সমালোচকঃ পবিত্র আচার্য্য
বরফবন্দীর ডায়েরি,
আষিক
বইটির শুরুতে ঝাঁ-চকচকে গদ্যের ভঙ্গিমায় কবি নির্দিষ্ট করতে চেয়েছেন তাঁর
এই কাব্যগ্রন্থের পেছনে ছুটে যাবার কারণ। “খুঁজে বেড়াচ্ছে কি নিয়ে বেঁচে থাকছে এই এত এত প্রাণ।” যেন এই ভাবনারাই ছোটাতে বাধ্য
করেছে তাঁকে। খোলামেলা ভাষায় অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছেন মুহূর্তের খন্ডচিত্র থেকে
কীভাবে বেরিয়ে আসে কাহিনী। আর কীভাবে ফ্রেমবন্দি হয়ে যায় অনুচেতনার স্বর। একটি
জীবনের কাহিনীরা জীবন্ত হয়ে ওঠে। কবি বলছেন “শরীরের ভেতর জমাট বাঁধছে বরফ। শরীরের ওপরে আস্তর পেরিয়ে কেউ কিছু জানতে
পারছে না। সেই স্থির সময়ের অস্থিরতার কথাই ‘বরফবন্দীর ডায়েরি’।”
‘বরফবন্দীর ডায়েরি’ এর সাথে সজ্ঞানে কবি জুড়ে
দিচ্ছেন সামাজিক মূল্যবোধ আর ভাবনার নিরবচ্ছিন্ন রেখাপথ। গল্পে গল্পে বলছেন “ একফুট, দু-ফুট, ইঞ্চি ছয়েক – একটা গোটা সমাজকে সে লাইন
পেরিয়ে যেতে উস্কোতে থাকে। পেরতে না পারলে, নিদেন পক্ষে লাইনকে ছুঁয়ে ফেলাও যায়!
সেই মাতাল কতটুকু জানে? বরফ পড়তে শুরু করলে লাইন ও রাস্তার রঙ এক হয়ে যাবে।” বিমূঢ় তলাতল থেকে উঠে আসা জীবন দর্শন। কবি আলাদা
করে কোন সীমানা রাখতে চান না। জীবনের শেষ স্টেজে যেখানে অমোঘ শীতলতা সেখানে সীমানা
আর রাস্তার ভেদাভেদ হীনতায় নজরে আসে। ঢাকা পড়ে যায় সকল বৈপরীত্য।
প্রতিটি কবিতাই আক্ষরিক অর্থে মূল্যবান দলিল। প্রথম কবিতাটিতেই একটি অনবদ্য
চিত্রপট তুলে ধরেছে কবি। এক যুদ্ধের দিনের ছবি। “কোন এক মনখারাপের শহরে যুদ্ধ হচ্ছে / বুটের তলায় ভেঙ্গে যাচ্ছে বরফ।” সেই একই দুর্যোগের দিনে
যুদ্ধকে গল্প বানিয়ে এক বৃদ্ধ গল্প বলছেন বাচ্চাদের। এ যেন প্রবহমানতার সত্যতা। যুদ্ধ,
ক্ষয়-ক্ষতি যেভাবেই বয়ে চলুক না কেন, গল্প থেমে থাকে না। থেমে থাকে না মানুষের
জীবন।
এভাবেই যতই কবিতার রথ এগিয়েছে তরতরিয়ে অনুভূতির চিকণ রশ্মিগুলো এসে পড়েছে লেন্সের
ভেতর। এই দৃশ্য দর্শন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না একবিন্দু। কবিতার কথাগুলো
বাজে নিরন্তর। “চোখ দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা যায়
পৃথিবীর ভঙ্গুর শরীর।” এই
ভুতলৌকিক জীবনসত্ত্বা কতটা অথই! চোখ দিয়ে স্পর্শ করছে গোটা পৃথিবী। শুধু কতগুলো
কবিতার লাইনই শুধু নয়। জীবনধারাকেও নতুন ভাবে পাঠ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। একেকটি
শিরোনামের আড়ালে জমা হয়েছে গুচ্ছ কবিতা। কোনটিই একে অপরের চাইতে বড় নয়। তবে বিশেষ
ভাবে কতগুলো কবিতার লাইন ঝঞ্ঝিত হয়ে আসছে। যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে মাথায়
বসিয়ে নিয়েছি অবলীলাক্রমে। তারই কয়েকটি শেয়ার করতে চাই।
“ তুমি দেখ / গান্ধার ধৈবৎ
ছুঁয়ে কীরকম নেমে আসে মল্লারের ঢেউ
তুমি কি গাইছ / নাকি, তোমাকেই
গেয়ে ফেলেছে কেউ?”
‘জন্মদিন’ এর কবিতাগুলি বিশেষ ভাবে
উল্লেখযোগ্য। “একটা অনন্ত পথ পেরিয়ে সেই বরফই
আবার জানলার ওপর থেকে বারেবারে নিচের দিকে ফিরে আসছে কিনা তুমি জানো না।”
এইভাবে কবিতার টেলিশট দিয়ে বোঝানো সম্ভবপর নয়। কবিতার ছত্রে ছত্রে কবি আওড়ে
গেছেন জীবনের আস্ত লিরিক। কবিতায় বহমানতা ধাবিত হচ্ছে দুরন্ত গতিময়তার দিকে।
কবিতার ভাষার ব্যবহারের কথায় আসি। প্রথাসিদ্ধ জটিল ভাষার স্রোত থেকে সহস্র
মাইল বিপরীতে হেঁটেছে কবি। সহজিয়া ভাষায় পাঠক কূলকে আকৃষ্ট করেছে নিশ্চিত ভাবে
বলতে পারি। যে ভাষা আমাদের দৈনন্দিন। যার সাথে নিত্য জারিজুরি। খুব দায়িত্ব নিয়ে
বলতে পারি আষিকের এই কাব্যগ্রন্থ নতুন উদ্ভাসে-উদ্দীপনায় ভরপুর। কোথাও রিপিটেশন
নেই কবিতাগুলোর মধ্যে ভাবনার। সবকটি স্বাতন্ত্র্য ভাবনার।
কবিতার বইখানি সত্যিই সংগ্রহণ যোগ্য। আমরা কবির কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ এই রকম
একটি বই উপহার দেবার জন্যে।
প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি ২০১৫,
সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী-বাগনান, হাওড়া, পৃষ্ঠাঃ ৮৮, মূল্যঃ ৮৯ টাকা
ISBN 978-1-63415-169-6
সমালোচকঃ পবিত্র আচার্য্য
সমালোচকঃ পবিত্র আচার্য্য
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন