প্রিয় অনুভব, প্রিয় সুব্রত
ভালোবাসার
কথা বলতে বলতে
একটা বই খুঁজে
পেলাম। ভাস্কর
চক্রবর্তীর 'প্রিয়
সুব্রত'। ভালোবাসার মতো ভালো লাগাটুকুও
ঘোরের। ক্রমাগত
নেশা ধরিয়ে দেয়। অনেক
আগের কোনো একদিন
, মনে হয় খুব
ছোটো তখন - বাস
থেকে দেখেছিলাম একটা
বকুল গাছের পাশের
মাচায় নদীর দিকে
মুখ করে গল্প
করছে দুটো ছেলে। বকুল
ফুলের গন্ধের মধ্যে
, একে অপরের কাঁধে
হাত রেখে।
প্রিয় সুব্রতর পাতায়
পাতায় ওরকমই কিছু
গল্প ছড়িয়ে - নিতান্তই
সাধারণ হয়েও যাদের
সাথে আমাদের সম্পর্ক
তৈরি হয়, ঝিম
ধরা ভালোলাগার।
মনে পড়ে বন্ধুর
সাথে কথা চালাচালি
- যেখানে অনেক কিছু
বলার। আবার
রকমফেরটুকু - কিছু
না বললেও বন্ধু
ঠিক বুঝে নেবে।
বইটি
গদ্যের, আমার
যদিও ভীষণ ভাবে
কবিতার মনে হয়।
উৎসর্গে ভাস্কর লিখেছেন
- " সঙ্গে থাকো।
সঙ্গে থাকো। সারাক্ষন
সঙ্গে সঙ্গে থাকো।
" কিরকম ছুঁয়ে
যাওয়া কথা, কি
সেই টান, সেই
বন্ধন যা আকুতিটাকে
রিপিট করছে বারবার।
যেকোনো সম্পর্কে এর
থেকে বড় চাওয়া
আর কি হতে
পারে।
বেশ
ছোটো বই , কয়েকটা
মাত্র পাতার - জিভে
দিলেই গলে যাবে।
আসলে ভাস্করের লেখা
এরকমই, আমেজে চোখ
বন্ধ হয়ে আসে
- একটা বুঁদ করা
ভাব। ঠিক আমাদের
পাড়ার দুপুরের রাস্তাগুলোর
মতন - শুনশান হয়েও
কয়েকটা মাত্র শব্দ
ছেড়ে যাচ্ছে। আর
হেঁটে হেঁটে নৈঃশব্দ
সমেত ওগুলোকেও শুষে
নিচ্ছি আমি।
বই
এর শুরুর স্তবকে
ভাস্কর লিখেছেন -
" সেই
অনেকদিন আগে - তুমি
বলেছিলে আমার শরীর
আরো খারাপ হয়ে
যাচ্ছে। শরীর নিয়ে,
দেখি , কাউকেই বেশী
কিছু ভাবেনা আজকাল।
তবু প্রায় রোজ
সকালবেলা তারপর থেকে
আমি একটা ডিম
খেতাম। ঘুম থেকে
উঠে সকালবেলায় ডিম
খেতে পাওয়া, সত্যি
, খুব মজার ব্যাপার
একটা। "
কত
সহজ একটা কথা।
যেরকম আমাদের প্রিয়
বন্ধুকে বলি - ' রোগা
দেখাচ্ছে তোকে। ' সেরকমই
আনমনে বলা কথা,
শুধু আপন কাউকে
বলা যায়। এই
প্রতিদিন সকালের ডিম
খাবার আনন্দ। কত
সরল আর কত
ব্যক্তিগত। আমাদের
এই প্রতিদিনের ছড়ানো
ছিটোনো মুগ্ধতা - ভাস্করের
গদ্য তাদের ঘিরেই।
এই
সমস্ত আরো অনেক
ইমেজারি উড়ে আসছে
লেখায়। খুব
আলতো করে ভাস্কর
ছুঁয়ে যাচ্ছেন প্রসঙ্গ
থেকে প্রসঙ্গান্তর।
হঠাৎ হঠাৎ মন
খারাপ এসে পড়ছে। সেই
চিরন্তন মন খারাপ,
যা আমাদের সবার
হয়ে থাকে, যাকে
আমরা প্রশ্রয় দিই,
তোলা দিয়ে দিয়ে
বাড়িয়ে তুলি।
সঠিক
জায়গায় শব্দহীনতা লেখায়
বিরাট একটা প্রভাব
ফেলেছে। ওই যে
ভাস্কর পরে লিখেছিলেন
না - " ঠিক সময়ে
ঠিক কথা বলার
দাম একটাকা, ঠিক
সময়ে চুপ করে
থাকার দাম দু'টাকা
"।
সেই
থম থমে পরিবেশ
আন্দাজ করতে পারি।
লিখেছেন '' আজ
চারিদিকের বাড়িগুলো
আরো চুপচাপ। আকাশ
চুপচাপ। শুধু গাছ
গুলো মাথা নাড়ছে
এমনভাবে, মনে
হচ্ছে, যেনো এখনই
কোথাও বেজে উঠবে
হারমোনিয়ম - যেনো
এখনই কোথাও নাচ
শুরু হবে '' এই
চুপচাপ থেকে সোজা
হারমোনিয়মে যাওয়ার
অংশটা লক্ষ করলে
বুঝতে পারি তিনি
নৈঃশব্দ থেকে শব্দ
চাননি। চেয়েছেন সুর
লয় তান। এতেই
এই অংশ এক
অন্য মাত্রা পেয়েছে
- নৈঃশব্দ থেকে সুরে,
অন্ধকার থেকে শধুই
আলো নয়, এক
অন্যরকম আলোতে ( জোৎস্নাও
হতে পারে ) প্রত্যাবর্তন। এতে কি
কোন দর্শন নেই?
ভাস্কর কি গল্প
করার ছলে আমাদের
ভালো থাকার মানে
গুলো ছুঁয়ে যাচ্ছেন
না?
যেনো
কোনো পুরোনো ফ্লাশ
ব্যাক, আমার মনে
পড়তে থাকে বৃষ্টির
সাথে প্রিয়জন বিয়োগের
চিরপরিচিত সম্পর্ক।
"আজও বৃষ্টির মধ্যে,
বাস্তবিক, আমরা
এমনই একটা শিশুর
মৃতদেহ বয়ে নিয়ে
যাচ্ছিলাম, যার
কোনো নামই ঠিক
হয়নি এখনো।" নাম
ঠিক না হওয়া
শিশুর মৃত্যু - কতোটা
নাটকীয় কথা খুব
সাধারণ ভাবে ভাস্কর
বলে নিলেন। বেদনাকে
বুকের ভেতর রেখে
হেঁটে যাওয়া ছড়িয়ে
এই বই এর
আনাচে কানাচে। এখানে
নিজের কান্নাটুকু উনি
কাঁদিয়ে নিয়েছেন বৃষ্টিকে
দিয়ে।
আবার
একটু এগিয়েই ভাস্কর
লিখেছেন - '' এক
একদিন ভাবি দিল্লী
যাবো। আর শিবুর
সঙ্গে দেখা হবে।
আর অনেক গল্প
করবো আর ঘুরে
বেড়াবো। তুমি চেনো
শিবুকে? চেনো
না? আমিও চিনি
না। '' রাগী রাগী
লোকজন হয়ত বলে
উঠবেন - 'ননসেনস' আর
আমার মনে পড়বে
আরও ছোটোবেলা যখন
ভাবতাম প্রত্যেক শহরেই
এরকম একটা আড্ডাবাজ
বন্ধু জুটে যাবে
- নিখাদ হুল্লোড়ের। এও
কি ম্যাজিক রিয়ালেজিমিয়ের থেকে কম
কিছু?
আসলে
এই বই পুরোটা
জুড়েই এক অদ্ভুত
আরোগ্যের ডায়েরী হয়ে
উঠেছে। শুধুমাত্র শরীর
না, মনের অদ্ভুত
সমস্ত অবসাদ কাটিয়ে
- ভাস্কর আরো শান্ত
হতে চেয়েছেন। ভিড়
থেকে সরে গিয়ে
একলা হতে চাওয়া
গুলো জুড়ে আছে
প্রতিটা অনুচ্ছেদেই। আমাদের
মধ্যবিত্ত ক্রাইসিস
, রহস্যময় ছেলে বেলা
, উত্তর কলকাতার এই
চাপা জীবন ভাস্কর
নিপুণ ভাবে সাজিয়ে
দিয়েছেন তার লেখায়।
সমস্ত টুকুতে ছড়িয়ে
এক অদ্ভুত শান্তির
ঘোর, ভাস্করের কথায়
- " ঘাস যেমন
সামান্য হাওয়ায় হেলে
পড়ে শান্তিতে , সেই
সহজ ফুর ফুরে
শান্তি। "
কিছু
ক্ষেত্রে এই বই
আমার নিজের অনুভব।
আমার বোকামি, হারিয়ে
যাওয়া বেলা থেকে
এক একটা মূহুর্ত,
প্রাইমারী স্কুল,
বোনের ব্যাথাভরা মুখ
- ' প্রিয় সুব্রত ' এর
আনাচে কানাচে সেগুলোকেই
ভাস্কর ডুবুরির মতন
তুলে দেখিয়েছেন আমায়।
ছড়িয়ে দিয়েছেন ভাঁজে
ভাঁজে নৈঃশব্দ , না
লিখতে চেয়েও একটা
জীবন লিখে ফেলেছেন
কোথাও।
আর
সুব্রত হয়ে উঠেছেন
ওনার অল্টার ইগো
- নিজেকে বলা কথা
গুলোই বন্ধুকে লিখেছেন
ভাস্কর। সেই যেমনটি
প্রথমে লিখেছিলাম।
আমার
চিরকালের চেয়ে আসা
- ওরকম একটা অসুখ
যা আমায় এক
অন্যরকম সেরে ওঠায়
নিয়ে যাবে, কিংবা
"এমনই এক জন
বন্ধু - যার বন্ধু
নেই কোনো"।
ভাস্কর তার এই
পাতলা বইটিতে করে
আমায় সেসব উপহার
দিয়ে গেছেন।
প্রিয় সুব্রত / ভাস্কর চক্রবর্তী
প্রথম প্রকাশ - ২০ শে জুন, ১৯৭৮
উৎসর্গ – ‘ সঙ্গে থাকো। সঙ্গে থাকো। সারাক্ষন সঙ্গে সঙ্গে থাকো।’
প্রচ্ছদ - কমলকুমার মজুমদার
পৃষ্ঠা সংখ্যা - ১৪ পাতা
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
বড় ভালো লিখেছেন
উত্তরমুছুন