তুমিই সারথি আজ
লোকদুটো অনেকক্ষণ কোনো কথা বলেনি।
চুপ করে বসে ছিলো। এমনকী, মাঝেমধ্যে পানীয়ের গেলাশে চুমুক দেওয়া ছাড়া, বা প্লেটের মিইয়ে
যাওয়া বাদাম নিবিষ্টমনে চিবোনো ছাড়া, তারা আর কিছুই করেনি।
টেবিলটি
জানলার ধারে। যদিও, অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ফলে, বাইরের কিছুই আর তেমন পরিষ্কার দ্যাখা
যায় না। ধূসর ও জলীয় একটি আস্তরণে চারিদিক পূর্ণতঃ গ্রস্ত হয়ে আছে য্যানো। কেবল, পুরু কাচ ভেদ করে, একপ্রকার শাদা
ও নিষ্প্রাণ আলো ভিতরে বিচ্ছুরিত হয়। সম্ভবতঃ বৃষ্টির কারণেই, আজ পানশালায় ভিড়
অত্যন্ত বেশি। বসার জায়গা পাওয়া দুষ্কর। দু-তিনজন ওয়েটার অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে
ছোটাছুটি করছিলো।
“এখন আর এসব
বলে কোনো লাভ নেই।” বেঁটে লোকটি লম্বা লোকটিকে বলে।
লম্বা
লোকটি, এর উত্তরে, চুপ করে থাকে। ও নখ দিয়ে টেবিলে আঁকিবুকি কাটে।
“কাজটা তুই
না করলেও কিছু এসে যায় না। আমি করবো...বা, বসের আরো অনেক লোক আছে, তাদের
কেউ...মোটের ওপর, কাজটা হওয়া নিয়ে কথা। হবেও।”
লম্বা লোকটি
গেলাশে চুমুক দ্যায়। হাতের উল্টোপিঠে মুখ মোছে।
“তোর প্রবলেমটা
কী?” বেঁটে লোকটি প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায়।
“আরে,
লোকটাকে চিনি না, জানি না...হঠাৎ, এইভাবে...”
বেঁটে লোকটি
সিগারেটে লম্বা টান দ্যায়। ও দেশলাই কাঠিটা দু-একবার নাড়িয়ে অ্যাশট্রেতে গুঁজে
রাখে।
“তোর বাড়ির
পাশে একটা মোটরপার্টসের কারখানা আছে না? হ্যাঁ? তো সেখানে যারা কাজ করে, মানে
লেবাররা, তারা কি নিজেরা গাড়ি চড়বে বলে লেদমেশিন চালায়? হ্যাঁ?”
লম্বা লোকটি
জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ও জামার হাতায় মুখ মোছে।
“কী হলো?
বল!” মোক্ষম যুক্তি হাতে পেয়ে বেঁটে লোকটির মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, “আরে, বসের নানা
কারবার। নানান ধান্দা। অতসবের খবর রাখলে চলে? আমরা কাজটা করে দিলুম, টাকা পেলুম, ব্যাস।”
“একটা বিড়ি
দাও।” লম্বা লোকটা বলে।
“বিলিতি
সিগ্রেট। কড়া মাল।” সে দেশলাই জ্বেলে সিগারেট ধরাতে যথোচিত সাহায্য করে। প্যাকেটটা
হেলায় ছুঁড়ে দ্যায় টেবিলের ওপর। তার চোখেমুখে কাজ হাশিল করার আনন্দ ফুটে ওঠে।
“কিন্তু...
বস এইভাবে... মানে লোকটার সঙ্গে...” লম্বা লোকটা সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নেয়। ও মন
দিয়ে নিরীক্ষণ করে। প্যাকেটের গায়ে নানাবিধ সতর্কবার্তা লেখা। সেইসব একে একে পড়ে
দ্যাখে।
“হবে কিছু
একটা। বললুম না, নানান ব্যাপার। তুমি চলো ডালে ডালে, তো সে পাতায় পাতায়। তাকে ধরাও
যায় না, ছোঁয়াও যায় না। সব বড়ো বড়ো জায়গায় হাত আছে।” তাকে খুবই তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট
দ্যাখায়। এমন একজন বড়ো মানুষের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্যে সে যারপরনাই মুগ্ধ, এইরূপ
মনে হতে থাকে।
“আমি বুঝতে
পারছি না—”
বেঁটে লোকটি
কথা শেষ করতে দ্যায় না। ঈষৎ রূঢ়স্বরে বলে, “দ্যাখ, গতবার কিন্তু বসই তোকে ছাড়িয়ে
এনেছিলো। আনেনি? তুই ছাড়া না পেলে তোর বউ এখনো থাকতো? পালাতো না শালা গণির সঙ্গে?”
অন্যজন
দ্রুত মদের গেলাশে চুমুক দ্যায়। তার ঠোঁট অল্প কেঁপে ওঠে।
“তোর তো
এমনিতেই কাজটা করে দেওয়া উচিত।” ঘেন্নায় বেঁটের ঠোঁট বেঁকে যায়। এক চুমুকে সে বাকি
মদটুকু শেষ করে ফ্যালে।
“আমি কি
বলেছি, করবো না?” লম্বা লোকটি অসহায়ভাবে বলে, “আমি শুধু—”
দুজনেই চুপ
করে থাকে। ওয়েটার পাশে এসে দাঁড়ায়।
“কী হলো?
হ্যাঁ? রিপিট কর! বলে দিতে হবে?” বেঁটে লোকটি উত্তেজিতভাবে বলে। বা চেঁচিয়ে ওঠে,
চাপাস্বরে। ওয়েটারের নাকের ডগায় নোটের গোছা বের করে দোলায়।
ওয়েটার চলে
যায়। ও পুনরায় ফিরে আসে। গেলাশে মাপ মতোন মদ ঢালে। এইমাত্র, আরো একদল লোক দরজা
ঠেলে পানশালায় এসে ঢুকলো। খোলা দরজা দিয়ে, বাইরে বৃষ্টির শব্দ শোনা যায়। বহুলোকের মিলিত কথা বলায় চারিদিক গমগম করে ওঠে।
“দ্যাখ,
ভালো কথা বলছি,” বেঁটে লোকটি চাপা গলায় বলে, “কী হবে, কী হবে না, লাভ-ক্ষতি, এসব
না ভেবে চুপচাপ কাজটা করে দে। বসের কাজ করার জন্যে আরো অনেকে খাড়া হয়ে আছে। তোকে
দিয়েছে, এটা একটা ভালো ব্যাপার।”
লম্বা লোকটি
সিগারেটের ছাই ঝাড়ে। জামায় পড়েছিলো। হাত দিয়ে ঝেড়ে ফ্যালে। জোরে জোরে নাক টানে।
“আখেরে তোরই
মঙ্গল। মাঝপথে ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে, সেটা কি বস ভালো মনে নেবে?”
“ভয়ের কথা
কে বলেছে। শালা ভয়ের আমি—”
বেঁটে লোকটি
আর কিছু বলে না। চুপচাপ মদ খায়। ও আড়চোখে দ্যাখে।
লম্বা লোকটি
সিগারেটের বাকি অংশটুকু অ্যাশট্রেতে গোঁজে। ক্ষীণ একটি ধোঁয়ার রেখা কুন্ডলী পাকিয়ে
ওপরে উঠে যায়। উঠতেই থাকে। সে আরেকটি সিগারেট ধরায়। চারিদিকে তাকায়। আশেপাশে এতো লোক দেখে য্যানো কিছুটা অবাক। হয়তো আগে খেয়াল করেনি। বা করলেও,
মনে রাখেনি। এরাও কি তাকে দেখছে? তাকে মনে রাখছে? অবিশ্যি, তাতে কিছু এসে যায় না।
তাকে কেই বা পোঁছে!
সে অনেকটা
মদ খেয়ে ফেলেছিলো। ও তার ফলে বেশ স্ফূর্তির ভাব জাগে। ততোটা চিন্তিত লাগছিলো না আর
তাকে। সে আলতো স্বরে শিস দিতে থাকে।
বেঁটে
লোকটিকে দৃশ্যতঃ নিশ্চিন্ত দ্যাখায়। তবু, সতর্কতাহেতু, সে পুনরায় বলে, “কাজটা
ঠিকঠাক উতরে গেলে বসের পেয়ারের লোক হয়ে থাকবি। তোর চিন্তা কী!”
লম্বা লোকটি
অন্যমনস্কভাবে তার দিকে তাকায়। চোখ সরিয়ে নেয়। বাইরে বৃষ্টি আবার ঝেঁপে এলো। কাচের
গায়ে জল পড়ার শব্দ হয়। রাস্তার জমা জল গাড়ির চাকায় ছিটকে ওঠে। ও কাচে এসে লাগে।
কিছুক্ষণ
এভাবেই কাটে। কেউ কোনো কথা বলে না।
পাশের
টেবিলের লোকটা ওয়েটারকে ডেকে বিল দিতে বলে। তার গায়ে নীল শার্ট। ওয়েটার বিল নিয়ে
আসে।
এরা দুজন
উঠে দাঁড়ায়। লম্বা লোকটা হাত দিয়ে বেল্টের কাছটা সমান করে নেয়। চুলে হাত বোলায়।
বেঁটে লোকটিকে জিজ্ঞেস করে, “বাইকের চাবি?”
বেঁটে লোকটি
পকেট থেকে চাবি বের করে দ্যাখায়।
ওয়েটার
তাদের জন্য বিল নিয়ে আসে। ভালো করে না দেখেই বেঁটে লোকটি তার হাতে কয়েকটি নোট
ধরিয়ে দ্যায়। সে ভালো করে গুণে দেখে নেয়। ও লম্বা সেলাম ঠোকে।
নীল শার্ট
দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। এরাও দরজার দিকে অগ্রসর হয়।
যেতে যেতে
লম্বা লোকটি বলে, “টাকাটা দেবে তো? অনেকগুলো টাকা...বৌটার আবার বাচ্চা হবে...ওষুধ
দিয়েছে। বলছে, হাসপাতালে যদি দিতে হয়—”
দরজা খুললে
বৃষ্টির শব্দে তাদের গলার স্বর চাপা পড়ে যায়।
পুনরায় দরজা
বন্ধ হয়। ভেতরে আলো। ও অনেক মানুষের গলা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন