ফোন
দেবাদৃতা বসু
ভবতারণবাবু সবেমাত্র সকালের দুধ-চিনি
ছাড়া গরম কফিতে চুমুক দিতে পেরেছেন, এমন সময় সামনের টি ভি- তে নিউজ
স্ক্রোলে তাঁর চোখ আটকে গেল। ভয় ও হতাশার কিঞ্চিৎ মিশ্র অনুভুতি টের পেতে পেতে শুরু
করলেন ঘরের মধ্যে পায়চারী এবং ঠিক ঠিক কি করা যায় তার একটা মানসিক
খসড়া তৈরি করেই হাত বাড়ালেন টেবিলে রাখা ফোনের দিকে। খবরটা এতক্ষণে হয়ত
সকলেই জেনে গেছে, তবু বিষয়টা নিয়ে না ভাবলেই নয় এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব
পরবর্তী কর্মসূচী ঠিক করে ফেলতেই হবে। এদিকে বড়বাজারের কেরানী কালিদাস
মিশ্রর ফোন ক্রমাগত এনগেজড । মনোবিদ ডক্টর সেনগুপ্ত কে ধরা যাক, নাহ, এর টা আবার সুইচড অফ। এদিকে
গোটা কন্ট্যাক্ট লিস্ট ঘেঁটেও ইন্সপেক্টর তিওয়ারি বা মধুসূদন বাবুর নম্বর টা পাওয়া যাচ্ছে না। মিস অন্তরার নম্বর
লাগছেনা, হয়ত মেট্রোতে আছে।
অদ্ভুত অসহায় লাগে ভবতারণবাবুর।
বসকে ডাইরেক্ট ফোন করা যাবেনা। অথচ এমন একটা সময়ে কাউকেই ফোনে পাওয়া
না গেলে, হাত পা গুটিয়ে বাড়িতে বসে থাকাও দুস্কর। এই দিনটার জন্য কবে
থেকে চুপচাপ অপেক্ষা করে আসছে ওরা। এবং ঘটনাটা ঘটলোও অতর্কিত একটা সময়ে।
গোটা শহরে হয়ত এতক্ষণে শোরগোল পড়ে গেছে। অ্যালেক্সর মৃত্যু একটা
সেন্সেশানাল ঘটনা। এই নিয়ে তোলপাড় শুরু হওয়ার আগেই গুছিয়ে ফেলতে হবে নিজস্ব
কর্মসূচী। অথচ কাউকেই পাওয়া যাচ্ছেনা ফোনে। কোনও ফোন আসেওনি ইতিমধ্যে।
আর বাড়িতে বসে থাকতে
পারলেননা ভবতারণবাবু। জামা প্যান্ট পরে বেড়িয়ে পড়লেন হেড কোয়ার্টারের উদ্দেশে।
ফোনে যখন কাউকে পাওয়া যাচ্ছেই না, তখন সশরীরে হেড কোয়ার্টারে পৌঁছে যাওয়াই
ভালো। এতক্ষণে জমায়েত শুরু হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। নির্ঘাত সমস্ত লাইনে কোনো
সমস্যা হয়েছে। কেউ কারোর সাথে যোগাযোগ করতে পারছেনা। হয়ত তাকেও ফোনে
ধরার চেষ্টা করছে অনেকে। আলেক্সের মৃত্যুর খবরে তো মানুষ চুপচাপ বসে থাকতে
পারেনা।
রাস্তায় বেরিয়ে অত্যন্ত অবাক
এবং বিরক্ত হলেন ভবতারণবাবু। মানুষের মধ্যে কোনো হেলদোল দেখা যাচ্ছেনা
কেন! মানুষ জন কি এতটাই নিরক্ষর রাজনৈতিক ব্যাপারে। টি ভি তে, খবরের কাগজে এতক্ষণে চাউর
হয়ে গেছে আলেক্সের মৃত্যুর খবর আর এদিকে লোকজন
আদিখ্যেতা করে ইলিশ দর করছে আর ঘ্যানঘ্যানে বাচ্চাগুলো মা বাবাদের হাতে ঝুলতে ঝুলতে
স্কুল বাসে উঠে পড়ছে। চকচকে ইস্ত্রি করা জামাকাপড়ে লোকজন অফিসে
যাচ্ছে এমন হাবভাব যেন কিছুই ঘটেনি। এটা কি সম্ভব এরা কেউ কি খবরটাই পায়নি
এখনো? না এরা জানে না যে আলেক্সের মৃত্যু তাদের দৈনন্দিন জীবনকে কিভাবে বদলে
দিতে পারে?
বিরক্তির পাশ কাটিয়ে আপাতত ভবতারণবাবুর
গন্তব্য হোল হেড কোয়ার্টার। বার তিনেক গেছেন উনি, তাই চিনতে অসুবিধা হবে না।
চট করে হাঁক দিয়ে একটা ট্যাক্সি ডাকেন এবং উঠে পড়েই ড্রাইভার কে নির্দেশ দ্যান “যাদবপুর স্টেশন রোড চলো” । ড্রাইভার
মুখ না ঘুরিয়েই প্রশ্ন- “কোনদিকে যাব? আমি ঠিক চিনি না” ভবতারণবাবু- “আরে বাইপাস ধরো
না ড্রাইভার!”-
“কোন বাইপাস?” – “আরে বাইপাস আবার কটা আছে?” –“ আপনি ঠিক কোথায় যাবেন বলুন
তো?” – “বললাম তো যাদবপুর স্টেশন রোড যাব। ১৪ নম্বর লেন।” – “কোন জায়গার কথা বলছেন দাদা, আমি চিনি না, অন্য গাড়ি ধরে নিন।” – “আরে তোমাকে তো পরিস্কার
করেই বলছি, আচ্ছা, দেশপ্রিয় অবধি চলো, বা রুবি হসপিটাল।”- “এসব কী বলছেন দাদা! কোথায়
যাব?” –“ লেকের কাছে চল তাহলে।”
ড্রাইভার এতক্ষণে ঘুরে
তাকায়। অভিব্যক্তি বুঝিয়ে দিচ্ছে, সে একটা জায়গারও নাম শোনেনি কস্মিনকালেও। এই
মুহূর্তে ভবতারণবাবু ঘামতে থাকেন, ড্রাইভারের মুখটা অনেকটাই আলেক্সের মত লাগছে।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
বেশ ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনRamanath Ray-er "Jaal Kolkata" bole ekTa galpo chhilo, haThat seTar katha mone poRe gyalo... besh chamotkar hoyechhe, lekhaTa... :)
উত্তরমুছুনগল্পটার কথা মনে পড়ল কেন? ... কৌতুহল জাগিয়ে চলে যাওয়াটা কিন্তু খুব অন্যায় হচ্ছে। বিশেষ করে আমি সেই গল্পটি পড়িনি।
মুছুন