অনুপম মুখোপাধ্যায়
অনিমিখ চক্রবর্তীর কল্পনাশক্তি : একটি পুনরাধুনিক উপন্যাস
অনুপম মুখোপাধ্যায়
অনুপম মুখোপাধ্যায়
২
এই স্কুলে
যাতায়াতের অনেকটা সময় বাঁচলেও, ক্লাসের
চাপ মোরগমারির চেয়ে ঢের বেশিই থাকবে। অনিমিখের আগের স্কুল ছিল মাধ্যমিক পর্যন্ত, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা চারশোর আশেপাশে। সেখানে এই নতুন স্কুলের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দেড় হাজারের উপরে। প্রতিটি শ্রেণিতে পাঁচটি সেকশন। শিক্ষকদের মধ্যে ভূগোল পড়ান মোটে আর তিনজন মাস্টারমশাই। অর্থাৎ দিনের মধ্যে তাকে কম করেও ছ’টা ক্লাস নিতে হবে, সাতটাও নিতে হতে পারে। আগের স্কুলে সে দিনে চারটের বেশি ক্লাস নেয়নি।
অনিমিখের মন একদমই মরে গেল। মোরগমারিতে প্রতি পিরিয়ডের ফাঁকে সে অবকাশ পেত। তখন বই পড়ত। সম্পাদকদের সঙ্গে কথা বলত ফোনে। মাস্টারমশাইদের হোস্টেলে ঢুকে টিভি দেখত। সিগারেট টানত। মন দিয়ে গদ্য লিখত। জীবনের বেশির ভাগ গদ্য সে স্কুলে বসে লিখেছে। কেউ বিরক্ত করেনি। তার লেখক পরিচয়টা নিয়ে সহকর্মীদের মধ্যে বেশ সমীহ ছিল। এখানে সেই সুযোগ নেই। আটচল্লিশজন মাস্টারমশাই এখানে পড়ান। তাঁদের
আসা-যাওয়ার উপরে খুবই কড়া নজরদারি আছে। ঠিকঠাক সময়ে আসতে হবে, বিদ্যালয় ছুটির পরে আবার সই করে বেরোতে হবে। এরকম কড়া নিয়মের মধ্যে বাঁচার অভ্যাস অনিমিখের নেই।
ছাত্রছাত্রীরা
অবিশ্যি এখানে অনেক আলাদা। ঝরঝরে কথা বলছে সবাই। সকলের পোশাক সাফ এবং ইস্ত্রি করা। অনেকেরই পকেটে সাইলেন্ট
মোবাইল। অধিকাংশ ছেলেমেয়েই পড়া করে এসেছে খুব যত্ন নিয়ে। মোরগমারির
ছেলেমেয়েরা অধিকাংশই খালি পায়ে স্কুলে আসত। হাঁটু অবধি লাল ধুলো। ময়লা জামার অনেক জায়গা ছেঁড়া থাকত। গ্রাম্যতার সঙ্গে কথা বলত। কথাবার্তা শুনে বিরক্তিও জন্মাত। অল্প কয়েকজন ছাড়া পড়া দিতে পারত না। কিন্তু তাদের মধ্যে আন্তরিকতাটা ছিল। এখানে ছাত্রছাত্রীদের কাছে সেটা ওইভাবে সে পাবে না। এখানে সম্পর্কটা আরো শোভন হলেও অনেকটাই মেকি হবে বলে মনে হয়।
প্রথম কয়েক
ঘন্টাতেই হাঁফিয়ে উঠল অনিমিখ। বিপন্ন বোধ করল। তার বাড়ির একেবারে কাছের হলেও এই বিদ্যালয়ের ছাত্র অনিমিখ নয়। কোনো মমতা আলাদা করে এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি তার নেই। যাতায়াতের দূরত্ব কমানো ছাড়া আর কোনো কারণও নেই এখানে চাকরি করতে আসার। এই স্কুলটিতে থাকলে অবিশ্যি তার নিজের সঙ্গেই দূরত্ব অনেকখানি
বেড়ে যাবে মনে হচ্ছে।
কিন্তু
আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই।
পরপর তিনটে
ক্লাস করার পর চতুর্থ পিরিয়ডটায় অনিমিখ ফুরসত পেল। সুযোগ পেল
মোবাইলে হাত দেওয়ার। এখানে স্টাফরুমে বসে বা স্কুলের কম্পাউন্ডে
দাঁড়িয়ে প্রয়োজন ছাড়া ফোন করার অনুমতি নেই। সে টয়লেটে গিয়ে
অন্বেষাকে একটা মেসেজ করল – ektu katha bolte paari madam? mon khub kharap aaj
amaar. মিনিট দুয়েক পরে উত্তর এল – class-e aachhi. notun
school-e mon khaarap keno? 1:40-er por phone korun. অনিমিখ বুঝতে পারল
গতকাল উত্তর আসতে অতখানি দেরি হওয়ার কারণ হয়তো অন্বেষার বর। মেয়েটা সুযোগ পায়নি উত্তর দেওয়ার। ওর বরের
অনেক কুখ্যাতি অনিমিখ শুনেছে স্কুলে। লোকটি ঠিকাদারির কাজ করে। সেই সঙ্গে আরো কিছু গোলমেলে
ব্যাপারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সারা মাসের মধ্যে কয়েকদিন মাত্র বাড়িতে থাকে। বাকি সময়টা
সারা পশ্চিমবঙ্গ চষে বেড়ায়। মেয়েটা একলা পড়ে থাকে। অথচ ভালোবাসার
বিয়ে। অন্বেষার
মতো শিক্ষিত রুচিশীলা একটি মেয়ে অয়ন মল্লিকের মতো একটি ‘মাল’-এর পাল্লায় কী করে পড়ল, সেই
নিয়ে অনেক গবেষণা চলত মোরগমারির শিক্ষকদের মধ্যে। শোনা যেত
অয়ন নাকি ওকে মারধরও করে। প্রচুর নাকি মদ খায়। অন্যান্য
অভ্যাসও আছে।
অবিশ্যি মোরগমারিতে পরচর্চার রীতি প্রবল। ওটাই সময় কাটানোর একমাত্র পন্থা ওখানে। তিল থেকে তাল করার প্রয়োজন তার ফলে মাঝেমধ্যেই হয়।
তবু, যখনই সে মেয়েটার দিকে তাকিয়েছে, ওর চোখে অনিমিখ এক ধরণের
আকুতি দেখেছে। একটি মেয়ে, নিজের মুখের ছেলেমানুষিকে আড়াল করতে ব্যস্ত চিন্তার ভান করে। সব সময় ওর মুখে উচ্ছলতা আর গাম্ভীর্যের খেলা চলে। জীবন তাকে অনেকটাই ঠকিয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা ওর রূপকে কিছু
কাঠিন্য দিলেও বয়ঃসন্ধিকে পুরোপুরি কেড়ে নিতে পারেনি। এখনও একটা
ষোল-সতের বছরের মেয়ের মতোই ও জীবনের প্রতি উৎসুক।
প্রাণশক্তি নিয়ে তৈরি। পুরুষকে বাদ দিয়ে বাঁচতে চায় বলে একেবারেই মনে হয় না। একজন পুরুষ তার জীবন নষ্ট করেও অন্য সব পুরুষের প্রতি আগ্রহকে মেরে ফেলতে পারেনি।
টয়লেট থেকে
বেরোনর পর পিয়ন হৃদয় এসে বলে গেল পঞ্চম পিরিয়ডের পরে হেডমাস্টারমশাই তাকে একবার নিজের
ঘরে ডেকেছেন। সেটায় সমস্যা
নেই। টিফিনের
পিরিয়ডে সবাই স্কুলের বাইরে খাওয়াদাওয়া করতে বেরোয়। সেই সময়
সে ফোনটা করে নিতে পারবে। আজ একজন সম্পাদককেও ফোন করার ছিল। কিছু কবিতা
সে পাঠিয়েছিল, পৌঁছেছে কিনা জানতে হবে। সেটা জানা
হয়তো আর হবে না সন্ধের আগে।
এই প্রথম সে এই স্কুলের স্টাফরুমে একটু বসার সুযোগ পেল। কয়েকজন মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে আলাপ হল। এঁদের অনেকেরই সে মুখ চেনে, একই ছোট শহরে বাস করার সুবাদে। বাজারে-দোকানে-সিনেমাহলে এঁদের সে দেখেছে। হন্তদন্ত হয়ে স্কুলের দিকে আসতে দেখেছে নিজের ছুটির দিনে। যেকোনো স্কুলেই মাস্টারমশাইদের মধ্যে একটা সাধারণ ব্যাপার অনিমিখ লক্ষ্য করেছে। সেটা অপরের প্রতি কৌতুহল। এঁরাও তার ব্যতিক্রম নন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার সম্পর্কে সবকিছু জানার চেষ্টা করলেন। অনিমিখ সবই বলল, শুধু নিজের লেখালেখির কথাটা এড়িয়ে গেল। শক্তিবাবু নামে একজন বয়স্ক শিক্ষক বাংলা পড়ান। তিনি জানালেন তিনি অনিমিখের বাবাকে চিনতেন, তাঁর অকালমৃত্যুতে সমবেদনা জানালেন।
একজন মানুষ
মরে যাওয়ার এক দশক পরে এই সহানুভূতির অর্থ থাকে না। তবু অনিমিখের ভালো লাগল। পুরনো দিনের শিক্ষকদের তার ভালো লাগে, নিজের প্রজন্মের তুলনায়। হয়তো সেটার কারণ সে এঁদের নিজের ছেলেবেলার স্মৃতির সঙ্গে সহজেই মেলাতে পারে।
টিফিনের বেশি দেরি ছিল না। তবু অনিমিখ একটা অস্থিরতা টের পাচ্ছিল। এই ফোনটা অনেক কিছু সাফ করে দেবে। এই মুহূর্তটার জন্য সে গত কয়েকমাস পরিকল্পনা করছে। স্কুল সার্ভিস কমিশনের চিঠি আসার পরেই সে মনে মনে এই মুহূর্তটার দিকে এগোতে শুরু করেছিল। কিংবা হয়তো আজ থেকে তিন বছর আগেই, অন্বেষা যেদিন মোরগমারি স্কুলে জয়েন করেছিল। কিন্তু একই স্কুলে থেকে প্রেম করার চেষ্টা অসম্ভব ছিল। বিশেষ করে মোরগমারির মতো একটি প্রত্যন্ত গ্রামে।
আরো বিশেষ করে মিলন সামন্তর মতো একজন বন্ধুকে সঙ্গে রেখে।
টিফিনের সঙ্গে সঙ্গেই অনিমিখ স্কুল থেকে বেরোল। শীতের রোদ আজও গরহাজির। আকাশে মেঘের আদল। তারমধ্যেই প্রচুর হইচই চলছে। আইসক্রিম-ফুচকা-ঘুগনি-এগরোলের দোকানে ছেলেমেয়েরা ভিড় এবং
আড্ডা জমিয়েছে। মাস্টারমশাইরাও বেরিয়েছেন। তার দিকে তাকিয়ে কয়েকজন হাসলেন। সে-ও হাসল, কিন্তু এড়িয়ে যেতে পারল।
স্কুলের কাছেই একটি নদী। অনিমিখ সোজা পা চালাল তার দিকে।
নদীর কাছেও শীতকালীন নিম্নচাপের বিরক্তিকর আবহাওয়া। দুর্বল জলটা যেন অনেক কষ্ট করে বয়ে চলেছে। স্কুলের কিছু বয়স্ক ছেলেকে এখানেও দেখতে পেল সে। দু-একটি মেয়েও আছে। ওরা সম্ভবত প্রেম করতে এসেছে। এই ছেলেরা একটু সিগারেটে টান দেবে, ঝাঁ চকচকে
চায়না মোবাইলে থ্রি এক্স ভিডিও দেখবে, মেয়েদেরও দেখাবার চেষ্টা করবে হয়তো। তাকে দেখে ওরা সরে যেতে শুরু করল।
অনিমিখ ফোনটা বের করল। অন্বেষার নাম্বার প্রথমবার
অবিশ্যি লাগল না। আউট অফ রিচ। এটা মোরগমারির পুরনো ঝামেলা। অধৈর্য অনিমিখ আবার লাগাল। এবার রিংটোন শোনা গেল – ‘মম চিত্তে’ গানটি বাজতে শুরু করছে। অন্বেষা নিজে খুব ভাল গান গায়। ও মোরগমারির কাছাকাছি যে শহর-প্রায় গ্রামটিতে থাকে, সেখানে ওর কাছে গান শিখতেও আসে কিছু ছেলেমেয়ে প্রতি রবিবার। অবিশ্যি অনেক অনুরোধেও স্কুলের অনুষ্ঠানে অন্বেষা গান গায়নি। সেটা নিয়ে স্কুলে একটু ক্ষোভ আছে অনেকের।
উল্টো দিক থেকে অন্বেষার
চমৎকার ‘হ্যালো’ ভেসে আসার সঙ্গে সঙ্গেই অনিমিখের বুকের অস্থিরতাটা অবিশ্যি মিলিয়ে গেল। এটা তার হয়। কবিসম্মেলনে কবিতা পড়তে ওঠার আগেও প্রথম-প্রথম খুব ভয় করত, কিন্তু মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালেই সেটা চলে যেত। অংক পরীক্ষার দিনও সকাল থেকে খুব বুক কাঁপত, মনে হত শুধু তাকে লক্ষ্য করেই একটি ভয়ানক প্রশ্নপত্র মঙ্গল গ্রহ থেকে খসে পড়ছে, প্রশ্নপত্রটি হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা আর থাকত না।
খুবই স্বাভাবিক এবং হাসিখুশি গলায় অনিমিখ বলল, ‘হ্যালোওও, কী চলছে? আমাকে ছাড়া স্কুল নিশ্চয়ই আরো জমিয়ে চলছে আজ?’
অন্বেষার
ফিচেল হাসি শোনা গেল, ‘এরকম বলছেন কেন স্যার? আপনার কথা আজ অনেকেই বলছেন এখানে। অনেকের
নিশ্চয়ই খুবই মন খারাপ লাগছে।’
অনিমিখ
বেশ জোরেই হেসে উঠতে পারল, ‘তাই নাকি? কই আপনাকে দেখে, থুড়ি, শুনে তো মনে হচ্ছে না!’
‘দেখে-শুনে কি সব বোঝা যায়? আমারও খারাপ তো লাগছেই! রোজ দেখা হত, আর তো সেটা হবে না।’
অনিমিখ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, ‘হ্যাঁ। আমার মনও খুব বিষিয়ে আছে। গতকাল আপনার কথা খুব মনে পড়ছিল, জানেন।’
‘আমার কথা! ওমা, সেকি! এতজনের মধ্যে আমার কথা কেন? আমি নগন্য মানুষ!’
অন্বেষা কি ব্যঙ্গ করছে? ও কি জানে না অনিমিখ ওকে আজ কেন ফোন করছে? কেন গতকাল ওকে দু-দুবার মেসেজ করেছে? স্কুলের কারো সঙ্গে আজ অনিমিখ কথা বলেনি, এমনকি ছায়াসঙ্গী মিলনের সঙ্গেও না। অন্বেষা অত বোকা মেয়ে কি? দুর্বলতা টের পাওয়ার অলৌকিক ক্ষমতা তো মেয়েদের থাকেই! অনিমিখের চরিত্র সম্পর্কে স্কুলের হাওয়ায় যে ফিসফাসগুলো ভেসে বেড়াত, সেগুলোও ওর কানে যাওয়ার কথা।
অনিমিখ বুঝল তাদের কথোপকথনের এই মোড়টা খুব বিপজ্জনক, সুতো ছিঁড়ে যেতে পারে এখনই। একটু সময় নিল। তারপর খুবই মৃদু গলায় বলল, ‘ওভাবে বলছেন কেন? আপনি স্টাফরুমে রোজ আমার উল্টোদিকের চেয়ারে বসতেন। এখন স্কুল শব্দটা কেউ উচ্চারণ করলেই আমার মনে আপনার মুখটা ভেসে ওঠে। চোখ তুললেই দেখতে পেতাম তো।’
অন্বেষার গলাও কোমল হয়ে গেল, ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। জানেন, আমারও মনে হচ্ছিল সেটা। আজ আপনার চেয়ারে বিমানবাবু বসেছেন, তাকালেই কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল।’
‘এটাও একরকম মরে যাওয়া, ম্যাডাম, তাই না? ওই স্কুলটায় আমি আজ একজন মৃত মানুষ। একটা অবাস্তব মানুষ। আমি যে একদিন আগেই ওখানে ছিলাম, ক্লাস নিচ্ছিলাম, আজই হয়তো সেটা প্রমাণ করার দরকার হবে।’
‘এভাবে বলবেন না! আপনি হয়তো
আমার সঙ্গে একটু কবিতা করছেন, কিন্তু আমার খারাপ লাগছে শুনতে।’
‘এটাই কিন্তু সত্যি! ওই স্কুলে একমাত্র মিলন আর আপনি ছাড়া আমাকে কেউই হয়তো মনে রাখবে না। ভাবতে কী বিশ্রী লাগে জানেন! আট বছর ওখানে কাটিয়েছি, একমাত্র আপনাদেরই বন্ধু ভাবতে পেরেছিলাম।’
এটা শোনার পর অন্বেষা চুপ করে গেল। উল্টোদিক থেকে ভেসে আসছিল মোরগমারির ছেলেমেয়েদের টিফিনকালীন চেঁচামেচি। নিশ্চয়ই মিড-ডে মিল খাওয়ানোর পালা এতক্ষণে শেষ হয়েছে, এখন বাসন ধোয়ার জন্য দৌড়োদৌড়ি করছে ওরা। অনিমিখ তাদের বন্ধুত্বের ব্যাপারে যেটা বলল, সেটা অবশ্যই নির্লজ্জ অতিকথন, এবং অন্বেষার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে সেটা ধরে ফেলতেই পারে। অনিমিখের বুক আবার অস্থির হয়ে উঠতে যাচ্ছিল, তখনই অন্বেষা আবার হাসল, এবং আগের চেয়ে অনেক হালকা গলায় বলল, ‘এটা অবিশ্যি খুবই সৌভাগ্যের ব্যাপার। আপনি তো সকলকে বন্ধু করেন না। আপনাকে আমরা বেশ উন্নাসিকই ভাবতাম। এর মধ্যে আমি যে কোন ফাঁকে আপনার বন্ধুত্বের সুযোগ পেয়ে গেছি, নিজেই জানি না।’
এটাও হয়তো একটা ঘুরিয়ে করা ঠাট্টা। কিন্তু অনিমিখ সেই ধারণাকে আমল দিল না। বলল, ‘আর আপনি ছিলেন বলেই আমি ওই স্কুলে একটু শ্বাস নিতে পারতাম, সেটাও কি জানতেন? নাহলে একঘেয়েমিতেই মরে যেতাম।’
অন্বেষা এবার সত্যিই হেসে উঠল, প্রাণখোলা হাসি, বলল, ‘যাক, না চাইতেই এত ভালো একজন বন্ধু পেয়েছিলাম! কিন্তু যখন সেটা জানলাম, সে অনেক দূরে চলে গেছে! এই কি জীবন, কালীদা?’
‘এই তো লাইফ অন্বেষা ম্যাডাম!’
‘ঠিক। এটাই লাইফ। কিন্তু এখন আমাকে ফোন রাখতে হবে। হেডস্যার হাতছানি দিচ্ছেন। অফিসে একটা কাজ আছে। আসি এখন?’
‘ওকে ম্যা’ম।’
‘বেশ। আবার কথা হবে। ভালো থাকুন। মন খারাপ করবেন না। টাটা।’
‘কথা হবে।’
ফোন কেটে যাওয়ার পর নদীটির ম্লানতার দিকে তাকিয়ে নিজের অনুভূতির স্বাদ বুঝতে চেষ্টা করল অনিমিখ। একটুও অবাক লাগছে না তো নিজেকে! এই মুহূর্তটার জন্য তাকে গত কয়েক মাস চিত্রনাট্য লিখতে হয়েছে। ছিঁড়তে হয়েছে। আজ সেটা সত্যিই সে যেমন চেয়েছিল প্রায় তেমনভাবেই ঘটাতে পেরেছে। গতকাল সারারাত জেগে এই মুহূর্তটাই হয়তো সে কল্পনা করছিল। কিন্তু রাতে কল্পনায় এই মুহূর্তটা যে পুলক তাকে দিয়েছে, এখন সে আর তা জাগিয়ে তুলতে পারছে কি? সম্ভবত না। অন্বেষার এই আলগা প্রশ্রয়কে তার এখন নিজের প্রাপ্য বলেই মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে সেটা সে শুধু হাত পেতে বুঝে নেওয়ার জন্যই এই নদীর দিকে হেঁটে এসেছে।
এর পরে অন্বেষাকে নিয়ে আরো রোমাঞ্চকর ও অকথ্য কল্পনাগুলোকেও যদি অনিমিখ একের পর এক ঘটিয়ে ফেলতে পারে, ঠিক যেভাবে অনিমিখ চেয়েছে ঠিক সেইভাবেই যদি অন্বেষা তার কল্পনার ধাপগুলোতে একের পর এক পা রাখে, সে কি পুলকের জোয়ারে ভেসে যাবে?
সে কি নিশ্চিত করে সেটা বলতে পারে? কেউ কি পারে?
জীবনের কাছে ইতিমধ্যেই আঘাত পাওয়া একটা একলা মেয়ের সঙ্গে সে এই খেলাটা খেলছে কেন, সেই প্রশ্নটাও তার নিজেকে করার সাহস আপাতত হচ্ছে
না।
অন্যমনস্কভাবে অনিমিখ একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল। তখনই বেশ দূর থেকে ভেসে আসা কিছু ছেলের হাসির আওয়াজে তার সংবিত ফিরল। ছাত্ররা নিশ্চয়ই তার সিগারেটের কারণেই হাসছে। কিন্তু এখন আর ফেলে দেওয়া চলে না। ওরা জিতে যাবে। সে সিগারেট টানতে টানতেই ফিরে চলল স্কুলের দিকে।
শালা সিগারেট!
তবু সিগারেটই তো দরকার হয় কল্পনার সঙ্গে পাল্লা দিতে
হলে ! সিগারেট শুরু হয় শখে, শেষ হয় শকে। ঠিক কল্পনার মতোই মোহময়। প্যাকেটে মৃত্যুর ছবি থাকলেও সিগারেটের বিকিকিনি কমে না, বরং বেড়ে যায়। সিনেমার পর্দায় যখন ভেসে ওঠে ধূমপানের বিধিসম্মত সতর্কীকরণ,
নেপথ্যে খুব ভারি বা মিহি গলায় সেটা পড়ে শোনানো হয়, কলেজের ছাত্ররা চেঁচিয়ে বলে,
‘তোর বাপকে বল!’
ফুসফুসে ক্যান্সার নিয়েও বাথরুমে লুকিয়ে সিগারেট খেতেন তার এক বন্ধুর বাবা।
টিফিন শেষ হয়ে আসছে। অনিমিখ বুঝতে পারছিল তার শরীরে এখন প্রায় জ্বরের তপ্ততা।
কোনো পুরুষ নিজেকে প্রশ্ন করতে পারে কি, একটি মেয়ের কাছে সে ঠিক কী চায়? অনিমিখ নিজের সঙ্গে ওই প্রবঞ্চনা কেন তাহলে করবে?
পঞ্চম পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগে সে অন্বেষাকে একটা মেসেজ করল – aaj mone hocche aamraa hoeto onektaai eki rokom manus. eki
rokom bokaa aar romantic. jibon-e amader kichhu hobe naa. Kintu bondhu to hotei
hobe. ki bolen?
পঞ্চম পিরিয়ড শেষ করে বেরিয়ে সে লুকিয়ে মোবাইল দেখল।
মেসেজ এসেছে।
অন্বেষার নয়। সেই সম্পাদক জানিয়েছেন তার কবিতা তিনি পেয়েছেন।
বিরক্ত মুখে অনিমিখ হেডমাস্টারের ঘরের দিকে গেল।
হেডমাস্টার বিনয়বাবুর ঘরে কাজ অবিশ্যি মিটতে বেশি সময় নিল না। উনি বেশ দুর্বল মানুষ। পেটের রোগে কাহিল। স্কুল চালানোর জন্য সহকারী প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জন মাহাতোর উপরেই অনেকাংশে নির্ভর করেন। নিরঞ্জনবাবুও হাজির ছিলেন। কথাও তিনিই বললেন। অনিমিখকে অনুরোধ করা হল বিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য প্রথম মাসের বেতনের একটা অংশ অনুদান হিসেবে দিতে। এটা সে আশংকাই করছিল। এসব ব্যাপারে ‘না’ বললে পরে সমস্যা হতে পারে। এই স্কুলে সে বাকি কর্মজীবনটা কাটাতে চায়। সে রাজি হয়ে গেল।
বেরিয়ে দেখল উত্তর এসেছে – setaa bujhte ektu deri kore fellen. school chhere jaaoaar
aage bujhte paaren-ni?
এই মুহূর্তটাও যেন তার কল্পনায় ছিল!
এটাই তো হওয়ার কথা ছিল !
অনিমিখ বুঝতে পারল তার অস্থিরতা আরো বাড়ছে। এই যে উত্তরটা সে এবার দেবে, তা তার নিজের হবে না – better late than never madam । তারপর একটা ভেংচি কাটা স্মাইলি।
এটা তার উত্তর হতে পারে কি!
একজন কবির
উত্তর হতে পারে না
এটা।
আরে
ধুর! অনিমিখ চক্কোত্তি আবার কবি হল কবে!
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন