অরবিন্দ কৃষ্ণ
মেহরোত্রা : শুধুমাত্র ভারতীয় ইংরেজি কবিতাকে অন্য একটি
বিস্তৃতির দিকে নিয়ে যান নি অরবিন্দ কৃষ্ণ মেহরোত্রা, বহুস্বর ও বহুবর্ণে
বিন্যস্ত আবহমান ও সমসাময়িক ভারতীয়
কবিতাকে বিশ্বপাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তার অন্তরঙ্গ অনুবাদ্গুলির মধ্যে দিয়ে।
১৯৪৭ সালে লাহোরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন অরবিন্দ।নাইন এনক্লোজারস, ডিস্টান্স ইন
স্টাটুট মাইলস,মিডল আর্থ, দা ট্রান্সফিগারিং প্লেসেস তাঁর উল্লেখযোগ্য
কাব্যগ্রন্থ। সম্পাদনা করেছেন দা অক্সফোর্ড ইন্ডিয়ান অ্যান্থলজি অফ টুয়েলভ মডার্ন
ইন্ডিয়ান পোয়েটস, অ্যান ইলাস্ট্রেটেড হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান লিটারেচার ইন ইংলিশ
প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি। কবীর,নিরালা,গজানন মাধব মুক্তিবোধ,বিনোদ কুমার
শুক্ল, মংগলেশ ডাবরাল, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আদিল মনসুরি প্রমুখর কবিতা অনুবাদ
করেছেন অরবিন্দ কৃষ্ণ মেহরোত্রা।সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কালেক্টেড পোয়েমস
১৯৬৯-২০১৪ কাব্যগ্রন্থটি।ড্যাম ইউ, এজরা, ফকির প্রভৃতি ম্যাগাজিনগুলি সম্পাদনা করেছেন তিনি।
অরবিন্দ কৃষ্ণ মেহরোত্রার কবিতা
একজন ভালো সুররিয়ালিস্টের গান
১.
হাওয়া একটা কাগজকে ভাঁজ করে দিচ্ছে
আর পালকের মত উড়ে যাচ্ছে দেশগুলো
মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে ম্যাপ
খেলনা, গ্লোব আর শেকলগুলো সমুদ্রের ওপর ভাসছে
সবকিছু একদম আকাশের মত দেখাচ্ছে
তটরেখাহীন একটা পৃথিবীতে রঙের লড়াই
কিছুই পাল্টাচ্ছে না
২.
জন্তু জানোয়ারের কথা উঠলেই আমার সমুদ্রের ধারে
মুখ গোমড়া করে বসে থাকা বেড়ালগুলোর কথা মনে হয়
আর সমুদ্রের তলায়
একটা সাবমেরিন ভর্তি ইঁদুর
৩.
একটি কয়েন,সামান্য আগুন, একটি রুমাল
একটি বিন্দু, একটি কাঠের হাতি, একটি পাতা
হাল্কা ঝড়, একটি হিমবাহের রাস্তা, একটি বাটি
আগুনের রং আর গন্ধ একদম লেবুর মত
আর হাতিটি তার শুঁড় দিয়ে বৃষ্টি ডেকে আনছে
হিমবাহটি অন্যপাশে ফিরছে আর মরে যাচ্ছে
চুলের দূরত্বে তারাদের দৈর্ঘ
গুটিয়ে যাওয়া একটি চোখ,অন্যটি পোকার বাড়ি
মাকড়সাদের থেকে বেশি ঝলমল করছে কানগুলো
৪.
পাহাড়, যাযাবর, শান্ত বাচ্চা আর রাজারা
এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে ঘুরছে
তাড়া খেয়ে বেড়াচ্ছে তাঁদের পবিত্র চেহারা
অদ্ভুত অভ্যাস আর সঠিক খুলিগুলোর জন্য
কেউ মৃত, কেউ নদীতে পড়ে আছে
কেউ আবার খুব তাড়াতাড়ি পৃথিবীতে ফিরে আসছে
গুহাগুলিতে এখনো তাঁদের পায়ের ছাপ পড়ে আছে
আর দাঁড়িয়ে থাকার জায়গাটায় একটি কালো হ্রদ
৫.
আমার হাতের রেখাগুলি একটি অ্যাকরিয়ামের মাছ
৬.
যখন দুটো পাথর কিম্বা শুকনো ডাল ঘষা হয়
আগুন জ্বলে ওঠে
আর যখনই কোনও মানুষকে ভুলে যাওয়া হয়
মৃদু একটি কাঁপুনি টের পাওয়া যায়
আকাশ বেলুনে ভরে ওঠে
প্রার্থনা আর মাশরুম
জন্তু জানোয়ার আর ক্লাউনরাই স্বপ্ন ডেকে আনে
৭.
একটি ফেলে যাওয়া ট্রাংকের ভেতর
হাত,পা
আর মাথার টুকরো পড়ে আছে
হাতগুলো একজন মৃত রাজমিস্ত্রির
বাঁ পায়ের পাতাটা একজন জেলপালানো বন্দীর
মাথাটা দিব্যি টেবিলের ওপর বসছে
আর কোন শব্দ করছে না
৮.
মেঘেদের সবসময় বিশ্বাস করা যায় না
একদিন একটি আমার ঘরের ভেতর ঢুকে পরেছিল
আর আলমারির পেছন থেকে ডাকছিল
আমি এই শহরটা ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম
অথচ একটি শিকারি কুকুরের মত
শহরটা আমার গন্ধ খুঁজে বের করেছিল
৯.
ফলের দিকে তাকালেই সেগুলি পেকে যায়
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আপেল বাদামি হয়ে যায়
আর দুধের দাঁতগুলি ইচ্ছে চাড়িয়ে দেয়
পতনের সকালবেলাগুলি অনেকটা বিষাক্ত কুয়োর মত
আমি একটি রুপোলী গেট খুলে বাইরে বেড়িয়ে এলাম
পর্দার ওপর একটি সাপের ফনা
আর দেওয়ালের খুব কাছেই আমার বোনের খুনী দাঁড়িয়েছিল
১০.
একটি গোল মুহূর্তকে আমি গিলে ফেলেছিলাম
আর ঘড়িগুলো আমার ভেড়াদের খাইয়ে দিয়েছিলাম
পাখির ডানায় ওদের বেঁধে দিয়েছিলাম
ফায়ারপ্লেসের আগুনে ছুঁড়ে ফেলেছিলাম
গলে যাওয়ার জন্য অ্যাসিডে চুবিয়ে রেখেছিলাম
ডুবে যাওয়ার জন্য জাহাজে উঠিয়ে দিয়েছিলাম ঘড়িগুলোকে
ফুলের গোল মাথাটিকে মাটির নিজস্ব কাজকর্ম
দেখানোর জন্য এসবকিছু করছিলাম শুধু
১১.
গাছেরা তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে রাখছে
আর যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করছে
আর চক্কর কাটতে থাকা কাকটির শরীরে
একটা গোপন পালক বেড়ে উঠছে
ঠিক ওখানেই উপত্যকাটি
অন্য একটি সূর্যের দিকে নিজেকে মেলে দিচ্ছে
ক্রমশ ধূসর হয়ে উঠছে নীল আকাশ
আর মনের মধ্যে একটি বেঁটে পাহাড় গড়িয়ে পড়ছে
প্রথম লাইনগুলির তালিকা
১.
ও আসলে একটি সাপ ,বাতাস, অথবা পাতা
ওর কান্না বারবার দরজায় আছড়ে পড়ছিল
আর আমি ওকে ভেতরে ঢুকতে দিয়েছিলাম
ওর মুখটা একটি কাগজের মত লাগছিল
যেখানে অনেক কিছু লেখার পর
সেগুলিকে মুছে ফেলা হয়েছিল। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল
ও একটি চেয়ারে এসে বসল আর সামনে ঝুঁকে
আমাকে একটি সাদা চুলের নুটি এগিয়ে দিল।
ও চাইছিল যতক্ষণ না ও কিছু বলছে
আমি যেন ওটা রেখে দিই।
সাড়ে চারটে বেজে গিয়েছিল অথচ
আমি তখনো জেগেই ছিলাম।বিয়ের বাজনা
কিছুক্ষনের জন্য থেমে গিয়েছিল
সাদা রঙ ফিরে আসছিল দেওয়ালে।
বুড়ি,কিভাবে আমি চমকে উঠবো
সূর্যের আলো দেখে,যখন তা
সবকিছু নিখুঁত ভাবে ভেঙ্গে ফেলে?
একটি জরাগ্রস্থ বাড়ি কখনও
তার ছায়ার ওপর ঝুঁকে থাকে না।
২.
একটি দরজা খুলে ও
রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছিল
আমি ঘুমের ভান করে বিছানায় পড়ে ছিলাম
ও বিছানার ওপর আমার পায়ের কাছে বসল
আমি ওর হাতদুটো লক্ষ্য করলাম
একদম ওর বাবার মত হাতদুটো।এগারোটা বেজে গিয়েছিল
বৃষ্টির ভেতরেও সূর্য উঠেছিল
পাখিরাও জেগে গিয়েছিল
কিন্তু ওদের বাসার কাছেই জড়ো হয়েছিল
খুব তাড়াতাড়ি আবার অন্ধকার নেমে আসবে
আমার মুখের ভেতর আমি একজন
ঘোড়ার ডাক্তারের নেহাই দেখলাম
বুড়ি,আমাকে বলতো
এর মধ্যে গোঁয়ার্তুমির ব্যাপারটি কোথায়?
পাখিদের পা’গুলি বাঁধাই আছে
ওদের গলাও কেটে দেওয়া হয়েছে
আর বড় একটি মাটির মেডেলের জন্য
আমিও আমার কম্পাসটি বিক্রি করে দিয়েছি।
৩.
ও আসলে একটি ভুত,জাদুকাঠি,একটি ডাইনি
নিজের খেয়ালখুশি মত ও আসত
এমনকি বৃষ্টির মত শব্দও করত না
সূর্যাস্তের মত
জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকত
রোববার করে ও একটি
ম্যাপ বই খুলে বসত
আর একটি একটি করে পৃষ্ঠা ওলটাত
আমি দেখতাম একটি মহাদেশের কোনাগুলি
সমুদ্রের রঙের ভেতর গিয়ে পড়ছে
বুড়ি,আমাকে বুধের মৃত্যু সম্বন্ধে কিছু বলো
আজ রাতে আমি তোমাদের
অস্থির দেশে ঢুকে পড়বো
যেখানে ডাঙ্গা একটি জুতোর মত
জলকে দাবিয়ে রাখে না আর চাঁদ
তার সবটুকু আলো আকাশে ছড়িয়ে দেয়।
আমি আমার অক্ষরগুলি ছুঁয়ে বলছি
একদিন ওরা তোমার সাদা হাতের কাছে জেগে উঠবে।
ভাষান্তর : শৌভিক দে সরকার
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন