চিত্রকরের স্বীকারোক্তি
-২
বিশ্বাস করুন আমার "ফিশারম্যান অ্যাট সোফা" শিরোনামে টেম্পারার
কাজটি দুবার এই রাজ্যেই সরকার পরিচালিত বার্ষিক প্রদর্শনী আর একবার বেসরকারি বার্ষিক
প্রদর্শনী থেকে রিজেক্ট হয়েছে। অথচ যে অনলাইন গ্যালারী থেকে আমার অধিকাংশ ছবি বিক্রি
হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, সেখানে উচ্চ-প্রশংসিত। ছবিটি আমাদের মতো বুদ্ধিজীবীদের
নিয়ে আঁকা। অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন চিন্তা-সমুদ্রে একমনে জাল ফেলে বসে থাকতে হয়ে
... কখন সঠিক ভাবনা ধরা দেয় সেই আসায়। সাম্প্রতিক একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা সেই কঠিন
কাজটি সোফায় বসে সারতে চান ... এটাই মূল ভাবনা। রিজেক্ট হয়েছে তাই ঠিক করলাম রাজ্য
চারুকলা উৎসবে এই ছবিটি ক্যালেন্ডার করে আমাদের স্টল 'আহ্লাদী আটজন' থেকে বিক্রি করব।
বিষয়ের সঙ্গে একাত্ম না হলে
আমি ছবি আঁকতে পারি না, তাই অনেক ক্ষুদ্র পত্রিকাকে মাসখানেক অপেক্ষা করতে হয়
আমার ছবির জন্য। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে "আমার কবিবন্ধুরা" আঁকি মাত্র দুইদিনে।
আমি নিজেও অবাক। জমাট কংক্রিটের জঞ্জালের মধ্যে একটি গাছ। গাছের পাতার পরিবর্তে পাঁচজন
কবিবন্ধু অক্সিজেন সরবরাহ করছে বাতাসে। প্রশ্ন উঠতে পারে কোন পাঁচজনকে আমি এঁকেছি।
কোনো বিশেষ জন নয় ... এতদিন পর্যন্ত আমার মেশা যাবতীয় কবিবন্ধুদের নির্যাস ঐ পাঁচজন।
আমার ছবি নিয়ে প্রায় অভিযোগ ওঠে ... আমি গণেশ পাইনের মতো আঁকি. যদিও মতামতটি রাজ্যবাসীর, ভিনদেশ বা ভিন্নরাজ্যের
শিল্পী বা দর্শকদের নিয়ে কোনো সমস্যা হয় নি কোনোদিন।একবার অভিযোগকারীকে প্রশ্ন করেছিলাম
... কোথায় মিল দেখলেন ? রচনা, তুলির টান না রঙের। ভদ্রলোক নিরুত্তর থাকলেন। আমি ওনাকে
বলেছিলাম গণেশ পাইন যেখানে থেকে রসদ সংগ্রহ করেন (অর্থাৎ বাঙালি সংস্কৃতি) আমিও সেইখান
থেকে নি ... মিল থাকা স্বাভাবিক। শুধু আমি নয় সৌমিত্র কর, অভিশংকর মিত্র এবং প্রণব
ফৌজদারের ছবিতেও একই মিল পাওয়া যায়। আর উনি বরেণ্য শিল্পী, ওনার কাছ থেকে কিছু নিতে
আমি বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করি না, আক্ষেপ একটাই আমি অন্য অনেক শিল্পী এমন কি আমার চেয়ে
বয়সে ছোট শিল্পীদের কাজ থেকে প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করি নির্দ্বিধায় ... অভিযোগকারীরা
সেটা খুঁজে দেখেন না কখনোই।
টেম্পারা প্রচণ্ড শ্রমসাধ্য মাধ্যম। পৃথিবীর প্রায় সব টেম্পারা শিল্পীদের
নিজের মত করে এর পদ্ধতি আবিষ্কার করে নিতে হয়। একটি ২০ ইঞ্চি বাই ২২ ইঞ্চি ছবি শেষ
করিতে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগে। প্রশ্ন উঠতে পারে তবে কেন ছবি আঁকি এই মাধ্যমে। রঙও
নিজেই তৈরি করতে হয়, তবে জেল্লা হয় অসাধারণ
আর ছবিটি কমপক্ষে টিঁকে যাবে ২৫০ বছর । চিরকাল বাবাকে দেখেছি টেঁকসই জিনিস কিনতে বা বানাতে
...আমি বাদ যাই কিভাবে।
সমালোচকদের সম্পর্কে বলা হয় ওনারা নিজেকে জ্বালিয়ে অপরকে আলো দেন।সমালোচক
সারা জীবন শুধু দিয়ে যায় ...পুরষ্কার থেকে মূর্তি স্থাপন কোনোটাই এনাদের জোটে না। কাছ থেকে কয়েকজন সমালোচককে দেখেছি। নাম করছি না
কারণ তাদের মধ্যে দু-একজনের পচন ধরতে শুরু করেছে। এরা আলোচ্য নয়। "সমালোচক"
ছবিটি প্রকৃত সমালোচকদের দেখে সৃষ্টি। এখানে আলোর উৎস বাতিদানি নির্বাপিত। পাঞ্জাবী/ফতুয়া পরা সম্পুর্ণ একা এক ব্যক্তি টেবিলের
সামনে বসে আছেন। মৃত মাছের চোখের মত নিস্তব্দতা
চারপাশে। অন্ধকারাচ্ছন্ন এই পরিবেশে সমালোচক
নিজেকে জ্বালিয়ে সেই আলোয় কলম ধরেছেন। বেলজিয়াম
নিবাসী বছর সত্তরের চিত্রকর মিশেল (উপাধি জানতে চাইবেন না আমার জিহ্বা অনুমতি দিচ্ছে
না) এসেছিলেন কয়েকদিন আছে আমাদের বাড়িতে
... ছবিটি দেখে তিনি আনন্দে আত্মহারা, বার বার হাঁটু ভেঙে ছবির সামনে বসছেন আর বিড়বিড়
করে নিজের ভাষায় কি বলছেন। শেষে কাঁধ চাপড়ালেন আমার। ছবিটি এই বছর জানুয়ারীতে সমাপ্ত
হয়েছে কিন্তু "বাক" এ দেব বলে এখনো সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আপলোড করিনি। এই ছবিটিও সদ্য পরিত্যক্ত হয়েছে সরকারি বার্ষিক প্রদর্শনী থেকে। তা হোক গে ... মিশেলরা
তো থাকছেন আমার সঙ্গে।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন