১
তমাল রায় এখন অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সম্পাদক। বিগত
পঁচিশ বছর ধরে তুই ঐহিকের সম্পাদনা করছিস , এই পুরস্কার তোকে স্বীকৃতি দিয়েছে। যে ‘পাগল’ সংখ্যার জন্য এই পুরস্কার এলো, তার চাহিদা এখন তুঙ্গে।
যাকে বলে ‘রেলিশ’ করা, তুই কি তাই করছিস এখন? নাকি খ্যাতি তোকে
বিড়ম্বিত করছে?
উত্তরঃ- না রেলিশ করছি না।কারণ রেলিশ করা আমার ধাতে সয় না। আমার পুরস্কার আমার
পাঠক।তারা আমাদের পত্রিকা খোঁজ করে ঠিক নিতে আসে। বাংলাদেশ হোক বা আন্দামান পাঠক
ফোন করে,আমরা বই পাঠিয়ে দিই।আর তাদের ভালো মন্দ যা অভিমত বলে আমরা শুনি।ওটাই আসল
পুরস্কার। ভালো কাজের এখনও কদর আছে।আর আমরা বিশ্বাস করি আমরা একা নয় আরো অনেকেই
আমাদের মত ভালো কাজ করে যাচ্ছে।আমরা একটা পুরস্কার পেয়ে তাদের থেকে আলাদা কিছু হয়ে
যাইনি।এটা ঠিকই বলেছিস এটা একটা স্বীকৃতি।কিন্তু ওই অবধিই।তার বেশী কিছু নয়। ভালো
কাজ করতে গেলে একটা বুস্টিং লাগে।সেটা বারীন ঘোষাল বা স্বপন রায় করলেও যেমন পাই
ঠিক তেমনটাই পাই মহাকালী গার্লস স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষিকা বা একটা সদ্য গোঁফ
দাড়ির উনিশ-কুড়ির তরুণ করলেও।ব্যস। পঁচিশ বছর একটা লম্বা জার্নি। তার মধ্যে বহু ঝড়
ঝাপটা গেছে।হাল ছাড়িনি।লড়ে গেছি।এটা আমার স্বভাবের দোষ বা গুণ যাই বলা হোক না কেন আছে।সহজে হাল ছাড়িনা।আর তখন
একবার ও ভাবিনি যে আমরা পুরস্কার পাবো। এটা চেয়েছি আরো অনেক বেশী পাঠকের কাছে
পৌঁছাবো।সেটা বোধ হয় করতে পারছি।পুরস্কার পাওয়া না পাওয়া আমাদের হাতে নয়।খুব
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমরা যারা ঐহিক শুরু করেছিলাম আজ থেকে পঁচিশ বছর
আগে।আজ ও তাই।ফলে আমাদের ঐহিক নিয়ে কামনা বাসনা গুলো ও তো আমাদের মতই সাধারণ
হবে।এই যেমন আমাদের কাছে ইউ এস এ বা কানাডা থেকে পত্রিকা কিভাবে পাবে,তারা জানতে
চাইছে।আমরা পাঠাতে পারছিনা।মন খারাপ।তবে পেরে যাবো,আজ নয় কাল নিশ্চিত।তবে সত্য স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে
পুরস্কারের থেকেও ভালো লেগেছে ‘পাগল’ সংখ্যা নিয়ে মানুষের প্রবল
আগ্রহ।পুরস্কার পাওয়ার অনেক আগেই পাগল সংখ্যার দ্বিতীয় সংস্করণ এসে গেছিলো। প্রথম
সংস্করণ শেষ হয় ২০১৪ বইমেলার পরই।সেই দিন
টা খুব ভালো লেগেছিলো যে পাঠক আগ্রহে আবার একটা সংস্করণ প্রকাশ করলাম।এখন পাগল সংখ্যার
তৃতীয় সংস্করণ আবার আসতে চলেছে।কারণ
দ্বিতীয় সংস্করণ শেষ।আবার ভালো লাগা।বলতে ইচ্ছে করছে- কালি দা এই তো জীবন,তাহলে
আবার পেরে গেলাম কি বলো?
২
ঐহিকের ওয়েবে আসা বেশিদিন
নয়। তোর কী মনে হয় , ঐহিক ওয়েবে এসে, ফেসবুকে এসে আলোকপ্রাপ্ত
হয়েছে? বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে?
নাকি ওয়েবম্যাগ নিয়ে এখনও
অনেক নাক কুঁচকে রয়েছে? তুই নিজে কী প্রিন্ট
মিডিয়াকে বেশি গুরুত্ব দিবি?
উত্তরঃ- ওয়েব এক ধুমাধার দুনিয়া।কালের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াই তো বিবর্তনবাদ।এমনটাই
তো ডারউইন সাহেব বলেছিলেন। তাই আমাদের ওয়েবে আসা।এতো বড় ভূবন গ্রাম থাকবে আর
সেখানে ঐহিক থাকবে না তা কি করে হয়।ঐহিক তো আমাদের সন্তান।নিজের সন্তান কে তো
যুগের সাথে মানানসই করে তুলতে হবে।ওয়েবে আসার পর ঐহিকের পরিচিতি নিশ্চিত রূপে
বেড়েছে এ কথা অস্বীকার করি কি করে। আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে ওয়েব না হার্ড? আমি
বলবো এ তুলনার কোনো মানেই হয়না।দুটো আলাদা মাধ্যম।আর প্রতিটি মাধ্যমের তার নিজের
মত করে ব্যাকরণ আছে।সেটা বুঝে নিতে হয়।নইলে বিপদ। এখন নাক যে সিঁটকোয় সে সব
কিছুতেই নাক সিঁটকোয়।তার জন্য
হার্ড বা ওয়েব লাগে না।কেউ জ্যোৎস্না দেখলে নাক সিঁটকোয়,কেউ রোদ্দুর দেখলে।কারো
নাক সিঁটকোনো কে আমরা বদার করিও না।আর তা নিয়ে আমাদের কিছু বলার ও নেই। হার্ড কপির
একটা বহু পুরনো ইতিহাস আছে। সেই তাল পাতার পুঁথিই বল বা অন্য কিছু।আমার প্রেমিকাকে
নিজের হাতে স্পর্শ করে দেখলাম আর ভার্চুয়ালি দেখলাম,বা অনুভব করলাম এ দুইয়ের তফাৎ
তো আছেই।তবে ওয়েব এই মুহুর্তের সব থেকে সম্ভাবনাময় অঞ্চল।তাকে অস্বীকার করবো এমন
সাহস আমাদের নেই।বরং তাকে আরো ভালো করে কিভাবে ব্যবহার করবো তা নিয়ে আগামী এক বছর
ধরে একটা দারুণ মনোজ্ঞ ওয়ার্কশপ চলতেই পারে।আশা রাখি হার্ড এবং ওয়েব এ দুই
ক্ষেত্রেই ঐহিক নিজের স্বাক্ষর বজায় রাখতে পারবে আগামী দিনেও।
৩
এবার তোর নিজের মুখে ঐহিক
শুরুর দিনের কথা শুনতে চাই। হঠাৎ কীভাবে শুরু করলি , সেই ছোটবেলায়? ডিটেইল-এ বল আমাদের।
উত্তরঃ- বাবা ছিলেন পাঠক।এক চোখ নষ্ট হয়ে গেছিলো সরকারি ডাক্তারের উদাসীনতায়।তবু
পড়তেন।হাতের কাছে বই না পেলে পড়তেন আমাদের সিলেবাসই।বা কাগজের ঠোঁঙা।আর মা ছিলেন
পারফর্মার।এ দুই গুণের কিছু কিছু আমিও পেয়েছিলাম,প্রদীপ জ্বালানোর আগেই তো থাকে
সলতে পাকানোর ইতিহাস। খুব ছোট্টো বেলা থেকেই আমার ছিলো সংগঠন করবার শখ।তাই কখনো
লাইব্রেরী করেছি।কখনো ক্লাব।আর সে গুলো ও খুব সফল ভাবেই করেছি। লাইব্রেরী করার এক
সপ্তাহের মধ্যে ১০০ সদস্য হয়েছিলো।তখন আমরা পনেরো ষোলো। সাহিত্য সংহিতা নামক এক
পত্রিকায় লেখার শুরু।তারপর আমরা ঐহিক করলাম।প্রথম দেওয়াল পত্রিকা।টানানো হোতো
আমাদেরই কিছু পরিচিত বা নিজেদের স্কুল বা
কোচিং এ। তারপর এলো সাইক্লোস্টাইল করা ঐহিক। সামনে রবি ঠাকুরের ছবি।পঁচিশে বৈশাখ
প্রকাশ পেয়েছিলো সাল ১৯৮৯। ঐহিক এলো ১৯৯০তে।দূর্গাপূজোর সময়।
আমি,সুতীর্থ,অরূপ,ঐন্দ্রীলা,অরূপ গাঙ্গুলী,শান্তনু ভট্টাচার্য,গুণেন শীল(পত্রলেখা
পাবলিশিং)।প্রথম প্রকাশ হয়েছিলো ১২০০ কপি ঐহিক।মুল্য দু টাকা।খুব অদ্ভূত হলেও
সত্যি আমাদের ১১৫০ কপি বিক্রি হয়েছিলো সে সংখ্যা। লিখেছিলেন যাদবপুরের প্রোভাইস
চ্যান্সেলর আমার মাস্টারমশাই ড.ক্ষেত্র প্রসাদ সেন শর্মা,আবুল বাশার,উইনি
ম্যান্ডেলার কবিতার অনুবাদ আর আমরা।সেই শুরু তারপর দীর্ঘ পথ চলা। পঁচিশ কি যে সে
কথা ! একটা লম্বা জার্নি।কত লোক এসেছে গেছে,আমরা কাজ করে গেছি।থামিনি।এক নাগাড়ে
বেরোয়নি ঐহিক।কিন্তু মাঝে কিছুদিন বাদ দিয়ে আবার ফিনিক্স পাখীর মত আবার জেগে উঠেছি
বার বার।এখন পেছন ফিরে তাকালে কেবল অজস্র মুখ মনে পড়ে।আর একটা কথা বলার যারা ছেড়ে
গেছে তাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আর স্মভবত তাদের ও। কারণ তাদের সাথে
যোগাযোগ একনো আছে।ভালোবাসার সম্পর্কও।এই যে পুস্কার পেলো ঐহিক তারা আমায় ফোন করেছে।শুভেচ্ছা
জানিয়েছে।ট্রিট দিতেও বলেছে।আসলে সম্পর্কটা ভালোবাসার,বন্ধনের।আর খুব বাড়াবাড়ি না
হলে বলি ঐহিক কিন্তু আমাদের ভালোবাসার কাগজ,শুধু আমাদের নয় এক বৃহত্তর বাঙ্গালী
পাঠক সমাজের।আর সেটাই প্রাপ্তী।এই ইন্টারভিউ নেবার সময় ও তো ফোন করলো পলাশি থেকে
অসিত বিশ্বাস,পাঠক,আর টেক্সাস থেকে কেয়া মুখোপাধ্যায়,লেখক ঐহিক।জানাচ্ছিলো তাদের
মুগ্ধতার কথাই।এভাবেই আমরা পেরে উঠি।
৪ অনেক পরিশ্রম, অনেক ঘাম ঝরানোর গল্প লুকনো থাকে এক
একটি সার্থক পত্রিকার পিছনে। সম্পাদকের কাঁধে থাকে বিশাল দায়। অর্থের যোগানের কথাও
ভাবতে হয় তাকে। সঙ্গে থাকে একটা টিমকে চালানোর ক্ষমতা। তুই কী করে করলি এত সব?
উত্তরঃ- অর্থ একটা প্রবল সমস্যা।সেটা থেকে বেরোনোর সমস্যা আজ ও পাইনি।লড়ে যাচ্ছি।জানিনা
কিভাবে কত দিন। কেউ কেউ তো নিশ্চিত সাহায্য করেই।না হলে আর এতো দিন চলছে কি করে।আর
আমাদের আর একটা দিক আছে বিক্রিও যথেষ্ট ভালো।তা থেকে ও টাকা ওঠে। কিন্তু তা দিয়ে
তো আর চলে না পুরো টা।তবে কিছু অদ্ভূত ভালো মানুষ ও আছে।যেমন ধরা যাক আজকের যারা
লেখক।বয়সে খুব ই কম।ভালোবাসে কিন্তু প্রবল তাদের ঐহিক কে,তমাল দা কে।নিজেরা লিখেও
অনেকে নিজেদের কপিটাও কমপ্লিমেন্টারি নেয় না,কিনে নেয়।নাম করবো না এটা ভালোবাসা।আর
তা আছে বলেই আমরা আছি।কিন্তু আমাদের প্যান প্যানানি পছন্দ নয়।‘আমরা লিটল ম্যাগ, কে পড়বে আমাদের বই।বড়
লেখকরা লেখা দেয় না, এটাই যেখানে শতকরা ৯৮
শতাংশ,তখন আমাদের মতও কিছু পত্রিকা আছে
যারা হা হুতাসে বিশ্বাস করে না।বুক চিতিয়ে
ঘোরে।টিম এ আমাদের সমস্যা নেই তা বলি না।কিন্তু আছে এক অদ্ভূত টান।আমি যখন মৃত্যু
শয্যায়,পুরো শরীর প্যারালাইজড। অপারেশন চলছে প্রায় ১২ ঘন্টা।বাইরে দাঁড়িয়ে অজস্র
ছোটো বড়।যে কদিন ভর্তি ছিলাম খুব বিরক্ত হচ্ছিলো হাসপাতালের অন্য রুগীর আত্মীয়
স্বজন,এতো ভিজিটর আমার। এতো সাধারণ কোনো মানুষ এতো ভালোবাসা কি করে পায় মাঝে মাঝে
ভাবি,নিজের সম্মন্ধে।পুরস্কার পাওয়ার পর আমাকে পারশনালি বহু মানুষ হয়তো ভিন্ন
পত্রিকার, জানিয়েছে ঐহিক পুরস্কার পাওয়ায় তারা খুশী।অনেক দিন পর একটা কাগজ যারা
ভালো কাজ করে তারা পুরস্কার পেলো। এ ও কি কম ভাগ্য।আর দায়িত্ব- ওটা নিতেই হয়।না
নিলে চলবে কি করে।আমরা সৌরভের গাঙ্গুলীর ভক্ত,পতৌদির ভক্ত।সামনে থেকে নেতৃত্ব
দেওয়ায় বিশ্বাসী। আর আমরা ‘আমি’ নয় ‘আমরা’তে বিশ্বাসী।‘আমরা’ শব্দের একটা আলাদা জোর আছে। জোর দেয়। আর আমি ও বিশ্বাস
করি এ ক্যাপ্টেন ইজ অ্যাজ গুড অ্যাজ হিজ টিম।
কেবল দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাও।ফল আসবেই।ঐহিক তো এক লড়াই এর ও নাম।উত্তর বা
দক্ষিন পূর্ব বা পশ্চিম আমরা আছি সর্বত্র। যেমন উত্তর বঙ্গ থেকে বাঙ্গলাদেশ
সর্বত্র আমাদের লড়াই জানা চেনা আরো অনেক অচেনা কে সাথী করে।কেবল চোখ বুজে লড়ে
যাও।ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে সাথিরে ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে সাথীরে ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে।ঐহিক
চলছে তার গতিতে।কেবল একটা কথা বলতে পারি,
এই অবিরাম চলতে থাকাও এক মুগ্ধতাই।নইলে পেজ সেটিং এর দিন রাতে ফাইল ক্রাশড হয়ে যাবার পর ও কি করে
ঐহিক বার করতে পারে তিন তিনটে সংখ্যা।মোট প্রায় ১২০০ পাতার কাজ।বহু তত্ত্ব,বহুল
প্রজ্ঞা ভেঙ্গে পড়েই,কালের নিয়মে।ভালো লাগে যখন দেখি এতো ভীড়েও মাথা উঁচু করে
দাঁড়িয়ে আছে ‘পাগল’, ‘বোধ’ অথবা একটি শ্যামল সিংহ সংখ্যা।তখন মনে
হয়ে এটাই শুধু এটার জন্যই আরো ঐহিক আরো বেঁচে থাকা।
(চলবে)
"কেবল দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাও। ফল আসবেই। "
উত্তরমুছুনবিভিন্ন বিষয়ে একের পর এক পরপর ঐহিক প্রকাশিত হয়ে চলায় আমি বিস্মিত। কতখানি উদ্যমী হলে যুগপৎ ওয়েব ও প্রিন্ট মিডিয়া কে দাপিয়ে শাসন করা যায়!
অভিনন্দন টিম ঐহিক কে।
অভিনন্দন তমাল, তুষ্টি, অনুপম কে।
আমি তো নিমিত্ত এখানে
মুছুনধন্যবাদ সৌমিত্র।তবে আমার ভুমিকা এখানে নগন্য
উত্তরমুছুন