জিয়াং হাও-এর কবিতা
অনুবাদ
: অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়

চীনের নব্বই দশকের কবি জিয়াং হাও-এর জন্ম ১৯৭২-এ। চীনের সিচুয়ানের
চংকিং-এ। জিয়াং একজন কবি, গদ্যকার, সম্পাদক এবং বুক ডিজাইনার। ২০০২
সাল থেকে সম্পাদনা করেন ‘নিউ পোয়েট্রি’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা। কবিতা লিখছেন
১৯৮৭ থেকে। একটি প্রবন্ধ সংকলন এবং চারটি কবিতার বই রয়েছে জিয়াং-এর। ১৯৯৪ থেকে
২০০৪— এই দশ বছরে লেখা কবিতা নিয়ে ২০০৫-এ প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতার বই ‘রেটরিকস্’।
এর আগে ২০০৩-এ প্রবন্ধের বই ‘ফ্র্যাগমেন্টস্ অফ ফিয়ার’। ২০০৯-এ দীর্ঘ-কবিতার বই
‘কমেডি’। ২০১০-এ ‘ক্লাইম্ব দ্য ট্রি টু ক্যাচ্ ফিশ্’। এবং ২০১৩-তে চতুর্থ কবিতার
বই।
একজন পরীক্ষামূলক কবিতা
চর্চাকারী হিসেবে জিয়াং ওঁর কবিতায় প্রায় সবকিছুকেই সম্ভব করার চেষ্টা রাখেন।
ইলাস্ট্রেশন, স্থানীয় স্ল্যাং, ডায়লেক্টস্, ভিস্যুয়াল আর্ট এবং আরো নানান আঙ্গিক—
সবকিছুই এসে যায় ওঁর লেখায়।
চীনের আরেক কবি-শিল্পী চেং জিয়াওবেই, বেজিং-এর কাছে ইয়ান পর্বতমালার নীচে
গড়ে তুলেছেন চীনের একমাত্র ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট রেসিডেন্সিয়াল প্রোগ্রাম— শাঙ্গিউয়ান
আর্ট সিন। যেখানে প্রত্যেক বছর মার্চ
থেকে অক্টোবর, এই সাত মাস পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে কম ক’রে তিরিশজন কবি,
ভিস্যুয়াল আর্টিস্ট, কিউরেটর, এ্যাকাডেমিশিয়ান একসাথে থেকে বহু-স্তরীয় সংস্কৃতি ও
শিল্প-মাধ্যমের আদান-প্রদান করেন, গবেষণা করেন, ওয়ার্কশপ করেন, নিজেদের শিল্প
নির্মাণ করেন, এক্সিবিশন করেন। ভিস্যুয়াল আর্ট,
স্কাল্পচার, সেরামিক, থিয়েটার, নাচ, সাহিত্য, ফিল্ম, আর্কিটেকচার, মিউজিক,
এ্যানিমেশন এতকিছু নিয়ে কাজ হয় সেখানে। জিয়াং হাও ২০০৮ সালে আর্ট ডিরেক্টর
হয়েছিলেন এখানেই।
জিয়াং, ওঁর কবিতায় নির্দিষ্ট কোনো একক উত্তরের সন্ধানে নামেন না কখনো।
দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত প্রত্যয়ে যেমন উনি কোনো কিছুকে সত্য বা স্থির ব’লেও স্বীকার করেন
না নিজের কবিতায়, তেমনি অস্বীকারও করেন না। ওঁর যেন কোনো নির্ভুল উত্তরের প্রয়োজনই
নেই। নিজের কবিতায় কোনো একটিমাত্র জবাবে জিয়াং থেমে থাকেন না। খুঁজতে থাকেন একের
পর এক নতুন নতুন অর্থকে।
সমুদ্রের আকার বিষয়ক একটি কবিতা
সমুদ্রের আকার নিয়ে প্রায়ই জানতে চাও তুমি
আমি ভাবছি এরপর থেকে দু’ ব্যাগ সমুদ্রের জল দিয়ে
দেবো তোমায়
একজোড়া চোখের মতো, এটাই সমুদ্রের আয়তন
অথবা চোখ যতটুকু দ্যাখে ততটাই
তুমি ছুঁয়ে ফেলছ, যেন মুছে দিচ্ছ জ্বলতে থাকা
চোখের জল
যেন অশ্রুই হ’ল এই সমুদ্রের আয়তন
এই যে স্পষ্ট, সে নিজেই লাফিয়ে উঠছে একই চেতন
থেকে
ঐ দুটো ব্যাগকে এক ক’রে দিলে
সমুদ্রটা বড়ো হয়ে যায় না।
এখনও তাজা, টাটকা জল থেকে
যেন দুটো না-মাছ বেরিয়ে আসবে এক্ষুনি সাঁতার
কাটতে কাটতে
তুমি জল ছিটিয়ে দেবে ফুলের বালিতে।
রুটি, হ্যাঁ রুটিও একটা সমুদ্রের আয়তন
পাল তোলা জাহাজের মতো তুমি তাকে সাবলীল কেটে
ফেলার আগেই
সে ছেড়ে চলে যাবে
তীর ছেড়ে চলে যাওয়া নৌকোর মতো।
টেবিলের ওপর ফেলে যাওয়া প্লাস্টিক ব্যাগ
সেটাও সমুদ্রের আয়তন
তীর থেকে জোয়ার সরে গেলে
সমতল।
যখন প্রকৃত জোয়ার চলে যায়, ফেলে যায় ওদের লবণ
সে-ও একটা সমুদ্রের আয়তন হতে পারে।
বিশ্বাস হচ্ছে না তো?
এক ব্যাগ জল আর এক ব্যাগ বালি নিয়ে দ্যাখো
সমুদ্রের আয়তন।
প্রথমে তুমি সত্যিটা স্বীকার করছ, এবং অস্বীকারও
তারপরে কি নয়-স্বীকার আর নয়-অস্বীকার?
যাও, নিজেই এবারে চেষ্টা ক’রে দ্যাখো না বরং
যেন এটা তোমারও আয়তন হতে যাচ্ছে। কিন্তু তুমি তো
বলবে,
‘আমি শুধুমাত্র আমারই ইমেজ ছাড়া কিছু নই’
উপলখণ্ড
এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায়, আবহাওয়া এখন পরিষ্কার
গাছের নীচে পাথরের এই বেদীও ঝকঝকে
বৃষ্টির জলের দাগ, ছোপছোপ, পাথরের গায়ে
আমি হয়ত আরেকবার বসব এই পাথরে, আধ ঘণ্টার জন্য।
সময় রেখে যাব পাখি, টিকটিকি
এমন কি কাঠবিড়ালির বসার জন্যেও,
ওদের সমুদ্র দেখার জন্যে।
যেন শাদা বালির ওপর পড়তে থাকা পাতার ওপর
ভেসে থাকা ডিমের মতো
মসৃণ আর চকচকে হয়ে উঠবে এই পাথরের গা
গোল হয়ে উঠবে এই উপলখণ্ড
এই নুড়ি আসলে গাছের ডিম
আমার মনে হয়, ডিম ফুটে বেরোবার অপেক্ষা করছে
ওপরে, কাৎ হয়ে ঝুলে থাকা গাছের ডাল
যুবতী সাপের মতো গুঁড়ি মেরে, নিঃশব্দে এগোচ্ছে
ডিম পাড়ার জন্য
ছোট্ট ছোট্ট পা দোলাচ্ছে
যেন লাথি মেরে শূন্য নুড়িটাকে সমুদ্রে ফেলবে
এক্ষুনি।
ডিম ফুটলো কি?
ছোট্ট
জিনিস
ওড়ো,
দ্যাখো, কত ছোট্ট দেখাচ্ছে তোমায়,
দেখতে পাচ্ছি।
দু’পাশে ঝোপঝাড়, গাছপালা
আমি কিচ্ছু জানি না।
গ্রীষ্মাবকাশে জমানো সইগুলো দেখাচ্ছ আমায়
এক ধূসর, শাদা রাস্তা
দিনের আলোতে স্নান করছে।
গাছের পায়ের কাছে এসে, রাস্তা একটা ছোট্ট বেড়ালের মতো
লুকোচ্ছে।
একটা রাস্তা, কোনো মুখ্য ভূমিকা নিচ্ছে না
তোমার কিম্বা আমার কাছে।
তোমার কোমরে উজ্জ্বল আঁচিলগুলো গুনছি
যেন জলাশয়ের ধারে একজনকে ফেলে গেছে কেউ।
প্রত্যেক রাতে, পুকুর, তার ছোট ছোট ঢেউয়ের
বাড়িয়ে দেওয়া আঙুল গুনছে
চকচকে সব আংটি পরাচ্ছে তাতে।
দেরি ক’রে আসা লোকজন হাওয়ার মতো দূরে নিয়ে যায় তাদের
ওরা অপেক্ষা করবে। এবং অপেক্ষা করবে।
যে ক’টা পাথর আর শিশির আমি ভালোবাসি
তারা দাবির চিৎকারে তুমুল হল্লা করছে
কাদা তুলে আনছে নৈঃশব্দ থেকে।
ছুটন্ত ট্রাকের হঠাৎ আলোয় ভাবছে
এ’ যেন এক উদোমডাঙ্গা।*
সন্ধ্যায় আমরা পাহাড়ে গিয়ে
ভাত খাবো, কিন্তু এখন নয়।
ইহা প্রদোষের আবছায়াতেই নিরাপদ।
ঘাসের তাজা পাতা দিয়ে সাজানো টেবিলক্লথ
বিছানার চাদর যেন একটা।
অনেক দূরের এক পাহাড়ের কোণে
বুদবুদ্ ব’সে থাকছে
কোকের কাপে
Nota Bene
উদোমডাঙ্গা। কবি বারীন ঘোষাল ওঁর ‘উদোমডাঙ্গা’ উপন্যাসের নামকরণে এই শব্দটির প্রয়োগ করেছিলেন, ‘Wasteland’-এর বাঙলা প্রতিশব্দ ক’রে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন