সাক্ষাৎকার : বেবী
তোমাকে দেখলেই মনে হয় তোমার মধ্যে একটা
‘ক্ষ্যাপা’ রয়েছে । তোমার চোখের ওই চশমা যেন
ইঙ্গিত দিচ্ছে , দেখো – আমি অন্যরকম ! তোমার লেখার ঘরকে তুমি
বল ‘ল্যাব’ । তোমার লেখার স্টাইল একেবারেই আলাদা ।
এসব কি সচেতনভাবে নিজেকে আলাদা প্রমাণ করার চেষ্টা ? নাকি , এসব মিলেই তুমি একটা প্যাকেজ ?
খুব একটা সচেতন প্রয়াস নয়... যেমন চশমা
বা ল্যাব বা চোখ... শেষেরটায় আমার কিছু করনীয় ছিলনা... প্রথমটা, প্র্যাক্টিক্যালি ছোটবেলা থেকে আমার
আইডল, রাঙাকাকু
এবং আমার ডিয়ারেস্ট ভিলেইন, আমার
বাবা দুজনেই কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পরতো... প্লাস আমার প্রথম গডফাদার, আমার রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণ এবং সংস্কৃত শিক্ষক
ঠাকুর্দার পেটেন্ট ছিল কালো মোটা ফ্রেমের চশমা... ফলে আমার একটা আনক্যানি লাইকিংস
ছিল তার প্রতি... ল্যাব, এ্যাকচুয়ালি
আমি নিজেকে টু সাম এক্সটেন্ট, টু সাম এক্সটেন্ট নয় সবটাই, বিজ্ঞানী মনে করি... তাই আমার কাজ হলো
প্রজেক্ট আর লেখার জায়গা ল্যাব...... পরে দেখেছি যখন এগুলো আমাকে আলাদা করছে, তখন সেটাতে বাধা দিনি, সচেতনতা এটুকুই
প্যাকেজ শব্দটাতে আমার আপত্তি নেই...
আই লাভ দ্যাট ওয়ার্ড... ইট'স
ট্রু আই এ্যাম এ প্যাকেজ... এ্যাজ এ হিউম্যান বিইং, এ্যাজ এ রাইটার, এ্যাজ এ রিসার্চার, আই এ্যাম এ প্যাকেজ... লাভ ইট অর হেট
ইট, বাট
কান্ট ডিনাই ইট...
আর হ্যাঁ, লেখার স্টাইল নিয়ে, আমি সিরিয়াসলি কোনদিনই ভাবিনি... ভাবতে
হোক কখনোই চাইনা... ট্রাস্ট মি...
অবিশ্বাসের কোনো প্রশ্নই আসছে না এখানে
। তবুও লেখার স্টাইলের কথা যখন এলো , সেই প্রসঙ্গেই আরও ডিটেলে জানতে চাইবো
তোমার কাছে । তোমার লেখায় শব্দকে ভাঙতে দেখি , বাক্যকেও । হিন্দি , ইংরেজির মিশেল দেখি । তোমার একটা
নিজস্ব স্টাইল তৈরী হয়েছে , এটা
ভালো কি মন্দ সে প্রসঙ্গে না গিয়ে জিজ্ঞেস করব – তোমার কবিতায় কি লিরিক আছে বলে তুমি
মনে কর ? অর্থাৎ
তোমার কবিতা কি যথেষ্ট লিরিকাল ?
দেখো, লিরিক
নিয়ে একটা চরম ভুলধারণা আছে... যে ভুলধারনা চলে আসছে জয় গোস্বামীকে লিরিক্যাল বলা
থেকে...লোকের মনে একটা ধারণা আছে লিরিক্যাল মানে হলো কিছু মিষ্টি মিষ্টি শব্দ
ব্যবহার, আমি-তুমি-তোমার-সন্ধ্যে-ফুল-ফল-নদী-সাঁঝ
ইত্যাদি... বারীনদা, রঞ্জনদার
কবিতা ও পরে আমার কবিতাকেও লিরিক্যাল বলতে গিয়ে লিরিকের অন্যরকম ব্যখ্যা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন "এমন সাউন্ডের ব্যবহার
যা সঙ্গীতের কাছাকাছি"... এটা লিরিকএর এ্যাকচুয়াল ধর্মের বেশ কিছুটা কাছে
যায়... তারপরেই বারীনদা স্বভাবসিদ্ধ মিষ্টি হুমহাম ভঙ্গিতে বলেছিলেন "এটা
বাঙালী কবিদের জন্মগত দোষ, বিদ্যাপতি
চন্ডীদাসের সময় থেকে চলে আসছে"... এই জায়গাটায় আমি মতফারাক করি... সেই অর্থে
দেখতে গেলে, অর্থাৎ
মিষ্টি সাউন্ডের ব্যবহারে বিদ্যাপতি লিরিক্যাল কিন্তু চন্ডীদাস অনেকটাই নন
লিরিক্যাল "সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল"... এখানে অনলে
পুড়িয়া গেল খুবই নন লিরিক্যাল... যাক সে তর্ক... আমি মনে করি ক বিতাতো একটা
সাউন্ডস্কেপ... ধ্বনি থেকে ধ্বনিতে পাঠক নামরূপী জীবটিকে ঘুরিয়ে মারছি, নিয়ে যাচ্ছি হাতি থেকে হট্টাকট্টা হয়ে
হট্টমেলায়... সেখানে এই ধ্বনি প্রযোজনা দু রকম হতে পারে...... দুটোই সঙ্গীতের
কাছাকাছি... ধূর্জটিপ্রসাদ উচ্চাঙ্গসঙ্গীত নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, গলা দুরকম, এক বাঁশির মতো, আরেক তারযন্ত্রের মতো... বড়ে গুলাম আলি
প্রথম ঘরানার আর আমীর খান দ্বিতীয় ঘরানার...... তো গানের যুক্তিটা খাটে না......
আমি মনে করি লিরিক লুকিয়ে থাকে ধ্বনিজার্নিতে...... ধরো আমি লিখলাম ফোন আসে/ফোন
কাটে/ কেটে যায় কট্টর মরুভূমি... এবার "কেটে যায় কট্টর মরুভূমি" একটা
আদ্যন্ত নন লিরিক্যাল উচ্চারণ... কিন্তু আমি যেই আমি এর পরের লাইনে লিখলাম
"কেটে যায় কট্টর মরুভূমি/ যেন থরথর করে আবেদন/ ফেরিওয়ালা লুপ্ত হয়ে
গেল"তখন ওই আদ্যন্ত্য নন লিরিক্যাল উচ্চারণও সুট করে লিরিকের আওতায় ঢুকে
পড়ে...... তার কারন কি? না
পরের একটি ক্রাফটেড অতিলিরিক্যাল অতিভাষ্য...... বহুকিছু বলা যায়...... আপাতত
এটুকুই... বলা যায় আমি অতিলিরিক্যাল কবি (যদি না বললে গর্দান যাবে এমন কন্ডিশান
থাকে)... আমি লিরিক ও নন লিরিক একাদিক্রমে ব্যবহার করি অতিলিরিক সহযোগে একটা
ইচ্ছাকৃত মনোটনি ক্রিয়েট করার ও ভাঙার জন্য
তোমার লেখালেখির সূত্রপাতের সঙ্গে আজ
পর্যন্ত বারীন ঘোষালের 'নতুন
কবিতা'-র
ধারণার যোগ কতটা ?
যখন সরাসরি নতুন কবিতার জেহাদের মধ্যে এসে পড়লাম তখন বিন্দুমাত্র অচেনা
লাগেনি কোনকিছু। কোন ইস্তেহার, কর্মসূচীর অস্তিত্বের প্রয়োজনবোধ হয়নি। প্রয়োজনবোধ হয়নি কবিতার ক্লাসের বা
কোন ইজম ঠেসে তোষক বানানোর জীবনযাপনের জন্য। সবই ছিল চেনা, মেনে নেওয়া অংশ, মেনে না নেওয়া অংশ, সবই খুব স্বাভাবিক, এমনই-তো-হওয়ার-কথা জাতীয় এ্যাটিটিউড
ছিল, উন্নাসিকতা
নয়। বলতে গেলে যখন সরাসরি বারীন ঘোষাল-স্বপন রায়-রঞ্জন মৈত্র-প্রণব পাল-অলোক
বিশ্বাস-ধীমান চক্রবর্তী এই ভুবনে এসে পড়লাম তখন কোন বিলেতবোধ হয়নি, উলটে মনে হয়েছিল দেশের বাড়ি ফিরেছি
বহুদিন বাদে।
মুগ্ধবোধ ও তার উষ্ণতাই ছিল যথেষ্ট।
জলশহর আমাদের দুটো বড় দামী নি-শব্দ শিখিয়েছিল "নির্বিচার" আর
"নিজস্বতা"। নির্বিচার কেমন? না কলেজে লোপামুদ্রার গাওয়া
"বেণীমাধব" বার বার চালিয়ে শুনেছি, এঞ্জয়ও করেছি। বা ব্রততীর "আমিই সেই
মেয়ে", পুরোদমে
উপভোগ করেছি। কিন্তু না ইন্দ্রনীল না আমি, কেউ কখনো ভাবার প্রয়োজনবোধ করিনি
আমাদের লেখায় কি আবৃত্তিযোগ্যতা আছে কি নেই, রাখবো কি রাখবো না। কারন ওটি বিশুদ্ধ
অপ্রাসঙ্গিক, মাথা
ঘামানোর বিন্দুমাত্র কারন নেই। দুজনেই এন্তার ছন্দে লিখেছি নাছন্দে লিখেছি, এবং খুব স্বাভাবিক ভাবে ও বিষয়ে সময়
নষ্ট করার প্রয়োজনবোধ করিনি। সাত মাত্রা না সাত দশমিক তিন রেকারিং মাত্রা, এ নিয়ে তর্ক বিতর্ক করা যে বৃহৎ
গান্ডুমি তা দুজনে অবলীলায় হৃদয়ঙ্গম করে গেছি। পরে যখন ছন্দের অপ্রয়োজনীয়তাটি বেশী
মূল্যবান আমাদের রাস্তায় তা বুঝেছি ও নেট প্র্যাক্টিসে নেমেছি, তখনো একটি প্রবণতা চতুর্দিকে প্রকট।
প্রবণতাটি হলো, দেখো
আমি ছন্দে জিনিয়াস, চাইলেই
লিখে দেব বাঘা কবিদের মতো ছন্দে, মারকাটারি মর যানা প্রেমের গন্ধে, চাইলেই আর্টেজীয় কূপের মতো উপচে দিতে
পারি তোমাদের তুখোড় কবিতা দিয়ে, এই সব পারি কিন্তু করিনা, এবার বুঝেছ আমি কে? হুঁ
হুঁ বাবা আমি গজু বসু, আমার
মাথা শসার মতো ঠান্ডা। এই যে প্রবণতা, আমি চাইলে তোমার হীরোকে হারিয়ে দিতে
পারি, তবু
আমি কমন ম্যানের রোলে এ্যাক্টিং করি, এটির প্রতি রিপালসান কাজ করতো বড়।
হাস্যকর লাগতো। বরং সরাসরি নতুন কবিতার হৃদয়ে এসে পড়ার পর অনেক জরুরী লেগেছিল
নিজস্ব প্র্যাক্টিস তৈরী করা... যে প্র্যাক্টিস পরিশ্রম স্বপন রায়ের মেঘান্তারার
স্বর্গীয় কবিতাদের মধ্যে আছে তাকে প্রতিবিন্দু অবধি সন্ধানের চেষ্টা করছিলাম, কুয়াশা কেবিন, ডুরে কমনরুম পড়ে ধাপগুলো স্টাডি
করছিলাম, ভাবছিলাম
"সুবর্ণরেখা রানওয়ে" থেকে "সেভেন বেলোর বাড়ি" যাওয়ার রাস্তাটা
কিভাবে তৈরী হয়েছে, কিরকম
ভাবে মোড় ঘুরেছে "ভাষাবদলের কবিতা" বা রূপসা পিয়ানো।
আর এর সবসাথে ছিল বারীন ঘোষালের একেকটা
গদ্য লেখা নিয়ে নুনুতে এ্যাসিড বাল্ব মারার মতো... যা পড়তাম, পড়ে অবধারিত রাগতাম আর সারাক্ষন
রাস্তায় অফিসে একটা মানস বারীন ঘোষাল নিয়ে ঘুরতাম, যাকে আমি পদে পদে দুরন্ত যুক্তি দিয়ে
বুঝিয়ে দিচ্ছি কেন ওনার ছাব্বিশ দফা প্রতারনা মানিনা। বোতলে বন্ডেল গেটের বাংলা জল
মিশিয়ে খেতে খেতে বালীগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে হেঁটে হেঁটে বাঘা যতীন ফিরছি মাঝরাতে একা, সারা রাস্তায় বারীন ঘোষালকে নানান জুডো
ক্যারাটের প্যাঁচে পর্যুদস্ত করছি কারন উনি সেভেন বেলোর বাড়ির মুখবন্ধে কেন বলেছেন
"সুবর্ণরেখা রানওয়ের সময় রঞ্জন তার প্রতিকবিতার স্তরটি পেরোচ্ছিল"।
উত্তেজিত কথোপকথন চলছে হাঁটার সাথে, যুক্তি-প্রতিযুক্তি, আর ফুটপাথের মহিলা তার বাচ্চাটিকে বলছে
"পাগলা হ্যায় রে। পাস মত যা, কাট দেগা"... সুবর্ণরেখা মুগ্ধ আমি রঞ্জনদাকে চিঠি লিখতে গিয়ে হঠাৎ
আবিষ্কার করছি এমন সব বাক্য আমাকে কে লিখিয়ে নিল... ফাঁকা ঘরে কাল্পনিক বারীন
ঘোষালকে আমি কাট কাট গলায় বলছি "আপনার অতিচেতনার কথা একটা বাল। আমি আপনার
সামনেই প্রমান করতে পারি" (তখনো বারীনদা 'আপনি', কারন মুখোমুখি কথা তো মাত্র কয়েকবার), বলে খাতা খুলে একের পর এক যুক্তি
শানিয়ে নেওয়া, লিখে
লিখে দেখানো আর আমার ঘরের মেঝেতে মাঝে মাঝে পত্রমোচী কোরেক্স গাছ থেকে ঝরে পড়ছে এক
একটা খালি কোরেক্স বোতল, উড়ে
যাচ্ছে আট প্যাকেট চ্যান্সেলার। এবং আমি জানি খানিকক্ষণ বাদে চাটু-দেবা আসবে, বা আমি ইন্দ্রকে ফোন করবো আর আমার কোন
এক শিহরণ জাগানো চিন্তাবিষ্কার বলে আরেকপ্রস্থ তর্ক শুরু করবো। জহর সেনমজুমদার
নাকি বারীন ঘোষালকে গুরুবাদ দোষে অভিযুক্ত করে বাংলার কবিদের বিপথে চালনার দায়
চাপিয়েছেন। জহরদা, আপনার
সাথে কাটানো দুরন্ত সন্ধ্যাগুলি, গরফায়, মনে
পড়ে। আপনাকে বিনীতভাবে বলি বারীনদার গুরুদেবত্ব এখানেই যে, ওনার থেকে রাস্তার হদিস তারাই পেয়েছে
যারা ওনাকে যুক্তিসঙ্গতঃ ভাবে নিরবিচ্ছিন্ন খিস্তি মারতে পেরেছে নিজের কাছে
বিশ্বাসযোগ্যভাবে। "তোকে শালা মানবো না, তুই কে? দেখ আমিও নতুন পথ বাৎলাতে পারি"
বলে যে সার্থকভাবে নিজের ঝাঁট জ্বালিয়েছে, সেইই অজান্তে নিজের রাস্তা খোঁজার
স্পার্ক পেয়ে গেছে। সেদিক দিয়ে আপনিও। মানুষ খাট-বালিশ-বিছানা চাদরের মধ্যে মহাভুল
খোঁজে না, খোঁজে
পিকাসোর পেইন্টিং বা সার্তের জীবনদর্শনের মধ্যে। (এই প্রসঙ্গে ঋত্বিকের বার্গমান নিয়ে
একটা ইন্টারভিউ থেকে তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছিনা। "বার্গম্যানকে জোচ্চোর
বলেছি। বলতে গেলে অনেক কিছু বলতে হয়...... প্যাগান ফিলোজফিকে আনার জন্য ইমোশানাল
সারচার্জ, গুরুদেব
তৈরী... এই যে গুল - এগুলো কী? What is this 'Seventh Seal'? Terrific জোচ্চোর বলেছি এই জন্য যে- জোচ্চোর তো
যাকে তাকে বলা যায়না। জোচ্চোর কাকে বলবে? - One of the supreme brains, one of
the supreme technicians, যে জেনেশুনে বদমায়েশি করছে। গাধাদের কাছ থেকে তো এটা আশা করা যায়না - যে
জোচ্চুরি করতে জানে না। If he doesn't know the truth he cannot cheat. So knowing fully well he
is cheating. Do you follow me?) বারীনস্তুতি নয়, এই
কথাগুলোর বলা প্রয়োজন, জানা
প্রয়োজন 'নতুন
কবিতা' বাংলা
লেখাজগতের সবচেয়ে মেধাবী মুভমেন্টটির মোডাস অপারেন্ডিকে বুঝতে হলে। বারীন ঘোষাল
গুরুদেব নয়, অগুরুদেব।
যে তোমার চিন্তাভাবনায় চ্যালেঞ্জের অগুরু মাখিয়ে দেবে যাতে তার থেকে তুমি স্পষ্ট
মৃতদেহের গন্ধ পাও আর হৃদয় নয়, মেধা নয়, খাস
তোমার প্রাণের, অস্তিত্বের
আঁতে লাগে। আর খোদ প্রাণ লাফিয়ে উঠে নতুন রাস্তা খুঁজে তার কলার চেপে ধরে
"কোন বাঁড়া বলে আমি মরদেহ??"। সোনারি ওয়েস্টের আট নম্বর বাড়িতে প্যান-ফ্রায়েড কৌমার্য নিয়ে মহুয়া ঢুকে
যায়।
এভাবেই আমরা ঢুকেছিলাম নতুন কবিতায়।
অনেকে জিজ্ঞেস করে "বেবীদা তুমি নতুন কবিতা 'করতে'?" বলি, "কখনোই না, আমি এস এফ আই করতাম"... এর কারন
অনেকের ধারণা নতুন কবিতা বোধহয় একটা কলেজ বা লার্ণিং প্রোগ্রাম, যার থেকে ডিসটিংশান সহকারে অমিতাভ
প্রহরাজ, ইন্দ্রনীল
ঘোষ, অনুপম
মুখোপাধ্যায়, অনির্বান
চট্টোপাধ্যায়, দেবাঞ্জন
দাস প্রমূখ পাস করে বেরিয়েছে। তাদেরকে ব্যাপারটা বোঝাই। আসলে বোঝার এই সঙ্কটটা হয়
কারন আমাদের শঙ্খচূড় বাংলা কবিতার লিগ্যাসী দেখিয়েছিল মুভমেন্ট দু প্রকার, এক) বিশেষ যাপন নির্ভর দুই) বিশেষ
এ্যাজেন্ডা নির্ভর। নতুন কবিতা এই দুইটির কোন একটিও নয়। এর কোন গন্তব্য ছিলনা, কোন ম্যানিফেস্টো না, বিশেষ জীবনযাপন না এবং সবার উপরে
বিন্দুমাত্র জার্গন বা লেবেলিং না। যে জার্গন বা লেবেলিং এর অভ্যেস এখন কোথাও
কোথাও লক্ষ্য করা যায়, তা
নিখাদই মধ্যমেধার ফলে উদ্ভূত আধবোঝার ফল। নতুন কবিতা ছিল একটা সময় ও সেই সময়ে
সবচেয়ে অব্যর্থ ও প্রয়োজনীয় চর্চার নাম। চর্যা নয়। সময়ের বৌ হল ঘটনা আর রাখেল হলো
সঙ্কট। তো এই সঙ্কটের সাথে ইন্টুপিন্টু চালাতে গেলে বৌকে এক্কেবারে না জানিয়ে, কিছু চর্চা বা প্র্যাকটিসের প্রয়োজন
পড়ে। আমরা অমোঘ পুনরাবৃত্তির সঙ্কটে পড়েছিলাম। এতদিন অবধি একে টক্কর নেওয়ার তরিকা
ছিল ক্লাসিক বা ধ্রুপদী জাতের মধ্যে তাকে ঠেলেঠুলে ঢুকিয়ে দেওয়া। দিলেই সমস্যা
শেষ। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি যুগে এসে ধ্রুপদের জিনা হারাম হয়ে উঠলো আর সে আত্মহত্যা
করলো। কারন ঘটনার পপুলেশান বাড়তে বাড়তে বার্স্ট করে গেল, আর কোনটা ইনফর্মেশান বা তথ্য, কোনটা এক্সপিরিয়েন্স বা অভিজ্ঞতা আর
কোনটা রিয়ালাইজেশান বা বোধ, সব
গুলিয়ে একাকার হয়ে গেল। ভিক্টোরিয়ার দুপুর রোদে প্রেমিকার প্রথম স্তনস্পর্শ করলো
প্রেমিক, এক
অনির্ব্বচনীয় অভিজ্ঞতা, সেটা
হয়ে গেল ৩৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসে ম্যামারি গ্ল্যান্ডের এপিথেলিয়াল লেয়ারের ওপর কতটা
প্রেসার অপ্টিমাম এক্সাইটমেন্ট আনবে পিটুইটারিতে!! একটা ইনফর্মেশান। ফলে এই ঘোর
অনাচারে দীর্ঘবিলাসী ধ্রুপদের কোন স্থান নেই। তাহলে এই অমোঘ পুনরাবৃত্তির সঙ্কট
আটকানোর একটাই উপায় বেরোলো, নিরবিচ্ছিন্ন
ও নিরঙ্কুশ নতুন উৎপাদন। এইখানে সবচে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, 'উৎপাদন' এই ক্রিয়াটিই হলো মূখ্য। উৎপাদিত
দ্রব্য নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। নতুন কবিতা মুভমেন্টের নামকরনে এই গন্ডগোলটা থেকে
গেছে বলে পরে প্রচুর কনফিউসান তৈরী হয়েছিল। আসলে হওয়া উচিত "নতুনভাবে
কবিতা" মুভমেন্ট। এই "ভাবে" টাকে যে যার প্রয়োজনীয়তা মতো চিহ্নিত
করেছিল। মানে ধরা যাক a b c d e f g h I j k, এই দশরকম পুনরাবৃত্তি বা মনোটনি আক্রান্ত ছিল সেইসময়ের কবিতা। এবার দশটিকেই
আমূল ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে তার কোন মানে নেই। কেউ a,b,g,h,I,k কে এ্যাড্রেস করবে ঠিক করলো, কেউ মনে করলো d,e,f,g,h,I থেকে মুক্তি পাওয়াটাই প্রধান লক্ষ্য।
এভাবেই যে যার প্রয়োজন তৈরী করেছিল। এবং এর কোন লিখিত থাম্বরুল ছিলনা। কয়েকটা কমন
অস্বস্তি ছিল, যেগুলোকে
বারীন ঘোষাল কবিতাধারার মুক্তি নাম দিয়ে পয়েন্ট আউট করেছিলেন। এই যা।
পুনশ্চঃ "নতুন কবিতা" থেকে
তো বেরিয়ে এসেছি বহুদিন কিন্তু "নতুনভাবে কবিতা"য় মগ্ন আছি চিরকাল... নতুন
কবিতা আমার হাত চিন্তা ভাবনা গড়েছে যাতে আমি ভেবে ফেলেছি "নতুনভাবে
কবিতা", এক নেভারএন্ডিং প্রসেস... ওই চর্চা
সময়কার সেন্সরগুলিও তুলে নিয়েছি এক এক করে... নতুনভাবে ব্যবহারের জন্য... গতবছর
ভালোপাহাড়ে পেলাম, পড়লাম সব্যসাচীর "পসিবিলিটি
টিসিবলিপ"... পাহাড়ের মতো "জীয়ো" বেরোল বুক থেকে... এইতো
নতুনভাবে... আমার চেয়েও নতুনভাবে...
তাহলে তোমার কবিতাকে ভাষাবদলের কবিতা বলা যেতে পারে কি?
দেখো ভাষাবদলের কবিতা এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কাকে বলে আমার জানা নেই...
প্রণবদা একটা কাজ করেছিলেন... সেটা মূলতঃ নামধাতু আর বিশেষ্য কে বিশেষণায়ণ দেদার
ভাবে... তাকে স্যালুট...... ওরকমভাবে নিজের কবিতা ছেড়ে একটা ভাষাকে বদলাবার
চেষ্টায় এবং চেষ্টাটাকে প্রকটভাবে দেখানোর ওই প্রয়াস প্রণবদা ছাড়া আর কেউ
করেননি... এটা শীর্ষে পৌঁছোয় শাস্ত্রহীন চলার বেদনায়... প্রণবদার এই
স্যাক্রিফাইসকে স্যালুট...... কিন্তু আক্ষরিক ভাষাবদলের চেষ্টা সব কবি, পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের যেকোন কবি, এমনকি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত করেছেন...
সত্যেন দত্তও করেছেন... কারন সৎ কবি মাত্রেই তা নিজস্ব ভূখন্ড নিজস্ব ভাষা তৈরী
করতে চায়... আর তা করতে গেলে অনিবার্য ভাষা বদলানো...... হয় চালু ভাষা বদলানো, নয়তো সর্বাধিক স্বীকৃত কবির ভাষা
বদলানো (কল্লোল, অমিয়
চক্রবর্তী), নয়তো
অন্য স্ফেয়ারের ভাষা বদলানো (কমলকুমার, বারীন ঘোষাল, প্রথমজনকে কবি বলেই মনে করি)...... এর
থেকে আলাদা কে বলো??? তুমিও
আলাদা নও
বোঝাতে পারলাম কি? যেমন
"কবি শব্দটি লিখতে তুমি কি ক ব্যবহার কর?" একইরকম একজন কবিকে প্রশ্ন করা
"তুমি কি ভাষাবদলের কবি?’ একই ব্যাপার ।
"ভাষাবদল"
এই টার্মিনোলজি বা জার্গনাইজেশানে আমার ভয়ঙ্কর আছে...... এটা বড্ড বোকা বোকা... এ
যেন কম্পিউটারে লিখছে বলে "টাইপিস্ট কবি" নামে একটা ঘারানা তৈরী
করা...... তবে এই সবের থেকে প্রণবদার কাজটা কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা...... প্রণবদা, নিজের কবিতা ফেলে, একটানা ১৫-২০ বছর কি তারও বেশী
"ভাষাবদলের কবিতা" লিখে গেছে...... সেটা একটা আপসেই হতে থাকা প্রসেস যে
কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় তা চোকঝে আঙুল দিয়ে দেখানোর কাজ...... প্রত্যেক
কবির ভাষাই বদলানো ভাষা... বলতে গেলে প্রত্যেক মানুষেরই... কসবা লাইনের মিনিবাসের
কন্ডাক্টরের ভাষা আর বরানগর রুটে এলে বদলে নিতে হয়...... আই এস আই এলে
"টেস্টিক্লস, টেস্টিকল্স
এসে গেছে" বলে চেঁচাতে হয়
গোড়ার কথায় ফিরি... তো এভাবেই আমরা নিজেদের মতো করে নতুন কবিতার প্রয়োজনীয়তা
অনুভব করেছিলাম, আর
সম্পর্কে নেমেছিলাম... কোথাও কোন বইতে লেখা ছিলনা, কোন স্যার বলে দেননি, কিন্তু কি অদ্ভূত ইন্দ্রনীল, আমি, অনির্বান, দেবাঞ্জন, আমরা ধীরে ধীরে ক্রিয়াপদ কমাতে লাগলাম, বিশেষণ-ক্রিয়াবিশেষণ বন্ধ করে দিলাম, উপমা রূপক অলঙ্কার এড়িয়ে গেলাম, 'মতো' 'যেন' ব্যানড করলাম, গল্প হটিয়ে দিলাম ইত্যাদি... একদিনে না, আত্তীকরণের মতো এসেছিল এই প্রসেস...
এবং এই প্র্যাকটিস চললো বছরের পর বছর, প্রায় আট ন বছর ধরে... কেউ পদস্থলন হলে
অন্যজন তার ভুল দেখিয়ে দিত... বাইরে থেকে মনে হবে যেন কন্ডিশন্স এ্যাপ্লাই কবিতা বা
ইচ্ছে করে কবিতাকে প্রতিবন্ধী করা। কিন্তু বাস্তবে এটা একটা প্র্যাকটিস, শচীনের অফে একটাও শট না খেলে সেঞ্চুরি।
একটা কনফিডেন্স জন্মানো নিজের মধ্যে যাতে সম্ভাবনা অসীম এই জিনিসটি হাতে কলমে ফীল
করতে পারি।
এই হাতে-কলমে ছিল একটা জবরদস্ত হাতিয়ার। কলেজ থেকে নতুন কবিতা হয়ে যে
জোনটায় পা রাখতে যাচ্ছিলাম তা হলো এক নতুন চিন্তাপদ্ধতি, স্বকীয় থট প্রসেস তৈরী করা লেখা
সম্বন্ধিয়। তার জন্য প্রয়োজন পুরোনো থট প্রসেস কে হাতে কলমে বাতিল দেখানো। উপলব্ধি
করা, উপলব্ধ
দেখানো আর উপলব্ধি দেখানো। এদের মধ্যে প্রথমটি সময়ের অতিকায় প্রয়োজন থেকে জন্ম
নিয়েছিল, দ্বিতীয়টি
সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছিল আর তৃতীয়টিই ছিল বোধকে মেধাকে চ্যালেঞ্জ।
বুঝতে পারছিলাম কবিতার শুরু শেষ বলে
কিছু হয়না। কি হয় তা নিয়ে বিস্তর মতবাদ ছিল, কেউ
পৃথিবীর সব কবিতা একসাথে মিলে একটাই মহাকবিতা, কেউ
কবিতার প্রতিটি পরমাণুই কবিতা, কেউ
কবিতা আত্মা, ইত্যাদি। এ নিয়ে মাথাব্যথা ছিলনা, এগুলির অপশান তো ইনফিনিটি, মানে শুরু ও শেষ না থাকা মানে কবিতা
কিরকম হতে পারে, তা তো অসীম সম্ভাবনা। বাংলা কবিতার অ'পূর্ব' ভিলেনটি
এ্যাসিড বাল্ব ছুঁড়ে দিয়েছিলেন আর আমি "চ্যালেঞ্জ নিবিনা শালা" বলতে
উদগ্রীব ছিলাম...
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন