(চলবে)
যশোধরাদির সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগে একটা ভূমিকার খুব প্রয়োজন। খুব
আবেগ এসে যাচ্ছে বলতে। তিন বছর আগের কথা। তখন আমি এফবিতে নতুন। লিখছিও খুব কম
দিন হল। যশোধরাদি আমার ফ্রেন্ডলিস্টে নেই তখন। কি এক কবিতা লিখে পোস্ট করেছিলাম
একদিন। আমার এফবির প্রথমদিককার বন্ধু বিপ্লব (গঙ্গোপাধ্যায়), সেই কবিতা
যশোধরাদিকে দেখায়। সেদিন সম্পূর্ণ অজানা একজনের সেই কবিতা উনি নিজের ওয়ালে শেয়ার
করেন। সেদিন অনেক আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল কবিতাটিকে
ঘিরে। চৈতালীদিও পড়েছিলেন। তো, তারপরে দেখলাম,
আমার মত অখ্যাত, অজানা, অচেনা যে কোনো কারুরই কবিতা উনি প্রায়ই নিজের ওয়ালে শেয়ার করেন। আজকের
এই ‘নিজের ঢাক নিজে পেটানোর’ দিনে, এই অভিজ্ঞতা আমার চিরদিন মনে থাকবে।
তুষ্টি: তুমি একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক-কবি , উচ্চ পদের চাকরী এবং সংসার সবই সামলাচ্ছো একা হাতে । আজ গুজরাট তো কাল
গ্রীস – ছুটেও বেড়াচ্ছ বেশ । এত কিছু সামলিয়ে
লেখার ইচ্ছেটা এখনও বেঁচে রয়েছে কী ? নাকি শুধু
পত্রপত্রিকার দাবী মেনে লিখতে হচ্ছে ? কিভাবে আজকের
যশোধরা রায়চৌধুরী নিজেকে ইন্সপায়ার করে লেখার জন্য ?
তোমার
প্রশ্নটা শুনে বেশ লজ্জায় পড়ে গেলাম। সেরকম কিছুই নয়। আসলে জানো তো, প্রত্যেক কবি
লেখকের কাছেই নিজের খ্যাতি প্রতিষ্ঠা
ব্যাপারটা অত্যন্ত গোলমেলে। আমি নিজেকে একেবারেই প্রতিষ্ঠিত মনে করিনা, বরং
আমার সামনে অন্য অনেকে আছেন যাদের আমি সত্যি সে অর্থে প্রতিষ্ঠিত লেখক মনে করি,
যারা লেখালেখির হোলটাইমারও হয়ত বা। আবার হয়ত এমন অনেক লেখক কবি
আছেন,
যাঁরা ভাবতে পারেন, আমি আমার সময়ের তুলনায় অনেকটাই বেশি পেয়েছি। যা আমার হয়ত আসলে
প্রাপ্যই নয়।
নিজেকে
নিয়ে ভাবনা ভাবার আসলে কোন মানেই নেই। কারণ আমরা আমাদের সঠিক বিচার কোনদিন করতে
পারিনা। সকলে বলে, তুমি ত বেশ ব্যালান্স করে চলো, চাকরি আর লেখালেখি। আমি কিন্তু
কিছুই আসলে বুঝি না। মনে হয় একেবারেই ব্যালান্স করতে পারছি না, উলটে সব ছড়িয়ে
ছত্রখান করে বসে আছি!
লেখালেখির
কথাই যদি বলো, নিজের জন্যই লিখতাম এবং লিখি, আগেও যা এখনো তাই। সেটা ছাড়া অন্য কোন
রকম লেখালিখির কথা আমি কোনদিন ভাবিও নি, জানিও না। ভেতর থেকে তাগিদ না থাকলে,
চার্জ না আসলে আমি এক লাইনও লিখতে পারিনা। চূড়ান্ত নিষ্প্রাণ কিছু লাইন লিখে
নিজেকে আরো কষ্ট দেওয়া ছাড়া।
যদিও
আবদার আসে অনেক সম্পাদকের কাছ থেকে। যদি বিষয়টা ভাল লাগে, সে মুহূর্তে নিজেকে সে
বিষয়ের যোগ্য বলে মনে হয়, লিখি। সম্পাদকদের চাওয়াগুলোও মূল্যবান, আমি বিশ্বাস করি
যে আমার অনেক লেখাই সম্পাদকের তাগাদা না পেলে লেখা হত না। কিন্তু এই তাগাদা বা
উশকে দেবার পর, যে লেখাটা হয়, সেখানে মাথার ভেতরে কিন্তু পাঠক নয়, আমি নিজেই বসে
থাকি। আমি নিজেকে খুশি করতে না পারলে লিখতেই পারিনা। টলস্তয় ই বোধ হয় একবার
বলেছিলেন , সব লেখক সেই লেখাটিই লিখতে চান যেটি তিনি পড়তে চাইছেন কিন্তু পাচ্ছেন
না। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমি নিজে ঠিক যে যে জিনিশগুলো পড়তে চেয়েছি নিজের জন্য
সেই লেখাগুলো লিখেছি। এটা একেবারেই অ্যাক্সিডেন্ট যে অন্য কারুর কারুর সেগুলো ভাল
লাগে, লেগেছে। তাঁরা সেগুলোকে সাহিত্য বলে অ্যাকসেপ্ট করেছেন। এক একটি
পাঠপ্রতিক্রিয়া, বা প্রশংসা , যখন পাই, এখনো প্রথমদিনের মত অভিভূত হই ঠিক এই জায়গা
থেকেই। কেননা, আমার এখনো ভাবতে অবাকই লাগে যে, কারুর কাছে ওই শুকনো, কাগজে ছেপে বসা শব্দগুলো আদৌ
ইম্পর্টেন্ট ! লিখিত শব্দ থেকে আমার ভাবনা তিলমাত্রও অন্য কাউকে কমিউনিকেট করতে
পারছি, এই আনন্দ, প্রাপ্তির কোন তুলনা নেই।
নিজের
জন্য লিখি বটে, কিন্তু অসম্ভব কুঁড়ে হবার ফলে, আর কিছুটা ওই ব্যালান্স করে,
গৃহিণীপনা করে চলতে পারার অভাবে, নিজের যা
যা আরো লেখার ইচ্ছে ছিল তার তিলপরিমাণও লিখে উঠতে পারলাম না। বা লেখার ইচ্ছাটাই
মরে গেল পরিস্থিতির চাপে। জানি না আদৌ পারব কিনা কোনদিন লিখতে সে সব । এক
এক সময়ে মনে হয়, যা লেখা উচিত ছিল, তার দশ শতাংশ লিখেছি। নব্বইশতাংশ লিখব ভেবেছি। একটা
উৎসাহ তো আসে বাইরে থেকে, ভাল ও খারাপ দুরকম পারিপার্শ্বিক সাহিত্য পড়ে । যে অতৃপ্তি, যে আনন্দ,
যে মুগ্ধতা, যে অসহ্য খারাপ লাগা, ভাল এবং মন্দ সাহিত্য দুই থেকেই যে বোধের সঞ্চয়,
তা আমাকে আরো লিখতে অনুপ্রাণিত করে। অথচ কোন না কোনভাবে সময় নষট করে চলেছি, লেখা
আর হচ্ছে না। অথবা ওই পরিশ্রমটুকুই করে উঠতে পারছি না।
তুষ্টি: একদম গোড়ার কথা একটু জানতে চাই । তোমার ছোটবেলার
কথা , লেখালেখির সেই শুরুর দিনগুলোর কথা , তখন কী একবারও ভেবেছিলে যে এই লেখক-কবি জীবনের সাথে জড়িয়ে পড়বে?
লেখক
কবি জীবন বলে আদৌ কিছু হয়কিনা জানি না। তবে ছোটবেলায় আদৌ ভাবিনি। এটা পরিষ্কার।
ছোটবেলায় ভীষণ ভালবাসতাম বই, একেবারেই ছোট্ট থেকে সুর, ছবির আর বইয়ের জগতেই বড় হয়েছি। মা
ছিলেন পেন্টার এবং গায়ক। মায়ের হাত ধরেই গেছি অ্যাকাডেমিতে ছবির একজিবিশনে। গেছি
গান শুনতে। তেমনই, প্রথম যখন মায়ের হাত ধরে
বইমেলায় যাওয়া শুরু হয়, সে এক অন্য উত্তেজনা। ঐ উত্তেজনার সঙ্গে মিলেমিশে ছিল নতুন
বইয়ের গন্ধ। নতুন বইয়ের গন্ধ আবার দু রকম, ইংরিজি নতুন বই আর বাংলা নতুন বইয়ের গন্ধ
আলাদা।
আবার
নতুন বই আর পুরনো বইয়ের গন্ধও তো কত আলাদা। আর দুটোই কী প্রিয়! পুরনো বই পড়তাম
দিদার বাড়িতে। আমার দাদামশায় একদা কারমাইকেল কলেজ, রংপুরে অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ
করেছেন। সাংঘাতিক জাঁদরেল অঙ্ক শিক্ষক তথা
ভারতীয় জনসঙ্ঘের একদা প্রেসিডেন্ট দেবপ্রসাদ ঘোষ। পন্ডিত হিসেবে খুবই নামডাক ছিল
তাঁর। চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া বলা হত। আমরা যে দাদুকে দেখেছি তিনি অশীতিপর , স্মৃতি
চলে গেছে। কিন্তু তাঁর উত্তর কলকাতার বৈঠক খানায় অসংখ্য পুরনো বই, আর সেই সব বইয়ের
ধুলোর একটা মাদক গন্ধ ছিল। মূলত দাঁত ভাঙা ইংরিজি বই। ওপরের তলাতেও অসংখ্য বই, এবং
সেই সব বই ঘেঁটে ছোটদের পড়ার উপযোগী একটিও বই পেতাম না বটে, কিন্তু যা পেতাম তাই
চেটেপুটে পড়ে ফেলতাম। নিচের তাকে পঞ্জিকাগুলো নিয়ে বসে পাঁজির সেই সব মহাবিখ্যাত
বিজ্ঞাপন পড়তাম। আমাদের শৈশবে পাঁজির বিজ্ঞাপন এখনকার ছেলেমেয়েদের শৈশবে ফ্যাশন
টিভি বা বড়দের সিরিয়াল দেখে পেকে ওঠার বিকল্প ছিল। কিন্তু মনে রেখো, সবটাই হত
ভাষার মাধ্যমে,বাহক ছিল বাংলা ভাষা। তাছাড়া কাশীদাসী মহাভারত কৃত্তিবাসী রামায়ণ
এবং যাবতীয় ধর্ম গ্রন্থ, ধর্মসংক্রান্ত গ্রন্থ এগুলো তাদের ভাষার ভেতর দিয়ে আমাদের
মরমে পশত। পুরনো পুজোবার্ষিকীর খন্ডগুলোতে (A)- মার্কা উপন্যাস, সুনীল গাংগুলি সমরেশ
বসুর লেখাগুলোয় শরীরী সব কান্ডকারখানা পড়ার অভিজ্ঞতা, দেশের পুজোসংখ্যায় ফেলুদা
খুলে রেখে পাতা উলটে উলটে রমাপদ চৌধুরীর পিকনিক বা এখনই-র মত অসাধারণ উপন্যাস পড়া,
তরুণ তরুণীদের প্রেম-ভালবাসা-আশা আকাংক্ষার গপ্পো আত্মস্থ করা, এগুলো ঐ সময়ে আমার
বা আমার মত অনেক শিশু কিশোরের মাথার কোষগুলোকে নিষিক্ত করতে যথেষ্ট ভূমিকা পালন
করেছে নিশ্চয়। সঙ্গে সুধীর মৈত্রর সেই অনবদ্য স্কেচ ইলাস্ট্রেশনগুলো ।
তো,
এইসবের সামনে পড়ে , বাঙ্গাল ভাষায় যাকে বলে শাপলা ক্ষেতে পড়া, প্রায় হামলে পড়ে
স্পঞ্জের মত শুষে নেওয়া সত্তর দশকের সমৃদ্ধ লেখালেখির পরিবেশটা তো কোথাও না কোথাও
বীজ বুনেইছিল। তা ছাড়া কাকা মানস রায়চৌধুরী কবিতা লেখেন, মাঝে মাঝেই কাব্যগ্রন্থ
বেরোয় তাঁর, বাড়িতে এক গুচ্ছ কবিতার বই আমার পরলোকগত বাবার কালেকশনের, মানে কবিতা
ও সাহিত্যপ্রীতিটা পরিবার প্রতিবেশের ভেতরেই ছিল এটা বলতে চাইছি ।
এরপর
যখন স্কুলের বড় ক্লাসে , আমার পাঁচ বছরের বড়ো দিদি বইমেলা থেকে কবিতার বই কেনা
শুরু করে, কবিতা লেখাও। দিদি বেশ কিছু দুর্দান্ত স্মার্ট কবিতা লিখেছিল। পড়ে লেখা
ছেড়ে দেয়। অসাধারণ চিঠি লিখত আরো পরে। ইমেল এসে সেটিও গেল।
আমিও ইস্কুল ম্যাগে লিখতাম। ইস্কুলের বাংলা
দিদিমণিরাও খুব স্নেহ করতেন, প্রচুর পড়তে উৎসাহ দিতেন। স্কুল লাইব্রেরিটাও দারুণ
অ্যাক্টিভ ছিল। ইতিহাসের দিদি বামপন্থী অবিবাহিতা সোজা শিরদাঁড়ার ইরা সরকার দি
আমাদের স্কুলে অ্যাসিস্টেন্ট হেড মিস্ট্রেস হয়ে এসে আমাদের বেশ কয়েকজনকে দারুণ
প্রভাবিত করলেন লিখতে পড়তে। স্কুলের দেওয়াল পত্রিকায় কবিতায় আমরা-র বদলে “মোরা” ব্যবহার করতাম আমি, আমাকে ডেকে
বলে দিয়েছিলেন, ওটা ব্যবহার করবে না, ওটা পুরনো হয়ে গেছে। কত কি শিখেছি ঐ সময়ে।
নীরেন চক্রবর্তী বা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় পড়েছি। এখন
ভাবলে মনে হয়, এই সব পরতে পরতে আমার আইডেন্টিটির মধ্যে মিশে গেছে নিজের অজান্তে।
আমরা দৌড় শুরুই করেছি আসলে অনেকটা এগিয়ে থেকে। প্রতিবেশ পরিবেশের এই সমৃদ্ধি যাদের
পাওয়া হয়নি, তাদের ক্ষেত্রে কবিতা লেখাটা অনেক বেশি কঠিন নিশ্চয়। আমি তো পড়ে পাওয়া
চোদ্দ আনা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিলাম । নিজের দু আনা আর যোগ করলাম কোথায়!
তুষ্টি: তোমার প্রথম কবিতার বই কবে এলো ? প্রথম বই নিয়ে কমবেশি আবেগ সব কবিরই থাকে। তার
পিছনে কিছু না কিছু ইতিহাসও থাকে । সেরকম কোন ঘটনা আছে কী ?
প্রথম
বই ১৯৯৬ তে। ওই বই হবার আগে, চিরদিন মনে হত, পৃথিবীতে এত এত ভাল ভাল বই আছে। আমার
বই কে পড়বে? কেনই বা কেউ ছাপবে?
ক্লাস
টেন ইলেভেন থেকে নিজের গোপন খাতায় কবিতা লিখতাম। বন্ধুদেরও দেখাতে ভয় পেতাম।
বাধ্যতামূলক ইনস্টিংক্টিভ লেখা। গোপন ডায়েরির এই লেখা বোধ হয় বাঙালি ছেলেপুলের,
আমার বয়সী যারা, অনেকেরই ছিল। তবে তা থেকে “কবিতা নিয়ে লড়ে যাব” এই অব্দি দৌড়ে আসাটাই
অনেকের হয়ে ওঠে না। আমারও না হতে পারত । হয়ে উঠল কী ভাবে জানি না। প্রথম কিছুদিন,
প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময়টা অস্তিত্ববাদ , কাফকা কামু সার্ত্র এসব তো অনেক করেছি
টরেছি, অন্যদিকে মার্ক্স হেগেল হাইডেগার। ওই সময়টা বামপন্থার তুঙ্গদশা। আমরা যা যা
আঁতেল হতে গেলে করতে হয় সেইসব ফ্যাশনেবল অনেক কিছু করেছি। ক্যান্টিন কফি হাউজে
আড্ডা চীৎকার ব্যর্থ প্রেম, সব।
কিন্তু
ওই, কবিতা লিখে বই করার ইচ্ছে অথচ মুখচোরা বলে কারুকে পড়াতে পারিনা। বন্ধুরা
অনেকেই বেজায় আঁতেল, এবং পুরুষ। তারা স্বঘোষিত কবি। কাজেই তাদের সামনে খাপ খুলতেও
অনীহা। অদ্ভুত অবস্থা। এর মধ্যে আবার প্রেসিডেন্সি কলেজ পত্রিকায় একটা কবিতা জমা
দিলাম সেটা রিজেক্ট হয়ে গেল। কিন্তু আমি আসলে যে লম্বা দৌড়ের ঘোড়া সেটা পরে
বুঝেছি। তখন লোকজন প্রচুর হৈহৈ করতে শুরু করে জয় গোস্বামীকে নিয়ে, ওনার ভুতুম
ভগবান ও উন্মাদের পাঠক্রম হাতে হাতে ঘুরছে সবার। উনি এলেন ক্যান্টিনে। নিয়ে এল
অদ্রীশ বিশ্বাস, অচ্যুত মন্ডল। ওরা সব তখন তরুণ তুর্কি। অচ্যুত অকালে মারা যায়।
আমাদের ভাল বন্ধু ছিল। কিন্তু আমি এতই মুখচোরা যে কোন কথাই বলতে পারিনি।
এখন
বুঝি, সেই সব দিনগুলোতে “কবি” হয়ে উঠিনি যে, তা
একমাত্র আত্মবিশ্বাসের অভাবেই।
তারপর
বি এ পাশ, এম এ পড়তে পড়তে, চাকরির পরীক্ষা
দেওয়া, জীবনে “কিছু একটা করব” এই জটিল পণ-ধরে থাকার
পর, যেই না মিলল ছাড়পত্র, জয়েন করলাম শিমলায় সর্বভারতীয় চাকরির ট্রেনিং
ইনস্টিট্যুটে, তখন আমি ২৬-২৭ হয়ে গেছি। একটার পর একটা লেখা পাঠাতে শুরু করলাম
কবিতা পাক্ষিক, কালপ্রতিমা পত্রিকাগুলোতে, এবং দেশ পত্রিকায়। এটা অনেক জায়গায়
বলেছি, আবারও বলি, আমাকে উৎসাহ দিয়েছিল সুপর্ণা দেব, আমার হরিহর আত্মা বান্ধবী,
একই চাকরির কলিগ ও। রুমমেট, হোস্টেলে। ও বলেছিল তোর কবিতাটা হবে। ও কবি বাসুদেব
দেবের কন্যা। এখন দুর্দান্ত ব্লগার। খুব ভাল গদ্যের হাত। অনেক কবিতা পড়া ওরও।
ওর
উৎসাহেই আরো লেখা পাঠানো শুরু হল। বাসুদেব কাকু ছাপলেন একটি একটি করে ওঁর পত্রিকা
কাল প্রতিমায়। বাসুদেব কাকু আবার মানস রায়চৌধুরীর বন্ধু।
১৯৯৩
তে দেশ পত্রিকার কবিতা মনোনীত হবার পর জয় গোস্বামী একটি চিঠি দেন, সেটি পাই শিমলায়
ইনস্টিট্যুটেই বসে। কী শিহরণ সেটা পেয়ে। কী উত্তেজনা।
সেই
ছাপ্পাটা, দেশে কবিতা প্রকাশের, আমাকে কয়েক যোজন চলার উৎসাহ যোগায়। তারপর , ১৯৯৬ এ কবিতা পাক্ষিক থেকে প্রথম চটি বই
পণ্যসং হিতা। ইতিমধ্যেই দেশ এ অন্তত গোটা পাঁচ-সাত কবিতা বেরিয়ে গিয়েছিল। আর, নানা
পত্র পত্রিকা মিলিয়ে বেশ অনেক। তখন প্রচুরই লিখতাম আসলে। এবং সে লেখাগুলি কীভাবে
যেন অনেকের চোখেও পড়ছে। নানা লোকে ভুরু তুলে বলছে, “এতদিন কোথায় ছিলেন?” জয় গোস্বামী খুব যত্ন নিয়ে একটি ডায়েরির কবিতা
ঘেঁটে ঘেঁটে, পেনসিলের দাগ দিয়ে দিয়ে পড়েছিলেন, বলেছিলেন, অনেকটা প্রস্তুতি নিয়ে
আপনি লিখতে এসেছে।
কিন্তু
এহ বাহ্য। কিছুটা আত্ম প্রত্যয় হয়ত আমার তখন এসেছিল যা তার আগের দশ বছরের
প্রত্যয়হীনতা, মুখচোরা লাজুক সত্তাটির চেয়ে আলাদা। কিন্তু, অন্যদিকে, এই তথাকথিত
প্রতিষ্ঠাটুকুর পর আরো অনেক স্ট্রাগল যে অপেক্ষা করেছিল সেটাও সত্যি। তবে হ্যাঁ,
আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি, এখনকার মত ফেসবুক অর্কুটের দাক্ষিণ্য ছিল না, একটা
লেখা অনেকদিন খাতায় পড়ে থাকত, আর লেখামাত্র লোকের কাছে অসাম অসাধারণ শোনার সুযোগ
ছিল না। তাই হয়ত কিছুটা জারিত হতে পেরেছিল কবিতাব্যাপার আমার ভেতরে। একটা সংযম
তৈরি হয়েছিল কোথাও। লেখক হিসেবে চিরদিনই আমি অজনপ্রিয়, অত্যন্ত কর্কশ, শ্লেষধর্মী
আমার লেখা তাই সবার ভাল লাগার মত নয়, এমনটাই আমার আত্ম-সমীক্ষা। এখনো জনপ্রিয় লেখক
বলতে যা বোঝায় তা আমি নই, হতেও চাইনি কখনো।
১৯৯৬
তে কবিতা পাক্ষিক
বেরোবার সময়ে প্রভাতদার কালীঘাটের বাড়িতে আমার হাজরা মোড়ের বাড়ি থেকে প্রায়ই চলে
যেতাম , প্রচুর আড্ডা হত। ওঁদের কাগজে অনেক লিখছি তখন, আর নাসের হোসেন, রজতেন্দ্র
মুখোপাধ্যায় , রবীন্দ্র গুহ, জহর সেনমজুমদার, এমন বেশ কিছু কবির সঙ্গে কথাবার্তা
আড্ডা হচ্ছে। ওই সময়ে এই ছোট চটি বই বেশ সাড়া ফেলেছিল, এমনকি বইটার বেরোবার বছর
খানেকও পেরোয় নি, কৃষ্ণা বসু ( তখনো যাঁর
সাথে আমার আলাপ নেই!) আমার বইটিকে দেশের “পঞ্চাশ বছরের সেরা” সংখ্যায়, কবিতার
বইয়ের পঞ্চাশ বছরের সেরা বইদের তালিকায় তুলে দিলেন! এইসব অভাবিত প্রাপ্তি আমাকে
মাঝে মাঝে জীবনের কাছে নতজানু হয়ে কৃতজ্ঞতা জানাতে বাধ্য করেছে।
তুমি
যে বললে, তোমাকে না চিনেই তোমার লেখা শেয়ার করেছি, আসলে সত্যিটা বলি। কৃতজ্ঞতা
থেকেই এটা করি, আমার বড়দের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা থেকে। আমার ছোট বয়সে আমি বড়দের থেকে অনেক স্নেহ
পেয়েছি কিনা, আর স্নেহের ধর্মই নিম্নগামিতা। বড়দের থেকে ছোটদের মধ্যে যাওয়া। তাই
মনে হয়, আই শ্যাল ডু দ্য ডিউ, যদি আমার ছোটদের একটুও উৎসাহ দিতে পারি। বড়দের ত
কৃতজ্ঞতা বশত কিছু ফিরিয়ে দিতে পারব না, পারিনি কোনদিন।
তুষ্টি: একজন মেয়েকে আজও নিজস্ব কাজ বা নিজের ভালোলাগার পথে চলতে
গেলে অনেক বাধার মুখোমুখি হতে হয় । একজন মেয়ে হিসেবে এই প্রশ্ন তোমার কাছে – তুমি কীভাবে পেরিয়ে এলে এতখানি পথ , কীভাবে
সফলতা হাত ধরল তোমার ?- এই পুরো জার্নিটা খুব সহজ নয় বলেই
জানতে চাই।
প্রথমে
বলি, যখন এই সদ্য লিখতে আসা, তখন একটু আধটু কেউ প্রশংসা করলেই বেশ আনন্দে থইথই
লাগতেও শুরু করেছে। কিন্তু কানে আসতে শুরু করেছে নিন্দেমন্দ, কিছু বলা না বলা
ইঙ্গিত এসে কাঁটা ফোঁটাচ্ছে, আমার মুখশ্রীর জন্যই নাকি, কবিতার জন্য নয়, লোকে
আমাকে ভাল বলছে। ঐ মেয়েটা কী করে নাম করছে রে? আসলে থোবড়টা একটু ঠিকঠাক হলেই এখন
মেয়েদের পক্ষে কবি হওয়া অনেক সোজা, বুঝলি। এসব কথাও রেগুলার কানে আসে তখন। সোজা
কথা কোন মেয়ে কবিতা লিখতে শুরু করেই একটু খ্যাতি পেলে সেটা কোন কোন পুরুষ কবির
সঙ্গে তার কবিতা বহির্ভূত অন্য রকমের সম্পর্কেরই ফল, এটাই বলা হচ্ছে। এবং আমাকে
হতভম্ব করে দিয়ে এরই ভেতর এসে পড়ল একটা ব্রাউন খামে বেনামি চিঠি, যাতে জয়
গোস্বামীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিয়ে চূড়ান্ত কদর্য কথা লেখা ছিল। “তুই অমুকের সঙ্গে অমুক অমুক করিস্” টাইপের কাঁচা খিস্তি ছিল
তাতে। হাতে লেখা চিঠি, মনে হয়েছিল প্রথমে,
চিঠিটা হ্যান্ড রাইটিং এক্সপার্টের কাছে পাঠাই। কিন্তু আমার প্রবৃত্তিতে কুলোয় নি।
বুঝতে পেরেছিলাম আমারই কোন সমসাময়িক কবি সম্পূর্ণভাবে ঈর্ষ্যার বশীভূত হয়ে কাজটি
করেছে। গা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলাম।
এর
পরেও অনেক কিছু ঘটেছে সে সব আর মনে রাখিনি, থাকেও না। অনেক গসিপের ঝাঁঝ,
নিন্দেমন্দ, অনেক মিথ্যা আর মিস ইন্টারপ্রেটেশনের সঙ্গে যুদ্ধ।
বিয়ে
করেছি অনেক পরে। ১৯৯৮ সালে। আমার হবু স্বামীকেও গুঞ্জন শুনতে হয়েছে, যশোধরার অনেক
অ্যাফেয়ার, একাধিক বিয়ে। সে বেশ অবাক হয়েই বলেছিল আমায়, এসব বলে কেন লোকে তোমার
সম্বন্ধে। সাহিত্য করতে এলে যেন অনেক অ্যাফেয়ার এবং অনেক বিয়ে করাটা পুরুষ লেখকদের
মুকুটে পালক এবং মেয়েদের জন্য অবশ্যম্ভাবী কিন্তু সেটা তখন নিন্দার্থে ব্যবহৃত।
লেখালেখি মানেই যৌনকেচ্ছা। এই ভিত্তিহীণ সহজ সমীকরণের অস্তিত্ব বার বার টের
পেয়েছি। অনেক মেয়ের সঙ্গে পরে যখন কথা হয়েছে, দেখেছি, এই একই অভিজ্ঞতা মোটামুটি
সবার।
এর
পরের স্ট্রাগল অবশ্য একেবারেই আলাদা।
কোন
পথ বলে দেওয়া নেই আসলে। কীভাবে আমার লেখা আমি চালাব, জীবনে আপোশ না করে কীভাবে
বেঁচে থাকা যাবে। সন্তান পালন, সংসার সব করেও কীভাবে অন্য একটা জীবনযাপন করা যাবে।
আসলে
বোধ হয়, লেখার বাধ্যবাধকতা , যেটা আমার ভেতর থেকে আসে, সেটা না থাকলে পারতাম না।
পারলেও, সাফল্য বলে কিছুই এখানে নেই। এটা আত্মধ্বংসকারী, একটা ক্ষতবিক্ষতকারী
প্রক্রিয়া। এটা এমনই, যে মাথার বিষফোঁড়ার মত তোমাকে কিছুতেই না লিখে শান্তিতে
থাকতে দেবে না। অথচ চাকরি করে শাড়ি কিনে, সিনেমা দেখে গাল গল্প করে সময়টা কাটিয়ে
দিতে পারলে হয়ত বেঁচে যেতাম। জানি না। হয়ত মরেই যেতাম!
তবে
শুরুর দিকে বুঝলাম একটা জিনিস। নিজের আনন্দের জন্য লেখার অভ্যাস আমার। হঠাত দেখলাম
সেটা দিনের পর দিন না করলেও দিন কেটে যাবে। তখন এল লড়াইয়ের তাগিদ। কেননা লড়াই না
করলে, লেখাটিকে ধরে রাখতে পারব না আমি। স্রোতের বিপরীতে যেতে হবে। দুটো সিনেমা কম
দেখতে হবে, দুটো নাটক মিস হবে। কিছু ম্যাগাজিন পড়া হবে না। সময় বাঁচিয়ে লিখতে হবে।
কিন্তু বাড়ির সবার দাবি মিটিয়ে তারপর। সব প্রায়রিটি আগে। চাকরি, স্বামী, মেয়ে।
তারপর লেখা, লাস্ট প্রায়রিটি। তবু লিখতে হবে। ছেড়ে যেতে যেতেও ফিরে আসতে হবে।
এই
যন্ত্রণা এখন প্রতিদিনকার। ভাতের হাঁড়ির পাশে একটু জায়গা করে টেবিলে খাতা রেখে
লেখালেখির যন্ত্রণা, অফিসের কাজের মধ্যে হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া কারুকে একটা গদ্য তৈরি
করে দেব বলেও দিতে পারিনি , যেই যন্ত্রণা। বার বার পিছিয়ে পড়ার যন্ত্রণা।
আর,
মাঝে মাঝে একটা দুটো নিজের ভাল লেগে যাওয়া লেখা নিজেই লিখে ফেলে খুব আনন্দের
প্রলেপ, শান্তি, প্রাপ্তি। যা হাজার হাজার মাইল মরুভূমি পেরোনর পর একটা ওয়েসিস হয়ে
আসে।
(চলবে)
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
এ ভাবে এগোতে হবে। লেখা লেখি তো মানুষের মনের ই অনুশীলন ।
উত্তরমুছুনতুষ্টি , আরও অবেক প্রশ্ন বাকি রয়ে গেল যে। যশোধরা , আমাদের আরও অনেক কিছুই শোনার আছে। খুব ভাল হয়েছে সাক্ষাত্কার।
উত্তরমুছুনএটা তো প্রথম পর্ব :)
মুছুনBhari sundor sakkhatkar ...antorik ar sabolil
উত্তরমুছুন