জন্মঃ ১৯৮৩
বইপত্রঃ কোনো একটা নাম (২০১৩, কৌরব প্রকাশন),
যতদূর বৈধ বলি (২০০৯,সপ্তর্ষি প্রকাশন)
যোগাযোগঃ eijeanimikh@gmail.com । animikh.patra@facebook.com
কবির সমাজ
স্বেচ্ছায় নয়, নিতান্তই দুর্ঘটনাপ্রসূত, একদিন কবি পরিচয় আর লুকিয়ে রাখা যায় নি। সেই এক বিড়ম্বনার শুরু। কবি পরিচয় চারপাশের সাধারণ সমাজে কতোটা ভারবাহী? টের পেয়ে হাঁফ ধরে যায়। দেখি, বেশির ভাগ মানুষ আগে থেকে কল্পনা করে রাখা এক একটা ধারণা দিয়েই বিচার করে নতুন মানুষকে , নতুন ভাবনাকেও নিরন্তর প্রতিরোধ করে। কবি এক অবাস্তব পৃথিবীর জীব, তাকে চিড়িয়াখানার পশুর মত কৌতূহল নিয়ে দেখতে হয়। যদি আবিষ্কার হয় কোনো প্রাগৈতিহাসিক ম্যামথ চিহ্ন, কোনো অতিরিক্ত শিং। না, এসব খালি চোখে দেখা যায় না মোটেই। তবু আমজনতার ভাবনা কি পালটায়! মানুষ ট্যাগ করতে বড়ো ভালোবাসে। না পারলে হন্যে হয় আরো। একই দায়িত্ব পালন করবে, একই মাইনে পাবে, তবু সে আলাদা। তার পা তো মাটিতে পড়ার কথা নয়। সে হবে ভুলোমনা, কোনো কাজই ঠিকঠাক সামলাতে পারবে না, অষ্টপ্রহর কবিতা ভাবতে থাকবে, মাঝে মাঝেই খস্খস্ করে কী সব যেন লিখবে – তবেই না আমাদের ধারণার সফল উদ্যাপন! আর কবিতা মানেই তো ফুল, পাখি, চাঁদ, তারা –এইসব। সে সবসময় ছন্দ মেলাবে – ফুল এর সঙ্গে ঝুল মিলিয়ে দেখতে গিয়ে সে নাওয়া খাওয়া শিকেয় তুলে দেবে! তবেই না তাকে আমরা ‘কবি’ বলে ভালো করে পেড়ে ফেলতে পারবো আমাদের কোড অফ কন্ডাক্টের অদৃশ্য অথচ সর্বময় বিধানবইয়ে।
কিন্তু আমার ধারণা কেনই বা এইরকম হলো? তার পেছনে তথাকথিত কবিদেরও হাত আছে নিশ্চয়ই! এই যেমন, কবিতা বিষয়ক গদ্যের কথা এলেই, দেখেছি, কবি তার বল্কল খসিয়ে ফেলে। এই এক্ষুণি যে কথায় কথায় রাজা উজীর মারতে মারতে নিজের অজান্তে চলে যাচ্ছিল রান্নাঘর ও রাজনীতির দিকে, সে হঠাৎ কেমন স্বরচিত কুয়াশায় নিজেকে হারিয়ে দিতে চায়। নিজের কথা বলতে থাকে। তার ভাষা পালটে যায়। তার গলা পালটে যায়। আর চেনা যায় না তাকে। তবে কবি কোথায় থাকে? আমি ধন্দে থাকি।
তাহলে কি কবি এক অর্কেষ্ট্রা-পরিচালকের মতো? কেবল এক নির্দিষ্ট ও বিশেষ সময়ই তার সময়? যখন তার দিকে চেয়ে আছে বিভিন্নরকম হাত? আর সে অধিকারী, সে স্পর্শ না করলে বাজনা হবে না? তারপর সময় ফুরোবে। রিং ছেড়ে নেমে আসবে সে। তার মন কেমন থাকবে তখন? সাধারণ হতে ঠিক কতোটা সময় নেবে সে? নাকি নেমে এসেই বুঝবে, যে ধরার সময় বোধ হয়নি, ছেড়ে এসেই খেয়াল হলো, সবকিছুতেই খেলনা হয়ে গেছে !
১/এ সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের যে বাড়িটায় আমার ছাত্রজীবনের সাত বছর, তার অতীত ও বর্তমান বাসিন্দারা, এবং সেইসূত্রে আরও কেউ কেউ আমাকে ‘কবি’ বলে ডাকে। অনুজরাও। এটা প্রপার নাউন। যেমন, বন্ধুপত্নীরা ‘কবি’দা’। এর বাইরে কবি সম্বোধন সহজভাবে নিতে পারি না আমি। কেন আড়ষ্ট হই, বোধহয় অসন্তুষ্টও, ঠিক বুঝতে পারি না। সালভাদোর দালি নাকি ক্লাসে পড়াতে যাবার সময় নিজের স্বাভাবিক মাপের চেয়ে একসাইজ ছোটো জুতো পরে যেতেন। পায়ে যত কষ্ট হবে তার লেকচার হয়ে উঠবে ততই ক্ষুরধার। মোপাসাঁ লিখতে বসতেন মাথার দুপাশে দুটো জোঁক রেখে। তারা যত রক্ত শুষবে তার লেখাও হয়ে উঠবে তত উদ্দীপ্ত। আমি তেমন কিছু নই। বিনয় নয়, এর সমর্থনও পেয়ে যাই ঘনিষ্ঠ পাঠকের কাছ থেকে। আমার সাম্প্রতিক বইটি গড়ে তুলবার সময়, শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার দীর্ঘ কথোপকথন চলে ই-মেইল-এ। সেখানে শুভ্রদা একবার বলে যে, আমার কবিতা পড়ে তার শিমাস হিনি’র কথা মনে হয়। অর্থাৎ “ A nine to five man touched by poetry”। চূড়ান্ত পান্ডুলিপিতে অবশ্য এই প্রশ্নটি বাদ পড়ে যায়। কারণ আমার এর স্বপক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলার থাকে না। আমি নিয়মিত স্যালারিবৃদ্ধির হিসেব কষি এবং ইলিশের দাম কমার জন্য অপেক্ষা করি।
একটা সমান্তরাল চিন্তা পৃথিবী অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে থাকে। স্মৃতির অনেক খোপে অনেকরকম পায়ের শব্দ। জ্ঞান ফিরে পাবার আধোসময়ে যেমন। কাচের পর্দার অপর পিঠ থেকে কোনো টিভি’র দোকান যেমন। এইমাত্র প্রেমে পড়া নবীন মানুষেরও কি তেমন নয়? আমি কবিতা লিখি, তাই আমি শ্রেষ্ঠতর জীব – এমন ভাবনা কি নানান চাবুকবাহিনির সামনে গড়ে তোলা যুদ্ধবর্ম নতুবা পরিশ্রমের ভয়ে ছুটি নেবার দরখাস্ত নয়? কবি ভাবজগতের ঊর্ধলোকের অধিবাসী, মাটিতে তার পা সতত পড়ে না- এমন প্রচলিত ধারণায় আমরাই সম্ভবত সলতে দিয়ে থাকি। কবি মাত্রেই ঋষি কিংবা শান্তমিঠে নন। প্রকৃত অভিজ্ঞতা বলে, মানবধর্ম মেনেই কেউ তিরিক্ষি কেউ ধীর কেউ বা দুইয়ের মিশেল। নইলে কেনই বা আর পারস্পরিক নিন্দেমন্দে ভরে থাকবে কবিদের দলীয় পৃথিবী?
আমাদের কলকাতা শহরেই, আমাদের আশেপাশেই তো ছিল দেব মাইতি, শূন্য দশকের প্রথমার্ধ জুড়ে দাপটের সঙ্গে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় রাগী কবিতা লিখে গেছে সে। একটা চটি বই, একটা বৃষ্টিদিন পুরষ্কার। বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক মন্দা’র আঁচ নাকি সফলভাবে থামিয়ে দিয়েছিল আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার। তবু তার যে যৎসামান্য আঁচড় ইতিউতি এসে পড়ে আমাদের পোড়া এই দেশে, তাতেই দেব এর অস্থায়ী চাকরিটুকু যায়। সে তার পৈতৃক গ্রামে ফিরে যায়। গ্রামএর নামটাও বেশ মানানসই- হরিণভাষা। তার না-চলা সংসারে বাবা-মা কবিতার ভূত তাড়াতে চেয়েছিলেন একমাত্র রোজগার-সক্ষম ছেলের মাথা থেকে। ভূত তাড়াতে নিদানস্বরূপ কবির বিয়ে দেওয়া হয়। শুনেছি, দেবের বউ নাকি ঘোড়ারোগের উপায় হিসেবে দেবের কবিতার খাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলে দেয়। ইরেজার দিয়ে কালি মোছার মত দেব মাইতি কবিতার প্রকাশ্যজগত থেকে মুছে গেছে। ভুল বললাম, ওটা বোধহয় কারেকশন ইঙ্ক লেখা উচিত, যা দিয়ে কারেক্ট করে দেওয়া হয়েছে কবিকে।
নভেম্বরের এক পড়ন্ত বিকেলে সাইকেল করে একদিন শম্ভু রক্ষিতের বাড়ি পৌঁছে যাই। দেখি ষাটের সম্ভ্রমজাগানো, স্বতন্ত্র ডিকশনের এই কবি রেললাইনের ধারে নয়ানজুলিতে মাটি কাটছেন, ঝুড়িতে তুলছেন, বয়ে আনছেন, বাড়ির সামনে ফেলে দিচ্ছেন – কেননা রাস্তা হবে। একাই। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে পুরো দৃশ্যটা দেখি। চোখে আবেগ এসে যায়। কবির শতচ্ছিন্ন বাড়ি, একটু উঠোন, তার চারদিকে অনেক গাছ। অনেক ছায়া। গ্রামে ছোটোবেলা কাটিয়ে ফেলা আমি এই প্রথম কোনো বাড়ি দেখি যার দেয়াল বলে কিছু প্রায় নেই। শম্ভুদা একটা টুল উঠোনে পাতেন। আমি বসি। মাটিমাখা হাতে শম্ভুদা আমার সামনে উবু হয়ে। একটিমাত্র টেবিলফ্যান তার, ক’দিন আগে চোরে নিয়ে গেছে, শম্ভুদা জানান। শম্ভুদা’র অনেক গর্ব- তার ছেলের নাম কীর্তিকর, মেয়ে দিওতিমা। আমি কবিকে তার লেখায় মিথের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন করি। কবি কেবল হাসেন। কথা ঘোরান। ষাট-সত্তরের কলকাতা দাপানো, জরুরি অবস্থায় জেলে যাওয়া এই কবির উঠোনটাকেই আমার মহাপৃথিবী বলে মনে হয়। প্রায় বছর পঁচিশ বিরিঞ্চিবেড়িয়ার ওই গ্রামে কাটিয়ে দেবার পরও কবির কোনো বন্ধু নেই। অটল একটা বর্ম দিয়ে প্রতিরক্ষা সাজিয়ে রেখেছেন শম্ভু রক্ষিত।
প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না ? স্টাফরুমে বসে আমার বরং হাসি পেয়ে যায়। না, দেব কিংবা শম্ভুদা – আমার জীবন এদের কারো মতো নয়। আমার কবিতার খাতা কেউ কখনো ছিঁড়ে দেয়নি। হয়তো বা বেশ খানিকটা প্রশ্রয়ই পেয়েছি। আমি বরং একটু তিরিক্ষি হয়ে যাই এরপর থেকে। সরলমনের প্রশ্নদেরও আক্রমণ করি। কেউ আমাকে ‘কবি’ বলে ডাকলে তাকে বলি মাইনে একটু বাড়িয়ে দেওয়ার সুপারিশ হোক তবে। কেন? কবি হওয়ার তো কোনো পরিশ্রম নেই। তিনি তো কেবলই ঊর্দ্ধগগনবিহারী। তার আর কষ্ট কি ? অথচ সকলেই কিন্তু ভেতরে ভেতরে দু-চার কলম কখনো সখনো, প্রেমে কিংবা প্রেম ভাঙায়, কবি হওয়ার চেষ্টা করে গেছে। তারপর যে ফুল ছিল ঝরার কথা, ঝরেছে। আমি প্রথমদিকে, কবি যে গণিতজ্ঞ হতে পারেন কিংবা উঁচুপদের ইঞ্জিনিয়ার, বোঝাতে কিছু উদাহরণ দিই। আর্যনীল মুখোপাধ্যায়। বারীন ঘোষাল। তারপর স্রেফ মৃদু হাসি। শৌখিন সমাজে আমারও নাহয় শৌখিন একটা বর্ম থাকুক।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন