........
হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় .......
(১৮৩৮-১৯০৩)
(কাব্যগ্রন্থ – ‘চিন্তাতরঙ্গিনী
’,’বীরবাহু কাব্য’,
‘বৃত্রসংহার’,’আশা-কানন’,
‘ছায়াময়ী’, ‘চিত্তবিকাশ’, ‘দশমহাবিদ্যা’)
বাংলা কবিতার ইতিহাস
অনুসরণ করলেই দেখা যাবে ইওরোপিয় শিল্প সাহিত্যের বদলই বাংলা কবিতার প্রথাসিদ্ধ চিন্তাকে অস্বীকার করার প্রাথমিক
কারণ। উনিশ শতকে বাংলাদেশে এল রেঁনেসাঁসের পরোক্ষ প্রভাব। এতদিনকার ধর্ম ও নীতি
সম্বলিত ধর্মধ্বজী কবিতাতেও পড়ল তার বিচ্ছিন্ন প্রভাব। রেনেসাঁসের স্বরূপ বিশ্লেশণ
করতে গিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছিলেন- “ রেনেসাঁস এসেছিল মানুষকে সর্ব দেশে
সর্বপ্রকারে মুক্ত করতে। শাস্ত্রের হাত থেকে, দেবতার হাত থেকে, গুরুর হাত থেকে,
পুরোহিতের হাত থেকে, রাজার হাত থেকে, সামন্তের হাত থেকে। কুসংস্কারের হাত থেকে,
কুপ্রথার হাত থেকে, অধীনতার হাত থেকে, অসাম্যের হাত থেকে। একদিনে বা এক শতাব্দীতে
নয়। ধাপে ধাপে। সা বিদ্যা যা বিমুক্তেও।
সেই হচ্ছে বিদ্যা যা মুক্তি দেয় । “- এই রেঁনেসা তরঙ্গেই উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলার
মুগ্ধ মিতলেখ কবিমন। সিপাহী বিদ্রোহ নীল বিদ্রোহ বা সাঁওতাল বিদ্রোহের মত ঘটনা
যেখানে মধূসূদনকে নাড়া দিল, পরাধীনতার
পোলারিটিগুলো ভাঙতে মেঘনাদবধ লিখিয়ে নিল মহাকবি প্রত্যাশী এক কবিকে দিয়ে । সেখানে
রামের বদলে রাবন হয়ে উঠল কবির অন্তরের কাম্য অর্থাৎ দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে
আসার মানসিকতাতেই নতুনভাবে বিশ্লেষিত হল হিন্দুপুরান। কেবল মধুকবিই নয়, পাশাপাশি
রঙ্গলাল ,নবীনচন্দ্র আর হেমচন্দ্রের ভাষ্যতেও উঠে এল যুগের ভাষা। পদ্মিনী
উপাখ্যানে রঙ্গলাল যেখানে লিখলেন “ স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে / কে
বাঁচিতে চায়” সেখানেই “ভারত বিলাপে” হেমচন্দ্রের করুন রসে চিত্রিত হল স্বাধীনতার
অমোঘ আর্তি। “বৃত্রসংহার”এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন হেমচন্দ্র হিন্দুপুরাণে মিশিয়ে দিলেন জাতীয় ভাবের
উন্মাদনা , সনাতনী মানসিকতা থেকে কবিতায় আমদানী করলেন চেতনার মুক্তি তেমনি “ভারত বিলাপে” উচ্চারিত হল স্বাদেশিক উত্তেজনা;
বিদেশী কাঁটার আঁচড়ে জর্জরিত সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর কবিতায় অভিবন্দিত হল স্বদেশ প্রেম-
“ কী হবে বিলাপ করিলে এখন,/স্বাধীনতা-ধন গিয়াছে যখন,/মনের মাহাত্ম্য হয়েছে
নিধন/তখনি সে সাধ গিয়াছে ঘুচে।/ সাজে না এখন অভিলাষ করা/ আমাদের কাজ শুধু পায়ে
ধরা,/ মস্তকে ধরিয়া দাসত্বের ভরা/ছুটিতে হইবে ওদেরি পাছে।/ হায়, বসুন্ধরা, তোমার
কপালে,/এই কি ছিল মা, পড়ে কালে-কালে/বিদেশির পদে জীবন গোঁয়ালে/ পুরতে নারিলে মনের
আশা।“-সঠিক অর্থে হেমচন্দ্রকে “স্বদেশ প্রেমিক স্বদেশ প্রিয় স্বদেশ ভক্ত
স্বদেশের হিতব্রতে অকপটভাবে অনুরক্ত” কবি হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়।
হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের
জন্ম হুগলী জেলার গুলিটা রাজবল্লভহাটে ১২৪৫ সালে অর্থাৎ ইংরেজী ১৮৩৮ সালে। দরিদ্রের
সন্তান ছিলেন হেমচন্দ্র অথচ তাঁর স্বীয় অধ্যবসায় ও পরিশ্রম তাকে সমাজে ও
সাহিত্যক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। ধীরে ধীরে ভাব সৌন্দর্য্য স্বদেশানুরাগিতার
পূর্ণ বিকাশে হেমচন্দ্র হয়ে উঠেছেন মহাকবি হেমচন্দ্র। তাঁর ‘বীরবাহু”, ‘বৃত্রসংহার’, ‘চিন্তা-তরঙ্গিনী’ বা ‘ভারত
সঙ্গীতে আন্তরিক ও অকৃত্রিম স্বদেশপ্রিয়তাই উচ্ছ্বসিত হয়েছে। তবে হেমচন্দ্রের
বেশীরভাগ দেশভক্তির কবিতায় বীররস অপেক্ষা করুণ রসের আধিক্য; দেশমাতৃকার প্রীতিতে
ক্রন্দন্দের নতুন রাগিনী যোগ করেছিলেন হেমচন্দ্র। মধুসূদনের লেখনীর প্রতি
বিশেষভাবে আকৃষ্ট ছিলেন তিনি। ‘মেঘনাদবধ” এর বিস্তৃত টিকা ও ভূমিকা লিখতে
অনুরোধ করেন স্বয়ং মধুসূদন এবং হেমচন্দ্র লিখেও দেন। মধুসূদনের ‘মিতাক্ষর’ ছন্দের
অনুরক্ত ভক্ত ছিলেন হেমচন্দ্র যার বহুল ব্যবহার পরবর্তীকালে তাঁর “বৃত্রসংহার” বা অন্যান্য কাব্যে আমরা লক্ষ্য
করতে পারি।হেমচন্দ্র মধুসূদনের বীরকাব্য মেঘনাদবধ বুঝেছিলেন আর তারই নতুন
প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর “বৃত্রসংহারে”। “বৃত্রসংহার”ই
হেমচন্দ্রকে মহাকবির আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। এর পটভূমিকা মহাভারতের অন্তর্গত বনপর্বে
বিবৃত ইন্দ্র কর্তৃক বৃত্রবধের উপাখ্যানের উপর প্রতিষ্ঠিত। মহাভারতের কাহিনির
অবিকল অনুসরন না করে নিজ কল্পনাবলে একাদশ সর্গের অভূতপূর্ব রচনা “বৃত্রসংহার”। মধুসূদনের
কাব্যভাবনায় এতটাই আত্মস্থ হয়েছিলেন হেমচন্দ্র যে তৎকালীন আলোচকদের অনেকেই তাকে
মধুসূদনের গোড়া বা মধুসূদনের ভক্ত বলেও উল্লেখ করেছেন। তবে পাশাপাশি মধুকবির
ভাষাকে, আঙ্গিকরীতিকে বাংলা কবিতার উত্তরসূরীতায় যে উৎসাহ তিনি দেখিয়েছিলেন তার
ভূয়সী প্রশংসাও হয়েছিল। ১২৮০ সালে মধুসূদনের মৃত্যু হলে বঙ্কিমবাবু বঙ্গদর্শনে
লিখলেন- “ কিন্তু বঙ্গকবি সিংহাসন শূণ্য হয়
নাই। এ দুঃখ-সাগরে সেইটিই বাঙ্গালীর সৌভাগ্য-নক্ষত্র। মধুসূদনের ভেরী নীরব হইয়াছে,
কিন্তু হেমচন্দ্রের বীণা অক্ষয় হউক! বঙ্গকবির সিংহাসনে যিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি
অনন্তধামে যাত্রা করিয়াছেন- কিন্তু হেমচন্দ্র থাকিতে বঙ্গমাতার ক্রোড় সুকবিশূন্য
বলিয়া আমরা কখন রোদন করিব না।“ –মধুসূদনের মৃত্যুতে হেমচন্দ্র লেখেন- “ হায় মা
ভারতি, চিরদিন তোর/ কেন এ কুখ্যাতি ভবে?/ যে জন সেবিবে ও পদ-যুগল/ সেই যে দরিদ্র
হবে।“-শেক্সপীয়ারের অনুরক্ত ভক্ত ছিলেন হেমচন্দ্র। শেক্সপীয়ারের ‘টেম্পেস্ট’ নামক
নাটকের অনুবাদেই ১৮৬৮ এর সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয় তাঁর “নলিনী-বসন্ত” । কবি
বিহারিলালের অনুরোধে তাঁর ‘অবোধ বন্ধু’ তে
ড্রাইডেনের “Alexander’s Feast” নামক
বিখ্যাত কবিতার অনুকরনে হেমচন্দ্র লেখেন “ইন্দ্রের
সুধাপান” যা হেমচন্দ্রের সর্বোৎকৃষ্ট
রচনাসমূহের অন্যতম। ১৮৮২ সালের শেষভাগে হেমচন্দ্র রচনা করেন “
দশমহাবিদ্যা” যা ভাবের মাধুর্যে বাংলা কাব্যসাহিত্যে নতুন রাগ রাগিনীর প্রতিচ্ছবি প্রতিভাস
করে।
স্বদেশপ্রেমিক মহাকবি
হেমচন্দ্র, যার স্থান হয়ত আধুনিক কবিতার প্রেক্ষিতে শূন্য, ব্রাত্য; কিন্তু সেই
ওজস্বী পুরুষোচিত কন্ঠ , ভাষাও ছন্দে তাঁর সাবলীলতা কি আজও বাংলা কবিতার ঐশ্বর্য্য প্রদর্শন করেনা?
আজও কি বাংলা কবিতার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা উঠলে প্রাগধ্বনি হয়ে বেজে ওঠেনা কি সেই
শাশ্বত প্ংক্তি- “ গাও হে তবে সে গীত/ শুনায়ে কর জীবিত/ নিঃস্রোত বঙ্গের হৃদি
স্রোতেতে ডুবাও/রহস্য, রোদন,কিংবা উৎসাহে ভাসাও- “ ...
ভারতে কালের ভেরী
[১৮২০ সালের দুর্ভিক্ষ উপলক্ষে]
(১)
ভারতে কালের ভেরী বাজিল আবার
!-
ওই শুন ঘোর ঘন ভীম নাদ তার
!
ছুটিছে তুমুল রঙ্গে, আকুল অধীর বঙ্গে,
উঠিছে পূরিয়া দিক প্রাণী
হাহাকার!
বাজিল অকাল-ভেরী বাজিল
আবার !
(২)
চলেছে প্রাণীর কুল হেরো
চারিধার;
চলে যেন পঙ্গপাল করিয়া
আঁধার-
স্থবির-বালক-নারী হা অন্ন হা অন্ন বারি,
বলিতে-বলিতে ধায় চক্ষে
নীরধার !
ধরাতলে চলে ধীরে কালির
আকার !
(৩)
দেখো রে চলেছে আহা শিশু
কতজন,
শীর্ণদেহ চাহি আছে
জননী-বদন;
আকুল জননী তার, মুখ চাহি বার-বার,
অনিবার বারিধারা করে
বরিষণ-
ভ্রমে যেন উন্মাদিনী
অন্নের কারণ !
(৪)
হেরো দেখো পথিধারে বসিয়া
ওখানে,
পতির চরণে লুটি আকুল পরানে
বলিছে কামিনী কেহ, “কই নাথ অন্ন দেহো,
কালি আর চাহিব না রাখো আজ
প্রাণে”-
বলিয়া ত্যজিল প্রাণ চাহি
পতিপানে !
(৫)
ছুটিছে যুবতী কন্যা ফেলিয়া
পিতায়;
মা বলি ডাকিছে বৃদ্ধ সকলি
বৃথায় !
কেবা কন্যা কেবা
পিতা, কে জননী কেবা মাতা,
অন্নদাতা পিতা-মাতা আজি
বঙ্গালয়-
হেরো হেন কতজন আজি এ দশায়
!
(৬)
হেরো কতজন আহা
উদর-জ্বালায়-
জননী ফেলিয়া শিশু ছুটিয়া
পালায়,
তুলিয়া যুগল পাণি, শিশু ডাকে মা-মা বানী
ক্ষুধায় জননী তার ফিরি না
চায়-
একাকী পড়িয়া শিশু পরানে
শুকায় ।
(৭)
চলেছে প্রানীর কুল এরূপে
আকুল,
নৃত্য করে অনশন, মুক্ত করি
চুল,
নৃত্য করি ভেরী-নাদে কঙ্কাল তুলিয়া কাঁদে,
খর্পর ধরিয়া করে করিছে
ভ্রমণ-
দেখো বঙ্গবাসী দেখো মূর্তি
কী ভীষণ!
(৮)
ছুটিছে নয়নে বহ্নি
স্ফুলিঙ্গ-সমান,
ফিরিছে উন্মত্ত ভাব উল্কার
প্রমাণ;
দন্ত-ঘরষণে শব্দ, ভারতভুবন স্তব্ধ,
করাল বিকট গ্রাস মুখের
ব্যাদান,-
আকাশে উঠিছে সঙ্গে কালের
নিশান ।
(৯)
কতই উৎসবপূর্ণ গৃহস্থ-আলয়,
নন্দিনী-নন্দন-রূপ
সুখপুষ্পময়,
আজি পূর্ণ কলরবে, অচিরে নীরব হবে,
শকুনি-বায়স কিংবা
পেচক-আশ্রয়-
ধরিবে, শ্মশান-বেশ মৃত
অস্থিময় ।
(১০)
কত সে জনতাপূর্ণ পণ্যবীথি
হায়,
এ রাক্ষস অনাচারে হবে
মরুপ্রায়।
ভীষণ গহন সাজ, ধরিবে পুরীর মাঝ,
পূরিবে বনের গুল্ম পাপ
লতায় ।
শ্রমিবে শার্দুল-শিবা
আনন্দে সেথায় ।
(১১)
আজি হাসিভরা মুখ প্রফুল্ল
যেসব,
আজি সুখপূর্ণ বুক আশার
পল্লব,
কালি আর নাহি রবে, শবদেহ হবে সবে,
শৃগাল-কুক্কুরে মিলি করিবে
উৎসব-
কর্ণমূলে গৃধ্র বসি
শুনাইবে রব ।
(১২)
কেমনে হে বঙ্গবাসী নিদ্রা
যাওসুখে?
ভাবিয়া এ ভাব, চিত্ত ভরে
না কি দুখে?
নিজ সুত-পরিবার, না জানিছে অনাহার
ভাবিয়ে না চাহ কি হে
অভুক্তের মুখে-
স্বজাতি-শোকের শেল বিন্ধে
না কি বুকে?
(১৩)
প্রিয়ে বলি গৃহে আসি ধর
যবে কর,
হয় না উদয় কি রে
হৃদয়-ভিতর,-
কত সতী অনাথিনী, পথে –পথে কাঙালিনী,
শ্রমিছে হতাশ হয়ে ত্যজি
শূণ্য ঘর,-
নাহি লজ্জা-কুলমান,
ক্ষুধায় কাতর ।
(১৪)
ক্রোড়ে ধরি হের যবে
কন্যা-পুত্রগণ,
ভাবিয়া জগৎ-মাঝে অমূল্য
রতন-
কভু কি পড়ে না মনে, সেইসব শিশুগণে,
অন্ন বিনে মরে যারা করিয়া
রোদন?
তাহারাও ওইরূপ নয়ন-রঞ্জন ।
(১৫)
হে বঙ্গ-কুলকামিনী আর্য
যতজন
জান যার পতি-পুত্র-পিতা সে
কেমন-
ভাবি দেখো একবার, বদন সে সবাকার,
ঘরে যারা প্রাতঃসন্ধ্যা
করে দরশন,
নিরন্ন, বিষন পতি, জনক
নন্দন।
(১৬)
একদিন অনশনে দিন যদি যায়,
জান না কি বঙ্গবাসী কী
যাতনা তার।
আজি সেই অনশনে, দারুণ হতাশ মনে
লক্ষ নরনারী শিশু করে
হায়-হায়।
তবুও চেতনা কি হে নাহি হয়
তায়?
(১৭)
ভাবো ওহে বঙ্গবাসী ভাবো
একবার
কী কাল-রাক্ষস আসি
ঘেরিয়াছে দ্বার –
নাশিতে সে দুরাচার, ব্রিটনের হুংকার,
ব্রিটিশ-কেশরীনাদ শুন
একবার,
ঘুমাও না বঙ্গবাসী, ঘুমাও
না আর
ভারতে কালের ভেরী বাজিল আবার
।
কামিনী-কুসুম
(১)
কে খোঁজে সরস মধু বিনা
বঙ্গ-কুসুমে?
কোথায়
এমন আর
কোমল-কুসুমহার
পরিতে-দেখিতে, ছুঁতে আছে এ
নিখিল ভূমে?
কোথা হেন
শতদল
হৃদে
পুরি পরিমল,
থাকে প্রিয়মুখ চেয়ে
মধুমাখা শরমে?
বঙ্গনারী পুষ্প বিনা মধু
কোথা কুসুমে?
(২)
কী ফুলে তুলনা দিব, বলো
চুতমুকুলে?
কোথার
এমন স্থল
খুঁজিলে
এ ধরাতল
সেখানে এমন মৃদু-মৃদু ঝরে
রসালে?
যেখানে
এমন বাস,
নব রসে
পরকাশ,
নবীন যৌবনকালে মধু ওঠে
উথলে !
বঙ্গকুলবালা বিনা মধু কোথা
মুকুলে?
(৩)
মধুর সৌরভময় ভাবো দেখি
চামেলি
চালে কী
অতুল বাস,
ফুল্লমুখে
মৃদু হাস
তরুকোলে তনু রেখে, অলিকুলে
আকলি ।
কী জাতি
বিদেশিফুল
আছে তার
সমতুল,
রাখিতে হৃদয়মাঝ পরে
চিত্তপুতুলি ?
বঙ্গকুলনারী এর তুলনাই
কেবলি !
(৪)
কী আছে জগতে বেল-মতিয়ার
তুলনা।
সরল-মধুর
প্রাণ,
সুধাতে
মিশায়ে ঘ্রাণ
ভুলায় মুনির মন নাহি জানে
ছলনা,
না জানে
বেশবিন্যাস-
প্রস্ফুটিত
মুখে হাস,
অধরে অমিয়া ধরি হৃদে পূরি
বাসনা-
বঙ্গের বিধবাসম কোথা পাব
ললনা>
(৫)
কে দেয় বিলাতি ‘লিলি’ নলিনীতে
উপমা?
দেশে যে
কুমুদ আছে
আসুক
তাহারি কাছে,
তখন দেখিব বুঝে কার কত
গরিমা ।
বিধুর
কিরণ-কোলে
কুমুদ
যখন দোলে,
কী মাধুরী মরি তার কে বুঝে
সে মহিমা?
কোথায় বিলাতি ‘লিলি’ নলিনীর
উপমা?
(৬)
“কী ফুলে তুলনা তুলি বলো দেখি
চাঁপাতে?
প্রগাঢ়
সুবাস যার
প্রেমের
পুলকাগার,
বঙ্গবাসী রঙ্গরসে মত্ত আছে
যাহাতে ।
কোথায়
ইরান ‘গুল’,
এ ফুলের
সমতুল?
কোথা ফিকে ‘ভায়োলেট’ গন্ধ
নাহি তাহাতে ।
কী ফুল তুলনা দিতে আছে বলো
চাঁপাতে?
(৭)
কতই কুসুম আরো আছে
বঙ্গ-আগারে-
মালতী,
কেতকী, জাতি,
বান্ধুলি,
কামিনী পাতি,
টগর-মল্লিকা দাগ নিশিগন্ধা
শোভে রে,
কে করে
গণনা তার-
অশোক,
আতস আর,
কতশত ফুলকুল ফোটে নিশি
তুষারে-
সুধার লহরীমাখা
বঙ্গগৃহ-মাঝারে !
(৮)
কিবা সে অপরাজিতা নীলিমার
লহরি !
লতায়ে-লতায়ে
যায়,
ভ্রমরে
তুষি সুধায়,
লাজে অবনতমুখী, তনুখানি
আবরি;
তাই এত
ভালোবাসি,
মেঘেতে
চপলা হাসি-
কে খোঁজে রে প্রজাপতি,
পেলে হেন ভ্রমরী
মরি কী অপরাজিতা নীলিমার
লহরী !
(৯)
এ মাধুরী সুধারস কোথা পাব
কুসুমে,
কোথায়
এমন আর,
কোমল
কুসুম-হার,
পরিতে, দেখিতে, ছুঁতে, আছে
এ নিখিল ভূমে ।
কোথা হেন
শতদল ,
হৃদে
পূরি পরমল ,
থাকে প্রিয়মুখ চাহি
মধুমাখা শরমে-
বঙ্গনারী-পুষ্প বিনা মধু
কোথা কুসুমে?
জীবন-মরীচিকা
জীবন এমন ভ্রম আগে কে জানিত রে!
হয়ে এত লালায়িত কে ইহা যাচিত রে !
প্রভাতে
অরুণোদয় প্রফুল্ল যেমন হয়,
মনোহরা বসুন্ধরা কুহেলিকা আঁধারে।
বারিদ
ভূধর দেশ, ধরিয়ে অপূর্ব বেশ,
বিতরে বিচিত্র শোভা ছায়াবাজি আকারে।
কুসুমিত
তরুচয়, ব্রহ্মান্ড ভরিয়ে রয়,
ঘ্রাণে মুগ্ধ সমীরন মৃদুমৃদু সঞ্চারে।
কুলায়ে
বিহঙ্গদল, প্রেমানন্দে অনর্গল,
মধুময় কলনাদ করে কত প্রকারে।
সেইরূপ
বাল্যকালে, মন মুগ্ধ মায়াজালে,
কত লুব্ধ আশা আসি, করে স্নিগ্ধ আত্মারে।
“পৃথিবী
ললামভূত নিত্য সুখে পরিপ্লুত”
হয় নিত্য এই গীত পঞ্চভূত-মাঝারে ।
ব্রহ্মান্ড
সৌরভময় মঞ্জু কুঞ্জ মন হয়
মনে হয় সমুদয় সুধাময় সংসারে ।।
মধ্যাহ্নে
তাহার পর প্রচন্ড রবির কর,
যেমন সে মনোহর মধুরতা সংহারে।
না থাকে
কুহেলি অন্ধ না থাকে কুসুম গন্ধ,
না ডাকে বিহঙ্গকুল সমীরণ ঝংকারে।
সেইরূপ ক্রমে
যত শৈশব যৌবন গত
মনোমতো সাধ তত ভাঙে চিত্ত বিকারে।
সুবর্ণ
মেঘের মালা লয়ে সৌদামিনী ডালা,
আশার আকাশে আর নিত্য নাহি বিহরে।
ছিন্ন
তুষারের ন্যায় বাল্য-বাঞ্ছা দূরে
যায়,
তাপদগ্ধ জীবনের ঝঞ্ঝাবায়ু-প্রহারে।
পড়ে থাকে
দূরগত জীর্ণ অভিলাষ যত,
ছিন্ন পতাকার মতো ভগ্ন দুর্গ-প্রাকারে।
জীবনেতে
পরিণত এইরূপে হয় কত,
মর্তবাসি-মনোরথ, হাদগ্ধ বিধাত রে !
ধর্মনিষ্ঠাপরায়ণ,
সুচারু পবিত্র মন,
বিমল স্বভাব সেই যুবা এবে কোথা রে !
অসত্য
কলুষলেশ, বিধিলে শ্রবণদেশ,
কলঙ্কিত ভাবিত যে আপনার আত্মারে।
বামাশক্তি
বামাচার, শুনিলে শত ধিক্কার,
জ্বলিত অন্তরে যার সে তপস্বী কোথা রে?
কোথা রে
দয়ার্দ্র-চিত্ত সংকল্প যাহার নিত্য
পরদুঃখ বিমোচন এ দূরন্ত সংসারে?
অত্যাচার
উৎপীড়ন করিবারে সংযমন,
না করিত যেইজন ভেদাভেদ কাহারে।
না মানিত
অনুরোধ না জানিত তোষামোদ,
সে তেজস্বী মহোদায়-বাঞ্ছা এবে কোথা রে।
কত যুবা
যৌবনেতে চড়ি আশা বিমানেতে,
ভাবে ছড়াইবে ভবে যঃশপ্রভা আভা রে ।
তুলিবে
কীর্তির মঠ, স্থাপিবে মঙ্গলঘট,
প্রণত ধরনীতল দিবে নিত্য পূজা রে।
স্বদেশহিতৈষী
কেহ, ভাবিয়ে অসীম স্নেহ,
কত করে প্রাণ দিতে স্বজাতির উদ্ধারে ।
করি চিত্ত
অভিলাষ হয়ে সারদার দাস,
পিবে সুখে চিরদিন অমরতা-সুধা রে ।
কালের
করাল স্রোতে, ভাসে যবে জীবনেতে
এইসব আশালুব্ধ প্রানী থাকে কোথা রে।
কিশোর
গান্ডীবধারী জামদগ্ন্য দৈত্যহারী,
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কালীদাস কত ডোবে পাথারে।
কতই
যুবতী বালা, গাঁথে মনোমতো মালা,
সাজাইতে
মনোমতো প্রিয়তম সখারে ।
হৃদয়
মার্জিত করে, আহা কত প্রেমভরে,
প্রিয়মূর্তি চিত্র করে রাখে চিত্ত-আগারে।
নববিবাহিত
কত, পেয়ে পতি মনোমতো,
ভাবে জগতের সুখ ভরিয়া ভান্ডারে।
এইসব
অবলার কিছুদিন পরে আর
দেখো, মর্মভেদী শেল দেয় কত ব্যথা রে !
দেখো গে
কেহ বা তার হয়েছে পঞ্জরসার,
শুষ্ক হয়ে মাল্যদাম শূণ্যে আছে গাঁথা রে ।
মনোমতো
নহে পতি মরমে-মরমে সতী,
উদযাপন করিয়াছে পতি-সুখ আশা রে।
কৃতান্তের
আশীর্বাদে দিবা-নিশি কেহ কাঁদে,
বিষম বৈধব্য দশা নিগড়েতে বাঁধা রে।
দারুণ
অপত্যতাপে, দেখো হে কেহ বিলাপে
অন্নাভাবে জননীর কোথা বক্ষঃ বিদরে।
আগে যদি
জানতাম, পৃথিবী এমন ধাম,
তাহলে কি পড়িতাম আনায়ের মাঝারে।
কোথা গেল
সে প্রণয় বাল্যকালে মধুময়,
যে সখ্যতাপাশে মন বাঁধা ছিল সদা রে।
সমপাঠী
কেলিচর আভেদাত্মা হরিহর
এবে তাহাদের সঙ্গে কতবার দেখা রে !
পতঙ্গপালের
মতো কর্মক্ষেত্রে অবিরত,
স্বকার্যসাধনে রত কেবা ভাবে কাহারে !
আহা পুঃন
কতজন, করিয়াছে পলায়ন,
মর্তভূমি পরিহরি শমনের প্রহারে।
গগন-নক্ষত্রবৎ
তাহারাই অকস্মাৎ
প্রকাশে ক্কচিৎ কভু মৃদুরশ্মি মাখা রে।
আগে ছিল
কত সাধ, হেরিতে পূর্ণিমা-চাঁদ,
হেরিতে লক্ষত্র-শোভা নীলনভঃ মাঝারে ।
দিন দিন
কতবার জাগ্রত নিদ্রিতাকার,
স্বপ্নে স্বপ্নে ভ্রমিতাম নদ-হৃদ-কান্তারে!
বসন্ত
বরষাকালে পিকবর, মেঘজালে,
হেরিতে দামিনীলতা কী আনন্দ আহা রে!
সে সাধ
তরঙ্গকূল, এবে কোথা লুকাইল।
কে ঘুচালে জীবনের হেন রম্য ধাঁধাঁ রে!
বিশুদ্ধ
পবিত্র মন, স্বর্গবাসী সিংহাসন,
পঙ্কিল করিল কে রে দগ্ধচিতা অঙ্গারে ?
বীরবাহু কাব্য
হেরিয়া বসন্ত শোভা বসুন্ধরা মাঝে,
ঋতুমহোৎসব সুখে রামাগণ সাজে।
রাজবালা বনমালী সখী কয়জন,
সবে কৈল সমরূপ বসন-ভূষণ।
তেয়াগি নেতের বাস রতনের দাম,
অরণ্য-কুসুমে বেশ কৈল অভিরাম।
নবীন বল্কল পরি লাজ সংবরিয়া,
ধরিল বিচিত্র বেশ কুসুম পরিয়া।
মুক্তামালা বিনিময়ে বনমালা-দলে,
সযতনে কন্ঠহার পরিলেন গলে।
কর্ণবালা করবালা করি তিরোহিত,
শ্রুতিমূলে ঝুমকা-ফুল হৈল বিরাজিত।
কপালের সিঁতি শোভা আভা লুকাইল ,
কৃষ্ণচূড়া কেশমূলে আসি দেখা দিল।
নিতম্বে মেখলা ঘুচে লোহিত গোলাপ ,
নাভিপদ্ম-সনে আসি করিল আলাপ।
চরণে নুপুরধ্বনি আর না বাজিল,
রক্তজবা অরুণের আভা প্রকাশিল।
এইরূপে বল্কবাস পুষ্প-আভরণ,
করে বীনা-বাঁশি আদি করিয়া ধারণ ।
চলিল যথায় চূত কাতর-হৃদয়,
মাধবী তুলিতে কোলে অধোমুখে রয়।
নিকটে আসিয়া বীনা-বাঁশি বাজাইয়া,
মাধবী লতায় চুয়া চন্দন ঢালিয়া।
মুকুলিত চুঁয়াশাখা নোয়াইয়া করে,
চূত মাধবিতে বিয়া দিল সমাদরে।
এইরূপে কত খেলা খেলিতে লাগিল,
পশু পক্ষী আদি সবে হরিষে ভাসিল।
হীনবল প্রভাকর প্রদোষ হইল,
বিপিন ভ্রমিয়া নৃপতনয় ফিরিল ।
তৃণাসনে কয়জনে বসিয়া তখন ,
ভোজন করিয়া ক্ষুধা করি নিবারণ।
পুনরায় বনলীলা আরম্ভ করিল,
রাজপুত্র এইবার সংহতি চলিল।
হৃদতটে নারীগণ আসিয়া তখন,
বিভু কী দশা হবে আমার
বিভু কী
দশা হবে আমার,
একটি
কুঠারাঘাত শিরে হানি অকস্মাৎ
ঘুচাইলে
ভবের স্বপন-
সব আশা
চূর্ণ করে রাখিলে অবনীপরে
চিরদিন
করিতে ক্রন্দন ।
আমার
সম্বল মাত্র ছিল হস্ত,পদ,নেত্র
অন্য ধন
ছিল না এ ভবে,
সে নেত্র
করে হরণ হরিলে সর্বস্ব ধন
ভাসাইয়া
দিলে ভবার্ণবে।
চৌদিকে নিরাশা-ঢেউ
রাখিতে নাহিকো কেউ
সদা ভয়ে
পরান শিহরে,
যখনি
আগের কথা, মনে পড়ে পাই ব্যাথা
দিবানিশি
চক্ষে জল ঝরে।
কোথা
পুত্র-কন্যা-দারা, সকলই হয়েছি হারা,
গৃহ এবে
হয়েছে শ্মশান;
ভাবিতে
সেসব থা, হৃদয়ে দারুণ ব্যথা,
নিরাশাই
হেরি মূর্তিমান।
সব
ঘুচাইলে বিধি হরে দিয়ে চক্ষুনিধি
মানবের
অধ্ম করিলে ;
বল-বিত্ত
সব হীন, পর-প্রতিপাল্য দীন,
করে ভবে
বাঁধিয়ে রাখিলে।
জীবনে
বাসনা যত সকলই করিলে হত,
অন্ধকারে
ডুবায়ে অবনী,
না পাব
দেখিতে আর, ভবের শোভা ভাণ্ডার,
চির-অস্তমিত
দিনমণি।
ধরা-শূণ্য-স্থল-জল, অরন্য-ভূমি-অচল,
না
থাকিবে কিছুর(ই) বিচার,
না রবে
নয়নে দৃষ্টি তমোময় সব দৃষ্টি
দশদিক
ঘোর অন্ধকার
বিভু কী
দশা হবে আমার !
প্রতিদিন
অংশুমালী, সহস্র কিরণ ঢালি,
পুলকিত
করিবে সকলে,
আমার
রজনী শেষ, হবে না কি? হে ভবেশ!
জানিব না
দিবা কারে বলে?
আর না
সুধার সিন্ধু, আকাশে দেখিব ইন্দু,
প্রভাতে
শিশির-বিন্দু জ্বলে,
শিশির
বসন্তকাল, আসে-যাবে চিরকাল,
আমি না
দেখিব কোনো কালে ।
বিহঙ্গ-পতঙ্গ-নর,
জগতের সুখকর,
তাও আর
হবে না দর্শন,
থাকিয়া
সংসার-ক্ষেত্রে পাব না দেখিতে নেত্রে,
দেবতুল্য
মানব-বদন।
নিজ
কন্যা-পুত্র-মুখ, পৃথিবীর সার সুখ,
তাও আর
দেখিতে পাব না,
অপূর্ভ
ভবের চিত্র, থাকিবে স্মরণ মাত্র,
স্বপ্নবৎ
মনের কল্পনা;
কী নিয়ে
থাকিব তবে, তবে কী সাধনা হবে,
ভবলীলা
ঘুচেছে আমার,
বৃথা এবে
এ জীবন, হয় ন কেন এখন,
বৃথা
রাখা ধরনীর ভার ।
ধন নাই
বন্ধু নাই, কোথায় আশ্রয় পাই,
তুমিই হে
আশ্রয়ের সার,
জীবনের
শেষকালে, সকলি হরিয়া নিলে,
প্রাণ ন
ইয়ে দুঃখে করো পার –
বিভু !
কী দশা হবে আমার !
কৌমুদী
হাসো রে
কৌমুদী হাসো সুনির্মল গগনে,
এমন মধুর
আর নাহি কিছু ভুবনে ।
সুধা
পেয়ে সিন্ধুতলে
দেবতারা
সুকৌশলে
লুকাইয়া
চন্দ্রকোলে লেখা আছে পুরাণে
বুঝি কথা
মিথ্যা নয়,
নহিলে
চন্দ্র উদয়,
কেন হেন
সুধাময় ব্রহ্মান্ডের নয়নে।
আহা কী
শীতল রশ্মি চন্দ্রমার কিরণে,
যেখানে
যখন পড়ে
প্রাণ
যেন লয় কেড়ে,
ভুলে যাই
সমুদয়,
চেতনা
নাহিকো রয়,
জাগিয়া আছি কি আমি কিংবা আছি স্বপনে !
আহা! কী
অমিয় খনি শরতের গগনে!
কিবা
সন্ধ্যা কিবা নিশি,
যেই হেরি
পূর্ণশশী,
ক্ষুধা-তৃষ্ণা
ভুলে যাই
শুধু
সেইদিকে চাই,
হেরি
পূর্ণ সুধাকর অনিমেষ-নয়নে ।
পড়ে
কিরণের ঝারা ঢাকি হৃদি বদনে,
যত হেরি
সুধাকরে,
হৃদয়ের
জ্বালা হরে,
কোথা যেন
যাই চলে,
স্বপ্নময়
ভূমণ্ডলে,
সংসারের
সুখ-দুঃখ নাহি থাকে স্মরণে ।
********************************
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন