‘এভাবে লিরিকাল
এভাবে ভালোবাসা না হলেও পারত
নতুন দুপুর জুড়ে কত কী বললে,লিখলে
তোমার চশমা জুড়ে সুদেষ্ণাদি লেগে
আছে...
পাখনায় রঙ – আমি
হলাম
উড়ন্ত পাল্লা দিয়ে দৌড় তোমার ঘর-দোরে
তোমার চশমা জূড়ে সুদেষ্ণাদি লেগে আছে ‘
কবিতারা কি
শরীরচর্চা করছে ? নিশ্চয়ই করছে । ভারী শব্দের সম্মোহনের বিদ্যা থেকে কবিতা ভেসেথাকার চেষ্টা করছে মগজের বহনযোগ্য অলস
স্তরে । এসমস্ত একরকম ভনিতা । প্রাথমিক ভাস্বরতার পর ধীরে ধীরে দুলে দুলে ডুবতে
থাকবে ,ডোবাতে থাকবে –এটাই এই সংকলনটির গুপ্ত এজেন্ডা ।
বইয়ের পাঁচ নম্বর পাতায় , ঠিক যেখানে ‘মুখবন্ধ’
টাইপের কিছু থাকে , সেখানে উপরের ওই লাইনগুলির ক্যাজুয়েল উচ্চারন বেশ ধ্বন্দে ফেলে
দেয় । কিভাবে পড়বো এই সংকলনটি ! পড়ার টেবলে বসে শিরদাঁড়াকে কম প্রশ্রয় দিয়ে !
...নাকি খুব ঘরোয়া অলস ভঙ্গিতে আধশোয়া ভাবে ! যেভাবে আমি অভ্যস্থ । এক বিঘৎ মাপের
হাল্কা –পাতলা এবারের কলকাতা বইমেলা থেকে আনা বইটির আগাম কিছু ঝলক দেখেছিলাম , ঐ
প্রোমো বলা যেতে পারে ,তাতে করে মাথায় ছিলোই নামটা । সুতরাং লেখকের গেম প্ল্যান
আনুযায়ী নিমজ্জ্বিত হতে থাকলাম ...
“ একটা কেওস বেঁধে গেল ব্যাখ্যা যে নেই তা নয় হঠাৎ বুঁদ রাতের পরদিন
হ্যাঙ্গওভার কাটাতে যে সব শব্দরা লাট খেতে থাকে তাদের দিকে তাকালে
কী রকম একতা প্রখর চেপে ধরে , কেওসটাকে পাত্তা দিলেই অনেকটা
সময় কাটত, স্ট্রবেরী আকাশটাকে ভোর বলে মনে হত না আদৌ ,রাতের
শেষ কেটে যাওয়া ঘোর মাত্র – নতুন
কি টার্ন নেওয়া অতীতের গন্ধ ? ছোট্ট
একটু স্পেস রাখলাম এখানে ...শিস দিতে দিতে একটা তীক্ষ্ণ শিরশিরে
ভাব মেরুদন্ড বেয়ে...” (
টার্নিপয়েন্ট)
কিরকম মসৃন লিখে
গেলেন কবি , যে লেখায় তাঁর সংকলনের নামকরন ! এরকমই নির্মেদ –সাশ্রয়ী আচরন ওনার এই
লেখাগুলোয় । কলমে খুব নরম কালি ঝুলিয়ে রেখে উনি লিখে গেলেন
“হুইসল থেকে ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে মাঝরাতের দিকে...
জোৎস্না নামা মতো প্রপাত চলে ভেতরে ভেতরে, টের পাই - ” ( টার্নিংপয়েন্ট)
পাঠকও টের পেতে
থাকে কবির মগ্নতার দৃষ্টি , নিছক দেখা থেকে উত্তরনের গল্পের আড়াল সরে যেতে থাকে । কবিতার
কূয়াশা ক্রমে ঘন হতে থাকে । কবিতায় কবিতায় ছত্রে ছত্রে কবির নির্বিকার আশ্চর্য
উচ্চারন সম্মোহিত করতে থাকে । আপাতসামান্য কিছু শব্দে নির্মান হয় কবির নিজস্ব
ইমেজারী, একান্ত নিজস্ব ছবিপ্রতি গল্প...
“ নতুন রোদ্দুর বুনছি, একটু ড্র্যাগ করে ওপরের দিকে তুললেই চমৎকার
হলো- আবছা আর রূপালির কন্ট্রাডিকশন আছে থাক...”(ড্র্যাগ)
‘সুজনেষু’ সিরিজে
কবি আপাতক্ষীন কবিতা থেকে বেড়িয়ে নিজেরই
হাত ধরেছেন । কখনও বিষয় কখন নাবিষয়ের দোলাচলে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন নিজের সামনে
। অবচেতনাবাসী অভিজ্ঞতা্রা নিপুন নেমে
এসেছে যখন
“ঝনক শব্দটার পাশে একজোড়া নূপুর খুলে রাখলে শব্দটা এগোবে না
পিছোবে ঠিক এখনই বোঝা যাচ্ছে না । দু পা জল-ডুব। ধুইয়ে দেওয়া
আলতার দাগ ধরে নকশা ঊঠছে । ...... ”(সুজনেষু ৩) ----------------------উচ্চারিত
হয় । মোহোময় বিন্যাসের সাথে সাথে কবি যেন এক চলমান জানালার ধারে বসে আছে্ন বহুদিন
! নিরন্তর ডাউনলোড হয়ে চলেছে আশেপাসের ছুটে চলা দৃশ্য, শব্দ ,ধ্বনি । কিংবা কখনও সত্যি মনে হয় কবি হঠাৎ ঘুম থেকে ঊঠে
লিখে ফেলেছেন এবং আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন -
“ঘুমের ভেতর ঘুম হয়-
আর একটু এলোমেলো ছূঁয়ে
নাভির চারপাশ ছূঁয়ে অল্প আলো,
জানলা বেয়ে ভোর আমেজ
জাগছি না...”(ঘুম)
এভাবে কবি ভালো
লাগাতে লাগাতে শিফট করেছেন এক কবিতা থেকে অন্য কবিতার বিষয়ান্তরে । কিন্তু মুল যে
তারে বাঁধা, যে স্কেলে বাঁধা তার পরিবর্তনের ঝাঁকুনি পাঠক টের পাচ্ছেনা । দৃশ্য
অদল-বদল হচ্ছে , টোনসেট বদলাচ্ছে না ! এটা কি কবি সচেতনভাবে করেছেন ? ঘোর সন্দেহ
হয় যখন কোনো কবিতা শুরু হয়
“চলো পালটানো মেঘ থেকে
দুপুর তুলে রাখি ...”(দ্বিপ্রাহরিক) – এরকম লাইন
দিয়ে ! নিজেকে নিজের বাইরে গিয়ে , অন্য স্বত্তায়(অপর)দেখার প্রয়াস বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে
আছে অজস্র কবিতায় । বিদুৎএর ঝিলিকের মতো চার-ছয় লাইনের কবিতাগুলি টুকরো মুহুর্তের
লিপি বলেই মনে হয় । কিংবা কবিতার ভ্রুণ । অজস্র কবিতা তুলে দিতে মন চায় ,কিন্তু
তাহলে পুরো বইটাই এখানে তুলে দিতে হয় ,যা সম্ভব নয় ।
কিন্তু প্রশ্ন
হচ্ছে,এভাবে কি একটা সংকলনের প্রতিক্রিয়া দেওয়া যাবে ! এখন একরকম পড়বো ছয়মাস পরে
আর একরকম মনে হবে ,তার ছমাস পর...কবিতা পালটে যাবে বইয়ের ভেতর । আমিও পালটে যাবো !
শরীরে হাল্কা , শব্দের ব্যবহার হাল্কা , বাক্য বিন্যাসে
মুন্সিয়ানার ছাপ রাখা ৫৫ পাতার সংকলনটি একটি নির্দিষ্ট প্রয়োগকে মাথায় রেখেই করা
,কিংবা নয় । কিন্তু কবিতাগুলি খুব নিরীহ
,সুপাঠ্য মেদহীন ওয়েফারের মতোই মুচমুচে । অস্থির করে তুলবেনা , অস্বস্তি জাগাবেনা
। কিছুটা নির্বিবাদী গোত্রের। স্বর খুব মৃদু,তাই বলার কথাগুলি নিচু উচ্চারনে
চিৎকৃত পৃথিবীর ভারে চাপা পড়তে পড়তে কানে কানে ফিসফিসিয়ে যায় ।
**বেগুনি মলাটের
হাত-বন্ধু বইটি সুন্দর ছাপা ,ভালো কাগজে । মনোরম প্রচ্ছদ –রোহন কুদ্দুসের করা । সব
মিলিয়ে অন্য মাত্রার আত্মমগ্ন কবিতার এক অনন্য সংগ্রহ ।
-
ইন্দ্রনীল বক্সী
বইয়ের নাম - টার্নিং পয়েন্ট (
কবিতা সংকলন)
লেখক – লিপিকা ঘোষ
প্রকাশক – সৃষ্টিসুখ
মূল্য – ৫০ টাকা
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন