মেজাজটাই
তো আসল রাজা
একটি
কবিতা লেখার আগে ও পরে মনোভাব / আলোড়ন :
খুব স্বচ্ছভাবে জানি, একটা কবিতা লেখার আগে আমার মনে কোনো আলোড়ন হয় না।
আলোড়ন হয় ভূমিকম্পের। কোনো দৈবিক কিছুও।
না। শিহরণ-টিহরণ, আবেগ। নাহ্। একজন রাজমিস্ত্রি যেমন আমার
বাড়ির বাথরুমটা বানাবার আগে, সব মাপজোক ক’রে দ্যাখে। দেখে যায়, কত স্কোয়ার ফিট
জায়গা। কত ইঞ্চির গাঁথনি। সিমেন্ট-বালি-বজরি-পাথর-ইঁট লাগবে কতখানি। আমিও তাই-ই। বস্তত, কবিতা
লেখাকে পৃথিবীর আর-পাঁচটা কাজের চেয়ে এবং
কবিকেও পৃথিবীর আরও সাড়ে পাঁচজন মানুষের চেয়ে আলাদা কিছু ব’লে বিশ্বাস করি না। একজন মাইক্রো-বায়োলিজিস্ট কিম্বা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার
যে কাজ করেন, যে সিরিয়াসনেস নিয়ে করেন, শিক্ষা-মেধা-চর্চা দিয়ে দক্ষ ক’রে তোলেন নিজেকে, কাব্যচর্চাও তার চেয়ে আলাদা কিছু নয়। আলাদা কোনো মহত্ব
দাবি করার কিছু নেই এতে। লিখতে গেলে আমার যেটা লাগে, মেজাজ। কিছু কাজ করার মেজাজ।
ব্যস। এই মেজাজটা কখনো নিজে থেকেই এসে যায়। কখনো তাকে তৈরি করতে হয়। নিজেকে প্রস্তুত
ও যোগ্য ক’রে তুলতে হয়, কাজটার জন্য। পারিপার্শ্বিকে
কবিতা টের পাওয়ার জন্য এবং মাথার মধ্যে কবিতার রসায়নটা ঘটতে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয়
পরিবেশ ও আবহাওয়াটা বজায় রাখতে হয় মাথায়, মনে। নিজের সামনে একটা সমস্যা তৈরি ক’রে সেই সমস্যাকে ভাঙবার একটা খেলা। লেখার মধ্যে এটাই উপভোগ করি আমি সবচেয়ে
বেশি।
Craftsmanship— এটাই, এটুকুই শিল্পের সবকিছু। আমার বিশ্বাসে। তবে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন
ভিন্ন জিনিস ট্রিগার করে একটা লেখার জন্য। সবসময় যে ট্রিগারের জন্যে অপেক্ষা করি
তাও নয়। ট্রিগারিত হতে তো আমিও চাই। তাই ট্রিগার খুঁজেও নিতে হয়। এ’ যেন অমিতাভ মৈত্র-র সেই কবিতার বইটির নাম, ‘বিদ্ধ করো, তীর’। তাই, নিজেকে vulnerable
ক’রে তুলতে হয়, ট্রিগারের সামনে,
জীবনের কাছে, কবিতার কাছে। এসো, আমাকে আঘাত করো। কখনোই যেহেতু একই সময়ে একটাই কাজ
আমি করি না, ফলে মাথাকে বেশ কয়েকটা আলাদা প্রকোষ্ঠে ভাগ ক’রে তাদের দায়িত্ব ও কাজ আলাদা ক’রে ভাগ ক’রে নিই। ফলে একটা বা দুটো লেখা একই সাথে লিখতে লিখতে কোনো ফোন রিসিভ করতেও
আমার কোনো সমস্যা নেই। বিরক্তিও না। অবশ্য যদি ফোন ধরার মেজাজটা থাকে। আমার যা
কিছু আয়োজন, যা কিছু আয়াস তার বেশিরভাগটাই এই মেজাজটাকে তৈরি করতে।
শিল্প একটা সেরিব্রাল জব। মস্তিষ্কেই তার ল্যাবরেটরি। মস্তিষ্কেই তার টের
পাওয়া থেকে প্লেজার, সবকিছু। আরেকটা জিনিস, একজন ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রির যেমন
টেস্টার। কোন্ পয়েন্টে কারেন্ট আছে কোন্ পয়েন্টে নেই, তা বুঝতে তিনি ব্যাগ থেকে
টেস্টারটি বের করেন। আমি খাড়া করি কান। যদি কোনোদিন অন্ধও হয়ে যাই, বধির যেন না হই
কখনো। শব্দ। শব্দ। মাঝরাতে হিম পড়ার শব্দ থেকে ব্লেড দিয়ে কড়াইয়ের কালি চাঁছার
শব্দ, বেড়ালের গোঙানি, বঁটিতে আলুর খোসা কাটার শব্দ, দেশলাই জ্বালাবার ফস্স্স্
থেকে প্রতিমা বড়ুয়ার গানের ঢোলক, দোতারা। কিশোরী আমোনকরের গলা। পৃথিবীর সব শব্দ যদি শুনে যেতে পারি, পৃথিবীর সব
দৃশ্য সব রঙ কল্পনা করা যেতে পারে।
আর, একটা কবিতা লেখার পরের মনোভাব? রাত জেগে অফিসের প্রোজেক্ট শেষ ক’রে আপনার যা মনে হয়, যা অনুভূতি হয়, আমারও আলাদা কিছু নয়।
কবিতার
নির্মাণ-বিনির্মাণে রান্নাঘর বৃত্তান্ত :
‘উৎপাদন প্রক্রিয়া প্রদর্শন করলে তা’ অশ্লীলতা’ — সমীর রায়চৌধুরী।
কবিতার
উৎসমুখ ও কলম— বনিবনা বে-বনিবনা :
গৌতম বুদ্ধের একটা কথা দিয়ে আমি এটাকে ভাবার চেষ্টা করি। আগেও
যতবার এই বিষয়টা নিয়ে ভেবেছি, বুদ্ধের এই কথাটাই মনে এসেছে। 'চৈতন্য আত্মার আগন্তুক ধর্ম'। এই
ছিল বুদ্ধের কথাটা। এবারে, সেই মূল উৎসমুখ, সেটাকে যদি 'আত্মা' ধরি, তাহলে তার কিন্তু চৈতন্য নেই। তাকে চৈতন্য দিতে হবে। এই মূলকে
সংবেদনে পাই। এটা কবিতার র-ম্যাটার হতে পারে। কিন্তু সেটা স্বরূপতঃ নিষ্ক্রিয়, নির্গুণ,
চৈতন্যহীন। আমার বুদ্ধি, জ্ঞান,
বোধশক্তি,
অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, উপলব্ধি ইত্যাদি ইত্যাদি এই ম্যাটারে
আকার দেবে। প্রাণ দেবে। ঠিক নদীর জলে যেমন স্রোত এলে তবেই তা প্রবাহিত হয়। এক
স্থান থেকে অন্যত্র যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে জল, ‘স্রোতগুণ’
পেলে।
আত্মা এবং চেতনার মধ্যে যতটা বন্ধুত্ব এবং
বৈরীভাব, কবিতার উৎসমুখ ও কলম বা কী-বোর্ডের মধ্যেও, ততটাই।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন