ভোর চারটের কবিতা
ভোর চারটেয় কবি, প্রেমিক এবং পাগলেরা টের পায়
আরশির
জীবন— জীবাত্মার ছাঁচে ও গঠনে
তৈরি
আলোক-উৎসারী
প্রতিচ্ছবিকে বেঁধার সাহস যদি ওরা ক’রে উঠতে পারে, ভেঙে
যাবে সব গভীর
শাদা
একদল জেলিফিশ সমুদ্রতীরে জন্মেছে—
(ছোট্ট সুন্দর
নাশপাতির মতো মিষ্টি ছিল একসময়,
স্নানের
পোশাক, নশ্বর, আধ-ন্যাংটো, আর উদ্ধত সারা গ্রীষ্ম জুড়ে।
আলোকভেদ্য
শরীরে লক্ হয়ে যাওয়া একশ’ বছরের ভয় ঘুরে যাচ্ছে
প্রতিশোধের দিকে।)
ভোরের
মধ্যে আমাদের ঢুকিয়ে দেবে ব’লে জেগে উঠছে গেটগুলো, খুঁটি
হাতে, রাজদণ্ড হাতে
চাঁদ
এবং সূর্যের জ্যোতির্বলয়টায় ফাটল ধরছে। হারিয়ে যাচ্ছে বলয়টা। ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে।
দেওয়ালের কোনো লুকোনো খাঁজে, তিমি মাছের পেটে
এখনও তুমি
খোদাই হচ্ছ ঘুমের ভেতর। যথার্থ এক কাঠের বালক।
কিন্তু
শ্বাস চলছে— যেন ঝড়ের হাতে তুমি ধরা প’ড়ে গেছ
আর
প্রতিনিঃশ্বাসে প্রতিহত করছ যে তোমার পিছু নিয়েছে।
পলায়নশীল
কোনো আলো নেই। স্মৃতি
দিয়ে পূর্ণ হয় বস্তু এবং জড়।
শ্রেণি,
প্রকার ও বর্গে আমরা বাছাই করছি নিজেদের।
অনেক
উপাদানের মধ্যে এক উপাদান হিসেবে রাখছি না।
হাওয়া
এবং আগুন থেকে উৎপন্ন জীব, মানুষও।
আর হলুদ
চোখের জন্তুরা মেপে নিচ্ছে
কি
থেকে কি হ’ল। কি রইল।
তোমার সাথে উলঙ্গ হয়ে দেখা করেছি মাঝরাতে— সময়ের একেবারে শেষ প্রান্তে।
যেখানে
একটা শরীর হস্তান্তরিত হয় আরেকটা শরীরের জন্য
কুমড়ো-পটাশ
অথবা রাজধানী জেগে উঠছে রথ থেকে
ক্ষেপণাস্ত্রের
বিস্ফোরণে চাঁদের কমলা-শাদা পাথুরে ডায়াস ভেঙে টুকরো হ’য়ে পড়ছে আমাদের হাতে
কর্জ
দেওয়া লব্জগুলো ফিসফিস করছে সমুদ্র তারায়
তাদের
মিষ্টত্বে, আকাশপথের মতো শরীর
মাটি
এবং শূন্যের মাঝখানে
সমস্ত
প্রেত ও জীবাত্মা এ’ সম্পর্কে জ্ঞাত হয়। ইহাই জ্ঞান।
সমস্ত মেটাফরকে ব্ল্যাক-হোলে ছুঁড়ে ফেলতে উৎসুক যে বিজ্ঞান
যার
অনস্তিত্ব বমি হয়ে হয়ে যেতে পারে একরাতেই
an exact mathematical
notation of loss
তোমার
মুখ ভরে যাচ্ছে বছরের পর বছর দিয়ে, ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে মানুষের গভীরে থাকা
গোলাপি
আর নরম মেয়েদের মুখ।
এটা
আমি নই যে তোমাকে ছুঁলো। এটা আলো।
রিফিউজ্-ক্যাম্প
বিহীন আলো, আমাদের ঝাঁকিয়ে দেবে।
গোল-চোখের
কাদামাটির শরীর,
প্রচুর
এক ব্রহ্মাণ্ডের কিনারায় ঘুরে দাঁড়াব
চমকে যাব আমরা আমাদের ভালোবাসায়।
ঠিক কতবার
আমরা ঘরে ফিরতে চাই
সমুদ্রযাত্রাকালে কতবার আমরা
ঘরে
ফিরতে চাই?
রাতের
দরজা খুলে যায়, ধীরে
ঘুমন্ত
জন্তুদের দরজা, যা লাফিয়ে ওঠে তাদের স্বপ্নের ভেতর
কাচের
দরজা, যেখানে চোখ দেখতে পায় পেছনের জিনিস
এবং
মুখ পাথরে পরিণত হয়।
ধীরে, জাহাজ ঢুকে যাচ্ছে রাতের মধ্যে
আলো
ছড়াতে ছড়াতে মুক্তোর ভেতর
আমাদের
লাভ-ক্ষতির ইশ্তেহার লেখা জীবনটাকে নিয়ে
দু’-একটা প্রতিশ্রুতির জাঁকজমক আর সত্যিই ধ’রে রাখা সম্ভব হ’ল না।
নির্ভয়ে স্থির আমরা কি
তাকিয়েছি অংশুমান চোখে
ব্যাকুল মুখের বিশ্বাস রেখে খেয়েছি কি চুমু
হয়তো বসতে পারি পাতার মতো সবুজ তার সীমানার
দিকে
এমন কিছুর মতো যার কোনো স্থান ও সময় থাকে না
ভেঙে যাচ্ছে, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে আমাদের
ভেতর থেকে
শূন্যে ঝুলে থাকছে যে মরীচিকার আলো
পরিণত হচ্ছে মুক্তো এবং গতিতে
যে সমস্তকিছু আমরা দেবো বলেছি, গৃহীত হয় নি।
যে সমস্তকিছু আমাদের জন্য, না ছুঁয়ে পিছিয়ে এসছি ভয়ে
এসবই ঘটে চলেছে চোরের মতো চুপি চুপি ভেসে চলা এই
জাহাজটায়
সমুদ্রযাত্রাকালে আমরা কতবার
ঘরে
ফিরতে চাই?
আর্মচেয়ারে
ফেলে আসা নিজের ছায়াটাকে আবার বসাতে
আলো
হয়ে যাওয়া একটা মুক্তো তাকে দিতে
যে
আবেগ কিছুই স্থাপন করতে কিংবা নিঃসঙ্গতার কালো রক্ত দিয়ে কিছুই আঁকতে চায় না
বরং
ভাসাতে চায় তাকে অবাধ সোনার মতো,
যে
ক্ষুধার আকুল লোলুপতা থেকে মুক্ত হয়ে একবার নদীতে ভেসেছে
বাঁশুরিয়া
যে কথা বলতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছি—
তুমি
না ডাকলে ম’রে যাব।
সত্যি
আর মিথ্যে, দুটো বলতে গিয়েই
বিভ্রান্ত
হচ্ছি আমি।
যে
কথায় পাহাড় সরে না।
নিজেকেও
কোথাও সরাচ্ছি না। ছাদের
কিনারায়,
এক বোকা লোক এসে বসেছে—
বাঁশি
বাজাবে।
আমি
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
তুমি
ডাকো নি। কেউ
মারাও যায় নি। শুধু
শ্রীমান
মুহূর্ত ছাড়া।
পাহাড় মা
পাহাড় মা চলে গেছে। এক রাতে
নীচের
রাস্তা দিয়ে। দৌড়ে।
আমাদের
টেরাসে রেখে গেছে শাদা কাচের ডিম।
শুকনো পাতা উড়ছে, সময় নাড়াচ্ছে আমাদেরকে তার ভেতর
অন্ধকার
পর্যন্ত ডেকে যাচ্ছে বুনো জন্তু
পাহাড়ের
গায়ে বিস্ফোরণ হ’ল একটা। আমরা রক্তের গন্ধ পাচ্ছি।
খিদে আর নিঃসঙ্গতায় মাথা ঘুরছে
চুপ ক’রে ব’সে থাকা ফুলের সাথে আমরা
খেলছিলাম, সূর্যের দিকে
পেছন
ফিরে। পাহাড়
মা চলে গেছে আমাদের অপেক্ষার ঘরে
তালা-চাবি
দিয়ে।
উড়ে
যাওয়া পাখির ছায়া এসে পড়ে একসময়
ছায়া
দেখে মনে হয়, ঐ পাখির কি চোখ আছে?
আমাদের মুখগুলো ঘাসের ওপর ওদের কাছাকাছি,
স্পষ্ট,
দুঃখ
এবং
স্মৃতিচিহ্নহীন।
শেয়ালের প্রতি
চোখের পাতার নীচে, বন্ধ চোখের নীচে
ভীষণ কাঁপছি
তুমি
আগুন জ্বাললে আমার চারপাশে। আমি বরফ ঠাণ্ডা।
টেনে মাটিতে
বসালে। শক্ত,
দুটো আঙুর গাছ
ঢেকেছে
আমাদের। শ্বাস
নেওয়া যাচ্ছে না। চারদিকে
আঙুরের ওপর আঙুর
আর আমার
শরীর ছড়িয়ে আছে কালো মাটিতে
তুমি
যাকে ছুঁলে, সে আমি নই। আমার ভেতরে আসোনি তুমি।
আমার
ভেতরে থাকা শেয়ালের কাছে এসেছো। বন্য বুনো এক জন্তু
আর
মুখমণ্ডল নেই এমন রাতের ভেতরে এসেছো।
ভয়ঙ্কর
নরম। প্রতিরূপ
দিতে সম্মত নয় যে-গভীর আমার কাছে
একটা অথবা দুটো দিনের
পরম
ভগ্নাংশের মধ্যে, সহজের কঠিন শাদা বিস্তারে—
লুঠ
হওয়া শিকারের মতো, তার খোলা ও বিশাল আমাকে অসাড় ক’রে দিচ্ছে।
এর ভেতর, পোড়াচ্ছি গতিশূন্যতা।
জীবন
প্রিয় হয়ে উঠছে আমার কাছে : দূরের কোনো এক ব্যাধের কাছে ছিল সে
তার
চোখ পরিষ্কার।
শরীর যখন প্রেমের স্মৃতিগুলো ঘাঁটছে—
একটা নরম
গলার আওয়াজ শোনা যায়, মিষ্টি...
ইতিমধ্যে
আমি জেনে গেছি, এই আওয়াজ
সূর্য,
ঘাস, জেগে ওঠার জন্য রক্ত
সবাইকেই
নিলামের দর দেবে।
আর এখান
থেকে পালাতে দেবে না আমায়।
মেয়েটা এলোমেলো কথা বলছে
অন্ধকার দেয়ালের সাথে কথা বলছে মেয়েটা। এলোমেলো।
খোলা
কুয়োর ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে মা
সামান্য
কেঁপে ওঠে কুকুরের কান— যেখানে আলো নেই
দূরত্ব
বেড়ে যায়। পালাতে
থাকে মানুষের গলার আওয়াজ।
প্রেমের
ভান করা মাস্টার, মেয়েটাকে লাল ফল দেখায়
যেন
এক ঝাপসা নদীর তল থেকে তুলে এনেছে।
একঝাঁক
মাছ শূন্যে লাফায়। ঝকঝকে।
মেয়েটি স্বাদ নেয় লাল স্বচ্ছ ফলের
প’রে আছে কালো, নোনতা রিং
হাওয়ার মতো মাটির ওপর বসেছে মা
মাস্টার
মেয়েটাকে আলোতে পাঠিয়ে দেয়। তারপর হাসছে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে :
অন্ধকারের
জাদু ব্যথার থেকেও
গভীরে খোদাই হচ্ছে
শব্দের
মধ্যে ভীষণ রাগের মিষ্টিভাব।
আলোর
রেখার ওপর হাঁটছে মেয়েটা—
শেষ সীমানা ওকে ভেদ ও টুকরো করে।
সূর্যের নোঙর
এইখান থেকে, সমুদ্র শেষের বন্দর, শুধু সূর্য জানে
রাস্তাটা
কোন দিকে। সূর্যের
কোনও নড়াচড়া নেই।
জলে
নোঙর ফেলে, এ’ এক ভারী অপেক্ষা চারদিকে।
মৃতের শহর কিম্বা গ্রামে গলি উপগলি নেই কোনও
জানা
নেই দিনে তুমি কোন বিছানায় শোবে—
রাত্রি
জাগবে কার বিছানায় জানো না এখনো।
বন্ধুর সাথে কপালজোড়ে দেখা হয়ে যাবে তোমার
তাকে
ছেড়ে চলেও যাবে দ্রুত
এখানে
আবেগের কোনো স্মৃতি নেই
অপেক্ষা
বিস্মৃত।
গোল গোল ঘুরতে ঘুরতে জল
তোমাকে
টলমল ক’রে ঠেলবে বিছানায়
বিছানায়
তোমার পাশে ঘুমিয়ে থাকা মুখ
তাকে
তুমি চিনতেও পারবে না।
পিছু হঠতে থাকা আলোর ভেতর জাগবে।
জলের
প্রান্ত থেকে মেপে নেবে অল্প
যে
ফ্যাকাশে মুখ দেখছে তোমাকে
ভাববে
তুমি তার পিছু নেবে কিনা
প্রবল ক্ষমতার এই জাহাজকে কিভাবে ছড়াবে আরও?
কিভাবে
ঘুমন্ত মুখ থেকে শব্দ সোজা বেরিয়ে আসে?
যিনি দেখছেন তাকে এ’ পাড়ায় দেখা যায় না
কখনো।
চিরকাল
চোখ মেলে, পৃথিবী বিপরীতেই ডুব দিয়েছে আকাশে।
অনুবাদ : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন