৯) গত পর্বে তোমার লেখালেখির বিষয়ে অনেক
কিছু জেনেছি আমরা। শেষ দিকে তুমি বলেছ,
“আজ, আমার অবচেতনের দিন
সমাসন্ন। টের পাচ্ছি!!!” –
চেতন বা অবচেতন, দুটো মিলেই তো কবিতা। একে অন্যের অবহেলা করার জায়গা নেই। এখন
প্রশ্ন হচ্ছে এটাই, অবচেতন তোমাকে কীভাবে আক্রান্ত করছে? তোমার লেখার মধ্যে এই
অবচেতন যে না বলেকয়ে ঢুকে পড়ছে, তুমি টের পেলে কী করে?
দ্যাখো এটা তো আর
টাইমের কলের জল নয় যে জানা সময়ে আসবে, বা বিধানসভা ভোটও নয় যে আগে থেকে শিডিউলড
থাকবে। চেতন আর অবচেতনের সংযোগ হয়ত সবসময়েই কবিতায় থেকে যায়। এই সম্পর্কগুলো
সুড়ঙ্গলালিত বলেই, আমাদের নিজেদের এই বিষয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই মঙ্গল। তবু,
অনধিকার চর্চা করি। একজিবিশনিস্টের মত নিজেকে নিয়ে বাগাড়ম্বর করি। অগত্যা।
আমার নিজের মনে হয়েছে,
যেকোন মানুষের শক্তিই আসলে তার দুর্বলতার জায়গা থেকে আসে। অসাড়ে, কলেরার পায়খানার
মত একটা লেখা হয়ে চলার অভ্যাস , এটা একটা দুর্বলতাই তো! ছোট বয়সে, মানে যখন
প্রথমদিকে লিখছি, আমার লেখালেখিটা পুরোটাই
সেইরকমই খারাপ অর্থে “স্বভাবকবিতা” ! ( যদিও এর বিপরীতে এক সময়ে অনেক শুনতে হয়েছে, তুমি সেরিব্রাল
কবি, সেটাও এক নঙর্থক বিবরণ যদিও)
এই জিনিশটাই অন্যভাবে
বললে, নিজেকে ছেড়ে দেওয়া, সঁপে দেওয়া, অথবা রিলিজ, নিষ্কৃতি। এই নিষ্কৃতির প্রয়োজনটা
এতটাই বেশি আমার পক্ষে, যে টানা বেশ কিছুদিন কবিতা না লিখলে আমি আমার মানসিক
অবস্থার অবনতি টের পেতাম। খিটখিটে টাইপের
হয়ে উঠতাম। খুব রেস্টলেস, অস্থির অশান্ত। অন্য
ধরণের লেখালেখি, যেমন গল্প বা প্রবন্ধ নিবন্ধ, না লিখতে পারলে সেরকম হয়না, হয়নি।
সেজন্যে বুঝেছি, আমার ভেতরের আসল জায়গাটা কবিতা। হয়ত একধরণের ডায়েরি। একধরণের
যাপন।
এখন এই অস্থিরতা, এই
কিচ্ছু ভাল না লাগা, আমার মাথার ভেতরে “অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করা” ডিপ্রেশনই বলো, রোজকার জীবনের
চাপই বলো, অথবা পারিপার্শ্বিক নিয়ে বিব্রত ক্ষুব্ধ থাকা, এই সবটা মিলিয়েই। তবে
যেটাই বলি, এগুলো নিয়ে বড়াই করার কিছু নেই। এটা আমার কালো অন্ধকার একটা সত্য। আমি
তাকে আমার দৈনন্দিন জীবনে মানুষের সঙ্গের অবিরাম সং ঘর্ষ এবং অবিরাম ওঠাবসা দুইয়ের
ভেতরেই লুকিয়ে রাখতে চাই। আমার এইসব দাঁত নখ কেউ দেখতে পায়না।
কিন্তু কবিতায় আসে।
অথচ ধর্ষণ নিয়ে কবিতা
লিখেছি, সেটাও তো ঐ বাইরের দিক থেকে আসা চাপে খুব ক্রুদ্ধ হয়ে লেখা কবিতাই। অথচ
নানা অন্য বিষয়ও তো কবিতায় আসে, সেগুলোও তো বাইরের দিক থেকে আসা সব চাপের ফল।
কিন্তু অবচেতনের কবিতা তাদের সে অর্থ আমরা বলি না কিন্তু।
অথচ, আমার একটা সিরিজ,
যেটা ২০১১ সালে লেখা, সেটা ছাপতে দিতে আমার খুবই কুন্ঠা হচ্ছিল। কেননা , আমার কাছে
এই ভাষাটা, এই এক্সপ্রেশনগুলো খুব সত্যি হলেও ভীষণ মন খারাপ থেকে উঠে আসা ছিল বলেই
নিজে ওগুলোর দিকে তাকাতেও অস্বস্তি হচ্ছিল।
১
সকাল
একরকম করে রাত্রির দেওয়ালের মুখোমুখি হয়
আর
তাকে ছিঁড়ে ফেলে
আমি
অন্যরকম ভাবে দেওয়ালের সঙ্গে কথা বলি,
তাকে
মেনে নিই, তার বুকে হাত বোলাই,
তার
সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে কমলালেবু খাই
তার
পায়ে মাথা কুটে রক্তারক্তি করি
ছিঁড়তে
পারি না। কে জানে, সকাল , তুমি কত তালেবর
তাই
দেওয়াল তোমার আর কিছুই করতে পারে না।
আমি, আমি তো আটকে গেছি।
এই
নিয়ে সকালের সঙ্গে আমার তর্ক বাধে
আমরা
বুঝতে পারি না,
দুটো
পথই তো ভাল, দুটোই ঠিক।
আমার
মন কালো হয়ে যায়
সকালের
মন ফকফকে সাদাই তো ছিল...
সকাল
বেশি সিরিয়াস, বেশি ভাল
আর
আমি অধিক পাগল, অধিক অন্ধকার।
২
তোমাকে
বলিওনি, কীভাবে লড়াই করি।
তোমাকে
ছিঁড়ে ফেলার পর, সকাল, আমি আরো একা হয়েছি।
কিন্তু
এখন তোমাকে জোড়া দেব ভাবছি।
কারণ
পাখির প্রলাপ আর গান,
রোদ
আর দুব্বোঘাস
বাতাসের
নিঃশ্বাস আর হাসি
আমাকে
পুনরুজ্জীবিত করে
তুমি
হলেই বা বেশি ভাল, বেশি কাজের, বেশি বোরিং
আমার
চাইতে
সকাল, তোমাকে তো আমি
ভালই বেসেছি
৩
যখন
আমার কেউ ছিল না,
তখন
তুমিও ছিলে না, সকাল।
আজ
বললে আমি নাকি দোকান খুলে বসেছি।
আজ
তুমি ঠেলে ফেলে দিলে আমায়
আমার
কনুই ঠুকে গেল আলমারিতে।
ও
সকাল , আমার সব গোলমালই তোমাকে নিয়ে নয়,
তুমি
আমার জীবনের ছোট একটু অংশ।
তবে , যদি তোমার ভাবতে
ভাল লাগে তুমিই
আমার
সব কষ্টের কারণ, ভাব তা।
আমি
তো রাত্তির, রাত্রিময়ী
ছিলাম, আবার হব।
মধ্যেখানে
একটুখানি মধ্যগগনের মত স্পষ্টতা নামুক।
যখন
আমার কেউ ছিল না,
তখনো
আমার সামনে দেওয়াল ছিল,
সকাল।
দেওয়ালকে
তোমার হিংসে হয়?
৪
কী
কষ্ট আমার , তা বলে বোঝাব কাকে ?
কষ্টেরও
চাররকম প্যাকেজিং এখন
আর
অনেক রকম দামাদামি।
তুমি
কি জানো, আমার কষ্টকে
বার
বার বিক্রি করেও
শেষ
হবে না?
সব
বিক্রিবাটার পরও আবার পেয়েছি
কষ্টের
নতুন স্টক?
এক
দেওয়াল আলমারি ভর্তি সেই মাল
দেওয়াল
আলমারিটা এমন শক্ত
তাতে
ঘুণও লাগে না, উইপোকাও না
মাথা
ঠুকতে ঠুকতে মাথা ফেটে যায়
তবু
কী
কষ্ট আমার , তা বলে বোঝাই কাকে?
তোমাকে, সকাল?
তুমি
তো আমাকে ভালবাসা দাও শুধু
আর
রাত্রি আমাকে দেয় অন্ধকার, দেওয়াল, মাথা ঠোকা,
কষ্ট
কে
আমাকে বেশি দিয়েছে সে কথা কাউকে নাই বা বললাম।
৫
আমরা
এখন নানান রকম কষ্টকে বলছি।
সোশ্যাল
কষ্ট ।
রঙিন
কষ্ট।
ফালতু
কষ্ট ।
হিমালয়
কষ্ট।
আমরা
এখন বলছি, একটা দেওয়াল আর তার উপরে
পড়ে
থাকা ছায়ার কথা।
দেওয়ালটা
তো পালটায় না। ছায়াগুলো পালটায়।
৬
সবই
যদি বিক্রি হয় তাহলে এটাও বিক্রি হবে।
আমার
এই কথাটারও দাম উঠবে
, আশি নব্বই একশো ।
মন
খারাপ হলেই আমার যানজট হয়।
শহরের
মত মনখারাপ হলেই।
আর , মেয়েদের মত মনখারাপ
হলে,
আমার
চুলে জট পড়ে, সেইসব চুল
যাদের
ভেতরে চিরুণি চলে না,
আঙুল চলে না, কথা চলে না আর।
সবই
যদি বিক্রির জন্যই ছিল,
তাহলে
রেশম, আহ্লাদ, আর এই কথাটারও
দাম
উঠে যেত।
একশো, একশো দশ।
আগের কিস্তির
সাক্ষাৎকারে তোমাকে যখন বললাম, আমার অবচেতনের দিন শুরু, তখন এই কবিতাগুলিকেই
প্রাথমিকভাবে মাথায় রেখে বলেছিলাম... কিন্তু এরকম আরো বেশ কিছু লেখা কখনো কখনো
আমার নিজের লেখা ঘাঁটতে ঘাঁটতে পাই। আমার “স্মার্ট” বনাম “মুখচোরা” কবিতাদের মধ্যে যদি দু ভাগ করে
দেওয়া যায়, তাহলে সেই মুখচোরাদেরই আমি অবচেতন বলতে চাইছিলাম হয়ত।
তবে ওপরে যা যা বললাম
সবটাই অন্ধের হস্তিদর্শন। একদম পিন পয়েন্ট করে বলতে পারব না, কী বলতে চাইছি। হয়ত
অনেক অসংলগ্নতা আসছে কথায়, অনেকটাই বিভ্রান্তি এবং স্ববিরোধিতাও।
আমি স্বতঃস্ফূর্ততায়
বিশ্বাসী, কিন্তু ঐ মুখচোরা আর চীৎকৃত-র স্ববিরোধিতা আমার আছে। এটা আমিও জানি।
১০) এতদিন এই লেখার জগতে আছ, তোমার কী এই জগতটাকে খুব স্বাভাবিক, সুস্থ অবস্থানের মনে
হয়? তুমি কী টের পাও নি তোমার বিরুদ্ধ স্রোত? পিছন থেকে এসে পিঠে ছুরি মারার মত
ঘটনা কী মনে পড়ে?
এই সব কথা তো আগেও হল।
অনেক পিঠে ছুরি মারা। অনেক খারাপ কথা। পরে, সবটাই গা দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যায়। আর, একটা
কথা বলি, মাঝে মাঝেই এই লেখালেখির জগতকে অসম্ভব জটিল ও কুটিল লাগে। মাঝে মাঝেই মনে
হয় আমি এখানে সম্পূর্ণ বহিরাগত ।
আগে আরো বেশি করেই এটা
মনে হত। কেন জানো? আমার কাছে তো কবিতা লেখা,
সাংবাদিকতা/অধ্যাপনা/কমার্শিয়াল লেখা ইত্যাদির পেশাগত স্থানাংক থেকে
উৎসারিত নয়। আমার পেশাটা এতই আলাদা কবিতার থেকে, সাহিত্য থেকে এত মা ইল দূরে
অবস্থিত , যে আমি আগে ভাবতাম, আমি বোধ হয় আসলে কবিতার লোক নই। যে অর্থে হোলটাইমার
সাহিত্যিকরা কবিতার লোক , যে অর্থে আমাদের সময়ের প্রধান কবিরা কবিতার লোক, সে
অর্থে নই।
আমার ডুয়াল
আইডেন্টিটিটা বেজায় গোলমেলে। একইসঙ্গে আমার কাছে এই চাকরিতেও আমার অবস্থান কেমন
যেন বাহিরির মত মনে হত।
অতি সদ্য, দুটো
আইডেন্টিটি যেন একসঙ্গে মিশে গিয়ে একটা স্থিতুভাব দিচ্ছে আমায়।
অতি সদ্য, আমি দেখছি,
আমার নিজেকে কবি ভাবতেও অসুবিধে হয় না। অডিটর ভাবতেও না।
হয়ত, আমি আগের চেয়ে
নিজের প্রায়রিটি, চাওয়া পাওয়া, তীব্র আকর্ষণ কবিতার প্রতি ,এ গুলো বেশি করে বুঝতে
পারছি, তাইই।
তবে বাংলা বাজারে খারাপ
ব্যবহার সে অর্থে কম পেয়েছি বোধ হয় এই বহিরাগত হবার ফলেই। কেউ ই প্রথমদিকে আমাকে
সিরিয়াসলি নেয়নি, ভেবেছে, ও টাইমপাস করতে কবিতা লিখতে এসেছে, কিছুদিন পরেই কেটে
পড়বে। সে অর্থে আমি কারুর থ্রেট ছিলাম না আর কি!!! হে হে।
যেটুকু অবহেলা, যেটুকু
অপমান, তা ঐ উলটো দিক থেকে। মানে, ভাবটা এই, দিব্যি তো চাকরি কর বাপু, আবার আমাদের
ভাত মারতে এলে কেন?
আর একটা জিনিশ আমি
লক্ষ্য করেছি, তা হল বাংলা লেখার জগত অসম্ভবরকমের গোষ্ঠী বিভাজিত। এই গোষ্ঠীগুলির
মধ্যে আমি কখনও কারুর কাছের ছিলাম না। সবার থেকে সমদূরত্বে ছিলাম। ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং।
একটা সময়ে জিগ্যেস করত সবাই, এই কবি রবিবার সকালে কার বাড়িতে যায়, সুনীলদা না শঙ্খ
বাবু।
আমি দীর্ঘকাল নিজেকে
নিয়েই থেকেছি, কারুর বাড়িই যাইনি। সাকুল্যে শঙ্খবাবুর বাড়ি পনেরোবার গেছি, বা কুড়ি
বার। আর সুনীলদার কাছে ওনার জন্মদিনে কয়েকবার গেছি। ব্যাস।
কোন কোন গোষ্ঠী আবার
পত্রিকা নির্ভর। প্রথমদিকে কবিতাপাক্ষিকের লোক বলে আমাকে মনে করা হত, সত্যিই
প্রভাতদা আমাকে খুবই স্নেহ করতেন, প্রথম দুটি বইও ওনাদেরই করা। কিন্তু তাই বলে আমি
কখনো নিজেকে ওই গোষ্ঠীভুক্ত ভাবিনি, আবার ওনারাও পরে ওনাদের থেকে দূরে থাকার কারণে
যে আমার ওপর রেগে গিয়েছেন বা ভুল বুঝেছেন তাও নয়।
খুব ভাল হত যদি নিজে
একটি পত্রিকা করতাম। কিন্তু চাকরি করে এবং মেয়েকে বড় করার মধ্যে দিয়ে কোনমতে
কবিতার সঙ্গে সম্পর্ক টিঁকিয়ে রাখতে গিয়ে আমার আর পত্রিকা করা হয়নি। কখনো ইচ্ছেও
হয়নি।
এসব লিখতে গিয়ে আমার
মনে হচ্ছে, আমি আসলে বেজায় একটি বেখাপ্পা বেকুব লোক। সবটাই অ-কবিসুলভ। আর, যেটা
পরে এই আমার উত্তরগুলো ভাবতে গিয়ে মনে হচ্ছে, সেটা হল তোমার প্রশ্নটাও গোলমেলে।
আমাকে যদি জিগ্যেস কর আমার শত্রু আসলে কে, তাহলে ওই সব হালকা ফুলকা “ঈর্ষ্যা” বা অপরের মুখ ম্লান করে দিতে
চাওয়া, কারুর ঈষৎ ঠেশ দিয়ে কথা... এগুলো কিছুই না। কিচ্ছু না। অ্যাবসল্যুটলি কোন
থ্রেট না। তার চেয়ে অনেক বড় থ্রেট আমার নিজের মধ্যেই বসে আছে। আমি।
হ্যাঁ, আমিই আমার
কবিতার সবচেয়ে বড় শত্রু। সেই আমি যে আমাকে ভুলিয়ে অন্যত্র নেয়। কবিতার সঙ্গে মন
দিয়ে থাকতে দেয়না। অন্যের কবিতা পড়তে দেয়না। কনসিস্টেন্টলি কিছুই ভাবতে দেয়না। কোন
আলোচনা, কোন পড়াশুনোয় আধ ঘন্টার বেশি মনঃসংযোগ করতে দেয়না। যে আমিটার কোন ফিল গুড
নেই, সবসময় দাঁত খিঁচিয়ে আছে। আবার যে আমিটা শপিং মলে ঘোরে, কফি খায়, হ্যা হ্যা
করে ক্যাজুয়ালি আড্ডা দেয়, নিজেকে সিরিয়াসলি নিতে দেয়না, ছেলেমানুষি করে বেড়ায়।
সেই আমিটাও আমার শত্রু। আমার অসম্ভব কুঁড়েমি আমার শত্রু। আমার অদ্ভুত
দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আমার শত্রু। আমার সবদিক ব্যালান্স করতে গিয়ে সবকিছু খুইয়ে বসা
আমার শত্রু। আমার যা যা লেখার ছিল সেগুলো না লিখতে পারা আমার শত্রু। আমার নিজের
আত্মম্ভরী হয়ে ওঠা মন, নিজেকে পিঠচাপড়ানো মন, সহজে খুশি হয়ে যাওয়া নিজের কবিতার দু
চারটে লাইনে, এই মন আমার শত্রু। আমার চারপাশে এমন সব পারফেকশনিস্ট লোক আমি দেখেছি,
যারা নিজেরা খুব পরিশ্রমী। খুব সিরিয়াস। আমি তাদের মত হতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি।
আমার মনে হয় আমি নিজে তাদের মত হতে চাই ও নি। আমি একটু ফুর্তিফার্তা করে সময়
কাটাতে চেয়েছি। আর যখন কষ্টে থেকেছি, তখন কষ্ট ঝেড়ে ফেলতে কবিতা লিখেছি। তিনটে
কবিতা লেখার পর কষ্ট ঝরে গেলে উঠে পরোটা আর বেগুনভাজা বানাতে গেছি। সংসারে, সন্তানে, সিনেমায়,
রান্নাঘরে ছড়িয়ে দিয়েছি নিজেকে। এইসব করতে করতে যে ৯৯ শতাংশ ফুরিয়ে গেল, তা কবিতায়
অনূদিত হল না। ১% মাত্র কবিতায় অনূদিত হল । এটা কি কম পিঠে ছুরি মারা?
১১) তুমি আগেই বলেছ যে সময়ের সাথে সাথে তোমার লেখার ধরণ বদলেছে। আর সেটা স্বাভাবিকও
বটে। এখন, বদলাতে বদলাতে কখনও কী মনে হয় যে বদলটা এখানেই থামানো দরকার? বা আগের
ধরণটাই ভালো ছিল। কেন যে বদলাতে গেলাম! ইত্যাদি ইত্যাদি এওরকম কোন প্রতিক্রিয়া আছে
কী?
আগেকার লেখা খুলে দেখি
যখন, নিজেই অবাক হই। নিজের পুরনো সত্ত্বাটাকে অনেক সময়েই হিংসে করেছি। ভীশণ হিংসে
হত নিজের ভাষা ব্যবহার দেখে, পাগল পাগল সব উপমা, অদ্ভুত ছবি , আমার আগের লেখার
অ-নিরুদ্ধতা দেখে।
এক একটা খরার সময়ে আগে
কখনো বন্যার মত বেগে হু হু করে অনেক লেখা লিখেছি, দেখলে কেমন একটা শুকনো ফিলিং
হয়না? সেইরকম।
এখন সেই হিংসুটেপনাটাও
পেরিয়ে এসেছি।
সবটাই তো আমি। ভালটাও,
খারাপ টাও। অতি মাত্রায় বহুপ্রজ যে , সেও আমি, আবার শুকনো বালির ওপর খুঁড়িয়ে
হাঁটাটাও আমি। পিশাচিনী সিরিজের সময়কার ঘোর, অদ্ভুত একটা মায়ার বলয়, আবছা অথচ
স্পষ্ট প্রেমের শরীরিতা , সব মিলিয়ে একটা চার্ম ছিলই। সেটা খুবই পরিষ্কার একটা ধাপ
আমার । ঐ সময়টা আসবে না। ওই লেখাটাও তাই আর আসবে না।
পরে অন্যভাবে , অন্য
লেখা আসবে। ক্ষতি কী?
১২) তোমার কী মনে হয় না, লেখকদেরও একটা রিটায়রমেন্টের বয়স থাকা উচিৎ? আর এই বয়স লেখকের
নিজেরই নির্ধারন করা উচিত। অনেক বর্ষিয়ান লেখকরা স্রেফ নামের খাতিরে অজস্র বাজে
লেখা লিখে চলেছেন, বা লিখেছেন মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। আমরা কী নাম ধুয়ে ধুয়ে জল খেয়ে
যাব চিরকাল?
নাম ধুয়ে জল খাওয়া অসম্ভব খারাপ ।
একদম সমর্থন নেই।
যেদিন লিখতে পারব না,
পরোটা বেগুনভাজা বানাবো। সেলাই ফোঁড়াই করব। অন্য যে যে কাজে আনন্দ পাই করব। কবিতা
লিখে আনন্দ না পেলে কবিতাটা তো লিখবই না।
বর্ষীয়ানরা লেখেন সে
তো সম্পাদকদের তাড়নায়! কী করবেন তাঁরাই বা! বাধ্য হন অনিচ্ছেতেও লিখে দিতে।
বাঁহাতের লেখা।
আমার সুবিধে আছে, আমি
লেফটি, তাই এমনিই বাঁহাতে লিখি। তাই আর বাঁহাতের লেখা দিলে অসুবিধে নেই। হা হা।
রিটায়ারমেন্ট বেঁধে
দিতে তা বলে পারবে না। মণীন্দ্র গুপ্ত বা দেবারতিদি বা শঙ্খবাবুর লেখা দেখ। এখনো
কী সজীব। সুনীলদার লেখাতেও, বহু সহবাসক্লান্ত লেখা বলে যাকে আমরা গালি দিতাম,
তাতেও কত না চার্জ থাকত, কত নতুনত্ব।
এখন বুঝি।
তবে পরবর্তী প্রজন্মের
প্রতিটি কবি আমাকে বার বার মনে পড়িয়ে দেয় এই সত্য যে কবিতার ময়দান ফাঁকা থাকবে না।
নতুন কবিরা এসে পুরনোদের সরিয়ে দেবেই।
ইতিমধ্যেই এক ঝাঁক
অসম্ভব মেধাবী এবং ভাল কবি এসে গেছে বাংলা কবিতায়। তারা আমাদের অটোমেটিক ভাবেই
রিটায়ার করিয়ে দেবে।
এই সব কবি, যারা
ফেসবুকেই বল, বা নানা ছোট পত্রিকাতেই বলো, লিখছে, তারা প্রত্যেকে এত তরতাজা এত
ঝকমকে, এত বেশি নতুন লেখা লিখছে, যে তাদের দিকে তাকাতে গিয়ে মাঝে মাঝে চোখ ঝলসে
যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, একটুও ইমোশন নেই এদের লেখায়। সেটা কষ্ট দিচ্ছে,
তারপর মনে হচ্ছে আমিই আসলে পুরনো অভ্যাসে এদের বুঝতে পারছি না বোধ হয়। তাই এমনটা
ভাবছি।
সাক্ষাৎকার - তুষ্টি ভট্টাচার্য
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন