বাতিঘর ও জাহাজের গল্প
“নতুন
ও পুরানো কাগজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে/ আমি ঘুড়ি ওড়াচ্ছি/মাঝে মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে
নিচ্ছি/স্বদেশ ও বিদেশ/ এখন দুই দেশেই বৃষ্টি হচ্ছে”। নতুন ও পুরানো কবিতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি ঘুড়ি
ওড়াচ্ছেন। মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে
নিচ্ছেন এঘর ওঘর। এখন দুই ঘরেই বৃষ্টি হচ্ছে। আর বৃষ্টিজলে ধুয়ে শ্যামলে শ্যামল
হয়ে উঠছে কবিতার ধূলোবালি। মেঘসম্ভাবনার ডানা ধরে আকাশে ছুঁড়ে দিয়ে চুপচাপ সরে
গেছিলেন মিতবাক মানুষটি। আকাশ-ভর্তি জামার গল্প থেকে স্বাধীনতা দিবসের গান গাইতে
গাইতে পাখির জন্মদিন আঁকা হয়েছিল সেদিন। ‘চাঁদ ও
খোঁড়া বেলুনওয়ালা”র কবি ছয় পয়সার জীবনের বাইরের সেই
সাদা গোলকের চোরা টানের কাছে বারবার নামিয়ে রেখেছেন ভেজা অক্ষরমালা। যে চাঁদ নষ্ট
করলে মানুষ ভিখারী হয়। যে চাঁদের অনুবাদ করার দুঃসাহস নিয়েই লেখা হয় “সূর্যাস্ত আঁকা নিষেধ”। ২০০২ সালে প্রকাশিত যে ক্ষীণতনু
বিস্ফোরক ভর্তি বই তেরো বছর পরেও ফিরে পড়ার পর দেখি “কবিতার
প্রতিটি লাইনে উড়ছে রুমাল/ লাল, সাদা ও কালো রুমাল/ রুমালের তলায় চিঠি/চিঠিতে
বহুতল বাড়ি/ বাড়ির তলায় বহে যাচ্ছে নদী/ নদীতে ভেসে উঠছে যুবকের মৃতদেহ”। দেখি শ্যামল কি ভয়ানক পৌনঃপুনিকতা বর্জিত। একটা
ছোট্ট বৃত্ত, তাকে ঘিরে আরো এক, তাকে ঘিরে ঘিরে ক্রমশই বড়ো বৃত্তেরা...সমান্তরাল।
কোনো বিচ্ছিন্ন লাইন হঠাৎ কবিতা হয়ে উঠলো বা একই বিষয়ের আলাদা আলাদা উপস্থাপনার
পুনরাবৃত্তি—এসব থেকে বিপজ্জনকভাবে মুক্ত শ্যামলের কবিতা।
মানে-বই হীন শ্যামলের কবিতা। সাদা ভাত ও
লাল শাকের মাখামাখিতে যে রক্তলাল তীব্রতায় জীবনের প্রথম কবিতাটি তার ভাতের থালায়
লেখা হয়েছিল---সেই প্যাশন’কে খুব সন্তর্পণে কবিতার মধ্যে দিয়ে
গড়িয়ে যেতে দিয়ে, চুঁইয়ে যেতে দিয়ে আপাত নিরীহ শ্যামলের কবিতা। চেতন ও অবচেতনের
মধ্যে দিয়ে ছোট ছোট ধাক্কা দিতে দিতে যাওয়া শ্যামলের কবিতা। সূর্যাস্ত আঁকার নিষেধাজ্ঞার আগে সে জানত সূর্য
আঁকা নিষেধ। সে তাই চাঁদ আঁকছিল। যে চাঁদ আঁকতে আঁকতে মারা যায় তার বাবা ও ঠাকুর্দা।
যে চাঁদ আঁকতে আঁকতেই বাঘের মুখ থেকে একদিন লাফিয়ে পড়ল চাঁদ। এই কুড়িয়ে পাওয়া চাঁদ
পকেটে পুরেই শ্যামল খুঁজতে বেরোলেন গাছেদের জন্মকথা। নিজেকে শূণ্যের ভেতর রেখে
উলটো দিক থেকে কথা বললেন আর তাঁর ভেতরে জন্মালো গাছ। আর কি আশ্চর্য সেই গাছেদের
ভেতর থেকে ভেসে আসতে লাগল শিশুদের কান্না! এ কি সেই শিশু যে আস্তে আস্তে রাত হয়ে গিয়েছিল
শ্যামলেরই কবিতায়? “টেবিলের ওপর জ্বলজ্বল করছে
টমেটো/তুমি কি বিবাহিত?”এত সোজাসাপটা ভঙ্গিমায় আর কে কবে ছুঁড়ে দিয়েছিল প্রেমনিবেদন?
মারাত্মক একটা চিত্রকল্প যেন একটা বুলেটের মত পাকা টমেটোর মাঝখান থেকে ফিনকি দিয়ে
ছড়িয়ে দিলো লালের তীব্রতা, চাপা যৌনতা ও নিষেধের মৃদু লাল রেখাটিকে। জ্বলজ্বল করে
ওঠা কামনাবিন্দুকে। একটা না দেখা দরজা যা লুকিয়ে ছিলো প্রতিদিনের আবর্জনা ঠাসা
বাতিল আলমারিটার পেছনে, যা আমাদের অজ্ঞাতে আসলে এক গোপন ওয়ান্ডারল্যান্ডের পাস্ওয়ার্ড---তাকেই
শ্যামল হাট করে খুলেছেন সেই পাঠকের কাছে যারা খুঁজে পেতে পড়ে নিতে জানে সেই কোড
ল্যাঙ্গুয়েজ। শ্যামলের সংকেতময় পৃথিবী তখন অন্য একটা না-দেখা জগতের, অন্যতর
বাস্তবতার মুখোমুখি একেবারে অসহায়ের মত বোল্ড আউট করে ছেড়ে দেয় তাকে। সে তখন
দ্যাখে তাঁর কোন কুটুম্ব নেই। টিয়াপাখির কাছে সে ফেলে এসেছিল শিস্। তার শরীর জুড়ে
শুধু জন্মদিন। জ্বর হলে তার মনে পড়ে
ভাস্কো-দা গামার কথা, মাছের বুকের ভেতর থেকে গড়িয়ে পরে ঘুঙুর।তার ঘরের ভেতর ঢুকে
পরে জাহাজ। তার আদার ব্যাপারীর গতানুগতিকতা চমকে ওঠে সেই জাহাজের গল্পে, লোণা জলের
ধাক্কায়। গাছের ভেতর জমে থাকে প্রচুর কথা। আকাশে ঝুলতে থাকে লন্ঠন, গান সাজাচ্ছে
ঘোড়াকে---। আর ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে এক চাঁদ পাগলের সাথে এক সূর্য পাগলের দেখা হলে পাখিদের
সাক্ষী রেখে এই দিনের আলোর স্পষ্টতা ও পূর্নিমার কুহকের দোলাচলের ভিতর শ্যামল লিখতে
থাকেন---
“কিছু
শব্দ থাকে চোখের ভেতরে গোপন
কিছু শব্দ থাকে কানের ভেতরে গোপন
তারপর শুরু হয় পথ চলা”
-----------------------------------------বাতাস
রচনা করে বাকি অংশটুকু।
(সূর্যাস্ত আঁকা নিষেধঃ শ্যামল সিংহ
মূল্য-তিরিশ টাকা)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন