টর মোহনবাগানী শুভ্র ২০০৮ থেকে কৌরব পত্রিকা সম্পাদনায় ও কৌরব প্রকাশনীর সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। আর হ্যাঁ, উল্লেখ থাকুক, এই প্রথম সে বাক-এ। তার একগুচ্ছ নতুন লেখা কবিতা এই পাতায় রাখতে পেরে আমরা আনন্দিত।
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা
সরাণঋতু
১
সামনে ভাঙা দেবব্রত বিশ্বাস
পরপর এল পি আমার মাথায় পাকানো দুশ্চিন্তা
অথচ আমি গ্লাভস খুলছি না
পেঁচিয়ে ধরা আলো আমাকে বধির করছে
অথচ আমি জিভ ছাড়ছি না তোকে
শুধু পরপর বাক্সে মেলা রয়েছে আমাদের বেঁটে ঘরগুলো
পার্কে বৃদ্ধদের অন্তহীন হাঁটা
আমাকে কী অসীম লোলুপ করছে
একটা দুটো খেলা – বানভাসি অমূলকে
ফুটপাথে একটা স্টিলের গাছ ও ছন্দবাঁধা আনাজ কাটার শব্দ
আমার শীর্ণ হয়ে ওঠা আঙুল
আর আয়নায় ছড়ানো আমূল আগুন
২
কোথাও কি চাবিগুলো ফেলে আসতে চাইছো?
একটানা পিঁপড়ে ঢাকা চলাচল দূরবর্তী কাচের বয়ামে...
দরজা ভরা ছেড়ে আসাগুলো আটকে রাখছে কে?
এভাবে বিরাট একটা বাক্স তৈরি হয়ে যাচ্ছে
প্রতিহিংসাপরায়ণ আলো ঢুকছে
আমাদের মাথার নিজস্ব শিয়রচাঁদা
থেঁতলানো কাঠবেড়ালিতে থমথমে কথা
নির্মিত হাঁটার গোলার্ধ...
দিকজ্ঞান বিছানায় পড়ে থাকছে বর্ণমালা
অপঠন পদ্ধতির দীর্ঘ পাঠ্যক্রম
৩
উদাত্ত বলে কিছু নেই
ঠিকরে উঠেও না বেরিয়ে যাওয়াকে অভ্যেস
মিত শব্দ চালান করে দেওয়া শুকনো ঘাসকে হৃৎপিণ্ড
এই তো সামান্য অভিধান!
একপ্রস্থ থকথকে স্তব্ধতা তারিয়ে দেখছি
বাল্ব ও শীত, আহিরিটোলার দিকে এবছরও যাওয়া হলনা
গঙ্গা শব্দটা শুধু আদি বা শ্রাদ্ধের সঙ্গে এঁটে
যেখানে নিশ্বাস নিচ্ছি সেখানে শুধু ভেজা পাখিতে ভরে থাকা পার্ক
৪
এই যে একগুচ্ছ বাক্সবন্দি রাস্তা
কোথাও কান্না নেই
শুধু পলিথিনে মোড়া পিয়ানো নিয়ে রাস্তা পেরোচ্ছে লোকে
নক্সাভাসা ঋতুগাছ
এভাবে পালিয়ে যায় নাগাল শব্দটার বশে
নভেম্বরের পৃথিবী একটা সোনালি ধুলোমাখা বল
মুহূর্তে ঝোপের মধ্যে
কোথায় কে জানে মাছ ও ফাতনার ধৈর্যে স্থির
এই শব্দগুলো কোনদিকে আমার রক্তে মাথা নামায়
অকেজো রাতের দিকে আমার বদল
বলি সেজে ওঠার কথা আরেকটু সহ্য করার দিকে
এভাবেই রোজ বেরিয়ে ছককাটা নিশ্বাসের নাম দিচ্ছি দেশ
মৃদু রাখালের তালুর যে বিশ্বাস গবাদি শরীরে লেগে থাকে
৫
অক্ষরহীন এসে পড়ছি পরপর ছাইদরিয়া, বর্ষা বা আকাশ প্রতিফলিত বালি জুড়ে শুধু সন্ধের ল্যাম্পপোস্ট জলের দাগ, আমি একা শব্দটির জোর পরখ করছি, দাঁতে কাটছিনা ছোট্ট মুনিয়া, যদিও বহুবার অজস্র নিরক্ষর পাতার ভোর মুখে পেতেছে তুলোয় জমাট খয়েরি সাধারণ মাথা নামানো আমার স্টিলের আঙুল যাকে খুলেছে তাকে দরজা বললে সামনে শুধু কাগজের ফেঁপে ওঠা খোপ – ভিতরে হলুদ আলো – একটা দীর্ঘকায় সহাবস্থান যাকে ছায়াহীন বেড়ে ওঠা বলি... মুঠো পাকাই, আয়নার সামনে বলি পেরে যাব... আরেকবার সমস্ত শুকনো ডালে ও চামড়ায় জানুয়ারির লতিয়ে ওঠা ভেঙে যেদিকে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড ভাঁড় চলা নাকচ করে চার্লি মিংগাস, ঋক্ষ ও বনবিবি
৬
মাথা নামিয়ে আনছি বাংলাভাষাহীন কয়েকটা শতক
ভাসমান জলবীজ যোজন ছড়ানো
অক্ষরলুপ্তির শিরা কেটে রাখছে ভাবনা
আয়না ঠাসা একটা সুড়ঙ্গ – আমাদের অক্ষরহীন মুখগুলো
আচমকা বৃষ্টিতে থামা পিকনিক
ভেজা ছাই উনুন ও বিন্যাস
শেষ করতে পারা যাচ্ছে না রাস্তা
সন্ধের আওয়াজ তেলে পেকে ওঠা বেসনের রঙ
একই ভাবে জিভের ওপর পড়লেও ভাষা ঝরে যাচ্ছে
এইভাবে বহুদিন শাঁখের পেটে পুরে রাখা সমুদ্রের নুন
আমাদের জোঁকজীবন উপহার দিয়েছে
আর কিছু নেই কেউ অক্ষরচটা বই রেখে আসছে বিখ্যাত কবরে
একটু আগে ঘর পাল্টানোর ছলে অতীশ দীপঙ্করের ডায়রিতে
গুঁজে দিয়েছি ভাদু ও দক্ষিণরায়
খণ্ডসত্যি পড়ে আছে বন্যাখাওয়া ল্যান্ডসডাউন রোডে
একটা ৪তলায় দাঁড়িয়ে মা রেডিওয় সন্ধ্যা মুখার্জি
৭
বলো ফাঁকি দেওয়ার মাঝে যে ফেরার কথা
শরীর জড়িয়ে ঋতু মেলে দেওয়া অভ্যস্ত মার্চের দিকে
বারবার ফেব্রুয়ারি গুঁজে দিচ্ছি পুরনো ছবি
আমার অশ্রুত খণ্ডে ছড়িয়ে থাকছে
আমি যাচ্ছি বারবার মাথা নামানোর যে উচ্চতা
শিউরে উঠছি – ভাবছি বিশ্বাস থাকাই কি ভালো?
এভাবে রাতের গায়ে যে সব রুপোলি রাস্তা গেলো
ক্রমশ না বাংলার দিকে
সেখানেই তো সহজ খাবার দোকান
খোল বাজানোর শব্দ একটা দুটো বৃন্দগানে
আমি কি আশ্বাস পাচ্ছি?
দু তালু উন্মুক্ত করি বহুদিন জলহীনতার দাগ
কোঁকড়ানো নরম রবারের দস্তানা
তবু আঁকড়ে থাকছি তাকে প্রাণপণ
দুলে উঠছে এই ক্রমশ পর্দাঢাকা ভ্রমণ
এইসব পোড়ামাটির খেতে কেউ শস্য দেখছে
পোড়া রাস্তা আল বরাবর গেলেই কি
চালতার গন্ধে ভরে থাকা বাক্স?
যাকে দুপুর বলে ডাকতেই একটা
গাঢ় খয়েরি ফড়িঙের হালকা উড়ান?
বন্ধুরা সলিল চৌধুরী মুড়ে ফেলে দেবে
একটা সপ্তাহঠাসা সুড়ঙ্গে?
কাটা উচ্চারণের গায়ে একটা মগ্নমাস,
ফসলকাটা ভারতীয় ভাষার অক্ষর
পুরনো নিভন্ত দাগ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে
সাদা পাতাটাকে বিশ্বাস বলা যাবে?
৮
এই যে ভাঙন মানতে চলে আসা
একঝলক কাঁঠালের গন্ধে জ্যৈষ্ঠ শব্দটি টলটলে
হাতপাখার মৃদু নীল পাড়া
ছাত বন্ধুত্বকামী সন্ধে ও উজাড়
তুমি চেয়ে রয়েছো
হলুদ কাগজ টানটান
হালকা বাতাসের এই বিকেল আসলে অপেক্ষা মোড়া পাতা
শব্দ আমার বশম্বদ নয়
ফিরতি ট্রেনে এল আই সি আছে,
আচমকা হাত রাখা কি আসলে তালুর ফাটল দেখে?
বলি তুমি তো যুদ্ধ জান না
খবর কাগজ থেকে দূরে যে ঋতুদাগ গড়ে উঠল তার পাশে
একটা ফ্যাকাশে হাড় রঙের পায়ে চলা
একে রাস্তা বলো আরেকটু গেলেই বালকেরা যে মনস্তম্ভ গড়ল
তাতে কালো দোতারা পুঁতে রাখল কে?
ক্রমাগত গ্রীষ্ম শব্দটি
কাদের বাড়ির ভাঙা বিয়ের বাল্বগুঁড়ো হয়ে উঠছে?
৯
শুধু একটা টুকরো দেখি
কমলা হলুদ সামিয়ানা হতে চেয়ে যে সময় ভেসে থাকল
চোখ বুজলে ত্রস্ত মাঠ বিন্যস্ত খেলা
ক্রমশ শুকনো একটা নদী খাতে টেনে নিচ্ছে
ত্যক্ত নৌকার কাঠে তখনও
তিরতির করে কাঁপছে আঁশটে খয়েরি
সেটাই বিকেল
কী প্রাণ দৌড়নো তোর
প্রথম বীজ তৈরি হচ্ছে
আয়নাহীন ভাষার
১০
আমি তো সহজে কোনও দরিয়ার কথা বলতে পারিনা
একটা নম্র বিকেল যেখানে প্রতিদিন নামিয়ে এনেছে
ট্রেন না যাওয়া ট্র্যাক বড় ঘাস বন্ধুত্বহীনতাগুলো
পরপর ফেরত আসছে শুকনো অক্ষরের খোল
একেই তো কথা বলে ডাকছি
এই জান্তব বিশ্রাম কামনা থেকে দূরে
ভেসে থাকছে তোমাদের যাতায়াত
হাওয়া ফাঁপিয়ে তুলছে ঋতু অভ্যস্ত ধাতব গাছ
তোমরা ফিরছ কিনা বোঝা যাচ্ছে না
শুধু বইগুলোয় পতঙ্গ হয়ে থেঁতলে থাকছে বাংলা
"প্রথম বীজ তৈরি হচ্ছে / আয়নাহীন ভাষার " - তবুও ঠিকরে পড়ছে ছবি, ছড়িয়ে পড়ছে
উত্তরমুছুনভাঙা ভাঙা মন, কোন এক অস্পষ্ট পরিসরে গিয়ে জোড়া লাগবার নাছোড় স্বপ্নের বিষণ্ণতায়, লোনাপানির দরদরে ন্যাকামি নয় তবু, অ্যারারুটমারা চতুরচালাকিও নয়। অভিনন্দন শুভ্র। - গৌতম চৌধুরী
শুভ্র-দা, যেকোনো কবিতার সার্থকতা তার নিরন্তর জায়মানতায়, যেভাবে এই শব্দের সারি পাঠকের মগজে গিঁথে যায় ও ক্রমাগত জারণ-প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে অন্যান্য সম্ভাব্য লেখার জন্ম দিতে থাকে। এই লেখাগুলো সেই কারণেই সার্থক, ও অনিবার্য।
উত্তরমুছুন