নিজের দর্পণে নিজের কবিতা
যা আছে তা থাকার সঙ্গে আছে,
স্মৃতির সঙ্গে থাকা, স্বপ্নের সঙ্গে থাকা। থাকা অর্থাৎ নির্বাচিত থাকা, যে
নির্বাচন জীবনের, জীবনযাপনের প্রশ্নে সদর্থক, অভীপ্সা, স্বতঃস্ফূর্ত, তার দিকেই
আমার সমর্থন, আমার পক্ষপাত--- জীবনযাপন অর্থাৎ নানাবিধ অভিজ্ঞতা, তার এক অংশ
বিরুদ্ধ শক্তি। তার দিকে আমার আগ্রহ অক্রিয় হয়, আমার টান তার দিকেই যা আমার জীবনকে
রচনা করেছে, লালন করেছে। তা
এমন একটা অনতিক্রম যাকে অতিক্রম করলেই আমার ভ্রমণ লক্ষ্যহীন অনাশ্রয়, ধুলোর সঙ্গে
ধুলো, সাদার সঙ্গে সাদা। আমার চরাচর আমার থাকার অনিবার্যতার আনুকূল্যে নিশ্চিত হয়,
ভাষা রচনা করে, ভাষা অর্থাৎ শব্দ-সঞ্চয়ন, ভাষা, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, ব্যক্তির
সর্বস্ব, একটা শব্দের পাশে আর একটা শব্দের সচেতন সংস্থাপন--- সঙ্গে সঙ্গে ধুলো
অবারিত হলো, নদী নৃত্যবিহ্বল। কালবৈশাখী, পূর্ণিমা নিশি। যা আছে তাকে অতিক্রম করে,
সেই অস্পর্শ, অবধারিত এখন, এখন আরো বিশুদ্ধ, সেই মাতৃভূমি যা দিন রচনা করেছে, লালন
করেছে।
আমি আমার
নিজের কবিতাকে সামনে রেখে কথা বলছি। সেই কবিতাগুলি নিয়ে যা আমার যতো চেনা তত
অচেনা, সেই কবিতা রচনার আড়ালে আমার কোনো দুঃখ কষ্ট ছিলনা, তাড়না ছিল না, কেবল একটা
সখ, একটা ঝিমুনি আর একটানা থাকার কথা। না থাকাটাকেও আমি ঠিক চিনতে পারছি না, ওই
একটা খেলা--- একটা নিমগ্নতা।
অনেক দিন
আগে, তা প্রায় ষাট বছর আগে, নিজের কবিতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লিখেছিলুম, আমার
কবিতার সঙ্গে আমার জীবনের কোনো যোগ নেই--- জীবন অর্থাৎ জীবনের ঘটনাবলী। তা দীর্ঘ
আলোচনা চায়। ছোট করে জানাই, প্রাত্যহিক
দুঃখকষ্ট, অভাব অনটন, সাফল্য অসাফল্য, এমনকী জননীর মৃত্যু, পিতার মৃত্যু, বিচ্ছেদ
মিলন ইত্যাদিকে আমি কখনো আমার কবিতার বিষয় করতে প্রলুব্ধ হইনি। একইভাবে সমাজ-সংকট,
মন্বন্তর, স্বদেশের পরাধীনতা-স্বাধীনতা। দেশবিভাগের বিষয়েও আমার কবিতা কখনো
কৌতূহলী হয়নি। সমাজের রোগ-ব্যধিগুলিকেও অবান্তর করেছে। অতীব দারিদ্রের মধ্যে আজীবন
যাপন করলেও আমার কবিতা তা নিয়ে আবেগ অভিযোগে বিহ্বল হয়নি। আমি খুব সহজেই কবিতা
রচনার প্রথম শুরুর প্রভাত বেলা থেকেই নিশ্চিত বুঝেছি--- কবিতার একমাত্র এবং
অদ্বিতীয় লক্ষ্য একটা কবিতা হয়ে ওঠা, আর কিছুই নয়। এই সম্পূর্ণতাকে পাওয়ার অন্যতম
সোপান একটা শব্দের পাশে আরেকটা শব্দের অভিক্ষেপ। শব্দের সঙ্গে দ্বিতীয় শব্দের সঠিক
বিবাহ।
নিজের
কবিতাকে সামনে রেখে এইসব কথা বলছি। সেই কবিতাগুলিকে নিয়ে যাদের প্রসঙ্গে আমার কোনো
ক্ষোভ নেই, ব্যর্থতা –বোধ নেই। মনে রাখতে
হবে এই উক্তি কেবল নিজের কবিতাকে ঘিরে।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
"...কবিতার একমাএ এবং অদ্বীতীয় লক্ষ্য কবিতা হয়ে ওঠা, আর কিছুই নয়। এই সম্পূর্ণতাকে পাওয়ার অন্যতম সোপান একটা শব্দের সাথে আরেকটা শব্দের অভিক্ষেপ ।...."
উত্তরমুছুনএই লাইন মন্ত্র হবার দাবী রাখে.... অন্য একজনের কটা লাইন তুলে দেবার লোভ সামলাতে পারছি না--
"কবি কোনকালে গন্ডায় গন্ডায় জন্মায় না । সুতরাং কবিতা লেখক, আপনি নিজেকে দুর্ভাগা মনে করবেন না উদ্বগ্ন হবেন না, রেডিও টেলিভিশন সংবাদ পত্রে প্রচারিত হবার জন্য ছুটোছুটি করবেন না । বরং বাসনাহীন হয়ে বইটি নিজের খরচায় ছাপুন, এরং তারপরে শক্ত মলাটে বাঁধিয়ে , ভালো করে কীটনাশক মাখিয়ে কালের গর্ভে নিক্ষেপ করুন।
মৃত্যুর পরে, অনেকদিন পরে , আপনি জানতে পারবেন আপনি কবি ছিলেন কি না...."