• কবিতা সুর্মা


    কবি কবিতা আর কবিতার কাজল-লতা জুড়ে যে আলো-অন্ধকার তার নিজস্ব পুনর্লিখন।


    সম্পাদনায় - উমাপদ কর
  • ভাবনালেখা লেখাভাবনা


    কবিতা নিয়ে গদ্য। কবিতা এবং গদ্যের ভেদরেখাকে প্রশ্ন করতেই এই বিভাগটির অবতারণা। পাঠক এবং কবির ভেদরেখাকেও।


    সম্পাদনায় - অনিমিখ পাত্র
  • সাক্ষাৎকার


    এই বিভাগে পাবেন এক বা একাধিক কবির সাক্ষাৎকার। নিয়েছেন আরেক কবি, বা কবিতার মগ্ন পাঠক। বাঁধাগতের বাইরে কিছু কথাবার্তা, যা চিন্তাভাবনার দিগন্তকে ফুটো করে দিতে চায়।


    সম্পাদনায়ঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়
  • গল্পনা


    গল্প নয়। গল্পের সংজ্ঞাকে প্রশ্ন করতে চায় এই বিভাগ। প্রতিটি সংখ্যায় আপনারা পাবেন এমন এক পাঠবস্তু, যা প্রচলিতকে থামিয়ে দেয়, এবং নতুনের পথ দেখিয়ে দেয়।


    সম্পাদনায়ঃ অর্ক চট্টোপাধ্যায়
  • হারানো কবিতাগুলো - রমিতের জানালায়


    আমাদের পাঠকরা এই বিভাগটির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন বারবার। এক নিবিষ্ট খনকের মতো রমিত দে, বাংলা কবিতার বিস্মৃত ও অবহেলিত মণিমুক্তোগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে আনছেন, ও আমাদের গর্বিত করছেন।


    সম্পাদনায় - রমিত দে
  • কবিতা ভাষান


    ভাষা। সে কি কবিতার অন্তরায়, নাকি সহায়? ভাষান্তর। সে কি হয় কবিতার? কবিতা কি ভেসে যায় এক ভাষা থেকে আরেকে? জানতে হলে এই বিভাগটিতে আসতেই হবে আপনাকে।


    সম্পাদনায় - শৌভিক দে সরকার
  • অন্য ভাষার কবিতা


    আমরা বিশ্বাস করি, একটি ভাষার কবিতা সমৃদ্ধ হয় আরেক ভাষার কবিতায়। আমরা বিশ্বাস করি সৎ ও পরিশ্রমী অনুবাদ পারে আমাদের হীনমন্যতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরটি সম্পর্কে সজাগ করে দিতে।


    সম্পাদনায় - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
  • এ মাসের কবি


    মাসের ব্যাপারটা অজুহাত মাত্র। তারিখ কোনো বিষয়ই নয় এই বিভাগে। আসলে আমরা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কবিকে নিজেদের মনোভাব জানাতে চাই। একটা সংখ্যায় আমরা একজনকে একটু সিংহাসনে বসাতে চাই। আশা করি, কেউ কিছু মনে করবেন না।


    সম্পাদনায় - নীলাব্জ চক্রবর্তী
  • পাঠম্যানিয়ার পেরিস্কোপ


    সমালোচনা সাহিত্য এখন স্তুতি আর নিন্দার আখড়ায় পর্যবসিত। গোষ্ঠীবদ্ধতার চরমতম রূপ সেখানে চোখে পড়ে। গ্রন্থসমালোচনার এই বিভাগটিতে আমরা একটু সততার আশ্বাস পেতে চাই, পেতে চাই খোলা হাওয়ার আমেজ।


    সম্পাদনায় - সব্যসাচী হাজরা
  • দৃশ্যত


    ছবি আর কবিতার ভেদ কি মুছে ফেলতে চান, পাঠক? কিন্তু কেন? ওরা তো আলাদা হয়েই বেশ আছে। কবি কিছু নিচ্ছেন ক্যানভাস থেকে, শিল্পী কিছু নিচ্ছেন অক্ষরমালা থেকে। চক্ষুকর্ণের এই বিনিময়, আহা, শাশ্বত হোক।


    সম্পাদনায় - অমিত বিশ্বাস

অনুপম মুখোপাধ্যায়




আন্তর্জালে বাংলা কবিতা : আমাদের দায়

অনুপম মুখোপাধ্যায়



একটা কথা  বারবার বলতে চাই, আশা করি এই কথা নিয়ে বিতর্কের খুব অবকাশ নেই : একদিন যেমন তালপাতা পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করেছিলাম ছাপাখানায়, আজ ছাপাখানা পেরিয়ে ডিটিপি সেন্টার পেরিয়ে ঢুকতে চলেছি সাইবার জগতে।  এ এক অনিবার্য বিবর্তন। চাইলেও একে রোধ করা যাবে না। আজ যেমন নিজের নিয়মেই এমনকি লেটার প্রেস অতীত হয়ে গেছে, ঠিক সেভাবেই এ আরেক ভবিতব্য। আর একে রোধ করতে চাওয়ার পিছনে কোনো যুক্তি নেই, হয়তো প্রগতিও নেই। স্মৃতিকাতরতা থাকতে পারে।
আজও কি আমাদের মন পোড়ে না লেটার প্রেসের সেই বইগুলোর জন্য? প্রিয় পত্রিকাগুলোর জন্য? নির্বিকার নিঃশব্দ ডিটিপি কি আমাদের অনেকের ছেলেবেলার স্বাদ এবং গন্ধ এবং শ্রুতিকে কেড়ে নেয়নি, আমাদের অনেকের যৌবনের দুরন্ত দিনগুলোকে? এই যে আমার হাতের কাছে রয়েছে এম সি সরকার এন্ড সনস প্রকাশিত ‘পরশুরাম গ্রন্থাবলী’, এই বই হাতে নিলেই হারানো দিনগুলো হরফের সারি ধরে ফিরে আসে, ঠিক যেমন ইউ টিউবে প্রমথেশ বড়ুয়া সাহেবের ‘রজত জয়ন্তী’ যখন দেখি। কিন্তু আজকের বাংলা সিনেমার প্রযুক্তিকে ‘রজত জয়ন্তী’-তে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সম্ভব নয় আজ তালপাতায় খাগের কলমে একটি কাব্যপুথি প্রকাশ। আর সেইদিন অনেক শতাব্দী দূরে নয় যেদিন বাংলা কবিতার শক্তিশালী পত্রিকাগুলোকে নিজেদের ওয়েব ভার্সান প্রকাশ করতে হবে, আমার যদি খুব ভুল না হয়।
কবিতা রচনার সঙ্গে প্রযুক্তির যোগকে আপনি হেলা করলেও করতে পারেন, কিন্তু কবিতা প্রকাশনার সঙ্গে উন্নততর, এমনকি সুলভ প্রযুক্তির যোগকে আপনি অস্বীকার করবেন কী করে? সেটা হয় না। কেউ কেউ বলছেন আজকাল কবিরা হাতের লেখার বদলে কম্পিউটারে টাইপ করে লেখা দিচ্ছেন, এর ফলে প্রাণের যোগ কমে যাচ্ছে। সেটা সম্ভবত হয় না। ফাউন্টেন পেন কি খাগের কলমের চেয়ে কম প্রাণবান ছিল? বা, কাগজ কি তালপাতার চেয়ে কম? কম্পিউটারে টাইপ করা লেখায় দুর্বোধ্যতা স্বল্প হয়, ছাপার ভুলের দুর্যোগ থাকে নাডাকের বদলে ই-মেলে পাঠানো লেখা অনেক নিশ্চিতভাবে পৌঁছে যায়, উদ্বেগ থাকে না। এখানে স্মৃতিকাতরতাকে খুব একটা প্রশ্রয় দেওয়া মনে হয় না উচিত কাজ।
কিছুদিন আগে একটি বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকায় একটি বিতর্কিত লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। একজন লেখক মতপ্রকাশ করেছিলেন বাংলা ছোট পত্রিকগুলোর দিন নাকি ফুরিয়ে এসেছে, লিটল ম্যাগাজিনের লোপ নাকি অবশ্যম্ভাবী। বিস্ফোরক এবং অনেকটাই অবিবেচক মতামত, সন্দেহ নেই। প্রতিবাদ হয়েছিল। ফেসবুকে ট্যুইটারেও ঝড় উঠেছিল। লেখক আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই আক্রমণ তাঁর প্রাপ্যও ছিল। যথেষ্ট হোমওয়র্ক করে তিনি লেখাটি প্রস্তুত করেননি। কিন্তু কিছু বস্তু তাঁর বক্তব্যে ছিল। সেগুলোকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আমরা জানি চিরকাল এক বা একাধিক তরুণ প্রাণ অনেক সাধ বুকে বেঁধে একটি ছোট কবিতা-পত্রিকা প্রকাশ করেন। তাঁদের পিছনে কর্পোরেট মূলধন থাকে না। নিজেদের হাতখরচের টাকা বাঁচিয়ে বা ধারদেনা করে একটি কৃশকায় পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এটাই নিয়ম। এটাই আমাদের গর্ব। সে যদি দীর্ঘজীবী হয় সে এক পরম আনন্দ ও বিস্ময়ের ঘটনা। আজও আমাদের মধ্যে ৪০ বছর বা ৫০ বছর পেরিয়েও এগিয়ে চলা কবিতা-পত্রিকাগুলি আছে। বেশ কিছু পত্রিকা কয়েক দশক পরেও তুমুল সজীব রয়েছে। সেটা হয়েছে শ্রদ্ধেয় সম্পাদকের রক্ত-অশ্রু-স্বেদের সিঞ্চনে। অনেক আত্মত্যাগ আত্মবিনিয়োগ ও শক্ত চোয়ালের কাহিনি ওই পত্রিকাগুলো বলবে। অন্যথায় দুই বা ততোধিক সংখ্যার পরেই পত্রিকাকে অনিয়মিত হয়ে পড়তে হয়, একটা সময় হয়তো তার মৃত্যুই ঘটে, হয়তো সঙ্গে নিয়ে যায় তখনও চেয়ে নেওয়া কিছু লেখাএটা আমাদের প্রত্যাশার মধ্যেই থাকে। কোনো তরুণ সম্পাদক তাঁর প্রথম সংখ্যার জন্য কম্পিত কন্ঠে লেখা চাইলে স্বনামধন্য কবি-লেখকরা ইতস্তত করেন, কারণ সংখ্যাটি যে শেষ অবধি বেরোবেই এমন নিশ্চয়তা তাঁদের কিছু তেতো অভিজ্ঞতা তাঁদের দেয় না। আর, বেরোলেও কজন পাঠকের হাতে তা পৌঁছবে? পৌছনর পথটায় অনেক কাঁটা বিছিয়ে থাকে। অনেক সময় অনেক আশা করে চেয়ে নেওয়া লেখা পুনঃপ্রকাশিত লেখা হিসেবে দেখা দেয়। প্রথম সংখ্যাই উদ্যোক্তাদের উদ্যমকে অনেকখানি ফুরিয়ে ফেলে। এর একমাত্র কারণ সাধ থাকা সত্বেও সাধ্যের অভাব। এই সাধ্যের অভাবেই একটি সম্মানিত পত্রিকার সংগ্রামী সম্পাদককে বিজ্ঞাপনের মুখ চেয়ে থাকতে হয়, অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত মানুষদের কাছ থেকে অপমান সহ্য করতে হয়। অনেক সময় অনেক জরুরি জায়গায় তিনি পত্রিকাকে পৌঁছে দিতে পারেন না। লিটল ম্যাগাজিন মেলায় নিজের শরীর, সংসার বা পেশার কারণে পত্রিকা হাতে সর্বদা উপস্থিত হতে পারেন না।
দৈনিক পত্রিকার সেই লেখকটি এই ঘটনাগুলো লক্ষ্য করেছিলেন। কিন্তু এগুলোকে পেরিয়ে দেখেননি। অশ্রু-স্বেদ-রক্তের প্রতিও তাঁর শ্রদ্ধা ধরা পড়েনি।
অবশ্যই আজ আন্তর্জাল আমাদের সামনে এক আশ্চর্য দিগন্তকে খুলে দিয়েছে। বাংলার প্রথম ওয়েব-পত্রিকা ছিল সম্ভবত ‘পরবাস’। প্রথম আন্তর্জাল কবিতা পত্রিকা ‘কৌরব অনলাইন’। এই শতাব্দীর প্রথমেই ব্যাপারটা একেবারে অন্যরকম ছিল। আজকের মতো ঘরে ঘরে কম্পিউটার পৌঁছে যায়নি। মোবাইল ফোন তখন হাতে হাতে ঘুরত না। মোবাইলে ইন্টারনেট-সংযোগ তো তখন কল্পবিজ্ঞানের মতো শোনাত। আমার মনে আছে ২০০৪ বা ২০০৫ নাগাদ সাইবার কাফেতে গিয়ে অনেক মেহনত করে একটি ওয়েবপত্রিকাকে লেখা পাঠাতাম। বেশ কিছু পয়সাও খসত, কারণ বাংলায় টাইপ করতে জানতাম না। আজ এগুলো বাস্তব। আজ আন্তর্জালে ‘কৌরব’, ‘আদরের নৌকা’, ‘দলছুট’, ‘নতুন কবিতা’, ‘বাউন্ডুলে’, ‘মাসকাবারি’, ‘দ্রঃ বিদ্রঃ’, ‘সৃষ্টি’, ‘ইচ্ছামতী’, ‘জার্নি ৯০জ’, ‘হাতপাখা’, ‘মথ’, ‘গুরুচন্ডালী’-র মতো ওয়েবপত্রিকারা হৈ হৈ করছে। পত্রিকাগুলো প্রকাশের পরেই মুহূর্তের মধ্যে ই-মেল বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের দৌলতে পাঠকের মনিটরে পৌঁছে যাচ্ছে। পাঠকের ঈর্ষনীয় সংখ্যাটাও প্রতি মুহূর্তে জেনে নেওয়া যাচ্ছে। কম্পিউটার বা ল্যাপটপ যদি না-ও থাকে, আজ মোবাইলেই একটি ওয়েবপত্রিকাকে পড়ে ফেলা সম্ভব। লেখা পাঠানোও সম্ভব। ইউনিকোড আজ সব বুদ্ধিমান যন্ত্রের মগজে ঢুকে আছে।
এবং, বাস্তব থেকেই তো পা তোলে স্বপ্ন। আজ কোনো তরুণ যদি একটি পত্রিকার স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু তাঁর ক্ষমতা হয় সীমাবদ্ধ, অর্থের কারণে বা মহানগর থেকে দূরত্বের কারণে, তাঁর স্বপ্ন সফল হতে বাধা নেই। তিনি একটি ওয়েবজিন প্রকাশ করতেই পারেন। সেটার জন্য ডোমেইন কিনতে হয়। কিছু টাকাকড়ি লাগে। ডিজাইন করার জন্য একজন প্রোফেশনাল প্রয়োজন হয় যেমন রোহন কুদ্দুস একজন কবি। শূন্য দশকের সূচনালগ্ন থেকেই তিনি এমন অনেক পত্রিকার দেখভাল করছেন তাঁর নিজস্ব ‘সৃষ্টিসন্ধান’ থেকে।
কিন্তু, এমনকি, যদি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে একটি আন্তর্জাল পত্রিকা কেউ চান, তা-ও সম্ভব। একটি ব্লগজিন বা ব্লগপত্রিকা প্রকাশ করতে পারেন। ব্লগের ডিজাইন করার জন্য বিশেষ কারিগরী বিদ্যা লাগে না। নিজেরাই একটা টেমপ্লেট অনায়াসে বানিয়ে নেওয়া যায়। আমরা ২০০৯ সালে ‘বাক্’ নামে একটি ব্লগপত্রিকা শুরু করেছিলাম ব্লগস্পট থেকে। প্রায় ৫ বছর হতে চলল। ‘বাক্’ ছিল প্রথম ব্লগজিন এর পরে আরো বেশ কিছু ব্লগপত্রিকা আত্মপ্রকাশ করেছে, যেমন ‘ই-দুয়েন্দে’, ‘অনলাইন কালিমাটি’, ‘অন্য নিষাদ’, ‘ক্ষেপচুরিয়াস’ ইত্যাদি। ২০১২-র পর থেকে তো দেখতে পাচ্ছি ঘনঘন এক-একটি ব্লগপত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। তারা সোচ্চারে জানাচ্ছে তাদের অস্তিত্ব। মাথা উঁচু করে লেখা চাইছে। তাদের ডিজাইন সুন্দরলেখালেখির মান নিয়ে কোনোরকম সমঝোতা নেইকোনো লেখকই আশা করা যায় একটি ব্লগপত্রিকায় লেখা দিতে বিমুখ হবেন না। পাঠকের সংখ্যা সেখানে সুপ্রচুর। ব্লগপত্রিকার সুবিধা হল সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ব্লগস্পট, ওয়র্ডপ্রেস, বা উইবলি-র মতো কিছু ব্লগসাইট থেকে ডোমেন নেওয়া যায়। শুধু একটি একাউন্ট খুলতে হয় এজন্য। একটি ইউজার আইডি এবং পাসওয়র্ড তৈরি করতে হয়। ব্লগস্পটের ক্ষেত্রে তো জি-মেলের আইডি এবং পাসওয়র্ডেই কাজ হয়ে যায়, কারণ ওটা গুগলের সাইট। তারপর খুব সহজেই গড়ে তোলা যায় একটি ঝকঝকে ওয়েবপত্রিকা। পাঠকও তা পড়ে ফেলতে পারেন বিনা অর্থব্যয়ে। অবিশ্যি নেট-সংযোগ তো লাগবেই।
আমার যতদূর অভিজ্ঞতা, অর্থের কারণে বা দূরত্বের কারণে বা যোগাযোগের কারণে একটি আন্তর্জাল পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায় না, তার অকালমৃত্যু ঘটে না। যদি সে মরে, তাহলে পত্রিকার জন্মদাতাদের আগ্রহ, ধৈর্য, এবং অধ্যবসায়ের দৈন্য ছাড়া অন্য কোনো কারণ থাকে না। ঠিক ওই কারণেই অনেক কবিতালেখকও কবিতা লেখা ছেড়ে দিতে পারেন।
আর, এখানেই হয়তো এসে পড়ছে ভবিষ্যতের লিটল ম্যাগাজিনের প্রসঙ্গ।
এই আন্তর্জাল পত্রিকাগুলো কি লিটল ম্যাগাজিনেরই রূপভেদ নয়? এদের মধ্যে কি একটি সার্থক ছোট পত্রিকার সব গুণ এবং সম্ভাবনাই লক্ষ্য করা যায় না? এই নতুন শতাব্দীতে ছোট পত্রিকার একটা অন্য জন্ম হচ্ছে আন্তর্জালে। অনেক সীমাবদ্ধতা অনায়াসে অতিক্রম করা যাচ্ছে। আমরা সকলেই জানি এবং মানি, বিক্রয় একটি লিটল ম্যাগের উদ্দেশ্য কখনওই হতে পারে না। তবু তাকে বিপননের কথা ভাবতে হয়, বিজ্ঞাপনের কথা ভাবতে হয়, বিজ্ঞাপনে পাতা আড়াল করতে হয়, বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু এ পোড়া দেশে কবিতার বানিজ্যে একটি শুদ্ধ লিটল ম্যাগাজিনের সফল হওয়ার কথা নয়। আন্তর্জাল পত্রিকায় বিপননের প্রসঙ্গটাই আসে না। আন্তর্জালে পত্রিকার জন্ম অর্থমূল্যে হয় না, হলেও যে অর্থ ব্যয় করতে হয় তা বিপুল নয়, ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। ফলে পাঠকের হাতে নিখরচায় পত্রিকা তুলে দেওয়ার কোনো অসুবিধা এখানে নেই। পাঠক সংখ্যা অসীম। এবং, একটি পত্রিকার কোনো বিশেষ সংখ্যা কখনও ফুরিয়ে যাবে না। এ এক সুবিধা যে, পত্রিকাটিকে চিরকাল আন্তর্জালে খুঁজে পাওয়া যাবে। অবিশ্যি কোনোদিন যদি আন্তর্জাল ব্যাপারটাই দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়, তাহলে কিছু করার নেই।
এই নতুন ধরণের ‘পত্রিকা’-গুলোকে অপছন্দ করার লোকও আছেন, অবশ্যই। তাঁদের অনেকেই প্রাচীন হয়েছেন এমন নয়, তরুণরাও আছেন, বয়স তো আসলে বয়স নয়এই অপছন্দের পিছনে কিছু কারণ থাকতে পারে-১) তাঁরা কম্পিউটারে অভ্যস্ত নন, এবং অভ্যাসের মধ্যে যেতেও চাইছেন না। এমন মানুষের সংখ্যা এখনও আদৌ কম নয়। এঁরা আন্তর্জাল পত্রিকাকে পত্রিকা বলেই মনে করেন না। সেখানে লেখা দিলে একটি লেখা নষ্ট হল বলেই ধরে নেন। একটি পত্রিকাকে হাতে ধরে না দেখা গেলে এঁদের আশ্বাস নেই। কিন্তু ১৫ দিন আগে ডাকপিয়ন যে পত্রিকাটি পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল, সেটাকে অনেক সময় এককথায় এঁরা খুঁজে না-ও পেতে পারেন। অবশ্যই ৪০ বছর আগেকার জীর্ণ পত্রিকাটিকেও সযত্নে তুলে রাখা মানুষেরা আছেন। দেখা যাবে তাঁরা আন্তর্জাল পত্রিকার সম্ভাবনায় উল্লসিত। সংগ্রহের মূল্য তাঁরা সম্যক বোঝেন। কবিতার অপরিসীম ভান্ডারকে আর্কাইভ হিসেবে রাখা একমাত্র আন্তর্জালেই সম্ভব ও সহজ। এ এক অনন্ত লাইব্রেরি। ২) কিছু মানুষ খুব আন্তরিকভাবে মনে করছেন এতে কবিতার অমঙ্গল হবে, শুভ কিছু এর থেকে জন্ম নেবে না। কবিতা এবং প্রযুক্তির কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ককে এঁরা অশ্লীল মনে করেন। গুটেনবার্গ এঁদের সামনে কিছু বক্তব্য হয়তো রাখতে পারেন, বা শ্রীরামপুরের সেই মিশনারিরা ৩) অনেকেই আছেন যারা কাগজের পৃথিবীটাকে অসম্ভব ভালবাসেন। আমি নিজেও তাঁদের একজন। কিন্তু এটাও তো ঠিক, কাগজের পিছনে কিন্তু থাকে গাছেদের মৃতদেহ ও আর্তনাদ। একদিন অরণ্যকে বাঁচানোর জন্যই কাগজ প্রস্তুতিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হয়তো বাধ্য হবে আমাদের মানবসভ্যতা।৪) অনেকে ভাবেন আন্তর্জালে কবিতা দিলে তা চুরি হয়ে যেতে পারে খুব সহজে। এঁদের জানানো যেতে পারে আন্তর্জালে চুরিটা বরং ঢের বেশি কঠিন। কবিতার বিশেষ একটি অংশও গুগলে দিলে ধরা পড়ে যাবে তা অন্য কোথাও অন্য কারও নামে প্রকাশিত হচ্ছে কিনা। প্রকাশের সাল-তারিখ আপনার হয়ে কথা বলবে। অনলাইনে কবিতা চুরি করে ধরা না পড়া খুউউব শক্ত।
দয়া করে এটা ভাববেন না আমি কাগজের পত্রিকার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলছি। আমাদের সাহিত্য আজও কাগজকে অবলম্বন করেই বেঁচে আছে। এখনও আমি আমাদের মফসসল শহরের ছোট্ট বই দোকানটিতে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পৌঁছে যাই যখন আমার প্রিয় কবিতা পত্রিকাটি সেখানে  আমার জন্য অপেক্ষা করে। এই ছুটে যাওয়া আমার জীবনভর থাকবে।
এবং আমি এটাও বলছি না আন্তর্জালে কবিতার জন্য কোনো ক্লেদ কোন অভিশাপ নেই।
অবশ্যই আছে।
আন্তর্জাল আজ বাংলা কবিতার ধারণাকে বহুদূর ঠুনকো করে দিতে চাইছে
সমগ্র আন্তর্জাল না বলে ফেসবুক বলতে পারি। এই একটি ওয়েবসাইট আজ পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে জনবহুল। বৃহত্তম রাষ্ট্র। এবং ভ্যাটিকানের চেয়ে সে ঢের শক্তিশালী কোনো ধর্মগুরু ছাড়াই। চরম সাম্যবাদের রূপটা যদি কেউ সত্যিই টের পেতে চান, তিনি কিছুদিন ফেসবুকে বেড়িয়ে আসতে পারেন। এখানে মুড়ি এবং মিছরি শুধুমাত্র আলাদা দুটো প্রোফাইল, আর কিছুই নয়।
ফেসবুকে কবিতা প্রকাশ... এ নিয়ে একটা মজার গল্প বলি? সম্প্রতি আমার এক বন্ধুর স্ট্যাটাস থেকেই এটা জানতে পারলাম। বন্ধুটিকে এক সুন্দরী মহিলা ফেসবুকে বন্ধুত্বের আমন্ত্রণ জানান। বন্ধুটি সানন্দে স্বীকার করেন। এরপর বন্ধুটি যখনই ফেসবুকে কোনো কবিতা পোস্ট করতেন, তরুণীটি লাইক দিতেন। বন্ধুটি ধরে নিয়েছিলেন মেয়েটি তাঁর কবিতার এক নীরব ভক্ত। এভাবেই চলছিল, দুজনের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। একদিন তরুণীটি বন্ধুকে ‘হাই!’ জানালেন। বন্ধুটিও পালটা সম্ভাষণ জানালেন এবং ধন্যবাদ দিলেন তাঁর প্রতিটি কবিতায় লাইক দেওয়ার জন্য। এরপর যেটা হল, তরুণী অত্যন্ত অবাক হয়ে বললেন, ‘আরে, আপনি কবিতা লেখেন বুঝি? বাঃ! আমি কবিতা খুব ভালবাসি, জানেনপড়াবেন কিন্তু আপনার কবিতা।
গল্প শুরু না হতেই শেষ। কিন্তু এর থেকেই হয়তো আমরা কিছুটা বুঝে নিতে পারি ফেসবুকে কবিতার ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের চোখে ঠিক কীরকম। অধুনান্তিক পরিসর কবিতাকে ঠিক যে অবস্থায় পেতে চেয়েছে, ফেসবুক, একমাত্র ফেসবুকই তাকে সেটা দিয়েছে। এখানে সকলেই কবি। কেউ কারও চেয়ে কম নন। এখানে কবিতার আলোচনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফাঁকা প্রশংসা, অথবা ব্যক্তিগত বিষোদ্গার। এর মধ্যে কেউ যদি অন্য পথে হাঁটার চেষ্টাও করেন, পথের মধ্যেই তাঁর সেতু ভেঙ্গে দেওয়া হবে। তিনি একঘরে হবেন। একাধিক গ্রুপে দেখতে পাই এমন সব লেখা নিয়ে শতাধিক সংলাপের ঢল নামে যে লেখাকে অ-কবিতাও বলা চলে না। কেউ কেউ এমন এক-একজনের অক্ষম এক-একটি লেখাকে প্রাণপনে ভাবগম্ভীরভাবে কবিতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন, দেখলে সন্দেহ হয় তার পিছনে কোন উদ্দেশ্য কাজ করছে। আন্তর্জালের অভিশাপ হয়তো এটুকুই। তবে এর চেয়ে বড়ো একটা বিপদ রয়েছে। সেটা হাইব্রিড কবিতা। নকল কবিতা। ঠিক কবিতার মতোই দেখতে, কিন্তু কবিতা নয়। এবং, এই ধরণের বস্তুকে কবিতা প্রতিপন্ন করার জন্য দল বেঁধে থাকেন বেশ কিছু মানুষ। অনেক সময় দেখেছি একটি তরুণ বা তরুণী অল্প কয়েকটি কবিতা ফেসবুকে পোস্ট করার পরেই অনেকে তাঁকে ঘিরে ধরেন, এবং সমবেত জয়ধ্বনিতে তাঁর মনে ধারণা আসতেই পারে, তিনি সত্যিই সর্বশেষ বাংলা কবিতা লিখে ফেলছেনতিনি আর বৃহত্তর বাংলা কবিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতেই চান না।
অধুনান্তিক তত্ত্ববিশ্ব চেয়েছিল মহৎ কবির অস্তিত্বকে মহাকবিতার ধারণাসমেত জলাঞ্জলী দিতে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে না হোক, ফেসবুকে সেটা হয়েছে। এই একটিমাত্র ওয়েবসাইট সেটা করে দেখাতে পেরেছে, অন্তত বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে।
আমি কিন্তু বলতে চাইব, ফেসবুক কবিতা প্রকাশের স্থান কোনোভাবেই হতে পারে না। একটি কবিতা কখনই হতে পারে না একজনের ফেসবুক স্ট্যাটাস, বা কমেন্ট। অথচ একবার একটি লেখাকে ফেসবুকে দেওয়ার পরে সঙ্গে সঙ্গে কয়েক হাজার চোখ তাকে পড়ে নিতে পারে। তারপরে তাকে আর অপ্রকাশিত লেখা বলা চলে না। তার একটা সামাজিক মান্যতা তৈরি হয়। কিন্তু সেই মান্যতার ভিত্তি কী? কোনো পত্রিকা কোনো সম্পাদক কোনো প্রকাশকের উপস্থিতি ছাড়া একটি কবিতার সামাজিক অস্তিত্বের অধিকার কী করে জন্মাতে পারে? সামাজিকভাবে এ এক ত্রিশংকু অবস্থা নয় কি? অবিশ্যি ফেসবুকের গ্রুপপত্রিকাগুলোর প্রসঙ্গ ভিন্নসেখানে কেউ ইচ্ছে করলেই লেখা দিতে পারেন না। গ্রুপের পরিচালকরা সেখানে অন্যের লেখা প্রদর্শনের অনুমতি দেন। কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত টাইমলাইনে দেওয়া লেখার ক্ষেত্রে কী হচ্ছে? নিজেই নিজের কবিতাকে জনসমক্ষে আনা, নিজেই নিজের প্রকাশক হয়ে ওঠা... একজন চারণ বা ত্রুবাদুরের মতো, খুবই মুক্ত ধারণা মনে হতে পারে, কিন্তু তার মানদন্ডের কী হবে? আপনার কবিতাটার সামাজিক কোনো প্রয়োজন আছে কিনা, এমনকি অসামাজিক কোনো আবশ্যকতা তার থেকে গেছে কিনা, কে নির্ধারণ করলেন? নাকি কোনো মানদন্ড জরুরি নয়? আপনি ভেবেছেন আপনার লেখা অন্যদের পড়ানো প্রয়োজন, আপনার পড়ানোর হক আছে, আপনি পড়িয়েছেন, এখানেই কি সমাপ্তি? যদি সেটাই বলেন, অধুনান্তিক প্রেক্ষাপটে ঠিক আছে, কিন্তু আধুনিকের নিরিখে নয়। চিরকালীন আধুনিকের যে পরিসর, সেখানে এই মানসিকতা হয়তো অচল। কবি-সম্পাদক/প্রকাশক-পাঠক ... এই ট্রিনিটি সেখানে অনিবার্য।
কবিতার স্থায়ীত্বের কী হবে? বাংলা কবিতার কিছু কিছু ফেসবুক-জাতক মনে হয় না কবিতা চিরকালীনতার দিকে আদৌ তাকাতে চান। একটি সদ্যরচিত কবিতা পড়িয়ে নিয়ে এবং কিছু হাততালি কুড়িয়ে নিয়েই তাঁরা খুশি। নিজের সেই লেখা তারপর তাঁরা বিস্মৃত হতেও বুঝি রাজি। অনেকে তো ব্লগপত্রিকা বা ওয়েবপত্রিকায় লেখা প্রকাশের পরেও আজকাল সন্তষ্ট থাকেন না, কোনো বিখ্যাত কাগজ-পত্রিকাতে লেখা বেরোলেও না। একটি প্রকাশিত লেখা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা সোল্লাসে ফেসবুকে তুলে দিচ্ছেন। আন্তর্জাল পত্রিকার লিংক দিয়ে অপেক্ষা করার মতো ধৈর্যও বুঝি নেই, সেই সঙ্গে কবিতাটাও পুরোপুরি দিয়ে দিতে হবে! ‘কবিসম্মেলন’, ‘কৃত্তিবাস’, এমনকি ‘দেশ’-এর মতো বহুল প্রচারিত পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাও কয়েকদিনের মধ্যে আমরা ফেসবুকে দেখতে পাই। খবরের কাগজের অসংখ্য কবিতা তো আছেই। তখনও হয়তো পত্রিকার সেই সংখ্যাগুলো হৈ হৈ করে বিক্রি হচ্ছে। খবরের কাগজটা আমাদের চায়ের টেবিল থেকে বিদায় নেয়নি তখনও। এ কি অনৈতিক নয়? দৃষ্টিকটু নয়? আপনার পাঠক আর কেন ওই পত্রিকার খোঁজ করবেন? তিনি তো আপনার লেখাটি পড়েই নিলেন!
কবিতার প্রতি এই ঝালমুড়ি মানসিকতা কি অধুনান্তিক গুণ?
সেটা যদি হয়, তাহলে সেটা আন্তর্জালের দোষ নয়। এবং একটি নতুন পরিসর আমাদের প্রয়োজন। শিল্পবিপ্লবের পরে যে আধুনিক জন্ম নিয়েছিল, আমাদের এখানে রামমোহন-রামকৃষ্ণ-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দর হাতে ও আত্মায়, বিশ শতক অবধি তা গড়িয়ে এসেহিল, কিন্তু বিগত শতকের পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধ তাকে সরিয়ে দিয়েছিল, এবং উত্তর-উপনিবেশের হাত ধরে দেখা দিয়েছিল অধুনান্তিক। তথ্যপ্রযুক্তির যে অসম্ভব বিপ্লব আজ আমাদের চোখের সামনে বাস্তব আর স্বপ্নকে এক করে ফেলছে, মনে হয় তার থেকেই আরেক আধুনিক জন্ম নিতে পারে। অধুনান্তিক এখনও ফুরিয়ে যায়নি। ফেসবুকে কবিতা চর্চা থেকেই বোঝা যায় আমরা আধুনিক থেকে এখনও অনেক দূরে। আধুনিক মানসিকতা থেকে এমনকি আমরা তরুণরাও অনেক দূরে। কিন্তু আমাদের জীবন এবং কবিতার স্বার্থেই আমাদের হয়তো এই ভঙ্গুর অধুনান্তিক পরিসরটিকে পেরিয়ে আরেক আধুনিকের স্বপ্ন দেখা জরুরি।
সোশ্যাল নেটওয়র্কিং সাইটে পরিচিত অপরিচিত কবিরা আড্ডা দিতে পারেন, কবিতার বইয়ের খবর দিতে পারেন, কোনো পত্রিকার প্রকাশসংবাদ দিতে পারেন, এমনকি নিজের লেখা ইনবক্সে বন্ধুকে পড়িয়ে মতামত নিতে পারেন, নিজের বা অন্যের কোনো বিস্মৃত লেখা সরাসরি পোস্ট করেই বন্ধুদের পড়াতে পারেন। এককথায় বলতে পারি, কবিতার প্রচার করতে পারেন, কিন্তু প্রকাশ নয়। ঠিক যেমন একজন মিশনারি হাটেবাজারে খেলার মাঠে সিনেমাহলে এমনকি গণিকালয়ে ধর্মপ্রচার করতেই পারেন, কিন্তু ওই জায়গাগুলোতেও ঈশ্বরের বাস থাকলেও ওগুলোকেই তিনি উপাসনাস্থল বানান না, সেটার জন্য একটা গীর্জা বা মন্দির বা মসজিদ প্রয়োজন হয়। আমি কি এখানে প্রতিষ্ঠানের কথা বলছি? অবশ্যই বলছি। একটি কবিতা পত্রিকা অবশ্যই একটি প্রতিষ্ঠান, এবং কবিতার স্থান সেখানেই। ফেসবুকও জনস্থলমধ্যবর্তী একটি প্রতিষ্ঠান, তার নিজস্ব বিধি এবং আইনকানুন আছে। ফেসবুক নিজেও চায় না তাকে কবিতা প্রকাশের জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা হোক। সে শুধু বন্ধুদের আদানপ্রদানের স্থান হয়েই থাকতে চায়। ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের স্থান। আমরা হয়তো তাকে তার উদ্দেশ্যের বাইরে গিয়ে ব্যবহার করছি। স্বীকার করতে হবে, আমি নিজেও করছি। আমিও তো ফেসবুকে ‘বাক্’-এর প্রচার করি, নিজের পুরোনো লেখা পোস্ট করি আর ফেসবুকে যে গ্রুপপত্রিকাগুলো তৈরি হয়েছে, তাদের নিজস্ব অবস্থান আছে, তারা নিজেদের অস্তিত্ব সমর্থণ করতে পারে। সত্যিই সিরিয়াস সুরে কাজ করতে চাইছেন কিছু মানুষ সেগুলোতে।
যাই হোক, ফেসবুক একটি ওয়েবসাইট মাত্র। পৃথিবীর অসংখ্য ওয়েবসাইটের মধ্যে একটি। সমগ্র আন্তর্জালের সঙ্গে তাকে এক করে দেখার কোনো কারণ নেই। সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাল আমাদের সত্যিই একটা ভিন্ন আধুনিকের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। পুনরাধুনিকের স্বপ্ন। সারা পৃথিবীতে লহমার মধ্যে আজ ছড়িয়ে পড়ছে বাংলা কবিতা। এখানে কোনো দুর্বলতার বা হ্যাংলামোর অবকাশ নেই। একে একমাত্র আলোকপ্রাপ্তির সঙ্গেই মেলানো যায়। বাংলা কবিতার একটা দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে এর ফলেই। দেখা দিচ্ছে ভবিষ্যতের লিটল ম্যাগাজিনগুলো। লিটল ম্যাগাজিনের যে মৃত্যু অসম্ভব, বাংলা কবিতাপত্র যে চিরজীবী, যে কোনো রূপেই হোক সে বেঁচে থাকবেই, এটা হয়তো বলার প্রয়োজন নেই। কবিতার ভবিষ্যত আজ এমনকি আগের চেয়েও ঊজ্জ্বল মনে হচ্ছে। কবিদের মেলবন্ধন আজ অনেক অনায়াস হয়ে উঠেছে। মুছে যাচ্ছে মহানগর আর জেলা সীমানা। মুছে যাচ্ছে বাংলা এবং বহির্বাংলার অলীক ভেদরেখা। যে কবি বাংলা কবিতা লিখছেন, তিনি ভারতীয় না বাংলাদেশী, সেটা বুঝে ওঠার আগেই আমরা তাঁর কবিতা পড়ে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। সুদূর নিউজিল্যান্ড থেকে, অস্ট্রেলিয়া থেকে কবিরা কবিতা দিচ্ছেন বাংলা ওয়েবপত্রিকাকে।
কোনো বাধা নেই।
বাংলা পৃথিবীর দেশটা এখন সারা পৃথিবীজুড়ে। সেই কারণেই বাংলা কবিতার দায়বদ্ধতা আজ এমনকি আগের চেয়েও অনেক বেশি হওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়। এক অপরিসীম সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের এখন নিজেদের সেই সম্ভাবনার যোগ্য হয়ে ওঠার প্রশ্নটির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

My Blogger Tricks

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন