উমাপদ,
সমস্ত আবেগ মুছে ফেলার পর অবশেষে তোমার কবিতার বই ‘ধনুক কথায় স্বর’ খুলে পড়তে গিয়ে অবশ হয়ে যাই। টানা দুদিন বইটা খোলা ছিল আমার টেবিলে। আমি রোজ কবিতা পড়ি, কবিতা ভাবি, সারাক্ষণ কবিতার জগতে বিচরণ করি। বাংলার কবি ও সম্পাদকদের ধন্যবাদ, তারা সবাই বইপত্র পাঠিয়ে আমাকে এই অক্সিজেন দিয়ে থাকেন। পাঠ ও বিচারের অভিজ্ঞতা আমার তো কম হল না। কিন্তু কদাচিৎ কারো কবিতার বই পড়ে এরকম থম হয়েছি। অদ্ভুত একটা ধীর সংক্রমণ (ট্রাঞ্জিশণ) ঘটতে দেখছি তোমার কবিতায়। তুমি কি তা পাচ্ছো টের? আগে তোমার কবিতায় বাস্তব রেফার করত বাস্তবকে, অর্থাৎ সাবজেক্ট সাবজেক্ট কে, বস্তু বস্তুকে ডাইরেক্টলি রেফার করত তোমার অনেক কথা বলার চারপাশে। এখন অবজেক্ট অবজেক্টকে, বস্তুগুন রেফার করছে আর এক বস্তুগুনকে। ধাপে ধাপে এটাই অতিচেতনার যাত্রা, যখন চেতনাকে কেন্দ্রহীন করে মন্ডলাকারে ছড়িয়ে পড়তে দেয়া হয়, অভিজ্ঞতা হয় ধ্বনিসঞ্চারের মধ্য দিয়ে নতুন বস্তুগুনের, লেখা হতে পারে ‘ধনুক কথায় স্বর’এর মতো কাব্যগ্রন্থ। কী যে অসাধারণ একটা কাব্যগ্রন্থ পড়লাম আমি, আহা!
‘শেষ পর্যন্ত কল্পনাই রেফার করল কল্পনাকে’—এই উপলব্ধি, ‘কত রোদ পড়ল ছায়াপথে’—এই কাটাকুটি খেলা, ‘কাঠের পাখি শিস মাটির সন্দেহ পাথর’—এই অতিচেতনার ট্রেকিং, ‘মনের ভেতর মানুষ আগুন পোহাক’—এই প্রার্থনা, ‘বেনীয়াসহকলা’ দিয়ে ‘ভালোবাসার ককটেল’ সেবন করে নিশ্চিন্তে বলা যায়—‘কোথাও একটু কবিতা লেগে থাকুক’। ‘কবিতার সঙ্গে এসবের যোগ নিয়ে একটা নিবন্ধ কয়েক পৃষ্ঠা’ লিখতে চাইনি বলেই এভাবে শুরু করলাম। সাধারণ পঠন অভ্যাসে শব্দার্থের নিগড়ে সচেতনতা আমাদের বেঁধে রাখে। কিন্তু অতিচেতনায় সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনি থেকে উৎসারিত গুঞ্জন রণন অপার অর্থময় জগতের সম্ভাবনা মেলে ধরে। তুমি এখন সেই খেলার মধ্যে আছো যেখানে তোমার মধ্যে বিবিধ তুমি ছবি আঁকো, রং গোলো, জলে ধোও, সাদা কাগজে কলম নাচাও, ক্ষণে ক্ষণে অরূপের মধ্য থেকে নানা রূপের কয়েক ফোটা উপভোগ করতে থাকো। তোমার বাধ্যতামূলক বালুরঘাট থাকাটা শাপে বর হয়েছে। সারাদিন নানা জৈবিক কাজের মধ্যে এবং অবসরে তোমার আত্মসমীক্ষার, কবিতা নিয়ে চিন্তাভাবনার সুযোগ হয়েছে। আমি খুশি হয়েছি কবিতার ক্রমবিবর্ধনের পন্থা ত্যাগ করে গড্ডলস্রোতে গা ভাসাওনি বলে। চালিয়ে যাও উমাপদ, যতদিন উপভোগ কর এই জার্নি। এই বইয়ে আমার সবচেয়ে ভালো লাগা কবিতাগুলো হল—মনে হওয়া, ম, ফাঁকার চারপাশে, কাঠের পাখি মাটির সন্দেহ, আতস, দু-পা দু-দিকে, কবিতার পরও, বর্ণহীনের সংসার, পানপরাগ, দ্বিতীয় এপিটাফ, বেনীয়াসহকলা, ঠোঁটে রঙ বসন্তদিনের স্প্রে, সবুজ উট, রঙের উপরে মিথুন, ধ্বনিচিত্র, বানে ভাসা খরা, ছায়াপথের ছায়ায়, গুলবদন, শীতের মানুষ, কদমচোখ—ইত্যাদি। মনে হচ্ছিল এগুলো আমারই লেখা, উমা কী করে পেয়ে গেল! ইচ্ছে হচ্ছে তোমার কাছে বসে তোমার মুখে কবিতাগুলো বারে বারে শুনি। এর চেয়ে বেশি আমি আর কিছু বলতে পারছি না।
ভালো থেকো। বারীনদা।
কবিতার বইঃ ধনুক কথায় স্বর
কবিঃ উমাপদ কর
পাঠপ্রতিক্রিয়াঃ বারীন ঘোষাল
প্রকাশকঃ ৯য়া দশক
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন