অনুপম বলছি
‘বাক’-এর ৫ বছর পূর্ণ হতে চলল। আর কয়েক মাস
বাকি। ভাবলে আনন্দ হয়। আবার দেখি একটু ভয়-ভয় করে। ভয়টা কীসের? খুঁজে পাচ্ছি না।
লেখালেখিতে সততার কথা বললে অনেকের কাছেই আজ হয়ত
হাস্যকর শোনাবে। সৎ লেখা... এই টার্মটির অবস্থা এখন সিন্ডারেলার চেয়েও করুণ। তবু,
আমি বলতে চাই, লেখালেখিতে সততা যদি না থাকে, জেদ যদি না থাকে, সাহস যদি না থাকে,
নিজস্বতা যদি না থাকে, একটা বিস্ময়ের উৎসার যদি না থাকে, লিখে আপনার লাভ কী? আমি
‘লাভ’ শব্দটাই ব্যবহার করলাম। আজ লেখক পরিচয় পাওয়াটা আগেকার যে কোনো সময়ের চেয়ে
সোজা হয়ে গেছে। কারণ হয়তো এই যে, পাঠকের সংখ্যা আজ করুণভাবে কমে গেছে। সকলেই লেখক।
সকলেই সবকিছু লিখতে ‘জানেন’। এবং, এর ফলেই একজন প্রকৃত লেখকের কাছে ব্যাপারটা আরো
মনের মতো হওয়ার কথা। সাঁতার যিনি কাটেন, অনুকূল স্রোত বা স্থির জল তাঁর পছন্দ
হওয়ার কথা নয়। এবারের ‘বাক ৮০’-তে কবিতার সংখ্যা বেশ বাড়ালাম। এটাকে ডকুমেন্টেশন
ভাবতে পারেন। প্রতিষ্ঠিত অনেকেই এখানে লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে একটা তুলনামূলক বিচার
হোক না? একজনের সঙ্গে মিলিয়ে পড়ুন আরেকজনকে। এই তুলনামূলক সাহিত্যপাঠ থেকেই আগাছার
ধারণা প্রাঞ্জল হয়। অহেতুক ঠিক বেঁচে যায়, অপ্রয়োজনীয়কে যেতে হয় ঝরে। এঁদের মধ্যে
২০১৪-এ কবিতা প্রকাশের অধিকার কতজনের আছে, কতজন ফেলে আসা পরিসরের হয়ে চর্বিতচর্বন করছেন,
সেই বিচার মহাকাল কেন, আজ এখানেই ‘বাক ৮০’-র পাঠক নিজেই করুন। বিচারটা নিজে টিকবে
কিনা পরে বোঝা যাবে।
কবি মিলটন গদ্য লিখতে চাইতেন না। কিন্তু কেন?
অনেকেই মনে করেন গদ্য লিখলে কবিতার হাত নষ্ট হয়ে যায়। সেটা অমূলক। ড্রাইডেন, কোলরিজ,
ওয়র্ডসওয়র্থ, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, মণীন্দ্র গুপ্ত, সুনীল, শঙ্খ
ঘোষ, আলোক সরকার, মলয়, সমীর, বারীন, আর্যনীল... তালিকা দেওয়ার কোনো দরকার আছে কি?
ঘটনা হল, কবি যখন অন্য কবি অথবা কবিতা নিয়ে গদ্য লেখেন, অপরূপ কিছু দেখা দেয়।
সেখানে কিন্তু আমরা তাঁর গদ্যটাই পাই। কবিতা পাই না। আসলে, লেখকের অধিকার যে
কতখানি, একজন কবির গদ্য তা প্রতিটি শব্দচয়নে বুঝিয়ে দেয়। এবারের ‘বাক’-এ সুব্রত
সরকারের গদ্যটিই ধরুন, আমার তো চমৎকার লেগেছে।
কিছু বন্ধু আজকাল অদ্ভুত গদ্য লিখছেন। কমলকুমার
মজুমদার, বা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁদের মিলিয়ে পড়লে অবিশ্যি চলবে না।
গদ্য এবং কবিতার ফারাক কখনোই মুছে যাওয়ার নয়। কারণ, আপামর জনসাধারণের জন্য একটি
প্রবন্ধ লেখা হয়। তারা কবিতার ধার ধারে না, কিন্তু কবিতা নিয়ে গদ্য তাদের জন্যও
লেখা হয়, সেটা এক জরুরি কাজ। সেই গদ্য যদি ন্যারেটিভ সাহিত্য হয়, আলাদা ব্যাপার।
তাহলে একটা ‘অন্তর্জলী যাত্রা’-র জন্য এক শতাব্দী অপেক্ষা করা চলে। কিন্তু সেই
গদ্য যদি নিজেকে ‘আলোচনা’ বা ‘মূল্যায়ন’ বা ‘প্রবন্ধ’ হিসেবে দাবি করে, সেখানে
ভাবপ্রকাশের অবকাশ থাকে খুব কম। হতে হয় ধারালো। থাকতে হয় অকাট্য যুক্তি। সিনট্যাক্স
এবং ডিকশনকে হতে হয় সাধারণ। এবং, অবশ্যই এমন কিছু উচ্চারণ থাকতে হয় যা লেখকের
উপলব্ধি তথা আবিষ্কার। সেখানে কোনো সুযোগ নেই কবিতার ভাষায় অসংলগ্ন কথা বলার। একজন
শিবনারায়ন রায়, বা সুকুমারী ভট্টাচার্য, বা বুদ্ধদেব বসুই সেখানে আদর্শ।
কিন্তু খুবই বিশ্রী ব্যাপার ঘটছে কিছু বন্ধুর ক্ষেত্রে। তাঁরা অনেক জায়গাতেই আজকাল লিখছেন। দেখছি তাঁদের
‘প্রবন্ধে’ একটি শব্দের পাশে আরেকটি শব্দ যেন খেয়ালখুশিতে এসে বসছে। সেটা কবিতা
হিসেবে পড়লে মন্দ লাগছে না। কিন্তু প্রবন্ধ হিসেবে এই অভ্যাস অসহ্য। সম্পাদক কি
পাতা ভরানোর জন্য এতই উন্মুখ যে, এই গদ্যটি পড়ে দেখার অবকাশ পাচ্ছেন না? নাকি,
তিনিও মনে করছেন যা বোঝা যায় না একমাত্র তাই উৎকৃষ্ট? ফেসবুকে দেখছি এই গদ্যকারদের
কিছু আত্মহারা বন্ধু আছেন। সব মিলিয়ে... ব্যাপারটা সন্দেহজনক। বন্ধুটি হয়তো যা
নিয়ে বা যাকে নিয়ে লিখছেন, সেটা নিয়ে বা তাঁকে নিয়ে তাঁর বলার কিছুই নেই। কিন্তু
লেখার ইচ্ছে আছে ভরপুর। ফলে এই সন্ধ্যাভাষার চালাকি। আসলে তিনি কিছুই পড়েননি,
কিছুই তাঁর বলারও নেই। বলার ইচ্ছেটা আছে বিস্ফোরক।
পরিশেষে 'বাক ৮০'-তে যারা লিখছেন, তাঁদের অনুরোধ, 'বাক' প্রকাশিত হওয়ার পরে নিজের নিজের লেখার লিংক ফেসবুকে শেয়ার অবশ্যই করুন, আপনার বন্ধুরা আপনার লেখায় তাহলে সরাসরি পৌঁছতে পারবেন। কিন্তু সরাসরি নিজের লেখাটি ফেসবুকে তুলে দেবেন না। তাহলে একটি ওয়েবপত্রিকার ক্ষতি হয়। অন্তত দিন সাতেক অপেক্ষা করুন। আপনার যিনি পাঠক, তিনি কি 'বাক'-এর লিংকে ক্লিক করে আপনার লেখাটি পড়তে পারবেন না? প্রিয় লেখাগুলির ক্ষেত্রেও একই অনুরোধ রইল। বন্ধুর লেখা যিনি ফেসবুকের পাঠককে পড়াতে চান, তাঁকেও একই অনুরোধ।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন