অমিতাভ মৈত্রর
জন্ম ১৯৫২ সালে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ বিদ্ধ করো, তীর প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। তাঁর
অন্য কবিতার বইগুলি হোলো পতনকথা, টোটেমভোজ, ষাঁড় ও সূর্যাস্ত আর পিয়ানোর সামনে বিকেল। গদ্যগ্রন্থ
দুটি। পতনশীল নায়ক আর সাপলুডো। অন্যরকম মানুষ। পরিচিতজনেরা জানেন। অন্যরকম পাঠক জানেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে বেদনার্ত আলো-বহনকারী
অমিতাভ মৈত্র
আপেল
আপেলের মধ্যে থাকে শুধু আর একটি আপেল অথবা তার সম্ভাবনা
যেমন নারী;
আর তার বেড়ে ওঠা কেবল পূর্ণতার
দিকে
যেমন মৃত্যু;
আর তার শরীরে এমন এক আদিম
সরলতা
যার সামনে ঘাতকের অস্ত্র থমকে
দাঁড়ায়।
আবার আপেলের যা নেই, খুব
সাধারণভাবে আমরা তাকে
বোধ বলতে পারি,
আর যার বোধ নেই তার কোন জাগরণও নেই।
হয়ত তাই একটা সুতো আঁকড়ে মুখ
বুজে ঝুলে থাকা
খুব স্বাভাবিক লাগে তার। আসলে
আপেলের
নেই শুধু কোন অসুখ, কোন
পরীক্ষামূলক যুদ্ধের প্রস্তুতি।
শিকার কাহিনি
রাত দেড়টায় আমরা চাঁদের শিকার
দেখতে বাগানে নেমেছি,
বন্য চিতার মতো গুঁড়ি মেরে
চাঁদ এসে লাফিয়ে পড়েছে
মেঘের নরম ঘাড়ে--
এ দৃশ্য দেখেনি কেউ, শুধু কিছু
রাত্রিভুক পাখি
অতর্কিতে ভয় পেয়ে ডেকে উঠেছিল
পুলিশ লাইনে টানা বেজে উঠেছিল
বাঁশি, আর
রাত্রিকে নস্যাৎ করে দৌড়ে
গিয়েছিল দমকল।
দৃশ্যটির ফ্রেম ভেঙে যেতে
আমরা বিরক্ত হয়ে ঘরে ফিরে
ঘুমিয়ে পড়েছি।
দাঙ্গার খবর শুনি পরদিন
রেডিওয়, স্থানীয় সংবাদে
যতক্ষণ টগর থাকবে
মেয়েটিকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে
যাওয়া হচ্ছে মিলিটারি ব্যারাকে
নাচের জন্য। ভিতরে মাংসের
গন্ধ, আগুন
আর জড়ানো গলার হৈ হল্লা।
নতুন দখল হওয়া এই শহরে
কোথাও আলো জ্বলছে না আজ।
ধোঁয়া উঠছে এখানে সেখানে—
একটানা বেজে যাচ্ছে বলির
বাজনা।
অভ্রকণার মতো চাঁদের আলো আছড়ে
পড়ছে
রক্তের হালকা ছোপ লাগা একপাটি জুতোয়
ভয়াবহভাবে কোথাও ফুটে উঠেছে
টগর।
যতক্ষণ চাঁদের আলো
থাকবে, টগর থাকবে
ততক্ষণ মেয়েটি হয়ত নিরাপদ।
কিন্তু তারপর?
সামান্য শব্দজীবি, এর বেশি
জানাবোঝা নেই।
কালো ওই মেয়েটিকে ঈশ্বর নিজের
হাত আজ
অনুচ্ছিষ্ট মাংস খাওয়াবেন।
ক্ষুধা
শাক্যসিংহ বিষয়ক আমাদের গল্পের
ভিতরে
ভেসে ওঠে ফাঁপা, গোল চাঁদ—আর
আমাদের ছোটবোন গলা মোচড়ানো সাদা
হাঁস
কাপড়ে আড়াল করে ভেজানো দরজা
খুলে
ভোর রাতে বাড়ি ফিরে আসে
ক্ষুধাকে সে বোধিজ্ঞান ভাবে
না এখন।
ত্রিশ-বত্রিশ বছর আগে যে
কবিতা লিখতাম তা ছিল এইরকম। বছর দশেক ধরে লেখা এইসব কবিতা নিয়ে বেরিয়েছিল আমার
প্রথম বই ‘বিদ্ধ করো, তীর’। দু-ফর্মার সেই রোগা বইটাতে যত বেশি সম্ভব কবিতা রাখার
চেষ্টা করেছিলাম। তখনই আমার মনে হয়েছিল—দীর্ঘদিন ধরে এমন কবিতা লিখে যাওয়া—আমি
পারব না। আরও প্রত্যক্ষ আরও কর্কশ ও তীব্র কিছুর জন্য প্রতীক্ষা করছিলাম তখন।
এমনকি যদি তা যোজন দূরত্বে চলে যায় শিল্প থেকে কবিতা থেকে—যায় আসে না কিছু।
চাইছিলাম শিল্পিত প্রকাশভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসতে। যদি নরম গোলগোল এইরকম সব কবিতা
আমাকে দীর্ঘদিন ধরে লিখে যেতে হয় এই সামান্য পুঁজিপাটা সম্বল করে—বজরা ঠেলা লগি
দিয়েও সেই কবিতা স্পর্শ করবেন না কেউ। প্রবল শক্তিমান যাঁরা তাঁদের কথা আলাদা।
তাঁরা যা পারবেন আমি তো তা পারব না। তাহলে কি আমাকে সারাজীবন এইরকম কবিতাই লিখে
যেতে হবে?
‘বিদ্ধ করো, তীর’-এর এইসব
কবিতা থেকে আমার আত্মা বিযুক্ত হয়ে গেল। নিজের কবিতা বিষয়ে স্ফীত আস্থা নেই এমন
মানুষ যা করতে পারেন, আমি তাই করলাম। এরিনা ছেড়ে সরে গেলাম।
২।
ফিরে এলাম দশ বছর পরে, রাত্রির
যুদ্ধক্ষেত্রে বেদনার্ত আলো- বহনকারীর মতো। যে পৃথিবী আমার ছিল এতদিন, তা ভাঙতে
শুরু করল আস্তে আস্তে। এক জান্তব আক্রোশ তৈরি হত। আমি নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিলাম সেই
আক্রোশের অভিমুখ। যে বিষবাস্পে পরিপূর্ণ অন্ধকার ঘরগুলি আমার দেখার কথা, কিন্তু
অসহনীয় বলে যে ঘরগুলি আমি এড়িয়ে গেছি এতদিন, আমি আশ্রয় খুঁজে পেলাম সেখানে। দেখতে
চাইলাম ডিসভর্তি থকথকে রক্তমাখা ঠোঁটগুলোর দিকে তাকিয়ে ‘আলো’ শব্দটি উচ্চারণ
করে সত্যি আমি আলো সৃষ্টি করতে পারি কিনা। নিজের জন্য এই ছিল আমার চপেটাঘাত।
চেয়েছিলাম আক্রোশের অভিমুখ আমার
দিকে ঘোরাতে। কিন্তু সেই আক্রোশ নিজেই জীবন্ত হয়ে উঠে প্রতিশোধ নিতে শুরু করল আমার
উপর। এমন এক ভয়ংকর দেখায় জীবন নিয়ে গেল আমাকে যে, প্রতিরোধহীন ভেসে গেলাম আমি।
বুঝলাম যে জীবন আমরা যাপন করি আসলে তা ইলিউশান, যেটা সরিয়ে নিলে দর্পণহীনভাবে
মেড়ুসার চোখে চোখ রাখতে হয় এবং ফেরা যায় না আর। রাতের পর রাত আমি ঘুরে বেড়িয়েছি
প্রেত-তাড়িত সেই প্রাচীন নাবিকের মতো একা। রক্তপাতের দৃশ্য সহ্য করতে
পারতাম না একদিন। পরে রক্তস্রোতেই নৌকা ভাসতে লাগল আমার। সেই বিভীষিকার জগৎ রক্তের
আঁশটে ব্লান্ট-গন্ধ মাখা ভাষায় উঠে এল ‘টোটেম’...-এ। বইটাকে কবিতার বই বলতে হলে
দু-বার ঢোঁক গিলতে হবে আমাকে।
এবার আমার মতো করে লিখতে
শুরু করলাম। তার আগে সর্বস্বান্ত করে নিলাম নিজেকে। যে ধরনের দেখায়, যে ধরনের
প্রকাশভঙ্গিতে সহজ ছিলাম, বর্জন করলাম সে-সব। ঠিক করলাম vision of evil থেকে যা উঠে আসে না, তা আমার
কবিতা নয়। ভাষাকে করে তুললাম আড়ষ্ট, মন্থর, শ্বাসরোধকারী। প্রচুর ক্রিয়াপদ চলে এল।
সংকেতময়তা থেকে মুক্তি দিলাম আমার ভাষাকে। ‘টোটেম’...এর পরে যখন ‘সি. আর. পি. সি ভাষ্য’ বা Tarot
card নিয়ে লিখতে শুরু করলাম তখন মনে হল ভাষার সঙ্গে এই অসমযুদ্ধ
এবার শেষ হওয়া দরকার। নাহলে এই ভাষা আমাকেই খেয়ে ফেলবে। ‘টোটেম’... লেখার সময়
একধরণের অ্যাংজাইটি নিউরোসিস চেপে বসেছিল আমার উপর। ‘অদ্ভুত সব চোখ, আর এক গোল
মাংসমাখা ভাষা’ আমাকে অস্থির করে দিত।
খুব বোকার মতোই আমি চেয়েছি
একটা project work-এর মতো
করে লেখা তৈরি করতে। ‘টোটেম...’—এ ছিল একটা সিউডো এপিকের আদল। ম্যাডাম এম. ছিল যার প্রোটাগনিস্ট এবং মাংসের বিরুদ্ধে যুদ্ধই যেখানে প্রধান। ‘ষাঁড় ও
সূর্যাস্ত’ বইটিতে আমি বস্তু, আলো গতি নিয়ে ছোটছোট ভাবনা লিখে রাখার চেষ্টা
করেছিলাম মেটাফিজিক্যাল ধরনে। ওইসব বিষয়ে আমার জানার পরিধি এত কম যে কবিতাগুলো
খানিকটা জটিল আর স্মোকি হয়ে গেছিল। মাংস থেকে পরিত্রাণ পেতেই কবিতাগুলো লেখা।
কিন্তু লেখাগুলো নিয়ে আমার সংশয় আছে।
দৃশ্য থেকেই আমার লেখা আসে।
দৃশ্য হয়েই আসে। ছায়ায় ঢাকা একটা বারান্দায় একটু আলো নামছে—এই সামান্য দৃশ্যটুকু
থেকে ‘ছায়া’ কবিতাটা লিখেছিলাম যা ‘ষাঁড় ও সূর্যাস্তে’ আছে। ওই বইটিতেই আর একটি
কবিতা ‘মোড় ও বৃষ্টি গাছ’। একটু বিস্তারেই লেখাটা নিয়ে যদি বলি? টেলিভিশানের একদম
প্রথম যুগ। ভারত ওয়েস্ট-ইন্ডিজের টেস্ট দেখানো হচ্ছে দূরদর্শনে। হোল্ডিং-এর একটা
তীব্র গতির বলে অসাধারণ একটা স্কোয়ার কাট করলেন গাভাসকার। অ্যাকশন রিপ্লে তখনও
আজকের দিনের মতো খুঁতহীন হয়ে ওঠেনি। উল্টোদিক থেকে দৃশ্যটি দেখানো শুরু হল। সীমানা
থেকে দ্রুত বলটি ছুটে আসছে গাভাসকারের ব্যাটে। শূন্য থেকে ব্যাট নেমে আসছে,
স্ট্যান্সের ভঙ্গিতে পিছিয়ে যাচ্ছেন গাভাসকার। এবার বল ডেলিভারি ও ফলো থ্রু থেকে
ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছেন হোল্ডিং তাঁর রান-আপ শুরুর জায়গায়। গোটা ব্যাপারটা ঘটল
রিওয়াইন্ড করে দেখার বিভ্রম থেকে। বছর কুড়ি পার বিকেল চারটেয় আমার বাড়ির সামনের
মোড়ে দাঁড়িয়ে। সামনে ওষুধের দোকান। হঠাৎ সেই খেলার দৃশ্যটি মনে পড়ল। ওষুধের দোকানে
হাসতে হাসতে ঢুকে পড়া মহিলাটিকে যদি সেই অ্যাকশান রিপ্লের মতো শেষ থেকে শুরুর দিকে
পিছোতে দেখা যায় কেমন হয়? এবার দেখা যাক কবিতাটি।
মোড় আর বৃষ্টিগাছ
ওষুধের বাক্স থেকে একজন মহিলা
হাসতে হাসতে পিছিয়ে যাচ্ছেন,আর রং—
ক্রিম একটা রেনকোট হাসতে হাসতে
পিছিয়ে যাচ্ছে খটখটে রোদ্দুরে,আর রং—
অর্দ্ধেক গলে যাওয়া বাস চাকায়
একজনকে দ্রুত পিছিয়ে যাচ্ছে
আর হাসতে হাসতে রং—
শেষের দিকে যে গলা তীব্র হয়ে ওঠে
আর দূরত্ব সরে যায়
আর একইরকম হাসতে
হাসতে রং—
দু’বছর ধরে। প্রতি রবিবার।
বিকেল সাড়ে চারটে। দু’বছর ধরে।
৩।
কয়েক বছর পরে যখন ‘পিয়ানোর
সামনে বিকেল’-এর কবিতাগুলো লিখছি তখন ‘ত্রিস্টোফার’ নামের একটা চরিত্র চলে এল।
(যেমন এখন যে কবিতাগুলো লিখছি সেখানে ‘হেনরি’ এসেছে) কবিতায় নাম আসে। কখনও সে নাম
মানুষের। কখনও না-মানুষের। কবিতাগুলি তাদের জন্যই লেখা হয়। আমি চেয়েছিলাম নাম
অতিক্রম করে তাদের চরিত্র করে তুলতে। নানা অবস্থার মধ্য দিয়ে চরিত্রগুলি কখনও
এগোচ্ছে, পিছিয়ে যাচ্ছে কখনও, দাঁড়িয়ে থাকছে। ঘটনার বিবরণ কবিতায় থাকে না সাধারণত।
কিন্তু আমার এইসব লেখায় ঘটনার বা গল্পের একটা আদল আছে। কবিতায় বিশ্বাসযোগ্যতার কোন
জায়গা নেই। কিন্তু এই লেখাগুলোকে আমি নিজেই কবিতা বলে মনে করি না, তাই এই
বিশ্বাসযোগ্যতা আনার চেষ্টা, যাতে পাঠকের (যদি আদৌ কেউ এগুলো পড়েন) সঙ্গে এভাবে
একটা কমিউনিকেশন গড়ে তোলা যায়। নামগুলো/ চরিত্রগুলো আসলে আমার হাত- আমার চোখ, যা
দিয়ে আমি পাঠককে ছোঁয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
কবিতা লেখার সঙ্গে প্রতিমা
গড়ার কোথাও একটা মিল আছে। (যেকোন শিল্পের ক্ষেত্রেই কথাটা খাটে।) যখন পৃথিবী
স্তব্ধ হয়ে আসে, আলো হারিয়ে যায় বৃষনক্ষত্র জ্বলজ্বল করে অনন্ত আকাশে—তখন সম্পূর্ণ
একা হয়ে যাওয়া একজন মানুষ ছোট্ট আলো জ্বেলে ঝুঁকে পড়ে এক টুকরো কাগজের উপর। ঠিক
তখনই হয়ত কোথাও আরেকজন মানুষ ছোট্ট আলো জ্বেলে তারই তৈরি করা প্রতিমার মুখে তুলির
শেষ টান দেবার আগে চুপ করে বসে আছে। এই স্থির মুখ, এই আত্মমগ্ন বসে থাকাটুকুই একজন
কবির নিয়তি আর অর্জন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন