সঙ্ঘমিত্রা হালদার
সঙ্ঘমিত্রা হালদার
জন্মঃ ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৪।
বইপত্রঃ নামানো রুকস্যাক (পত্রলেখা,২০১০), দীর্ঘ-ঈ (পাঠক
প্রকাশনী,২০১৪)
যোগাযোগঃ ৯৪৭৪০৫৬৪৭৮
আমার হাত ছাড়িয়ে
হেঁটে যাচ্ছে আমার মতো কেউ
আমার হাত ছাড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে আমার মতো কেউ
হুবহু আমাদের জুতো ও
মাপ
তবু একার মতো একা হয়ে বেরিয়ে পড়া যাবে না কোনদিন
হাত রাখা যাবে না মাথায়
দৃশ্যে বোঝানো
যাবে না সে শেষের গাছ
আড়ালে আমাদের অভাব থাকবে এমনকি ফলনের মাঠে
বিগত এক বছরে গোটা তিনেক কবিতা ভাবনা বা লেখা ভাবনা লেখার
পর আবারও আরও একটা ‘লেখা-ভাবনা ভাবনা-লেখা’র প্রস্তাব অনেকটা দিশেহারা করে দেয়।
সত্যিই কি এত নতুন—না বলা কথা জমেছে আমার মধ্যে যা বলতে পারি এখানে? প্রথম ধাক্কাটা
সামলে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম লেখা, যে বিশ্বাস, সেই বিশ্বাস বদলানোর, বাড়ি
বদলানোর লেখা তো আমার মধ্যে অনবরত ভাঙচুর চালাচ্ছে। অতএব ঝাঁপ ফেলাই যাক। আলাদা
করে ‘ভাবনা-লেখা’টা মাথার মধ্যে সেঁটে রইল।
আজকাল হুলুস্থুল ছোট করে ছাঁটা চুলের যে মানুষটি
সাদা পাতা বা স্ক্রিনের সামনে বসে, তাকে আমি পেছন থেকে দেখতে পাই। কিন্তু তার
ভাবনা কতটা আমার, বা সে ভাবনায় কতটা অধিকার আমার— ভেবে মাঝেমধ্যে আতান্তরে পড়ে
যাই। কেননা যে লেখাটা আমার ভেবে লিখতে বসা, লিখে উঠে আসার পর লেখাটা অনেকখানিই
পালটে যায়। হয়ত বা শুধু লেখা নয়, একটা লেখার পর মানুষও কিছুটা পালটায়।
কিছুদিন আগে ইডেনে সরকারি
টাকার মোচ্ছব হয়ে গেল। অথচ আয়লায় বাড়িহারা সর্বহারাদের
বেঁচে থাকবার সামান্যতম অধিকারটুকু সুরক্ষিত করা গেল না আজও! ভাবলাম
অন্তত লেখার কাছে অসহায়তাটুকু ধরা যাক। কয়েকদিন বাদে একটা লাইন উঠে এল—যখন
কীর্তনের এ সুর মনে নেওয়াই একধরনের বিদ্রোহ... অথচ আমি তো লেখার কাছে এ অবস্থার
প্রেক্ষিতে একটা নিস্ক্রমণ চেয়েছিলাম। এই প্রেক্ষিতে একজন সুবিধাভোগী মানুষের
অপরাধবোধের ক্ষরণ চেয়েছিলাম। লেখাটায়। তাহলে? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—প্রকাশই সাহিত্য।
কিন্তু আমি তো কোনদিন ‘রূপমকে একটা চাকরি দিন...’ লিখতে পারব না। তাহলে আমি কি একজন ব্যর্থ লেখক?
এই ‘তাহলে’ আসলে কেবল ইগোর সম্পূর্ণ প্রকাশ নয়। ভাবনার কাঁটা। অস্বস্তিতে রাখা
অনুসন্ধানের কাঁটা। কাঁটায় কাঁটা বাড়ে। ভাবনায় ভাব(না)। ঘুরে ফিরে নিজের কাছে আসি।
দেখি, লিখতে বসা মানুষটা পাখির ডানা মুড়ে বসছে।
ভাবি এসময়
‘পাখি’ ভাবতে পারাটাই তো বিদ্রোহ! আর যে গানের কথা লিখলাম সেই গানও তো এই সময়টার
বিরুদ্ধে আরও খানিকটা দারুণ বেঁচে নেওয়ারই বিদ্রোহ! অবস্থা আর ইচ্ছের
ফারাকটাকে—ধাঁধাটাকে চোখে অঙুল চালিয়ে দেখা। দেখে নেওয়া। বর্তমান সময়ে যখন বাংলা
ভাষাটাই ঠিক করে না জেনে বা ভুল জেনে বা ইচ্ছাকৃতভাবে খানিকটা অন্যরকম দেখাবার
চেষ্টায় নিজের মাতৃভাষার ব্যবহার সচেতনভাবে কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বা জোর করে বিকৃত
করা হচ্ছে। এবং তার ভুল (বাংলা) ব্যবহারের জন্য বিন্দু পরিমান অপরাধ নেই চেতনায়।
তার আকাশে কোথাও সচেতনতার আবছা ধোঁয়াটুকুও দেখা যাচ্ছে না। বরং বাংলা ভাষাটা
ভালোভাবে না জানার জন্য বা ব্যবহার না করার জন্য প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ রয়েছে, তখন বাঙালি তার আত্মমর্যাদাকে কেবল ধর্ষণ করছে—তা তো নয়, তার ভাবনার কুঠুরিটাকেই আসলে বিলুপ্ত করে ফেলছে। ফলে বাংলা
ভাষাতে লেখা বা ভাবতে পারাটাও একধনের অহংকার। কিংবা টাকাই যখন একমাত্র স্থির(ধার্য) মূল্যাঙ্ক।
তখন নিজেদের তাগিদে পত্রিকা করা গান লেখা না- নেভা আগুনের বিদ্রোহ। তেমনি শক
থেরাপিস্টের হাতে ঘুরতে দেখা গান থেরাপি—একধরনের ভাবনার বিদ্রোহ।
আর এ সবই হল ভাবনার
বিশ্বাস। বিশ্বাসের ভাবনা। বিশ্বাস ভাঙলে ভাবনা পালটায়। লেখা বদলে বদলে যায়। রোগা,
পুরু, মেদহীন এক একটা চরিত্র গড়ে নেয় তারা। সমতলের বঙ্গীয় প্রদেশে দেখা যায় না যে
কাঠের বাড়ি তার জন্য শিকারে বেরোয় মন—এ যেমন একপ্রকারের ভাবনা, তেমনি আমার লেখারও
একটা চরিত্র সে। বন্ধু’কে যেমন পুরোটা আবিষ্কারের রাস্তায় কখনো হাঁটি না—তেমনি
পুরোটা আবিষ্কার হয়ে আছে, অর্থাৎ যে লেখায় আমার অংশগ্রহনের সুযোগ নেই, এক ভাবনা
থেকে পিছলে আরেক ভাবনায় পিছলে যাওয়ার অনিশ্চিত আঁকিবুকি নেই, এমন লেখা নিজের একদম
কাছটায় টানতে পারি না কখনোই। তা সে নিজের হোক বা অন্যের লেখা। বরং জানতে জানতে
নিজেকে আবিষ্কার করতে করতে এগোই আমার লেখার কাছে। বোঝা আর না-বোঝার নো-ম্যানস্-ল্যান্ডটার
কাছে ঘুরঘুর করতে করতে এগোই আমি। নতুন পথের অপাচ্য হাড়গোড়, এমনকি কাঁটা, তার রসায়ন
লক্ষ করে এগোই আমি আমা বরাবর। তুমি বরাবর। আমি থেকে তুমি’র যেটুকু নো-ম্যানস্-ল্যান্ড-এর
শিহরণ, ভাঙতে ভাঙতে এগোই।
আমি থেকে তুমির
গন্তব্য পালটায়। পালটায় আমার বিশ্বাসের চরিত্রও। আমার বিশ্বাস ফুরিয়ে আসে। আমি
জেগে থাকি তখনো। তার মাথার কাছে। পুরনোরা ফেরে না কখনো। তার ভুল আর ভগ্নাংশ থেকে
নতুন গজানো পাতার অল্প নড়ে ওঠা দেখতে পাই আমি। তো এইভাবেই আমার প্রথম বইয়ের অধিকাংশ
লেখাই আমার কাছে একপ্রকার বাতিল হতে থাকে মনে মনে। কেউ সেখান থেকে কোনো লেখার কথা
বললে আমি আমার পুরনো লেখা থেকে বরং পরিমার্জিত অবয়বকে— একটা নতুন লেখার বিশ্বাসকে
খুঁজে পাই। অনেক সময় নতুন লেখাটার দিকে তাকিয়ে দেখি—“আমার হাত ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে
আমার মতো কেউ/ হুবহু আমাদের জুতো ও মাপ”... অর্থাৎ লেখা তার বিশ্বাস নিয়ে যতটা
দ্রুত পালটে যায়, বাইরে, আমি হয়ত ততটা না। আমি পেছন থেকে দেখি ঝাঁকড়া মাথায় হুলুস্থূলু
করে লিখতে বসেছে কেউ। আমার মতো কেউ। কখনো তার পাশে বা সামনে গিয়ে দাঁড়ানো হয় না।
তার আগেই প্রতিবিম্ব কেটে যায়। সে প্রথম লাইনটা সবসময় কোথায় থেকে পায় আমি বুঝে
উঠতে পারি না। এক কবি তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন—প্রথম লাইনটা আসে স্বর্গ থেকে।
তাই কী! আমার দেওয়ালে তো কোনো ঈশ্বর বা শয়তানের বিশ্বাস নেই। তাহলে? এই ‘তাহলে’
আসলে কবিতার – আমার ভাবনার সূত্রধর— জানা না-জানায় ‘দেখা না-দেখায় মেশা হে’।
রবীন্দ্রনাথ কত সহজে এই অনিশ্চিত জায়গাটা ধরতে পেরেছিলেন!
এই অনিশ্চিতকে একেকজন শিল্পী এক এক
রকমে ধরতে চেষ্টা করেন। একজন সঙ্গীত স্রষ্টা সুর দিয়ে, একজন চিত্রকর রেখা আর তুলির
আঁচড়ে। ও আরো এরকম বহু আয়াস ও সাধ্য-সাধনায়। একজন কবি তাঁর পরিধির শব্দ-ভান্ডার
দিয়েই পৌঁছতে চাইবেন এই অনিশ্চয়তার কাছে। এমনকি তাঁর চেনা পরিধির বাইরে যেতে
চাওয়াটাও পুনরায় তাঁরই নিজস্ব পরিধি। ফলে চাঁদ যেভাবে আকর্ষণে আকর্ষণে জলকে সারা
করে তোলে। তার সাড়া না দিয়ে উপায় থাকে না। আকর্ষণের মুঠো একসময় আলগা হবে জেনেও। শব্দের
সঙ্গে কবিতার অনিশ্চিত জায়গাটার সম্পর্কও এই টানাপোড়েন আর আকর্ষণের। মুঠো আলগা হবে
জেনেও। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য শব্দগুলো দিয়ে অচেনা জায়গাটায় আর কতদূর কাঁহাতক ঢুঁ মারা
যায়। কেননা টানাপোড়েনেরও একটা দম আছে। আছে বিনীত অপেক্ষা। তাই ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে
একটা রফা হওয়া দরকার। সবার আগে ক্লাইম্যাক্স বিন্দুটিকে চিহ্নিত করা দরকার। আমার
কাছে এটাই শিল্পীর ভারসাম্য। আর এই মধ্যকালীন সময়টিতে অনেকসময়ই দেখি ভেতর থেকে
ভেঙে পড়ছে বাক্যের সিনট্যাক্স, তার দৈনন্দিন ব্যবহার। এই জার্নিটুকু পাহাড়ে চড়ার
মতোই ক্লান্তিকর আর পরিশ্রমের আর উত্তেজনার। এরকম লেখায় দু-তিনদিন বা কখনো
মাসাধিককাল পর, চাপা রাখা কবিতার হুঁশ, তার নড়ে ওঠা টের পাই। এতটাই ক্লান্ত সে তখন,
অথবা আমি, তার হয়ে ওঠা বুঝতে ঢের সময় লেগে যায়।
আসলে নিজেকে
খুঁড়তে খুঁড়তে শেষ অব্দি দম ধরে রাখার প্রকৌশলই আমার কাছে বড় কথা। আর এই কৌশলে
নিজের মতো করে লেখার একটা হাত-ধরাধরি সম্পর্ক আছে। শব্দ ব্যবহারে কতটা নতুন হলাম,
সেটা বড় কথা নয়, আমি যা করতে চাইছিলাম, বলতে চাইছিলাম সেটা কতটা নিজের মতো করে বলতে
পারলাম সেটাই আমার কাছে বিবেচ্য। প্রায় তিনশ বছর অতিক্রম করে লালনের গানের কথাগুলো
যে আজও কত নতুন আর প্রাসঙ্গিক রয়ে গেল, সে বিস্ময় গেল না আমার আজও।
মনে পড়ে যাচ্ছে
হুয়ান র্যামোন হিমেনেথের বিখ্যাত কবিতাটা। যেখানে সব অলংকার আর আভরণ খসিয়ে
ফেলাটাই কবিতার সাধনা। ঠিক-ভুল জানি না। এই বিশ্বাস বরাবর হাঁটছি। ট্র্যাক চেঞ্জ
হতেই পারে। তবে হয়ত পুরনো বিশ্বাসের কাছে ফিরব না। বরং পুরনো-নতুনে একটা বোঝাপড়া
করে নেব প্রয়োজনে।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
বেশ বেশ ভাল।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ
মুছুন