• কবিতা সুর্মা


    কবি কবিতা আর কবিতার কাজল-লতা জুড়ে যে আলো-অন্ধকার তার নিজস্ব পুনর্লিখন।


    সম্পাদনায় - উমাপদ কর
  • ভাবনালেখা লেখাভাবনা


    কবিতা নিয়ে গদ্য। কবিতা এবং গদ্যের ভেদরেখাকে প্রশ্ন করতেই এই বিভাগটির অবতারণা। পাঠক এবং কবির ভেদরেখাকেও।


    সম্পাদনায় - অনিমিখ পাত্র
  • সাক্ষাৎকার


    এই বিভাগে পাবেন এক বা একাধিক কবির সাক্ষাৎকার। নিয়েছেন আরেক কবি, বা কবিতার মগ্ন পাঠক। বাঁধাগতের বাইরে কিছু কথাবার্তা, যা চিন্তাভাবনার দিগন্তকে ফুটো করে দিতে চায়।


    সম্পাদনায়ঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়
  • গল্পনা


    গল্প নয়। গল্পের সংজ্ঞাকে প্রশ্ন করতে চায় এই বিভাগ। প্রতিটি সংখ্যায় আপনারা পাবেন এমন এক পাঠবস্তু, যা প্রচলিতকে থামিয়ে দেয়, এবং নতুনের পথ দেখিয়ে দেয়।


    সম্পাদনায়ঃ অর্ক চট্টোপাধ্যায়
  • হারানো কবিতাগুলো - রমিতের জানালায়


    আমাদের পাঠকরা এই বিভাগটির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন বারবার। এক নিবিষ্ট খনকের মতো রমিত দে, বাংলা কবিতার বিস্মৃত ও অবহেলিত মণিমুক্তোগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে আনছেন, ও আমাদের গর্বিত করছেন।


    সম্পাদনায় - রমিত দে
  • কবিতা ভাষান


    ভাষা। সে কি কবিতার অন্তরায়, নাকি সহায়? ভাষান্তর। সে কি হয় কবিতার? কবিতা কি ভেসে যায় এক ভাষা থেকে আরেকে? জানতে হলে এই বিভাগটিতে আসতেই হবে আপনাকে।


    সম্পাদনায় - শৌভিক দে সরকার
  • অন্য ভাষার কবিতা


    আমরা বিশ্বাস করি, একটি ভাষার কবিতা সমৃদ্ধ হয় আরেক ভাষার কবিতায়। আমরা বিশ্বাস করি সৎ ও পরিশ্রমী অনুবাদ পারে আমাদের হীনমন্যতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরটি সম্পর্কে সজাগ করে দিতে।


    সম্পাদনায় - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
  • এ মাসের কবি


    মাসের ব্যাপারটা অজুহাত মাত্র। তারিখ কোনো বিষয়ই নয় এই বিভাগে। আসলে আমরা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কবিকে নিজেদের মনোভাব জানাতে চাই। একটা সংখ্যায় আমরা একজনকে একটু সিংহাসনে বসাতে চাই। আশা করি, কেউ কিছু মনে করবেন না।


    সম্পাদনায় - নীলাব্জ চক্রবর্তী
  • পাঠম্যানিয়ার পেরিস্কোপ


    সমালোচনা সাহিত্য এখন স্তুতি আর নিন্দার আখড়ায় পর্যবসিত। গোষ্ঠীবদ্ধতার চরমতম রূপ সেখানে চোখে পড়ে। গ্রন্থসমালোচনার এই বিভাগটিতে আমরা একটু সততার আশ্বাস পেতে চাই, পেতে চাই খোলা হাওয়ার আমেজ।


    সম্পাদনায় - সব্যসাচী হাজরা
  • দৃশ্যত


    ছবি আর কবিতার ভেদ কি মুছে ফেলতে চান, পাঠক? কিন্তু কেন? ওরা তো আলাদা হয়েই বেশ আছে। কবি কিছু নিচ্ছেন ক্যানভাস থেকে, শিল্পী কিছু নিচ্ছেন অক্ষরমালা থেকে। চক্ষুকর্ণের এই বিনিময়, আহা, শাশ্বত হোক।


    সম্পাদনায় - অমিত বিশ্বাস

শক্তিপদ ব্রহ্মচারী



...শক্তিপদ ব্রহ্মচারী...
(১৯৩৭-২০০৫)
(কাব্যগ্রন্থ-সময় শরীর হৃদয়,অনন্ত ভাসানে, কাঠের নৌকা,
লঘু পদ্য, দ্বন্ধ অর্হনিশ )



আধুনিক বাংলা কবিতার সার্বিক পরিসরে কলকাতা কেন্দ্রিক বাংলা কবিতার সমান্তরলে আসাম ত্রিপুরার বিপুল বাংলা সমাজকে কেন্দ্র করে  বরাক তথা বৃহত্তর বাংলায় গড়ে ওঠা কবিতার একেবারে প্রথম শ্রেনীর কবি হিসেবে মান্যতা দেওয়া যায় কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারীকে।  উদয়ন ঘোষের হাত ধরে বরাক উপত্যকার বাংলা কাব্যচর্চায় ষাঠের দশকে জন্ম নিয়েছিল যে অতন্দ্র গোষ্ঠী তার সহযোদ্ধা ছিলেন শক্তিপদ।বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য কলিকাতার বাংলাসাহিত্য ও দেশভাগ পরবর্তী বাংলাদেশে গড়ে ওঠা বাংলাসাহিত্যের স্বীকৃত ভুবনের বাইরে সাহিত্যের যে তৃতীয় ভুবনের প্রসঙ্গ এনেছেন চল্লিশ বছরের দীর্ঘ কবিজীবনে তারই চর্চা করে গেছেন শক্তিপদ। তাঁর অল্প কথায় তাই একই সাথে উঠে এসেছে দেশভাগের স্মৃতি রোমন্থন এবং মফস্বলী মনতাজ। সাথে সাথে তাঁর কাব্যভাষার ছোট ছোট ভাব ও ভংগীতে প্রতীকি হয়ে উঠেছে ছোট ছোট মানুষের প্রেম যন্ত্রনার শিল্পিত প্রকাশ।কখনো তিনি নিজেকে নিয়ে বিজ্ঞাপন নামক রচনায় পূর্ববঙ্গে ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করেন আবার কখনও বা আসাম শ্রীহট্টের ধীর প্রবাহিত জীবন উঠে আসে তার নন্দনভাবনায়। সমস্ত শরীর হৃদয় কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা একান্ত ব্যক্তিগত কিংবা তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ অনন্ত ভাসানেএকটি গ্রামীন পদ্য কবিতায় ধরা পড়ে ফেলে আসা জীবনের টূকরো টুকরো ছবি। পৃথ্বীশ দেশমুখ্য এ কবিতার এক সুন্দর বিশ্লেষনে বলছেন –“ বিশুদ্ধ অর্থে পাড়া-গাঁ বলতে যা বুঝায় কবির নিবাস ছিল সেখানেই। শহর থেকে পঁচিশ মাইল দূরে, ট্রেন এবং মোটরগাড়ি অনেকদিন এখানে পদার্পণ করেনি। গ্রামীন লোকের দুরত্ব বোঝানোর ভাষায় কবি বলেছেন, তিন বাঁক উজানের অর্থাৎ উৎসের দিকে নদীটা তিনটা বাঁক নেবার পর একজন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার ছিলেন। ইঞ্চিকাটা শিশিতে তিনি সাদা জলের ওষুধ দিতেন। সেখানে কোনো ডাকঘর বা ইস্কুল ছিল না। অর্থাৎ আধুনিক সভ্যতার ভোরের আলো সেখানে পৌঁছায়নি। তবুও সেখানে অনেককিছুই ছিল, দিগন্তবিস্তৃত মাঠে সবুজ আর সোনালী রঙ ছিল, আর ছিল একটি নদী- তার নাম বিবিয়ানা। পাশের বাড়িতে অনাদরে বেড়ে ওঠা একটা মেয়ে ছিল। সুন্দর শব্দটা বোধহয় একমাত্র তার নামের পাশেই বসানো যায়।......শক্তিপদের কবিতা এমনই মানুষকে নিয়ে বেড়ে ওঠা, তার সুখ দুঃখের গল্প নিয়ে, স্বপ্ন ও বাস্তব নিয়ে, তার জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিসরের বিপুল ব্যঞ্জনা নিয়ে কাব্যিক দ্যোতনায় বাঁধা।আকুলতা শিখেছে মা্নুষ কবিতায় শক্তিপদ যখন বলেন –“ আহা রে মানুষ যায় দূর মাঠে লন্ঠন জ্বালিয়ে/আহা রে মানুষ যায় কীর্তন-কৃতার্থ বাংলাদেশে/.../ এইভাবে আমাদের যুগপত ঘৃণা ভালোবাসা/ বসন্তে উড্ডীন যথা শিমূলের আনন্দিত ধোঁয়া-সে মূর্হুতে শক্তিপদকে আমাদের আত্মজৈবনিক কবি মনে হয়। যেন তাঁর আলিঙ্গনের ভেতর জীবনসত্যই একমাত্র উপজীব্য। কি বিনীতভাবে শক্তিপদের বক্তব্যে বাহিত হয়ে রয়েছে জীবনের ছোট ছোট ডুবসাঁতার,যেন একজন সাধারন মানুষ যিনি তার তাকাবার দেখাটা বলবার ভাষাটা খুঁজে চলেছেন কবিতার পদ্যবন্ধনীতে। আর ফিরে ফিরে সুখদুঃখের দ্বন্ধ আভাসে দুলছে, দুলছে শক্তিপদও, তাই তো কবি শেষ জীবনের কবিতাতেও ভুলতে পারেন না ফেলে আসা দেশের মাঝিমল্লারকে, ভুলতে পারেন না যুবতী বিবিয়ানাকে- কবির ভিতরে গুমরে কাঁদে বিবিয়ানা; গুমরে কাঁদে কার্তিক দরজির তৈরি সাদা মার্কিনের ফতুয়া  কিংবা আসমতল গোচারনভূমিতে বাতাবির বল নিয়ে দৌরাত্ম্য, ক্ষেত্রমাস্টারের জালিবেতের আস্ফালন সত্ত্বেও স্কুলকামাই, ঘোলাজলে ঝাঁপ দেওয়া, অসুস্থ হলে ঠাকুমার টোটকা কিংবা বোস্টমী দিদির জড়িবুটি, মহামারীতে নগর সংকীর্তন-সবকিছুই যে গুমরে কাঁদে প্রৌঢ় কবির স্মৃতিদর্পনে।  

আসলে সময়ের সাথে সাথে কবিতার শরীরও পালটায়। নতুন সাজে সিন্থেসিস হয় জীবন ও বোধের প্রতিটি নবমূহূর্ত; অথচ আছন্ন কোডাকে পরে থাকে কিছু স্মৃতিডাঙ্গা।কবিতার আদর্শ ভাষা কি? এ প্রশ্ন যদি শক্তিপদের কবিতার সামনে রাখা যায় তার একটাই উত্তর হতে পারে-মানুষকে নিয়ে পৃথিবীকে নিয়ে সার্থক চিত্রকল্পের রচনা; এমনকি স্মৃতিভারে প্রপীড়িত বিকেলের ধূসরতা নিয়ে উড়ে যাওয়া পাখি কিংবা পাঁশুটে বাসিচাঁদের মাঝেও শক্তিপদ খুঁজে নিয়েছেন মানুষের সান্নিধ্য, বেঁচে থাকার নিভৃত সাক্ষাৎকারগুলিকেই। প্রিয় কবিতার কাছে বিদায় নিতে নিতেও শক্তিপদ বিদায় চেয়েছেন সেই মানুষের কাছেই-

হে মানুষ ক্ষমা করো
হে আমার বিমূঢ় বিস্ময়, ক্ষমা করো
এই হওয়া না-হওয়ার মাঝখানে সফল চাষীর কপালের ঘামের মতো
আজ আমাকে অবলীলায় মুছে ফেলতে দাও
হে কবিতা, তোমাকেও...

কবিতার আর্দশ ভাষা নিয়ে মুকারোভস্কির বারবার বিচ্যুতি কথা বলেছেন, সৌন্দর্যসৃষ্টির তাগিদে দৃশ্য ও ভাষার মৌখিক থেকে দূরে যাওয়ার কথা বলেছেন কবিতার ভাষাকে।Poetic Language is not a brand of the standard. … For poetry the standard language is the background against which is reflected the aesthetically intentional distortion on the linguistic component”- কিন্তু কোথাও যেন লোকজীবনের সামান্য বহমান মুখের ভাষাই হয়ে উঠেছে শক্তিপদের কবিতার আভরণ। প্রাধান্য পেয়েছে মাটি,মাটির কাছাকাছি থাকা কাঙাল মুখগুলি, নির্বোধ মানুষগুলি; যতটা না প্রচ্ছন্ন প্রতীকি ভাষা উঠে এসেছে শক্তিপদের কবিতায় তার থেকে ঢের বেশী অভিব্যক্ত হয়েছে জীবনের ছবি। পাঁক পানা আর ধুলোবালির ছবি। তাই তো শক্তিপদ অনায়াসে লিখতে পারেন শরীরের কোন গহ্বরে জানিনা রোদ পোহাচ্ছে কয়েকটি মুখ/ একজন ভিখিরি, একটা পাগলী ও স্বপ্নে পাওয়া একটি চোর/ ওরা তিনজনেই আমায় শিখিয়ে রেখেছে/ ভয়ের আরেক নাম ভালোবাসা...”—লোকায়িত দানায় ভরপুর তাঁর কবিতা,আর তা পাঠকের দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে আটকালেই আমাদের পেয়ে বসে মফস্বলী কবির বিজন বনস্থালী যেখানে কবি খুঁজে চলেছেন জীবনের সুক্ষ থেকে সুক্ষ সুগন্ধী ছিটমহল্লাটিকে। আর দৈনন্দিন বিচ্ছিন্নতাবাদে মননশূন্য দ্বীপে আটকে পড়া পাঠকটির দিকে তাঁর কবিতার ভাষা দিয়ে সেরে নিতে চেয়েছেন সারাজীবনের জরুরী কথা।

আর দশটা বাঙালী কবির মতই শক্তিপদ ব্রহ্মচারী বা তাঁর কবিতার পথ যে ধীরে ধীরে প্রত্নতাত্ত্বিক হয়ে উঠবে সে আর নতুন কি! আর যেখানে কোলকাতা কেন্দ্রিক কবিতার স্বীকৃত ভুবনের বাইরে কবির পরিক্রমা সেখানে তার ডাকে খুব বেশি হলে হয়ত সামান্য অতীতচারিতারই নিমন্ত্রন ফিরে ফিরে আসবে। তবে কোথায় যাবেন কবি? কোথায় যাবে তাঁর কবিতা? অক্ষরের প্রতি তাঁর ভালোবাসা? এ প্রশ্নের মুখোমুখি হলে বারবার মনে পড়ে শক্তিপদেরই নিজের কিছু পংক্তি-
             পোষা বেড়ালের মত ভালবাসা শুয়ে থাকে/বারান্দার কোণে/
                এবং রোদ্দুর মরে গেলে/ভালবাসা ঘরে উঠে আসে---  

                                                                                 
বারবেলা

আমরা প্রত্যেকটা মানুষ দুঃখী    ভিতরে ভিতরে
কিন্তু কেউ কারো দুঃখকে ছুঁতে পারি না
আমরা প্রত্যেকটা মানুষ সুখী     ভিতরে ভিতরে
কিন্তু কেউ কারো সুখকে ছুঁতে পারি না

সেদিন একজন আধ-পরিচিত মানুষ
আমাকে বললে
আপনার জন্মসালটা আমি জানি
এবারে যদি আপনার রাশিটা...
আমি বললাম, সিংহ

লোকটি অবাক হওয়ার মতো মুখভঙ্গি করল
তারপর বলল
কক্ষনো হতে পারে না
আমারও তো সিংহ
অথচ আমরা দুজনে কত আলাদা




এলিয়টের কুকুর

শব্দের অভিধা নিয়ে ব্যস্ত থাক এলিয়টের কুকুর
আমার হাতে মোষের শিং-এর সিঁদকাঠি
নিয়ম-দুরস্ত গৃহস্থের দেউড়ির মধ্যে উবু হয়ে বসে রয়েছি আমি
দুচোখে লোভ, সে কি সোনাদানা বিষয়-সম্পত্তির ।

গত দুর্ভিক্ষের সময় থেকে আমার
এক ফোঁটা আমানি জোটেনি
সবুজ কার্পেটের মতো পায়ের তলায় চিকন ঘাস
দাঁতে কেটেছি; তাকেই কি সাধুবাংলায় বলে দন্তে তৃণ ধারণ

গত জন্মে আমাদের পোষা রামছাগলের গলায় ঘন্টা বাঁধা ছিল
আমাদের বিদ্যেধরীর চোখে ছিল আগুন
একজন স্বভাবশীতল সংস্কৃতি প্রেমিককে
আমাদের প্রেমিকার অর্থাৎ যৌথ ছেনালির কথা মনে রেখে
একটি শব্দকল্পদ্রুম উপহার দিয়েছিলাম

মহান এলিয়টের কুকুর
দ্রুম মানে বৃক্ষ নয় , গাছ গাছালি নয়,লতা গুল্ম উদ্ভিদ নয়
দ্রুম মানে বন্দুকের আওয়াজ, দ্রুম মানে অরণ্যের সাবালক সঙ্গলিপ্সা
দ্রুম মানে না-হক কথার উথালি-পাথালি
রাতের দুচোখে জ্বলে উঠছে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ
আমার হাতের সিঁদকাঠি ধর্ম-পাঠশালার মাস্টার মশাই এর মতো
নিস্পৃহ চৈতন্যের অন্ধকারের তলায়
মাথা খুঁড়ে মরছে
বিঘৎ পরিমাণ শাসনের দেয়াল পেরুনোর আগে
এলিয়টের কুকুর
সে কি শুনতে পেয়েছে রাত্রির বুক চিরে চিরে ফেটে পড়ছে
সানাই-এর কোমরভাঙা শীৎকার ধ্বনি ?
ব্যস্ত থাক, চরাচর নিখিলের নিদ্রাহীন কুলাঙ্গার
এলিয়টের কুকুর, তোমার জিভের লালায় ভিজে যাচ্ছে
পাখির কলজে,হরিণের চোখ, ঘৃতকুমারীর ঠোঁট
এবং তৈল-চিক্কন কাব্যসাহিত্যের এনামেল-করা বিদ্যায় অভিনন্দন
বিদায় এলিয়টের কুকুর, বিদায় সন্ধ্যারতি, বিদায় শব্দকল্পদ্রুম ।                                                 

হঠাৎ একটি কবিতার মতো

অনেকদিন আমি কবিতা লিখছি না
আজকাল আমি হাটুরে মানুষের মতো
জিনিসপত্রের দাম নিয়ে দর কষাকষি
এবং মাথা গরম করি।
অথচ কবিতা লিখব বলে হাটের খবর রাখব না
এমনও তো কথা ছিল না
কিন্তু, হাটও আমাকে হটাতে থাকবে কবিতার বাজার থেকে
এমনও কথা ছিল না ।
আসলে কথা কিছুই ছিল না
যখন যেমন হচ্ছে সেটাই হল কথা
এবং প্রকৃত বিচারে কোনো কথাই আমাদের নেই
আসলে সার কথাটা হল তাই।
যে মাঝি-দিগন্তে মেঘ দেখতে পেয়েছিল
লক্ষ্যে পৌঁছাবার আগে অন্ধকারকে ঠেলে রাখতে হবে
এই ছিল কথা
যার ডান হাত কাটা পড়েছে
বাঁ হাতকে আরো বেশি সাবলীল গড়ে তোলা
ছিল তার কথা
কিন্তু আসলে কিছুই কিছু নয়
আমাদের সময়ের পোশাকি নাম এখন দুঃসময়
গা বাঁচিয়ে আছি
এবং গা বাঁচিয়েই মরছি।



মা বলতে পারতেন

ছাইপাঁশ লিখে যাস, মানুষের কী যে কাজে লাগে
বুঝি না কিছুই, দেখি,কলমের শিস মুখে, আর
মাঝে মাঝে বিড়বিড় করিস
শব্দ শব্দ শব্দ ব্রহ্ম চারিদিকে শব্দের জঞ্জাল
অর্থহীন বাক্যমালা তোকে শব্দ খুবলে খেয়ে যাবে।

জামায় বোতাম নেই, চুলেও চিরুনি দিস না তুই
কেন যে আকাশ দেখতে মাটিতে হোঁচট খাস রোজ
অ্যাতো লেখাপড়া করলি, অফিসের বড়োবাবু হলি না এখনও
হরিদাসপুর থেকে ডাকাডাকি করেছিল কেন যে গেলি না
কিছুই বুঝি না তোর মতিগতি, বই বই বই হল কাল
কাল রাতে ঘুমঘোরে কার সঙ্গে কথা বলাবলি
হয়েছিল, তুই কি জানিস ওই পদ্মপত্র কার ডাকনাম?

যে মেয়েটি রোজ আসত তোর কাছে এখন কোথায়
তার বিয়ে হয়ে গেছে? ভালো ঘর, ভালো বর, জানিস তো ঠিক
সবাই থাকুক ভালো, চারিদিক শান্ত স্নিগ্ধ চোখ
আলো নিয়ে জেগে থাক, শস্যদানা খুঁটে নিবি তুই
আমার বুকের দুধে তোর মুখ বারবার ধুয়ে দেব আয় ! 

পারমুটেশন

ছোটো কাগজের এক কবি
ছোটো কাগজের কবি এক
ছোটো এক কবি কাগজের
ছোটো এক কাগজের কবি
ছোটো কবি কাগজের এক
ছোটো কবি এক কাগজের
কাগজের ছোটো এক কবি
কাগজের ছোটো কবি এক
কাগজের এক ছোটো কবি
কাগজের এক কবি ছোটো
কাগজের কবি ছোটো এক
কাগজের কবি এক ছোটো
এক ছোটো কাগজের কবি
এক ছোটো কবি কাগজের
এক কাগজের ছোটো কবি
এক কাগজের কবি ছোটো
এক কবি ছোটো কাগজের
এক কবি কাগজের ছোটো
কবি ছোটো কাগজের এক
কবি ছোটো এক কাগজের
কবি কাগজের ছোটো এক
কবি কাগজের এক ছোটো
কবি এক ছোটো কাগজের
কবি এক কাগজের ছোটো ।

আস্তিকতা বিষয়ক কয়েক পংক্তি

মাঝে মাঝে মনে হয় ঈশ্বর নামক কেউ একজন থাকলে
বড়ো ভালো হত ।
যখন, মাঝে মাঝেই আমার মনখারাপ হয়
তখন মনখারাপের যাবতীয় দায়ভাগ আমি
ঈশ্বরের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে
দিব্যি কাপাস তুলোর মতো ঘুরে বেড়াতাম।

কিংবা ধরা যাক, মানে ভাবা যেতে পারে
যে-সব দুর্ঘটনার জন্য আমি আদৌ দায়ী নই
কিংবা প্রকারান্তরে আমিই দায়ী
যেমন মহারাষ্ট্রের ভূমিকম্প কিংবা অন্তঃরাষ্ট্রীয় ডাঙ্কেল প্রস্তাব
কিংবা অনন্তবাবুর সেরিব্রাল অ্যাটাক অথবা ইত্যাদি
সব এবং সব কিছুর জন্যই ঈশ্বরকে দায়বদ্ধ রেখে
আমি আমার ফুরফুরে পালক ঝেড়ে
বুদ্ধমূর্তির সৌম্য হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখতে পারতাম।

আমার মাঝে মাঝে খুবই মরে যেতে ইচ্ছেকরে
আবার মাঝে মাঝে খুবই বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়
রাত্রিবেলা এক আকাশ তারার দিকে তাকিয়ে
আমার ঈশ্বরের সঙ্গে সদালাপ করতে
খুব, খুবই ইচ্ছে হয় ।

আমাদের পাড়ায় একজন ঈশ্বরবাবু ছিলেন
তিনি বৃদ্ধ বয়সে একেবারে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন
তার অন্ধকার চোখের দিকে তাকালে
আমার কেবলি মনে হত যে
এক অনন্ত অন্ধকারের মধ্যে
একটু আলোর স্বপ্ন জাগিয়ে রাখার নামই
                                   আস্তিকতা ।

ফুল কিংবা মা বিষয়ক কবিতা

ফুলকে পুষ্প বলে ডাকার বিলাস শেষ হয়ে গেছে অনেক আগে
কুসুমের মধ্যে যারা কাঁটা ও কীটের যন্ত্রনায় অস্থির
তাদেরও বর্তমান ডাকনাম এক ধ্বস্ত কবিতা
এই মুর্হুতে আমার একটি ফুলকে বড়ো প্রয়োজন
কিন্তু তাকে কী নামে ডাকব বুঝতে পারি না বলেই
অন্যমন্সকতার মধ্যে পাপড়িগুলি ঝরে পড়ল মাটিতে, পায়ের পাতায়।

মাকে কোনোদিনই জননী বলে ডাকিনি
সে লেখা আছে বই-এর পাতায়, নয় তো
মদমত্ত তান্ত্রিকের কর্কশ উচ্চারণে
জনন কথাটির মধ্যে যে যৌন-সর্বগ্রাসিতা
তাকে শিথিল লাজুক মুঠিতে শাসন করতে করতেই
কখন যে একদিন
মায়ের শরীরের লালপাড় শাদা থান য়ে গেছে
লক্ষ করিনি।

নিজের দুঃখের কথা সাতকাহন করে আর কত বলব !
বরং আজ বড়ো প্রাচীন ভোরবেলার চোখ নিয়ে
চেয়ে দেখলুম-
কচিপাতার আড়ালে দাঁড়িয়ে মা আমার
শিশিরের গায়ের চাদরে
শাদা ফুলের নকশা এঁকে দিচ্ছেন।

রজনীর দিন শেষ

এখনো অভ্যাসে শুই তোমার পাশেই
চোদ্দো বছরের খাট, পুরোনো বাসিন্দা দুই,আগন্তুকও আছে
এমন ছিল না কথা, মনে ছিল ঊর্ধ্বমুখী সুখে দিন যাবে
মনে ছিল হতে হবে উপান্তে উদাসী
তোমার ঘুমন্ত মুখে জটিল অক্ষর গোনা শেষ হয়ে গেছে
পারাপারহীন এই দিগন্ত বিলাসী মেধা
মধ্যরাতে হা হা করে ওঠে
তবুও অভ্যাসে শুই তোমার পাশেই

দেয়ালে বিষন্ন শাদা শবের শরীরে লগ্ন
রজনীগন্ধার মতো চিৎ হয়ে আছে
ফাল্গুনের হাওয়া
ব্যর্থ মেঘদূত তুই, প্রতিহারী, ফিরে যা ফিরে যা
রজনীর দিন শেষ, এখন রাতের হলো শুরু
এবং অভ্যাসে আমি শুয়ে থাকি তোমার পাশেই।

হঠাৎ কোন হিরন্ময়

চতুর্দিকে হল্লা করে মানুষ যাচ্ছে হাটে
আমি শুয়ে চিৎপটাং খাটে
সরলরেখায় টেনে নামাই সামান্য বিন্দুকে
হাজার রকম ব্যাখ্যা করে হাজারটা নিন্দুকে
এটা গেল, ওটা রইল, জানি তো সবই-তা
                               তুই আমার কবিতা।

কারা যেন বাড়ি করছে গগনচুম্বী আশায়
আমি তখন ব্যস্ত থাকি আরেক ভালোবাসায়
হঠযোগীর মতন আমি রাংতা করি সোনা
                     ভেতর জুড়ে ব্যস্ত আনাগোনা
রয়ে গেলাম অপেক্ষমান শ্যামা কিংবা রামার
                              কবিতা তুই আমার।

মহোৎসবের বাজনা বাজে মানুষ যেথায় ঠাকে
                      আমি কেবল দৈব দুর্বিপাকে,
চতুর্দিকের ভয় জাগানো হাজার রকম তাড়ায়
গোলকধাঁধায় ঘুরে মরছি, ভট্টাচার্য পাড়ায়
হঠাৎ কোন হিরন্ময় রহস্য আলোকে
                         পেয়ে গেলাম তোকে ।

কবিতা যখন গদ্য হয়ে যায়

দুধপাতিল গ্রাম নিয়ে কবিতা লিখলেন শঙ্খ ঘোষ,
এটা আমার লেখার কথা ছিল ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখলেন
হারাঙ্গাজাও স্টেশনের কথা
ওটা তোমার লেখার কথা ছিল।

আসলে আমরা সবাই একসঙ্গে
ভালোবাসার কথা বলেছি একসময়ে
আসলে আমরা সবাই
শত্রুতার কথা বলছি এখন।
আমাদের আঞ্চলিকতা ও বিশ্ববীক্ষা
হলুদপাতার মতো মিইয়ে আছে অনেকদিন
আমরা অনেক, অনেক দিন
কারো মুখের দিকেই
সোজাসুজি তাকাতে পারছি না ।

সিদ্ধি

তাড়াচ্ছ কেন? বসতে দাও ।জিরোই ।
ফুল মাটি ও ভালোবাসার রং বুঝতেই
কেটে গেল পঞ্চাশ বছর
এবার পলাশ ফুটবে,পটলও ফলবে
আকাশ ভেদ করে এক জোড়া
পটলচেরা চোখ তার সাক্ষী
সোনা খুড়িমা সব কিছু দিবালোকের মতো
স্পষ্ট দেখতে পায় ।

আদালে-বাদালে এত কথা কাটাকাটি
হয়ে গেছে যে
এখন কোনো কথারই মানে স্পষ্ট হয় না
মায়াবতীর কাছে দাঁড়িয়ে কয়েকটি কথা
কানে কানে বলেছিল নরু
সেই কানেরই এখন মাথামুন্ডু নেই
বন্ধ কালার শব্দ আর ব্রহ্ম সব একাকার
সোনা খুড়িমার এত কান-পালা
আড়াল থেকে শুনতে পেয়ে
আঙ্গুলে তুড়ি বাজিয়ে বললেন
কথাগুলো ঠিক বলেছিস নরু ।

একটা দামড়া মোষের পেছন কঞ্চি হাতে
লাফাচ্ছে একটা বাচ্চা
কচি কচুর পাতার ডগায় গত রাতের শিশির
আর পলিমাটির পেট ফাটানো
তুমুল পাটখেতের মাথায়
কোন স্বর্গ থেকে উড়ে আসা একটি ছেঁড়া ন্যাতা
বুলিমাসির বদনামের মতো
কোমর দোলাচ্ছে হাওয়ায়।
আমাদের না রাম, না গঙ্গা
বুলিমাসি সারাজীবন এত কম কথা বলেছে যে
সোনা খুড়িমা তার নাগালই পেলে না
ঈশ্বরের মতো সর্বাস্য হয়ে
নরু এখন হাই তুলছে
বরাক এক্সপ্রেস কেন্নোর মত ছুটছে
আর তখুনি হত্তুকি গাছের মাথায়
ধনীরাম বকসির মতো
একটা নিঃসঙ্গ ঢুপি ডেকে ওঠে
ছাপাই বাঁধাই চমৎকার
কিন্তু জীবনটা বড্ড ঝরঝরে থেকে গেল হে !


********************************
My Blogger Tricks

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন