--অদ্বয় চৌধুরী
একটি ফুটপাথ বেয়ে এগিয়ে আসে ছেলেটা। এবড়ো-খেবড়ো পথ। এঁকেবেঁকে
হাঁটতে হাঁটতে উপরের দিকে তাকায় সে। চারিপাশের নানান ধাঁচের পেল্লায়
কংক্রিট-কাঠামোর চাপে কুঁচকে যাওয়া আকাশটা এক লম্বা কালো হাত হয়ে ঝুলে রয়েছে। আহত।
ক্ষতবিক্ষত। তাই বোধহয় মেঘের ভেজা ব্যান্ডেজ জড়ানো। সেই ব্যান্ডেজের গায়ে কালো
বিন্দুর মতো কিছু একটা চুঁয়ে পড়ছে। একটা ঘুড়ি। রংহীন। অথবা সব রং গ্রাস করে নেওয়া
কালো রঙের। গোঁত খেয়ে নেমে আসছে, লাট খাচ্ছে। কেটে গেছে নাকি? রাস্তার মোড়ে পৌঁছে
দাঁড়ায় ছেলেটি। ঘাড়ের উপর নেমে আসা কংক্রিটের ছায়াপথ আর দিঘির টলটলে কালো জলের মতো
লম্বা এক বিল্ডিং-এর ফাঁক গলে বৃষ্টি ধেয়ে আসে, হঠাৎ। উদ্ধত একঝাঁক অতিদীর্ঘ
বল্লমের মতো, অবিরাম। ঘুড়িটাও উধাও হয়ে গেছে এই ফাঁকে। ব্যস্ত ট্রাফিক, জীবন। ক্রমশ
ধাবমান অন্তিম গন্তব্যের দিকে। গতিশীল সময়কে থামিয়ে দিয়ে ছেলেটা, সিক্ত, আহত, দৌড়াতে
শুরু করে। বিস্মৃতির কালো উপত্যকা পেরিয়ে। সারি সারি উদ্যত মৃত্যুথাবা এড়িয়ে। ওপারে
এক ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে যেখানে সময় বরফ-ঠাণ্ডায় প্রস্তরীভূত হয়ে আছে,
অনুভূতি আকাঁড়া বাস্তব ছাপিয়ে অধিবাস্তবকে আঁকড়ে ঝুলে আছে। দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে
যায়। আপনা থেকে।
--কলকাতার যীশু!
ক্যাফে। স্বচ্ছ কাচে আবৃত। ঠাণ্ডায় আবিষ্ট। দূর থেকে দেখলে
মনে হয় শববাহী গাড়ির পিছনের শবাধার। রাস্তার ধারে টেবিল, কাচের এপারে। আশপাশে
ছড়ানো আরও অনেক টেবিল যাতে আরও কয়েকজন বসে আছে। মেয়েটির হাতে একটি বই। সে বইটা
দেখছে। এবং রাস্তাও।
--মানে?
--নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। দু-দিকে উদ্যত মৃত্যু, তুমি তার মাঝখান দিয়ে/ টলতে টলতে
হেঁটে যাও।
সব্যসাচী
বুঝতে পারে। সুরঙ্গনা উচ্চশিক্ষিতা, অতিশিক্ষিতা। সব্যসাচীর থেকে কোন অংশে কম নয়। সব্যসাচী
টের পায়, আবার, আরও একবার। নতুন করে। সে আরও বেশি করে আকৃষ্ট হয় সুরঙ্গনার প্রতি।
--বুঝলাম!
কিন্তু সুরঙ্গনা, আমি তো কোন শিশু নই!
--না, তুমি
শিশু নও।
--তাছাড়া এখন
তো মেঘ ফুঁড়ে রোদ নেমে আসছে না। বরং, রোদ গলে গিয়ে বৃষ্টি হয়ে পড়ছে।
--ঠিক। আরও
ডিফারেন্স আছে। বল তো কি?
--এই... ঝাঁকামুটে
বা ফেরিওয়ালা বা দোকানী কি খদ্দের নেই এখানে। কেউ আঁতকে ওঠেনি।
--হুম।
--ভিখারি মা
নেই।
--রাইট।
--আর... বাইরে
কোন মায়াবী আলো নেই। নেই মায়াবী পরিবেশ।
বৃষ্টির
ফলাগুলো কাচের দেওয়ালে আঘাত করছে, আঁচড় কাটছে। ভেদ করতে না পেরে গলে গলে পড়ছে। কাচ
বেয়ে, ক্রমাগত। ব্যর্থ, তবু দাগ রেখে যায়। বাকি সব ঢেকে দেয়। বিস্মৃত অতীত। জীবিত
শুধু এই ঠাণ্ডা ঘর। এবং ওদের পিছনে বসে থাকা মানুষগুলো। স্থির, জড়। তবু জীবিত।
অন্তত বিস্মৃত নয়। বইটা বন্ধ হয়ে গেছে আগেই। এখন টেবিলের একধারে পড়ে আছে, জড়সড়, উলটানো।
মার্জিনালাইজড। সেন্টারে এখন মৃত্যুর দগদগে দাগওয়ালা গ্রীল্ড স্যান্ডউইচ, দাহ হয়ে
যাওয়া ব্রাউনি আর চুল্লির ধোঁওয়া ছড়ানো কফি। মেইন্সট্রীম সাবজেক্ট। সব্যসাচী দেখে
ওদের। তারপর সুরঙ্গনাকে।
--বই আর
খাবারের মধ্যে স্ট্রাগল্ ফর এগজিসটেন্স চলছে! দেখেছ সুরঙ্গনা?
--হি হি!
ঠিক বলেছ। এলাকা দখলের লড়াই। ক্ষমতার লড়াই।
--ডিসকোর্স
অফ পাওয়ারের জেনেসিস কিন্তু এই ডারউইন। মানতেই হবে।
--তা বলতে
পারো। তারপর নীৎশে।
--ফ্রয়েড,
লাকাঁ, ফুকো এবং দেরিদা। ছ’ জন। লাইনটা মোটামুটি এরকম।
--হুম। জেনেসিস...
শব্দটা... খুব ইম্পরট্যান্ট। পোস্টমডার্নিজমকেও ফিরতে হবে অতীতে। তাই না? না ফিরতে
পারলে... অতীত না থাকলে... সবকিছুই তো নীরব হয়ে যাবে... ফাঁকা। মেকী।
--কিন্তু এই
না-ফেরাটাই তো আসল লড়াই। পোস্টমডার্নিজমের... আমাদের। অতীতের শেকল ভেঙে বেরিয়ে এসে
আবার ফিরে যাওয়াটা অবাস্তব।
কাচের আবরণের
ওপারে অসীম ধূসরতা এখন। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বুলেটে পরিণত। একটা লোক দৌড়ে ক্যাফেতে
ঢোকে। সারা গায়ে বৃষ্টির সাথে যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন। টেবিলের খালি প্লেটগুলো
পেরিফেরিতে চলে গেছে। সুরঙ্গনার হাতের বইটা, এবং ব্যাগের আরও নতুন কিছু বই, ফিরে
আসে মধ্যিখানে। সব থেকে উপরে, যে বইয়ের নাম পড়া যায়, রিফ্লেকশন্স অন দ্য নেম অফ দ্য রোজ। উম্বার্তো একো। এক অদ্ভুত পরিবেশ ক্যাফের ভিতরে। স্বপ্নালু। নিরাপত্তার ছদ্ম
আশ্বাসে চোবানো। ছেলেটার ভাল লাগতে থাকে এই মায়াবী পরিবেশ। মেয়েটাকেও। বেশি করে,
ক্রমশ আরও বেশি। পৃথিবীর এক-কিনার থেকে অন্য-কিনারে সে ছুটে যায়। টালমাটাল পায়ে।
বাকিরা, বাকি সাত জন, পিছনে, স্তব্ধ হয়ে দেখে তাকে, তাদের। বিমূঢ়, নির্বাক। কিন্তু
মেয়েটা কথা বলে ওঠে, আবার।
--স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে,/ টাল্মাটাল পায়ে/ রাস্তার এক-পার থেকে অন্য-পারে
হেঁটে চলে যায়/ সম্পূর্ণ উলঙ্গ একটি শিশু...দু-দিকে উদ্যত মৃত্যু, তুমি তার মাঝখান
দিয়ে/ টলতে টলতে হেঁটে যাও।/ যেন মূর্ত মানবতা, সদ্য হাঁটতে শেখার আনন্দে/ সমগ্র
বিশ্বকে তুমি পেতে চাও/ হাতের মুঠোয়...।
--তুমিও কি কিছু
পেতে চাও সব্যসাচী?
চমকে ওঠে
সব্যসাচী। কান ও হৃদয়ের মধ্যিখানের দীর্ঘ পথ খুব দ্রুত পেরিয়ে যায় এই প্রশ্ন।
--এটাই কি
তোমার গুরুতর আলোচনা? আমাদের ভবিষ্যত নিয়ে?
--হয়তো তা
নয়। আবার, হয়তো তাই!
--হুম। আমি
পেতে চাই। তোমায়। তুমিই আমার বিশ্ব।
--জানি। তুমি
আমায় পেতে চাও... হাতের মুঠোয়। তুমি জয় করতে চাও বিশ্ব।
এক অদৃশ্য
খিঁচুনিতে কেঁপে ওঠে সব্যসাচী।
--আমি তোমায়
ভালবাসি সুরঙ্গনা।
--এই কথাটা
বহু পুরনো, সব্যসাচী। যুগ যুগ ধরে বহু মানুষ বলে আসছে এই কথা। তোমার নিজের কথা কই?
--তাহলে অতীতের
সেই মানুষগুলোকে উদ্ধৃত করেই বলি, “আমি তোমায় ভালবাসি”।
--হাহ!
অতীতে ফিরলে তাহলে? কিন্তু, আমরা কি সত্যিই অতীতে ফিরতে পারব? তুমি পারবে? পারবে
আমায় নিষ্পাপ, নিঃস্বার্থ ভালবাসা দিতে? শিশুর মতো? পারবে আবার শিশুর মতো সরল হতে?
--অতীতে না
ফিরলে কি শিশুর মতো সরল হওয়া যায় না সুরঙ্গনা?
--শৈশব
পেরিয়ে অভিজ্ঞতার সরণী বেয়ে এতখানি পথ এসে সরলতা খুঁজতে গেলে আবার অতীতেই ফিরতে হয়
সব্যসাচী।
--তাহলে
আমি, এইভাবে, জীবনের পরোয়া না করে, দৌড়ে এলাম কেন তোমার কাছে? এক বেপরোয়া শিশুর
মতোই কি এই আসা নয়?
--না। উদ্যত
মৃত্যুকে থামিয়ে, অগ্রাহ্য করে এতোটা পথ তুমি দৌড়ে এসেছ কারণ বাইরের ধারালো বাস্তব
তোমায় আহত করছিল। ক্ষতবিক্ষতও। তাই তুমি খোলসে আশ্রয় নিয়েছ... আরামদায়ক খোলস। নিশ্ছিদ্র,
নিরাপদ। তুমি... উলঙ্গ নও... মুক্ত নও। তুমি... কোন শিশু নও। তুমি... আমি... এই
সময়... হারিয়ে ফেলেছি... শৈশব। হারিয়ে ফেলেছি সরলতা; অতীত। আমরা... হারিয়ে ফেলেছি...
প্রেম।
সব্যসাচী
চেয়ে থাকে সুরঙ্গনার দিকে। একদৃষ্টে। নীরবে। পিছনের সাত জনও মৃতবৎ চেয়ে থাকে।
স্থির, অথচ নিরবচ্ছিন্ন সেই দৃষ্টি। সামনে, কাচের ওপারে, বৃষ্টি ফুঁড়ে, রাস্তা
থেকে উঠে আসে এক অবয়ব। এক উলঙ্গ শিশুমূর্তি। হাতে তার ধরা আছে জলে ভিজে, চুপসে
যাওয়া, ছেঁড়া একটি ঘুড়ি। রংহীন। অথবা কালো রঙের। ঠাহর হয় না ঠিক। সে স্পষ্ট হয়ে ওঠার
চেষ্টা করে ঝাপসা বাস্তব পেরিয়ে। ক্রমশ, একটু একটু করে। কাচের দেওয়ালে, দেওয়ালের
ওপারে, নিয়মিত সরলরেখায় নামতে থাকা উল্লম্ব জলধারাগুলোকে কাঁপিয়ে দেয়, বিশৃঙ্খল
করে তোলে তার ছোট্ট হাতের স্পর্শ। সরলতার উৎস থেকে জেগে ওঠা সেই কাঁপুনির পারে, দেওয়ালের
অপর প্রান্তে, পৃথিবীর অন্য কিনারে কি প্রেম আছে?
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন