স্যার আপনার কাছে পড়বো
অংশুমান
যে
বইটা নিয়ে বলছি এখন, আসলে সেটা পড়ার পর আমার কিছু বলার ছিলো না। শুধু কিছু কাছের লোকজনকে পড়ে শুনিয়েছিলাম। বেশ কয়েকজনকেই। তাদেরও কিছু বলার ছিলো না প্রায়। আসলে জীবনের এত কাছাকাছি কিছু জিনিস যার মধ্যে অবিরাম আছি, সেগুলো হঠাৎ চোখের সামনে চলে এলে যা হয়। মানে ধরুন আপনি চুল আঁচড়ে জামা-প্যান্ট
পরে দুটো খেয়ে বাইক স্টার্ট করে কাজে বেরিয়ে গেলেন এই পুরো ব্যাপারটা আমাদের মনে ঘোরে না কারণ অন্য কোনো উদ্দেশ্য আমাদের মাথাকে কান ধরে টেনে রেখেছে। আমি এগুলোর মধ্যে দিয়ে আমি হয়ে উঠছি রোজ। স্নানকরা, খেতে বসা রাত্রা শুতে সব কিছুরই আমাদের নিজের ঢঙ আছে, আছে প্রতিটি পদক্ষেপের অমোঘ প্রয়োজনীয়তা। এইসব যখন কবিতা হয়ে উঠবে তখন চোয়ালটা সামান্য ঝুলে যাবে সে আর নতুন কি। আপনাকে নিজের ভেতরদিকে তাকিয়ে দেখতে, নিজের জারণ-যাপনকে পরতে পরতে খুলে দেখতে বাধ্য করাবে। বাসে বসে যখন বলি, "দাদা, একটা সাতটাকা", কন্ডাক্টর
টিকেট দিয়ে চলে যান। এই প্রত্যেকটা মুহূর্তকে ভেবে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে যাওয়ার মধ্যে যে কতটা কবিতা লুকিয়ে আছে সেইটাই বের করে এনেছেন সঞ্জয় ঋষি তার "মেঘেদের টিউটর” বইটাতে।
এই
বইটা কেনার আগে আমি কবিকে চিনতাম না। না শুনিনি কোনোদিন। একটা চটি বই, ১৫টাকা দাম। লিটল ম্যাগের কোনো একটা স্টল থেকে দেখতে দেখতে কটা লাইন পড়ে কিনে ফেললাম, লাইনগুলো
এরকম,
গতবার তন্বী বাংলায় মরিয়ামের থেকে
পাঁচ নম্বর কম পেয়েছিল বলে
এ বছর আর পড়তে আসেনি
শুধু কেঁদেছিল মার্কশিট হাতে
পড়ার
পর আবার পড়লাম। আবার পড়লাম এই কটা লাইন। কিছুই নেই মনে হচ্ছে অথচ তন্বী, মরিয়াম আমার চোখের সামনে চলে আসছে হুহু করে। তন্বীর জন্য মনখারাপ হচ্ছে ওইখানে দাঁড়িয়েই। একজন টিউটর-এর কাছে কত ছাত্রছাত্রী পড়তে আসে, প্রত্যেক
বছর, হয়তো, পরের বছর চলেও যায়। টিউটর এদের কমতি, দুর্বলতা,
দোষ-গুন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারেন। টিউটর ভালোবেসে ফেলেন তাদের। ভালোবাসা না থাকলে তো সঠিক শিক্ষা দেওয়াও মুশকিল। এভাবেই নতুন একজন পড়তে আসে হয়তো ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে, এসে ভয়ে-বিনয়ে-অনুগ্রহ প্রার্থী হয়ে বলে, "স্যার আপনার কাছে পড়বো..."
ভাগ্নেকে দিয়ে লিফলেট ছড়িয়ে দিয়েছি পথে পথে
লিফলেট কুড়িয়ে নিয়ে যায় কচি হৃদয়
'প্রস্তুতি' নামক
বিজ্ঞাপণ হাতে
আমাকে খুঁজতে এসেছে ষাণ্মাসিক পরীক্ষা
দেওয়া সেই ছাত্রটি--
যে কোনদিন কোনো মাষ্টারের কাছে পড়েনি
আকাশে মেঘ করেছে
বারান্দার বাইরে বৃষ্টি...
এই
কবিতার শেষে আমিও দাঁড়িয়ে থাকি ঐ ষাণ্মাসিক পরীক্ষা দেওয়া ছাত্রের পাশে। বাইরে বৃষ্টির শব্দ পাই। আমি দেখতে পাই একজন বেকার যুবক যিনি যা স্কুল-কলেজে শিখেছেন তাই ভালোবেসে বিক্রি করে দিন যাপন করছেন। যার টিউশনের লিফলেট বিলি করে দেয় ভাগ্নে। যার কাছে কেউ পড়তে এলে তার সংস্থানের পক্ষে সুখকর। আমিও অপেক্ষায় থাকি উত্তরের, স্যার কি পড়তে নেবেন। জানি নেবেন, কারণ, শুধু রোজগার নয়, ছাত্রদেরকে
সাহায্য করাটাও টিউটরের কাজ। ছাত্রের জন্য চিন্তা হয় বইকি, ছাত্রীর
জন্য তো বটেই...
যে ভাবে তন্বী চলে গেলো
সে ভাবে আর কখনো ফিরে আসবে?
আসুক নাই বা আসুক
সে প্রকৃত মানুষ হোক এটাই চাইবো
মরিয়াম আজ তন্বীর কথা বললো
কোন শিক্ষক ওর ভালো লাগেনা
কেন আমি মরিয়ামকে বলতে পারলাম না
ওকে আমার কাছে আসতে বলো
কিংবা তোমার নোট খাতাটা
খাতা-কলম-বই
প্রতিদিন মেলে রেখে
চোখ বন্ধ করে থাকি পঁচিশ মিনিট
ছাত্রীর
জন্য চিন্তা হয়-এ জোর দেওয়ার কারণ এই তন্বী। এই তন্বী-কে নিয়ে টিউটর বেশ চিন্তিত। তবে কি শুধু তন্বী-ই টিউটরের মেঘ? না না তা হতে পারেনা। ধোঁয়া ধোঁয়া আবেগ... এই খানেই তো হারিয়ে যাওয়ার জায়গা। তন্বীর অভিমান খুবই মেঘের মতো, আকাশে খেলা করে বেড়ায়, কখনো বৃষ্টি হয়ে ঝরে। পঁচিশ মিনিট টিউটরের হিসেব। আমি তো পঁচিশ দিন...
আমি জানি আমাদের পাড়ায়
স্টুডেন্টের তুলনায় টিচার বেশি
তাই আমি অন্য পাড়ায় যাই
টিনের বারান্দা থেকে ইঁটের ঘরে
লাইট-পাখা, দু'কাপ
চা-বিস্কুট
সংসারের কথাবার্তাও জেনে যাই অনেক
অনিমেষকাকুর ছোট মেয়ে নাইনে পড়ে
সপ্তাহে দু'দিন যাই, বাংলা পড়াই
মাসে পাঁচশো টাকা দেয়
উফ্ফ্! গ্রাম মফস্বলের এই জীবন আর কী ভাবে কাছে আনা যায়। টিনের বারান্দা থেকে ইঁটের ঘরের খসখস স্নায়ু কাঁপিয়ে দেয়। নাইনের একটা মেয়ে কে পড়িয়ে পাঁচশো টাকা পাওয়া এই তো যাত্রা। এই তো দেখতে দেখতে যাওয়া। লড়ে নেওয়া নিজের জন্য। সম্ভাবনা আর সম্ভাবনা...
সঞ্জয়ের
লেখার স্টাইল সহজিয়া। খুব সোজা সাপটা কথার মধ্যে কীকরে গভীর দর্শন ঠেসে রাখতে হয়। কোথায় আবেগ কে লুকিয়ে রাখলে উলঙ্গ হবার সম্ভাবনা কম, কোথায় গরীব-বড়লোক-বেকারত্ব-প্রলেতারীয়
অবস্থা-টিনের চাল-অল্প মাইনে-ছাত্র-ছাত্রীর পাশ-ফেল-অভিমান-ছেড়ে যাওয়া-লড়াই এর মধ্যে অন্য জীবনের প্রতিফলন আবার নিজের দুঃখ-ভালোবাসা-বোধের বিচ্ছুরণ খুবই স্পষ্ট করে তোলায় খুবই পারদর্শী। মেঘেরা এক এক করে চলে গেলে টিউটর একা বসে থাকেন... আমিও তাই থাকি...
তিন দিন ধরে মুষল ধারায় বৃষ্টি
প্রদীপদের পড়াতে যাওয়া হয়নি
বাড়িতেও দু-একজন ছাড়া কচি কচি মুখগুলো আসেনি
এসব নিষ্পাপ মুখগুলো যখন বারান্দা থেকে চলে যায়
তখন নিশব্দে পড়ে থাকে ধুলো
বই:
মেঘেদের টিউটর
সঞ্জয়
ঋষি
দাম: ১৫টাকা
প্রকাশক: সুতরাং
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন