• কবিতা সুর্মা


    কবি কবিতা আর কবিতার কাজল-লতা জুড়ে যে আলো-অন্ধকার তার নিজস্ব পুনর্লিখন।


    সম্পাদনায় - উমাপদ কর
  • ভাবনালেখা লেখাভাবনা


    কবিতা নিয়ে গদ্য। কবিতা এবং গদ্যের ভেদরেখাকে প্রশ্ন করতেই এই বিভাগটির অবতারণা। পাঠক এবং কবির ভেদরেখাকেও।


    সম্পাদনায় - অনিমিখ পাত্র
  • সাক্ষাৎকার


    এই বিভাগে পাবেন এক বা একাধিক কবির সাক্ষাৎকার। নিয়েছেন আরেক কবি, বা কবিতার মগ্ন পাঠক। বাঁধাগতের বাইরে কিছু কথাবার্তা, যা চিন্তাভাবনার দিগন্তকে ফুটো করে দিতে চায়।


    সম্পাদনায়ঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়
  • গল্পনা


    গল্প নয়। গল্পের সংজ্ঞাকে প্রশ্ন করতে চায় এই বিভাগ। প্রতিটি সংখ্যায় আপনারা পাবেন এমন এক পাঠবস্তু, যা প্রচলিতকে থামিয়ে দেয়, এবং নতুনের পথ দেখিয়ে দেয়।


    সম্পাদনায়ঃ অর্ক চট্টোপাধ্যায়
  • হারানো কবিতাগুলো - রমিতের জানালায়


    আমাদের পাঠকরা এই বিভাগটির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন বারবার। এক নিবিষ্ট খনকের মতো রমিত দে, বাংলা কবিতার বিস্মৃত ও অবহেলিত মণিমুক্তোগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে আনছেন, ও আমাদের গর্বিত করছেন।


    সম্পাদনায় - রমিত দে
  • কবিতা ভাষান


    ভাষা। সে কি কবিতার অন্তরায়, নাকি সহায়? ভাষান্তর। সে কি হয় কবিতার? কবিতা কি ভেসে যায় এক ভাষা থেকে আরেকে? জানতে হলে এই বিভাগটিতে আসতেই হবে আপনাকে।


    সম্পাদনায় - শৌভিক দে সরকার
  • অন্য ভাষার কবিতা


    আমরা বিশ্বাস করি, একটি ভাষার কবিতা সমৃদ্ধ হয় আরেক ভাষার কবিতায়। আমরা বিশ্বাস করি সৎ ও পরিশ্রমী অনুবাদ পারে আমাদের হীনমন্যতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরটি সম্পর্কে সজাগ করে দিতে।


    সম্পাদনায় - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
  • এ মাসের কবি


    মাসের ব্যাপারটা অজুহাত মাত্র। তারিখ কোনো বিষয়ই নয় এই বিভাগে। আসলে আমরা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কবিকে নিজেদের মনোভাব জানাতে চাই। একটা সংখ্যায় আমরা একজনকে একটু সিংহাসনে বসাতে চাই। আশা করি, কেউ কিছু মনে করবেন না।


    সম্পাদনায় - নীলাব্জ চক্রবর্তী
  • পাঠম্যানিয়ার পেরিস্কোপ


    সমালোচনা সাহিত্য এখন স্তুতি আর নিন্দার আখড়ায় পর্যবসিত। গোষ্ঠীবদ্ধতার চরমতম রূপ সেখানে চোখে পড়ে। গ্রন্থসমালোচনার এই বিভাগটিতে আমরা একটু সততার আশ্বাস পেতে চাই, পেতে চাই খোলা হাওয়ার আমেজ।


    সম্পাদনায় - সব্যসাচী হাজরা
  • দৃশ্যত


    ছবি আর কবিতার ভেদ কি মুছে ফেলতে চান, পাঠক? কিন্তু কেন? ওরা তো আলাদা হয়েই বেশ আছে। কবি কিছু নিচ্ছেন ক্যানভাস থেকে, শিল্পী কিছু নিচ্ছেন অক্ষরমালা থেকে। চক্ষুকর্ণের এই বিনিময়, আহা, শাশ্বত হোক।


    সম্পাদনায় - অমিত বিশ্বাস

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

মৃতের সহিত কথোপকথন : অর্ঘ্যর বিনয় এবং তাঁর বিনয়ী পাঠক

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

ইন্টারভিউ এক সংলাপী ফর্ম হলেও সংলাপ মাত্রেই ইন্টারভিউ নয়। সংলাপ নাটকনভেলগল্প বিভিন্ন ন্যারেটিভেই থাকে কিন্তু ইন্টারভিউ ফিকশন নয় বলেই সেখানে প্রামাণ্যতার দাবি থেকে যায়। সেই যাচাইযোগ্যতার বাস্তববাদ সমস্যায়িত হয় যখন ইন্টারভিউ হয়ে ওঠে মৃতের সহিত কথোপকথন অর্থাৎ প্ল্যানচেট। অর্ঘ্য দত্ত বক্সীর ২০১৫র কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত গ্রন্থবিনয় মজুমদার: প্ল্যানচেটে যৌনসমীক্ষায় শুরু হয়েছে এমনই এক প্ল্যানচেট-ইন্টারভিউ দিয়ে।  অর্ঘ্য এই আলাপচারিতায় মৃত বিনয়ের যে ভাষ্য নির্মাণ করেছেন সেখানে বন্ধনীর মাধ্যমে বিনয়ের নিজের কথাগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে যেখানে যেখানে বন্ধনী ছাড়াও কথা বলেছেন বিনয় সেখানেও তার বিভিন্ন গ্রন্থে ও সাক্ষাতকারে বলা কথাগুলিকেই নিজের বয়ানে ও বয়নে তুলে ধরেছেন অর্ঘ্য। দীর্ঘ এই আলাপচারিতার শেষে লেখকীয় বন্ধনীর ভেতর তিনি পাঠকদের জানিয়েছেন যে এই লিখনে 'লেখক হবার কারিকুরি বিন্দুমাত্র প্রয়োগ করা হয়নিএবং তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল বিনয়ন্মোচন। এই ইন্টারভিউয়ে তাই প্রামাণ্যতার কোনো দাবি নেই এবং বিনয় এখানে দ্বিপ্রকার মৃত কারণ তিনি শুধু বাস্তবেই মৃত ননএই কাল্পনিক আলাপচারিতার কাল্পনিকতায়ও তিনি মৃত। এ এমন এক প্ল্যানচেট-সাক্ষাত্কার যা আগে ঘটেনি আর পরে কোনদিন ঘটবে না বলেই নিজেকে জানান দিয়েছে অর্ঘ্য প্রথমেই স্বীকার করে নিয়েছেনবিনয়ঋত্বিক আর কার্ল ইয়ুং তাঁর গুরু এবং এই বই রাধা কেলোনামা ও বিনয়ী না-কবিতা সিরিজ  (২০১১) নামক পূর্ববর্তী গ্রন্থের পর তাঁর দ্বিতীয় গুরুদক্ষিণা। হয়ত সেই কারণেই তথাকথিত নিরপেক্ষ এবং নৈব্যক্তিক সমালোচনাগ্রন্থ তিনি শুরু করেছেন বিনয়ের অথরিয়াল স্পেসের ভেতর থেকে। সমালোচনার সাবজেক্টিভিটি এই গ্রন্থের আবেগময়তার সম্পদ। বিনয়কে তাঁর নিজের নান্দনিক টার্মসে তুলে ধরতে চেয়েছেন অর্ঘ্য। তাই তাঁর কবিতা ও দর্শন বিষয়ক দীর্ঘ প্রেতালাপের পর তিনি প্রবেশ করেছেন বইটির দ্বিতীয় এবং শেষাংশে যেখানে যত্ন সহকারে পঙতি ধরে বিনয়ের কাব্যগ্রন্থ অঘ্রাণের অনুভূতিমালা  দ্বিতীয় দীর্ঘকবিতা 'বিশাল দুপুরবেলা'র সাইকোআনালিটিক যৌনবিশ্লেষণে হাত দিয়েছেন।

প্রশ্ন জাগে কেন অর্ঘ্য কথোপকথন শুরু করলেন বিনয়ের ভাবমূর্তির ক্যারিকেচারমার্কা ক্লিশে, উন্মাদনা দিয়ে। তাঁর ব্যর্থ গায়ত্রী-প্রেমউন্মাদনা আর তার মিথিফিকেশন তো এক আনক্রিটিকাল বিনয়-কাল্টযেমন ঋত্বিকের মদ্যপানযাকে নান্দনিক সর্বস্বতা দিলে কমলেশ্বরের ঘটক জাতীয় একটা সিনেমাটিক ডিজাস্টার তৈরী হয়। অর্ঘ্য বিনয়ের উন্মাদনাকে 'ঐশ্বরিকবলেছেন, কিন্তু অধম এই পাঠকের কাছে এমন মরমিয়াবাদী দাবির একটাই অর্থ হয় আর তা হল ঈশ্বর নিজেই উন্মাদ। আমার তো মনে হয়উন্মাদনাও ঈশ্বরকে অস্তিত্বশীল করে তুলতে অপারগ! অর্ঘ্যর বিনয় বলেছেন, গণিত প্রমাণ করেছে তিনি উন্মাদ নন। প্রমাণ করেছে তাঁর কবিতাও কিন্তু এই প্রমাণ কি নিতান্তই আবশ্যকপ্ল্যানচেটে নিজের তথাকথিত 'উন্মাদনানিয়ে বিনয়ের এই হতাশা এবং নিজেকে অনুন্মাদ প্রমাণ করতে চাওয়া আমার কাছে হতাশাজনক। বিনয় বা হোল্ডারলিন উন্মাদ নাকি উন্মাদনা নিজেই উন্মাদ নাকি আমরা মানুষেরা সকলে জন্মগতভাবেই উন্মাদ, এই সব আলোচনা স্রষ্টার সৃষ্টির জাদুকাঠি নয় বরং নিতান্তই অনুসঙ্গমাত্রতাই থাকুক না। নচেত কবিতাকে যুক্তিবাদী বা জাতীয়তাবাদী প্রভুত্বের প্রতর্কমুক্ত করা যাবে না! অর্ঘ্যকে ধন্যবাদ কারণ শুরুতেই এই প্রসঙ্গ আনলেও আলাপ দ্রুতই তাকে অতিক্রম করে অন্য অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেছে।  বিনয় খোলাখুলি কথা বলেছেন সৃষ্টিতত্ত্ব এবং তার এককত্ব নিয়ে; কবিতার জন্ম ও পাঠ নিয়ে বলেছেন আশ্চর্য কিছু কথা যাতে নির্মাতা আর ভাবুক বিনয়ের চমত্কার মেলবন্ধন চোখে পড়েবিনয়ের মত একজন কবির কাছে মহাজীবনের বোধ আর সেই বোধে জীব ও জড়ের নিবিড় টান কবিতারও জন্মরহস্য। বিনয় লিখেছেন, কবিতা শুধু মাথা দিয়ে পঠিত হয়নাপঠিত হয় 'সমগ্র শরীরদিয়েমৃত্যু অপর নয়মৃতপাখিও পাখিই বটে। অঘ্রাণের অনুভূতিমালাকে তিনি বলেছেন তাঁর ধর্মগ্রন্থ। সেটি 'আদিরসাত্মকঅথচ 'নারীভূমিকাবর্জিতযা অর্ঘ্যর কাছে স্ববিরোধিতা মনে হয়েছে যদিও আমার মনে হয় আদিরসের ভেতর আত্মকাম থাকতে পারে যেখানে যৌনতার ভাষ্য যৌন অপরের ওপর নির্ভর করে না। লাকানীয় মনোবিশ্লেষণে যৌনতা সম্পর্কের নয়বরং অ-সম্পর্কের প্রতর্ক কিন্তু আমরা বর্তমান আলোচনায় এই টেকনিকাল বাদানুবাদে নয় নাই বা ঢুকলাম। তাছাড়া আদিরসের যৌনতা সমলিঙ্গীয়ও হতে পারে যাতে নারীর ভূমিকা থাকে না। বিনয় অর্ঘ্যকে বলেন, এই বই ধর্মগ্রন্থ শুধু এইকারণে নয় যে এর ভেতর ঈশ্বরজিজ্ঞাসার দর্শন রয়েছে বরং 'একটি ঘোর থেকে অবচেতন ছলকে ছলকে উঠে এসে বইটি রচিত' এই আলোচনার সীমিত পরিসরেঅবচেতন আর ধর্মের এই উস্কানিমূলক সম্পর্কের জটিলতায় ঢোকা সম্ভব নয়শুধু এইটুকু বলা যায় যে ধর্ম এবং মনোবিশ্লেষণের এক দীর্ঘ অম্লমধুর সম্পর্ক রয়েছে। ইয়ুংগীয় ভাবনার অন্তর্গত মিথিকাল আর্কেটাইপ এবং 'কালেক্টিভ আনকনশাসএর তত্ত্বায়ন তাঁকে ধর্মীয়চেতনার কাছে নিয়ে যায়অন্যদিকে ফ্রয়েড ও লাঁকা ধর্মীয় প্রতর্ককে ব্যবহার করলেও তাকে 'ওয়ার্ক থ্রুকরে মনোবিশ্লেষণকে ধর্মবিশ্বাসমুক্ত করার চেষ্টা করেন। অর্ঘ্য ইযুংগীয়ান আর আমি লাকানিয়ান। এই প্রসঙ্গে এখানেই পিরিয়ড। 

লেখকীয় বন্ধনীর মধ্যে বিনয়ের কবিতায় প্রাত্যহিকতার অহরহ আনাগোনা নিয়ে যে অব্যর্থ মূল্যায়ণ করেছেন অর্ঘ্য, তা তুলে ধরছিঃ 'কোন বস্তুর যাবতীয় বাতিল করতে করতে যখন আর বাদ দিলে তার মৌলিকতা নষ্ট হয়সেই নিউক্লিয়াসের সরল নিরাভরণ নিরালঙ্কার বয়ান তার দিনপঞ্জীর কবিতা।এই উজ্জ্বল বিশ্লেষণ বিনয়ের ফান্ডামেন্টাল-ইজমকে এক 'জেনেরিক' (Generic) মাত্রা দ্যায় যা হয়ত গণিতের সাথে কবিতার মিলনের একটি বিশেষ বিন্দু বলে বিবেচিত হতে পারে। ফরাসী লেখক জর্জ পেরেক এই প্রাত্যহিক বিষয়হীনতার প্রবাহকে 'ইনফ্রা-অর্ডিনারিবলেছিলেন। এরপর বিনয় এবং অর্ঘ্য কবিতাপাঠের ও পাঠ প্রতিক্রিয়ার যে আলোচনায় যান তা যতটা অবয়ববাদী (structuralist) ততটাই 'রিডার-রেসপন্স থিওরি'র দ্বারা প্রভাবিত। কবিতায় কবির লিখিত শব্দপরম্পরা কিভাবে পাঠকের নিজের অভিজ্ঞতায় প্রতিভাত হয়ে উদ্বৃত্ত এক অর্থ উত্পাদন করে যেখানে কবির জীবনের ঘটনা প্রতিস্থাপিত পাঠকের জীবনচিহ্ন দিয়ে--এই প্রক্রিয়াকে ছুঁয়ে যায় মনজ্ঞ এই আলোচনা। পরবর্তী পর্বে বিনয়ের নিজস্ব শব্দনির্মাণ সম্পর্কিত বয়ান আগ্রহব্যঞ্জক। তাঁর মতে বাংলা ভাষায় ইংরেজির তুলনায় অনেক কম শব্দ রয়েছে বলে আরো বেশি করে শব্দনির্মাণ করা দরকারযেমন 'মোমেন্টাম'এর বাংলা হিসেবে বিনয়-সৃজিত 'গমত্ত্বশব্দটি। শব্দ নিয়ে এই আলোচনা অর্ঘ্যর হাতে তাত্ত্বিক চেহারা পায় যখন তিনি বিনয়কে বলেন, শব্দের অর্থ ও শরীর মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় আর তাই লাঁকানিয়ান তত্ত্বে মানুষ ভিন্ন অন্য কোন প্রাণীর অবচেতন স্বীকৃত নয়। বিনয় এই তত্ত্বের বিরোধিতা করে বলেন পাখিরা খেতে পারলে 'খাওয়াশব্দটি নিশ্চয় তার অভিধানে থাকবে কারণ 'চিন্তা মানেই শব্দের চলাচল' দেরিদার আলোচনা থেকে যদিও এমন একটা ছবি বেরিয়ে আসে যে লাঁকার কাছে মানুষই একমাত্র প্রাণী যে অবচেতন চিন্তা করতে সক্ষমএই প্রশ্নটিও আসলে অনেক বেশি জটিল এবং অনেক কম মীমাংসাস্বাপেক্ষ। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণী যেমন কুকুরবিড়াল কিম্বা সজারু সাইকোআনালিসিস করাতে এলে তাও একটা বিহিত হতে পারতো! কিন্তু আসে নাআসে মানুষ। তাই লাঁকাও তার প্র্যাকটিসের ওপর দাঁড়িয়ে শুধু মানুষের অবচেতনের কথাই বলতে পারেন। লাঁকা বিনয়ের মতই চিন্তাকে ভাষার বাহির বলে মনে করেন না। তাঁর মতে, 'there is no other thought [...] pure thought, thought not submitted to the contortions of language; in other words, extended thought.' লাঁকানিয়ান মনোবিশ্লেষণে অবচেতনের দুটি ভিত্তিপ্রস্তরের একটি ভাষা হলে অপরটি হলো শব্দের শরীরে সংবাহিত এক রমনীয়তা যাকে তিনি 'jouissance' বা রমণ বলে চিহ্নিত করেন আর মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীদের মনুষ্যভাষা আছে কিনা আমাদের সঠিকভাবে জানা না থাকলেও লাঁকা সুনিশ্চিত যে 'jouissance' অন্যান্য প্রাণীর মধ্যেও রয়েছে। লাঁকার মতে, 'if there is something that gives us the idea of "enjoy yourself", it is the animal.'  তিনি কখনই অস্বীকার করেন না যে অন্যান্য প্রাণীরা চিন্তা করতে পারে না। বরং হেজহগ নিয়ে বিখ্যাত একটি উক্তিতে লাঁকা পরিস্কারভাবেই বলেন যে হেজহগ তথা অন্যান্য প্রাণীরা মানুষের মতই শুধু মাথা দিয়ে নয়বরং গোটা শরীর দিয়ে চিন্তা করে থাকে। বিনয়ও তো বলেছেন পাঠক তার সমগ্র শরীর দিয়ে কবিতা পড়ে। এই আলাপচারিতার পরবর্তী পর্বে বিনয় মজুমদারের জীবনরাজনীতিলিখনপ্রভাব ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোচনা চলতে থাকে। এই অধমের নজর কাড়ে আস্তিক্য এবং নাস্তিক্যের প্রশ্নটি। বিনয় সেখানে বিশ্বাস ও কমিউনের এক অন্তর্বর্তী স্পেস খুঁজে ন্যান। রবীন্দ্রনাথের আস্তিক্য আর জীবনান্দের ব্যর্থ ঈশ্বরসন্ধানের মাঝে কোথাও নিজের কাব্যগহরে নিবিষ্ট হন মহাকবি। এছাড়া নিজের লেখা পুরোনো কবিতা বহুবছর পর পড়তে গিয়ে তাতে অজ্ঞাত নতুন অর্থের উন্মেষে বিনয় যে কাব্যিক 'অতিচেতনা'র কথা বলেন তাও এই প্রেতালাপের শেষাংশের সম্পদ। 

এবার আসা যাক এই গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশে যেখানে 'বিশাল দুপুরবেলা'র যৌনবিশ্লেষণ করেছেন অর্ঘ্য। তাঁর গুরুর কাছে নতজানু হয়ে তিনি আবারও জানিয়েছেন অন্তিম লেখকীয় বন্ধনীর ভিতর যে আর কিছু না হলেও পাঠককে এই দীর্ঘকবিতাটি ভাগ ভাগ করে পড়াতে পারাটাও তাঁর পরম পাওয়া। সত্যি পরম পাওয়াই বটে। তবে এই প্রাপ্তি ছাড়া প্রবন্ধের অন্যান্য প্রাপ্তির দিকে এবার আমরা সংক্ষেপে মন দেবো। এটি বিদ্যায়তনিক সন্দর্ভ না হলেও অর্ঘ্যর লেখায় সাইটেশনের সামূহিক অনুপস্থিতি চোখে লাগে। ফ্রয়েড আর ফুকো নিয়ে এক লাইনের মন্তব্যগুলি সরলীকরণের উপরিতলে রয়ে গ্যাছে; সেখানে গভীর পাঠ বা সমস্যায়নের দারিদ্র্য লক্ষনীয়। অর্ঘ্য নিজেই তাঁর লেখাকে সাইকোআনালিটিক ক্রিটিসিজম বলেছেন অথচ ইয়ুং বা অন্য কোনো চিন্তকের সাথেই সেভাবে এনগেজ করেননি তিনি, লেখার ভেতরে পাঠ করেননি তাঁদের তত্ত্বায়ন। সাহিত্যে সাইকোআনালিটিক ক্রিটিসিজমের একটি একশো বছরেরও পুরোনো ধারা রয়েছে যেখানে ফ্রয়েডীয় অনুসরণের ক্ল্যাসিকিয়ানায় সাহিত্যের টেক্সটে সাহিত্যিকের বা তাঁর চরিত্রের মনোবিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে কিম্বা লেখাটিকে অবচেতন মনের বর্ণমালা বলে ধরা হয়। Text mirrors unconscious--এই আলেগরিকাল ধারায় সাহিত্যে যৌনতার ব্যবহার অবশ্যই বিবেচ্য কিন্তু সম্প্রতিকাকলে আমরা এই ক্ল্যাসিকিয়ানা পেরিয়ে সাহিত্যে সাইকোআনালিটিক ক্রিটিসিজমের যে নব্য-ধারায় এসেছি সেখানে টেক্সটের বিনির্মাণ গুরুত্বপূর্ণগুরুত্বপূর্ণ অর্থের নেতিকরণ প্রক্রিয়াটিকে দেখানো। যৌনতা লাঁকানীয়-দেরিদীয় ভাষ্যে কেবল দুটি শরীরের সঙ্গম ও রতিক্রিয়া নয়, যৌনতা শব্দের ভিতর-বাহিরে স্থিত এক রমণ-গমত্ত্ব, শব্দের অন্তর্গত এক নিজস্ব ইরোটিসিজম। এই যৌনতা কিভাবে এপিস্টেমলোজির সর্বজ্ঞতায় আঘাত হানতে পারে তা দেখানো অধুনা সাইকোআনালিটিক ক্রিটিসিজমের মুখ্য উপজীব্যএইদিক থেকে অর্ঘ্যর আলোচনা নিবিড় পাঠে উজ্জ্বল হলেও ক্ল্যাসিকিয়ানায় ভরপুর। তিনি বিনয়ের ল্যান্ডস্কেপ বর্ণনার সাঙ্কেতিকতা থেকে রতি, রমণ ও সঙ্গমক্রিয়ার আলেগরি তুলে ধরেছেন যেখানে লেখক ভীষণভাবেই জীবিত এবং বারবার নিজের পাঠকে প্রামাণ্যতা দিতে অর্ঘ্য বিনয়কে অথর-গডের মতই ব্যবহার করেছেন।
যৌনতা আর সঙ্গম এক হয়ে গেছে এই আলোচনায় যা সাইকোআনালিটিকালি উদ্বেগজনক। দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকা তাই সহজেই দ্বিতীয় যোনি হয়ে উঠেছে, ঘাস, যোনিরোম আর হ্রদ যোনি। এই সরলীকৃত সিম্বলিজম কিন্তু বর্তমানে অনুন্নত সাইকোআনালিটিক পাঠের বৈশিষ্ট্য বলেই চিহ্নিত হয়। এই আলোচনার প্রান্তে কয়েকটি প্রশ্ন তোলেন অর্ঘ্য যেগুলোকে তিনি বিশেষ কোনো গন্তব্যে নিয়ে যাননি কিন্তু আমার মনে হয় ওই প্রান্তিক প্রশ্নগুলিই এই পুরাতনপন্থী আলোচনাকে নতুনের স্পন্দন দিতে পারতো। এরকম কয়েকটি প্রসঙ্গের দিকে নজর দেওয়া যাক। বিনয়ের কবিতায় ব্যবহৃত 'সসীম ইনফিনিটি'র গাণিতিক ধারণার সঙ্গে যুক্ত করা যেতো যৌনতার প্রতর্ককে, যেমনটা করা হয় একবিংশ শতকের মনোবিশ্লেষণে, প্রধানত লাকানিয়ান প্ররোচনায়। পুরুষের যৌনতা আর নারীর যৌনতার মধ্যে কেমনভাবে বিভাজিত হয় সসীম ও অসীম? এই ইনফিনিটির প্রতর্কের সাথে কি সম্পর্ক সেট থিওরি বা টোপলজিকাল জিওমেট্রির? এই প্রশ্নগুলি আমাদের সময়ে সাইকোআনালিটিক ভাবনার কেন্দ্রীয় জিজ্ঞাসা আর বিনয়ের গাণিতিক পান্ডিত্য প্রশ্নগুলিকে আরো প্রাসঙ্গিক করে তোলে। আলোচনার এক জায়গায় অর্ঘ্য মন্তব্য করেন, 'দেখুন এ কবিতার যৌনক্রীড়ার কোন শেষ নেই। এই অন্তহীনতার প্রশ্নটিকে ফিরিয়ে আনা যেতোইনফিনিটির বিশ্লেষণে। যৌনতা কি স্বততই অসম্পূর্ণ, এমনকি ট্রমাটিক? এই প্রশ্নটি উঠে এলো না সম্ভাবনা সত্ত্বেও। অর্ঘ্য লেখেন, 'সব মিলে একক গণিকা শরীর, দর্শন হয়ে থাকে গোটা যৌনমুক্তাঞ্চল।এই যৌনমুক্তাঞ্চলে ক্ষমতার বিষয়ে অর্ঘ্য নীরব যদিও আলোচনার শুরুতেই তিনি ফুকোর ক্ষমতাতত্ত্বের উল্লেখ করেছিলেন। এরপর মার্কসের শ্রমতত্ত্বের 'লিবিডিনাল ফেটিশিসিজম'ও তেমনই এক অব্যবহৃত রেফারেন্স। যৌনতা আর শ্রম, বিপ্লব আর অবচেতন, মনোবিশ্লেষণ আর মার্কসবাদের তাত্ত্বিক সূত্রায়নের দীর্ঘ আলোকধারায় হতে পারতো কোনো নতুন সংজোজন কিন্তু হয়নি। আলোচনার আরেকটি জায়গায় অর্ঘ্য লেখেন 'সকল শব্দই যৌনতাময় শব্দ' কিম্বা অন্যত্র, 'ভাষা ক্রিয়া ভিত্তিক, এবং সব ক্রিয়ার শ্রেষ্ঠ ক্রিয়া যৌনতা'অন্যঅংশে রমণের গতির এক উদ্দীপনাময় উল্লেখ পাই কিন্তু আবারওঅর্ঘ্য এই গতিকে কোনো গতিমুখ দেননি এমন গহীনবাক্যগুলি এই লেখায় খাদের ধারে অযত্নে পড়ে থাকা মনিমানিক্য। লেখক অন্তত এই লেখায়তাদের কদর বোঝেননিব্যক্তিগতভাবে আমি কালেক্টিভ আনকনশাস তত্ত্বের সমর্থক না হলেও অর্ঘ্যর আরেকটি প্রতিশ্রুতিময় বাচন হতে পারতো যদি দেখানো যেতো কিভাবে বিনয়ের কবিতায় গণিত এবং মিথিকাল অবচেতন উভয়ই সামান্যিকরণের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। কিন্তু অর্ঘ্য শুধুই গণিত এবং ইয়ুংয়ের এই প্রবণতাগত সাদৃশ্যকে উল্লেখ করে প্রসঙ্গান্তরে চলে যান। আর তাছাড়া গণিত মাত্রেই সামান্যিকরণ করে এও এক সামান্যিকরণ। ডিডাক্টিভ ম্যাথেমাটিক্সের কি হবে? তবে এইসব সূক্ষ সমস্যা সত্ত্বেও অর্ঘ্য দত্ত বক্সীর বিনয় মজুমদার: প্ল্যানচেটে যৌনসমীক্ষায় লেখকের সততা এবং ঐকান্তিক বিনয়পনায় আলোকিত; তাঁর গদ্য সুখপাঠ্য এবং বিশ্লেষণ সংযত। অভিমুখের অভাব থাকলেও তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছেন আর সর্বোপরি বিনয়ের কবিতা ও চিন্তন এই গ্রন্থের আকর: 'যে কোন কাহিনী তাই যৌনাঙ্গের আত্মকাহিনীই/ যে কোন চিন্তাই তাই এই চিন্তাকারীটির একক জীবনী হয়ে যায়।' পাঠক সঙ্গে থাকুন অর্ঘ্যর এই মেধাবী অভিনিবেশের।  


বিনয় মজুমদার: প্ল্যানচেটে যৌনসমীক্ষায়
প্রকাশকঃ প্রতিষেধক
প্রকাশকালঃ জানুয়ারী, ২০১৫
মূল্যঃ ২০ /-
             


        
My Blogger Tricks

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন