• কবিতা সুর্মা


    কবি কবিতা আর কবিতার কাজল-লতা জুড়ে যে আলো-অন্ধকার তার নিজস্ব পুনর্লিখন।


    সম্পাদনায় - উমাপদ কর
  • ভাবনালেখা লেখাভাবনা


    কবিতা নিয়ে গদ্য। কবিতা এবং গদ্যের ভেদরেখাকে প্রশ্ন করতেই এই বিভাগটির অবতারণা। পাঠক এবং কবির ভেদরেখাকেও।


    সম্পাদনায় - অনিমিখ পাত্র
  • সাক্ষাৎকার


    এই বিভাগে পাবেন এক বা একাধিক কবির সাক্ষাৎকার। নিয়েছেন আরেক কবি, বা কবিতার মগ্ন পাঠক। বাঁধাগতের বাইরে কিছু কথাবার্তা, যা চিন্তাভাবনার দিগন্তকে ফুটো করে দিতে চায়।


    সম্পাদনায়ঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়
  • গল্পনা


    গল্প নয়। গল্পের সংজ্ঞাকে প্রশ্ন করতে চায় এই বিভাগ। প্রতিটি সংখ্যায় আপনারা পাবেন এমন এক পাঠবস্তু, যা প্রচলিতকে থামিয়ে দেয়, এবং নতুনের পথ দেখিয়ে দেয়।


    সম্পাদনায়ঃ অর্ক চট্টোপাধ্যায়
  • হারানো কবিতাগুলো - রমিতের জানালায়


    আমাদের পাঠকরা এই বিভাগটির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন বারবার। এক নিবিষ্ট খনকের মতো রমিত দে, বাংলা কবিতার বিস্মৃত ও অবহেলিত মণিমুক্তোগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে আনছেন, ও আমাদের গর্বিত করছেন।


    সম্পাদনায় - রমিত দে
  • কবিতা ভাষান


    ভাষা। সে কি কবিতার অন্তরায়, নাকি সহায়? ভাষান্তর। সে কি হয় কবিতার? কবিতা কি ভেসে যায় এক ভাষা থেকে আরেকে? জানতে হলে এই বিভাগটিতে আসতেই হবে আপনাকে।


    সম্পাদনায় - শৌভিক দে সরকার
  • অন্য ভাষার কবিতা


    আমরা বিশ্বাস করি, একটি ভাষার কবিতা সমৃদ্ধ হয় আরেক ভাষার কবিতায়। আমরা বিশ্বাস করি সৎ ও পরিশ্রমী অনুবাদ পারে আমাদের হীনমন্যতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরটি সম্পর্কে সজাগ করে দিতে।


    সম্পাদনায় - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
  • এ মাসের কবি


    মাসের ব্যাপারটা অজুহাত মাত্র। তারিখ কোনো বিষয়ই নয় এই বিভাগে। আসলে আমরা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কবিকে নিজেদের মনোভাব জানাতে চাই। একটা সংখ্যায় আমরা একজনকে একটু সিংহাসনে বসাতে চাই। আশা করি, কেউ কিছু মনে করবেন না।


    সম্পাদনায় - নীলাব্জ চক্রবর্তী
  • পাঠম্যানিয়ার পেরিস্কোপ


    সমালোচনা সাহিত্য এখন স্তুতি আর নিন্দার আখড়ায় পর্যবসিত। গোষ্ঠীবদ্ধতার চরমতম রূপ সেখানে চোখে পড়ে। গ্রন্থসমালোচনার এই বিভাগটিতে আমরা একটু সততার আশ্বাস পেতে চাই, পেতে চাই খোলা হাওয়ার আমেজ।


    সম্পাদনায় - সব্যসাচী হাজরা
  • দৃশ্যত


    ছবি আর কবিতার ভেদ কি মুছে ফেলতে চান, পাঠক? কিন্তু কেন? ওরা তো আলাদা হয়েই বেশ আছে। কবি কিছু নিচ্ছেন ক্যানভাস থেকে, শিল্পী কিছু নিচ্ছেন অক্ষরমালা থেকে। চক্ষুকর্ণের এই বিনিময়, আহা, শাশ্বত হোক।


    সম্পাদনায় - অমিত বিশ্বাস

অধীশা সরকার

কাঠবাদামের গন্ধ

৪।

লজিকের বাইরে কি কিছুই নেইশুধুমাত্র লজিক দিয়েই কি দুনিয়ার সবকিছু এক্সপ্লেন করা যাবেএসি গাড়ির হিমশীতলতার ভেতর থেকে বাইরের গনগনে শহরটাকে দেখতে দেখতে নীলের অলস মস্তিষ্কে নানা ভাবনা ভেসে বেড়াচ্ছিল। ছোটবেলায় সে একবার পরি দেখেছিল। তাদের পুরনো ধাঁচের নর্থ কলকাতার বাড়ির ছাদের কার্নিশে। ব্যাপারটা সে আজ পর্য্যন্ত কাউকে বলতে পারেনিকিন্তু ভুলতেও পারেনি। কাউকে বলা অসম্ভব। কেউ বিশ্বাস করবে না। তাকে এমনকি সাইকিয়াট্রিস্টের কাছেও পাঠানো হতে পারে,কিন্তু নীল জানে যে লজিকের বাইরেও অনেক কিছু আছে।

এই যে কলকাতা শহরটা। এত মানুষ এখানে ভীড় করে আছে কেন এখনোএত পালে পালে মানুষ কেন গড়িয়াহাটের ফুটপাথরাসবিহারীর মোড়শ্যামবাজারের পাঁচমাথা,এমনকি কদিন আগে গজিয়ে ওঠা সেক্টর ফাইভের রাস্তাগুলোয় এই হাড়গলানো গরমেও হেঁটে বেড়াচ্ছেকেন পালে পালে সবাই পালিয়ে যাচ্ছে নাআছে কি এই শহরটায় এখনো আশা দেওয়ার মতঅজস্র গর্তে জর্জরিতপ্রতিদিন ভেঙ্গে পড়া ইঁট-কাঠের জঙ্গল আর মাঝেমধ্যে টাইম-ট্র্যাভেল করে মাটি ফুড়ে উঠে আসা দুচারটে শপিং মল আর ফ্লাইওভারচলটা-উঠে যাওয়াকার্নিশ ভেঙ্গে পড়ারাশি রাশি প্লাস্টিকের আবর্জনায় ভর্তি একটা হেল-হোল। যেখানে বাসগুলো চললে থামতে চায় না আর থামলে চলতে চায় না। ট্যাক্সিরা কখনো কোথাও যেতে চায় না। বাইকেরা মাধ্যাকর্ষণট্র্যাফিক সিগনাল কোনোকিছুই না মেনে উড়ে যেতে চায় আর প্রায়শই মুখ থুবড়ে পড়ে ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানের মত। বস্তিগুলো ডালপালা মেলে ঝিমোতে ঝিমোতে হঠাৎ করে একদিন পুড়ে ছাই হয়ে যায়। নতুন চিফ মিনিস্টার শহরটাকে নীল রঙ করে দিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে থাকেন ম্যাজিকের অপেক্ষায়। ইন দ্য মিন হোয়াইল কার্টুন আঁকার অপরাধে জেলে যায় প্রফেসর আর রেপিস্ট ধরার অপরাধে ট্রান্সফার হয়ে যান করিৎকর্মা পুলিশ অফিসার। ১৫০ বছর বয়সী এক বুড়ো সারি সারি হোর্ডিং থেকে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থাকেন আর শোনেন ট্র্যাফিক সিগনালের হর্নের ক্যাকোফোনি চিরে নিদারুণ আর্তনাদে, ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারেতাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিই বা করার আছেকেন চেয়ে আছ গো মাএক্স্যাক্টলি। কেনহোয়াই? মাটির টান কথাটা সে বহুবার শুনেছে। দূরদূর। মাটি। হুঁহ। কর্পোরেশনের জলের লাইন পোঁতার জন্য রাস্তা না খুঁড়লে মাটি দেখতে পায় নাকি শহরের লোকযত ঢপ। অনেকে বলে শিকড়। কিসের শিকড়মানুষ কি গাছ নাকিজিজ্ঞেস করলে ঊর্ধতন তিন পুরুষের নাম বলতে পারবে কিনা সন্দেহআবার বলে শিকড়। রবীন্দ্রনাথতা হতে পারে। বাঙ্গালির ওই একটাই শিকড় বোধয়। অথবা নাড়ি। এক লাইন না পড়লেও রবীন্দ্ররচনাবলীটা বুকশেলফে থাকতে হবে। ১৫০ বছর পরেও নাড়ি কাটা সম্ভব হল না। হলে বোধয় মা-মাটি-মানুষের হাত থেকে অন্তত রেহাই পেত বেচারা বুড়োটা।

নীল যখন এতসব হাবিজাবি ভেবে চলেছে তখন খুব তীক্ষ্ণ লজিক প্রয়োগ করে নীলকে একটা প্রশ্ন করা যেতেই পারে। সে যখন পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে এ শহরে পড়ে থাকার কোনো লজিক্যাল কারণ থাকতে পারে নাতাহলে সে নিজে এখানে পড়ে আছে কেনকিন্তু উত্তর দেওয়া দূরে থাকপ্রশ্নটা করার আগেই নীল পার্ক স্ট্রীট বারিস্তার সামনে পৌঁছে গেল। এখন আর তাকে গাড়ির মধ্যে অযথা বসিয়ে রেখে গল্পের গতি আটকানোর মানে হয় না। এসব ফান্ডামেন্টাল প্রশ্নের উত্তর পরে পেলেও হবে।

হায়। চরিত্রেরা লেখকের কথা শোনে আর কই। নীলের উচিৎ ছিল অবিলম্বে গাড়ি থেকে নেমে বারিস্তায় ঢোকা। কিন্তু সে গাড়ি থেকে নামল না। গাড়িটা পার্ক করার মূহুর্তে সে পুরোপুরিভাবে অনুভব করল তাকে আর একবার একটি মেয়েকে ফেস করতে হবে এবং বিবাহ-বিষয়ক কথা বলতে হবে। তার একবার ইচ্ছে হল গাড়িটা স্টার্ট করে দিঘা চলে যেতে। বা মন্দারমণি। কিন্তু যা অসম্ভব তা নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবার ছেলে নীল নয়। ফলে সে অতি দ্রুত ট্র্যাক বদলাল এবং ছক কষতে লাগল যে মেয়েটাকে সে কি বলবে। বলবে যে তার অন্য প্রেমিকা আছেএই অজুহাত সাধারণত কাজে দেয়কিন্তু মাঝেমধ্যে ব্যাকফায়ার করে। যেমন আগে একটি কেসে হয়েছিল। তাহলেসে কেরিয়ার নিয়ে খুব ব্যস্তবিয়েতে বিশ্বাস করে নাইম্পোটেন্টড্রাগঅ্যাডিক্টসমকামীকোনোটাই মনে হচ্ছে ধোপে টিকবে না। বাড়িতে জেনে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। শেষতমটা ট্রাই করা যেতে পারেযদি না মেয়েটাকে দেখে মনে হয় সে বাড়িতে গিয়ে চুকলি কাটবে। এটা নীলের আর একটা সমস্যা। সে মানুষকে দেখে কিছুতেই বুঝতে পারে না লোকটা আসলে কিরকম। এত খামতি নিয়ে যে কিকরে সে পুলিশের হোমিসাইড স্কোয়াডে এখনো রয়েছে সেটাই তাকে সবচেয়ে বেশী অবাক করে। 

বারিস্তায় ঢুকে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে সে একজন মাত্র মেয়েকেই দেখতে পেল যে একা বসে আছে। সুতরাং এ-ই হবেযদি না নীলের চেয়েও বেশী লেটলতিফ হয়ে থাকে,যার সম্ভাবনা কম। মেয়েটাকে দেখে নীল অতি কষ্টে হাসি চাপল। কফি শপে অপেক্ষা করাকালীন অনেকে অনেক কিছু করে। মেসেজ করেগান শোনেম্যাগাজিন পড়ে,ইত্যাদি। কিন্তু আজ পর্য্যন্ত সে ঘুমোতে কাউকে দেখেনি। ঝিমুনি নয়গভীর নিদ্রা। মেয়েটা পা দুটো জড়ো করে টেবিলের ফুটরেস্টে রেখেকোলের ওপর একটা ব্যাগ রেখে,সেটা গভীরভাবে আঁকড়ে ধরেআরাম করে ঘুমোচ্ছে। নীল আস্বস্ত হল। এ মেয়েটাকে সহজে বোঝানো যাবে। তবুও কোথাও একটা তার সামান্য অস্বস্তিও হল। কেনসে ধরতে পারল না। মেয়েটাকে তো বেশ নিরীহ দেখতে। ফিংফিঙ্গে ফড়িংএর মত চেহারা। কালো রঙের স্কার্ট-ব্লাউজ পরে আছেচুল কোঁকড়ানোকানে রুপোর গয়না। লিপস্টিক। কাজল। ফর্সা গায়ের রঙটিপিক্যাল ম্যারেজ মেটিরিয়ালটিপিক্যাল বাঙালি মেয়ে। অস্বস্তিটা হচ্ছে কেনসে ব্যাপারটাকে তত পাত্তা দিল না। মেয়েটার দিকে সে খানিক্ষণ তাকিয়ে রইল। তার ঘুমন্ত মেয়েটাকে ভাল লাগল। কেমন নিরীহনিস্পাপ দেখাচ্ছে। একরকম মায়া হল তার।

নীল খুব সন্তর্পনে মেয়েটার সামনের চেয়ারটায় বসল। তার হাতে খানিকটা সময় আছে। সে দেখতে চায় না ডাকলে মেয়েটা কতক্ষণে জাগে। জাগার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। নীল তার ব্ল্যাকবেরি বের করল। ফেসবুক দেখা যাক। 
ফেসবুকে একটা আপডেটের উত্তরে একখানা কমেন্ট লিখে সে যখন আর একবার মেয়েটার দিকে তাকাল তখন সে এতটাই চমকাল যে ফোনটা প্রায় তার হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল। মেয়েটা জেগে উঠেছে। শুধু তাই নয়স্থিরদৃষ্টিতে তাকে দেখছে। মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে নীলের অস্বস্তিটা ফিরে এলো। তার একটু শীত করল। এখন আর মেয়েটাকে একেবারেই মায়াময় দেখাচ্ছে না। নিরীহ বা নিস্পাপ তো নয়ই। চোখদুটো মোটেই কদাকার নয়কিন্তু চোখের মণিদুটো ঘোর কালোঅসম্ভব কালোমানুষের চোখের মত নয়। ঠান্ডানিস্পৃহ দৃষ্টি। মেয়েটা হাসল। হাসিটাও অদ্ভূত। একপেশেসরু হাসি। নীল হাসার চেষ্টা করল।

আমার নাম নীল ... নীলকন্ঠ চৌধুরী । ওই... মানে আমার মা... আপনার সঙ্গে বোধয়...।
আপনার মায়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। উনি বলেছিলেন আপনার সঙ্গে যেন আমি দেখা করি।
হ্যাঁ... মানে এক্স্যাক্টলি... সেই জন্যেই আমি...

আর কি বলবে ভেবে না পেয়ে নীল কফিতে চুমুক দিতে যাচ্ছিলকিন্তু ঠিক তখনই একটা বোম্বাই বিষম খেয়ে কাপের অর্ধেক কফি টেবিলে ফেলে দিল। কারণ মেয়েটা ঠিক তখনই তাকে জিজ্ঞেস করেছে - আপনি পুলিশ হয়ে গীটার শিখছেনইন্টারেস্টিং

নীল যে সপ্তাহে একদিন গীটার শেখে এটা অহনা বসু কেনসে আর তার গীটার-শিক্ষক রানাদা ছাড়া পৃথিবীতে আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব না। একেবারেই সম্ভব না। সিয়াইএ এজেন্টরাও নিজেদের আইডেন্টিটি এতটা গোপনে রাখে না যতটা নীল এ ব্যাপারে গোপনীয়তা অবলম্বন করে। গীটারটাও এমনকি সে রানাদার বাড়িতে রাখে। এক হতে পারে মেয়েটা কোনোভাবে রানাদাকে চেনে। কিন্তু তা কি করে হয়রানাদা জন্মেছে এবং বড় হয়েছে দিল্লীতে। সম্প্রতি কলকাতায় এসেছে। আর এই মেয়েটাসে যতদূর জানেকলকাতাতেই মানুষসাউথ কলকাতা। তবুও...
নীল টিস্যু পেপার চেয়ে নিয়ে কফি মুছতে মুছতে বলল - আপনি কি কোনোভাবে রানা গাঙ্গুলিকে চেনেন?

নাহ। তবে এই রানা গাঙ্গুলি যে আপনাকে গীটার শেখান সেটা বুঝতে পারছি অহনা নিজের ব্যাগটাকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দিলইন কেস আবার নীল বিষম খায়।

কি করে বুঝতে পারছেনহাউআপনি অবশ্যই রানাদাকে চেনেন। তা ছাড়া আমি যে গীটার শিখি সেটা আপনার পক্ষে জানা অসম্ভব। জাস্ট অসম্ভব।

সে দেখল মেয়েটা বেশ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

আপনি সত্যিই বুঝতে পারছেন না কিভাবে জানলামআপনি তো ইনভেস্টিগেটিং অফিসারমানে একরকম ডিটেক্টিভ?

একরকম নয়। ডিটেক্টিভ। নিঃসন্দেহে ডিটেক্টিভ। তাতে কি হলআপনি গীটার শেখার ব্যাপারে জানলেন কিভাবেআমার মা এটা জানে না। পাড়াপ্রতিবেশীও জানে না। আপনার পক্ষে জানা সম্ভব নয়যদি না আপনি রানাদাকে চেনেন। আপনি বলছেন আপনি চেনেন না। আপনি কোনো কারণে মিথ্যে বলছেন। কেনযদি আপনি রানাদাকে না চেনেন তাহলে কিভাবে জানলেন রানাদা আমাকে গীটার শেখায়আমাকে বোকা ভাববেন না প্লিজ। জাস্ট টেল মি।

মেয়েটা একটা হাই তুলল।
জাস্ট টেল মি হাউ ইউ নো অ্যাবাউট মাই গীটার লেসনস।
ফ্রম ইওর হ্যান্ডঅফ কোর্স।
হ্যান্ডমানে আমার হাত??
হ্যাঁ। হাত। হাতে গীটার স্ট্রিংএর দাগ আছে।
- শিখছি বললেন কিভাবেআমি তো বহুদিন ধরে গীটার বাজাই এমনও হতে পারে। আর কার কাছে শিখছি সেটাই বা কি করে জানলেন?
অহনা আবার হাই তুলল। ঘুমঘুম চোখে ওয়েটার খুজছে।
উইল ইউ প্লিজ আন্সার মাই কোয়েশ্চেনস?
আমি একটা ব্ল্যাক কফি খাব। আর ক্লাব স্যান্ডুইচ। 
একটা কেনযত ইচ্ছে খান। কিন্তু আমার প্রশ্নটার উত্তর দেবেন কি?
মেয়েটার ভুরুতে এবার সামান্য উত্ত্যক্ত হওয়ার চিহ্ণ দেখা গেল।

কি মুশকিল... ব্যাপারটা তো জলের মত সোজা। এ নিয়ে এত উত্তেজিত হওয়ার কি আছেতোমার নখের ডগায় সদ্য কড়া পড়ার দাগ রয়েছে। দাগগুলো বেশ কাঁচা,পুরনো দাগ নয়। মানে সদ্য শিখছ। আমি গীটার বাজাও বলতেই তুমি চমকে উঠে বিষম খেলেমানে ব্যাপারটা গোপনখুব কেউ জানে না। জিজ্ঞেস করলে আমি কোনো এক রানা গাঙ্গুলিকে চিনি কিনা। মানে সে তোমার গীটার শেখার ব্যাপারটা জানে। আমাকে বলে থাকতে পারে। গীটার শেখাটা যদি গোপনে হয়ে থাকে তাহলে যার না জানলেই নয় সে হল সেই লোক যে গীটার শেখাচ্ছে। সুতরাং রানা গাঙ্গুলিই গীটার শেখাচ্ছে। ভেরি সিম্পল। জলবৎ তরলং।

নীল বেশ খানিক্ষণ থ হয়ে রইল। এর মধ্যে অহনা ব্ল্যাক কফি আর স্যান্ডুইচের অর্ডার দিল।

আপনি কি আগের জন্মে ফেলুদা ছিলেন?
মেয়েটা আবার সরু করে হাসল।
ফেলুদার লজিকে অনেক ফাঁক থাকা সত্ত্বেও সে অপরাধী ধরে ফেলত। আফটার অল গল্প তোকিন্তু তুমি তো সত্যিকারের গোয়েন্দা হয়েও এই সহজ ব্যাপারটা বুঝলে না। তোমার পক্ষে তো কেস সল্ভ করাটা একটু কঠিন হয় তার মানেতাই না?

নীলকন্ঠ আর বিষম খেল না বটেকিন্তু চিন্তিত হয়ে পড়ল। ঠিক তখনই তার ফোনটা না এলে সে এরপর মেয়েটাকে কি বলবে তার কোনো ধারণা ছিল না। ফরচুনেটলি,ফোনটা তাকে বাঁচিয়ে দিল। 

হ্যাঁ স্যার... ওখান থেকেই আসছি... লাশ চলে গেছে মর্গে... না... ফরেনসিক টিম কাজ করছে... এখনো পর্য্যন্ত তো কিছু... হ্যাঁ স্যার... হ্যাঁ...

ফোন রেখে নীলকন্ঠ আরো বেশী চিন্তিত হল। লেটেস্ট কেসটা তার মাথার অন্তত তিন হাত ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেছে। চিৎপুরের এক ব্যাঙ্কের লকার রুমে এক ব্যাঙ্ককর্মীকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়যে পুলিশ ইন্সপেক্টর প্রথম ঢুকেছিল ক্রাইম সিনেসে ঘর থেকে বেরিয়েই প্রচন্ড অসুস্থ বোধ করেহাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই শেষ। আরো দুজন কনস্টেবল ঘরটার ধারেকাছে ছিলতারাও অসুস্থ। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। কেস এখন তার হাতে। যথারীতিকেস ক্লোজড হয়ে যাওয়ার অনেক পরে হয়তো মাথায় ঢুকবে ব্যাপারটা। কিন্তু এবারে সেটা হলে ওর প্রমোশন ইনডেফিনিটলি আটকে তো যাবেইউপরন্তু সিনিয়রদের চোখরাঙ্গানি সইতে হবে। পুলিশ মারা গেছেব্যাপারটা খুব সেন্সিটিভ হয়ে গেছে।

অন্যমনস্ক হয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়েই বার করে নিল নীল। ক্যাফের ভেতর নো স্মোকিং। তারপর চোখ পড়ল সামনে বসে থাকা বিপদটার দিকে। এখন একে কি করে কাটানো যায়?

মেয়েটা এখনো ওকে মেপে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে কফি আর স্যান্ডউইচ এসেছিল। সেগুলো এখন শেষ। কোনো এক্সপ্রেশন নেই মুখে। নীলের বেশ বিরক্ত লাগছে এবার। আর ভদ্রতা করতে ইচ্ছে করছে না।

-     সরিকিন্তু আমাকে এবার উঠতে হবে। আপনার সঙ্গে একটা বিশেষ কারণেই কথা বলতে আসা। সেটা এক লাইনে সেরে নিই। দেখুনবিয়েটা আমি করতে পারব না। কিন্তু আমার পক্ষে বাড়িতে না বলা অসম্ভব। আপনি জানিয়ে দিন আপনার পছন্দ হয়নি।

-     কিন্তু তোমাকে তো আমার বেশ পছন্দই হচ্ছে।
নীল এবার আতঙ্কিত বোধ করল। এবং বিস্মিতও। মেয়েটা নির্বিকার মুখে কথাটা বলছে। কিছুক্ষণ আগে থেকেই তুমি বলে সম্বোধন করছে!
-     আপনি ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না...
-     না পারার কিছু নেই। তুমি বিয়ে করবে না। আমিও করব না। সুতরাংসমস্যা নেই।
-     আপনিও... করবেন না??
-     নাঃ।
-     ও। কিন্তু তাহলে... এই যে শাদি ডট কম থেকে আপনার সম্বন্ধ... বাড়ির চাপ?
-     না।
-     তাহলে... বয়ফ্রেন্ড আছে?
-     বেশ কিছু।
-     আ...চ্ছা... তাহলে...
-     তোমার অত খবরে কাজ কিতুমিও বিয়ে করবে নাআমিও করব না। মিটে গেল।
-     হ্যাঁতা... গেল... কিন্তু বাড়িতে কি বলব?
-     তোমার বয়েস কত?
-     আমার...বত্রিশ... কিন্তু তার সঙ্গে...
-     বলবেআমি বড় হয়ে গেছি।
-     মানে??!
-     মানেমাকে বলবেআমি বড় হয়ে গেছিআমার বিয়ে সংক্রান্ত চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। আমি নিজেই করব।

নীলকন্ঠ অনেকখন কোনো কথা বলতে পারল না। ঠিক এই কথাটাই যে ও কতবারকতভাবে মাকে বলার চেষ্টা করেছে... কিন্তু পারল কইঅবশ্যমেয়েটা যেভাবে গুছিয়ে বলল সেভাবে বলার কথাটা ওর মাথায় আসেনি কখনো... ঠিকই তোএটা এমন একটা লজিক যেটা মা কোনোভাবেই ভাঙ্গতে পারবে না। এরপর কিছু বলতে হলে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করতে হয়আর সরলা চৌধুরীকে ও যতদূর চেনেসেটা ওঁর পক্ষে বেশ কঠিন ব্যাপার। সত্যিই বাড়ি গিয়ে এটাই বলবেবলতে পারবে?

মেয়েটাই এবার নিজে থেকে কথা বলল।
-     থম মেরে বসে আছো কেনএখুনি তো বললে উঠতে হবে।
-     না... তেমন কিছু না... আপনি কোথায় যাবেনড্রপ করে দেব?
-     আমার আপাতত কোনো কাজ নেই। তুমি কোথায় যাবে?
-     আমি অরুনকাকুর... মানে আমার বাবার এক কলিগের বাড়ি যাব। একটা কেসের ব্যাপারে আলোচনা করতে।
-     কোনদিকে?
-     লেক গার্ডেনস।
-     বেশআমাকে যাদবপুরে নামিয়ে দাও।

৫।

বালিগঞ্জ ফাঁড়ি পৌঁছনোর আগেই মুশল ধারে বৃষ্টি নামল। মে মাসে এমন বৃষ্টি ভাবা যায়নীল বিরক্ত মুখে গাড়ির কাঁচ তুলে ওয়াইপার চালিয়ে দিল। পাশে বসে থাকা অহনা বসু আর একটা ম্যানেকুইনের মধ্যে বিশেষ কোনো তফাৎ নেই এই মূহুর্তে। কথা তো বলছেই নানড়াচড়াও করছে না। চোখের পাতা ফেলছে তোনীল খেয়াল করার চেষ্টা করল। ধ্যান করছে নাকিএমন অদ্ভূত মেয়ে সে আর একটাও দেখেনি। মেয়েটাকে যতটা নিরীহ মনে হয়েছিল প্রথমে এখন মোটেই তা মনে হচ্ছে নাবরং বেশ ঘোড়েল মনে হচ্ছে। চোখ খুব ভাল এরআর যাই হোক। ওকে দেখার আড়াই মিনিটের মাথায় নখের ডগায় কড়ার দাগ লক্ষ্য করে ফেলল! মাথাটাও শান দেওয়াকোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এরকম উদ্ভট ব্যবহার করছে কেনএই এত কথা বলল... এই একদম চুপ। যাকগে বাবা... কি দরকার... বিয়ের ঝামেলাটা তো কাটানো গেছে...

কিন্তু মেয়েটাকে যে আমাদের নীলকন্ঠ কাটানোর জন্য উৎসুকসেরকম নাও হতে পারে। বরংঅন দ্য কন্ট্রারিঅহনা বসুর প্রতি ওর একটা তীব্র কৌতুহল তৈরী হয়েছে। নাহলে লিফট অফার করার কোনো কারণই ছিল না। কথা শেষ হলেই স্মার্টলি উঠে বাই বলে চলে যেতে পারত। এই ব্যাপারটা আমরা ধরতে পারলেও নীলকন্ঠ নিজে এখনো ধরতে পারছে না। কেস-এর চিন্তা সরিয়ে ওর মাথায় এখন অহনা বসু ঘুরপাক খাচ্ছেকিন্তু কেনসেটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। ফলেনীলকন্ঠ নিজের ওপর বিরক্ত হচ্ছেট্র্যাফিক জ্যামের ওপর বিরক্ত হচ্ছেমমতা ব্যানার্জির ওপর বিরক্ত হচ্ছেচিৎপুরের ওই ব্যাঙ্কটার ওপর বিরক্ত হচ্ছেঅসময়ের বৃষ্টির ওপর বিরক্ত হচ্ছেএবং সবচেয়ে বেশী বিরক্ত হচ্ছে অহনা বসুর ওপর।

-     আপনি ঠিক কোথায় নামবেন?
-     অ্যাঁ?
-     বলছি... আপনি। কোথায়। নামবেন।
-     যেখানে খুশি নামিয়ে দিলেই হবে।
-     মানেআপনি যাবেন কোথায়?
-     তেমন কোথাও যাওয়ার নেই। কোথাও একটা গেলেই হবে।

-     দেখুনআমি নাখুব সোজা কথার মানুষ। আমার সঙ্গে বেঁকিয়ে-চুরিয়ে কথা না বললেই ভাল হয়। আপনি যদি আমায় বলতে না চান কোথায় যাবেনতাহলে সেটাও পরিস্কার বলে দেওয়াই যেত। আপনি জাস্ট বলে দিন আপনাকে নামাব কোথায়।
মেয়েটা হঠাৎ দরজার দিকে হাত বাড়াল। দরজা খুলছে।
-     কি করছেন?
-     নেমে যাচ্ছি।
-     আহা... আমি তা বলিনি... আচ্ছা... নামবেন না রাস্তার মাঝখানে... দাঁড়ান... সরি... আমি জাস্ট বলছিলাম...
মেয়েটা আবার নির্বিকার মুখে হাত সরিয়ে নিল। সামনের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। কি বলবে ভেবে না পেয়ে নীলকন্ঠ আবার চুপ করে গেল। এতক্ষণে সামনের জ্যামটা ক্লিয়ার হয়েছেসুতরাং গাড়ি এগলো। গড়িয়াহাট ফ্লাইওভারে উঠতে বৃষ্টির জের আরো বাড়ল। নীলকন্ঠ এবার বেশ বিরক্ত হল। এই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটাকে মাঝরাস্তায় নামিয়ে দেবেটা কি করেকোনো স্পেসিফিক যায়গা বললে সুবিধে হত...
যাদবপুর থানার কাছাকাছি সিগনালে দাঁড়িয়ে নীল এবার মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করল আপনার সঙ্গে ছাতা আছে?

-     না তো?
-     এই বৃষ্টিতে রাস্তায় কোথায় নামাব আপনাকে বলুন তোআপনি কোথায় যাবেন বললে ড্রপ করে দিতাম... আমার হাতে খানিকটা সময় আছে...
-     বললাম তো... সেরকম কোথাও যাওয়ার নেই।
-     না... মানে... আপনি তো বললেন যাদবপুরে নামাতে... আপনার বাড়ি তো এদিকে নয়... কোথাও যাবেন বলেই তো তাহলে...
-     তুমি বললে লেক গার্ডেনস যাচ্ছ। তাই যাদবপুর বললাম।
-     আরে... কি মুশকিল... সে আমি আপনাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়েও আসতে পারি... কোনো অসুবিধে নেই... গাড়ি ঘোরাব?
-     না। এখানে কোথাও সাইড করো। নেমে যাব।
-     আপনি কি খচে গেলেন নাকি মশাই আমার ওপর?
মেয়েটা বেশ অবাক হয়ে তাকাল।
-     খচে যাব কেন?
-     না... মানে... হঠাৎ নেমে যাবেন বলছেন... খুব বৃষ্টি হচ্ছে আসলে... আমি আপনাকে বাড়িতেই ছেড়ে দিয়ে আসি বরং। বলছেনই যখন কোথাও যাওয়ার নেই... এই বৃষ্টিতে রাস্তায় কোথায় ঘুরবেন?
-     আমাকে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসবেআমার বাড়ি কোথায় তুমি জানো? (অহনার ঠোঁটে একটা হালকা হাসির রেশ)
-     বালিগঞ্জে তোমা বলেছে...
-     মা ভুল বলেছে। আমি নর্থ কোলকাতায় থাকি। এক্স্যাক্টলি কোথায় সেটা বলব না।
-     মানে?? আপনার প্রোফাইলে তো বালিগঞ্জ লেখা...
-     কার প্রোফাইল?
-     আপনার...
-     আমারআমার নাম কি?
নীল বিস্মিত এবং আরো বিরক্ত হল। মেয়েটা কানা মাছি ভোঁ-ভোঁ খেলার চেষ্টা করছে নাকিসিগনাল ছেড়ে দিয়েছে। ও গাড়ি স্টার্ট করল। 
-     আপনার নামটা আপনি নিজেই জানেন নামনে করিয়ে দিই তাহলেঅহনা বসু। তাই না?
-     না। আমার নাম অহনা বসু নয়। আমার নাম বিদ্যুৎলতা বটব্যাল।  
নীলকন্ঠ এক মিনিটের জন্য স্টিয়ারিং-এর ওপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলল। সশব্দে ব্রেক কষল। আশেপাশের গাড়িগুলো প্রবল হর্ণ বাজিয়ে ও খিস্তি করে যাচ্ছেআর ও হতভম্ব হয়ে পাশে বসে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। এ কি পাগল নাকি?
-     এক মিনিট... আমি কিছু বুঝতে পারছি না...
-     গাড়িটা চালাও... এরকম মাঝরাস্তায় দাঁড় করিয়ে দিলে তো পুলিশে ধরবে...
মেয়েটা ঠিক আগের মতই নির্বিকার। তবে এবার ব্যাগ খুলে একটা জিনিস বার করেছে। একটা সিগারেটের প্যাকেট। নীল যাদবপুর থানা পেরিয়ে একটা ফাঁকা যায়গা দেখে গাড়িটা সাইড করে দাঁড় করাল। বিদ্যুৎলতা বটব্যাল ততক্ষণে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে। লম্বা টান দিয়ে খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে বলল তুমি বেশ স্লোজানো?মানে... ডিটেক্টিভ হিসেবে। 

৬।

নীল হতভম্ব হয়ে বসে আছে। এসব কি হচ্ছে? পাশে বসে থাকা এই মেয়েটা কে? ওর যার সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল সেই অহনা বসু নয়? তাহলে... কি হল? ও কি এতক্ষণ ভুল মেয়ের সঙ্গে কথা বলে চলেছে? কিন্তু তা কি করে হয়... মেয়েটাই তো বলল ওর মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে... সেটাও কি কোনো কনফিউশন...? কিন্তু... বিয়ে নিয়েও তো কথা হল... নাকি হয়নি? আজ সকাল থেকে হচ্ছেটা কি! কমেডি অফ এররস?? একটুও কমিক লাগছে না এই মূহুর্তে, বরং ট্র্যাজেডি মনে হচ্ছে। কে যেন বলেছিল... কমেডি ভিউড ফ্রম আ ওয়াইড অ্যাঙ্গেল ইজ ট্র্যাজেডি...? কে বলেছিল সেটা... দূর শালা! এসব কি চিন্তা! ওদিকে চিৎপুরে যে ঠিক কি হল... অরুণকাকু হেল্প করতে পারবেন। রিটায়ার্ড ডিসিপি অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সত্তরের দশকের শেষের দিকে নক্সাল ঠেঙ্গিয়ে খুব নাম কিনেছিলেন। বাবার সঙ্গে খাতির আছে।
আরে দূর... ফোকাস! এই মেয়েটা কে?

-    আপনি ঠিক কে বলুন তো?
-    আমি বিদ্যুৎলতা বটব্যাল।
-    আমি তো অহনা বসুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম...
-    কিন্তু অহনা বসু তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি। থাকলে তো আসবে। অহনা বসু বলে কেউ নেই। মানে... ভূভারতে কেউ নেই তা বলছি না, কিন্তু যে অহনা বসুর প্রোফাইল দেখে সম্বন্ধ ঠিক করে তোমার মা তোমাকে মেয়ে দেখতে পাঠিয়েছেন সেই অহনা বসু নেই। ওটা একটা ফেক প্রোফাইল।
-    ফেক প্রোফাইল??
-    হ্যাঁ।
-    কে এরকম ফেক প্রোফাইল বানিয়েছে?
-    এটা সত্যি জিজ্ঞেস করছ? মানে... বুঝতে পারছ না? আমি।
-    আ-আপনি!!! কেন??
-    এমনি।
-    এমনি মানে??!!
-    এমনি। ইচ্ছে।
-    এবং আপনি অহনা বসু সেজে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন?
-    এইতো মাথা খুলেছে। হ্যাঁ।
-    কিন্তু কেন? বিয়ে করার ইন্টেনশন তো তার মানে প্রথম থেকেই ছিল না!
-    না তো। বললাম তো... এমনি।
-    আমি কিছুই বুঝতে পারছি না...
-    সেটা কি নতুন কিছু?

নীলের হঠাৎ খুব হাসি পেল। লোকে ভাবে পুলিশের জীবন খুব অ্যাডভেঞ্চারাস, উত্তেজক। আদৌ তা নয়। অন্য যে কোনো প্রফেশনের মতই কাজ অধিকাংশ সময়ই বোরিং, রুটিন। কিন্তু আজকে কি যে হচ্ছে। এতরকম অদ্ভূত রহস্য ঘিরে ধরছে কেন তাকে? আর এই মেয়েটা... মাথা খারাপই বোধয়। ফেক আইডেন্টিটি বানিয়ে দেখা করতে এসেছিল! কেন?? এমন কোনো সাঙ্ঘাতিক কেসে ও জড়িত নয় যে গুন্ডাদলের লিডার ওকে মার্ডার করার জন্য সুপারি কিলার পাঠাবে, বা কোনো মাতাহারি ওর পিছু নেবে। নিতান্তই নিম্নমানের পুলিশকর্মী, অতি সাধারণ। আজ পর্য্যন্ত একটাও কেস সল্ভ করে উঠতে পারেনি। ওর সঙ্গে এরকম আজগুবি ব্যাপার ঘটছে কেন তাহলে? আর... এই আজগুবি ব্যাপারটা তো... বেশ ভালোও লাগছে... তাই বা কেন? মেয়েটা কোন ব্র্যান্ডের সিগারেট খাচ্ছে। গন্ধটাও বেশ ভালো।

-    আপনি যেটা করেছেন সেটা আইনের চোখে একটা ক্রাইম, জানেন?
-    তুমি কি আমাকে অ্যারেস্ট করবে? মনে হয় না।
-    না... তা করব না... আচ্ছা... তার মানে তো... যাদবপুরের দিকে আসার কোনো কারণই নেই আপনার। তাহলে আমার সঙ্গে এতদুর এলেন কেন? নাকি কোনো কাজ ছিল?
-    গাড়ি চড়তে ইচ্ছে করছিল।
-    অ্যাঁ???!!
-    তুমি কথায় কথায় এত অবাক হও কেন?
সে তো ঠিকই। অবাক হওয়ার মত এমন কিই বা ঘটেছে। নীল আবার থম মেরে গেল। বৃষ্টিটা এখনো কমার কোনো লক্ষন দেখাচ্ছে না।
-    আমি চললাম।
-    অ্যাঁ...? কিন্তু... বৃষ্টি পড়ছে যে... ভিজে যাবেন...
-    তাহলে কি করব?
-    ওয়েট করে দেখি... কমে কিনা... আপনি যাবেন কিসে?
-    বাস।
-    হুমমম... আমার আবার অরুনকাকুর বাড়ি যেতেই হবে... এক কাজ করা যাক। আপনিও চলুন সঙ্গে। ওখানেই বসে একটু ওয়েট করবেন...? আমার কথা হয়ে গেলে বেরিয়ে আপনাকে নামিয়ে দেব? ঠিক আছে?

কথাটা বলে নীলকন্ঠ নিজেই খুব অবাক হল। এটা কি বলল? এই মেয়েটা কে... কি করে... কিছুই জানা নেই... তার ওপর ফেক আইডেন্টিটি নিয়ে দেখা করতে এসেছিল... কোনো মতলবও তো থাকতে পারে! ও কিনা মেয়েটাকে... নামিয়ে না দিয়ে, কোনো কড়া কথা না বলে... সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে চাইছে! নীলকন্ঠ নিজের ব্যবহারে নিজেই খুব চমকে গেল।

মেয়েটা ওর ট্রেডমার্ক নির্বিকার মুখ দিয়ে একটু ধোঁয়া ছেড়ে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ওকে

নীল ফের গাড়ি স্টার্ট করল। বাকি রাস্তা কোনো কথা বলল না। মেয়েটা তো এমনিতেই সাইলেন্ট মুভি। লেক গার্ডেন্সে অরুণকাকুর বাড়ির সামনে গাড়িটা থামানোর পর নীলের মনে হল, এর সামনে চিৎপুরের কেস নিয়ে আলোচনা করা কি ঠিক হবে? নাঃ, একেবারেই হবে না। নীল একটু গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করল। বৃষ্টিটা এখন কমে গেছে। মেয়েটাকে চলে যেতে বললেও হত। কেন কে জানে... সেটা বলতে পারছে না।

-    ইয়ে... বিদ্যুৎলতা... (কি নাম রে বাবা!) বলছিলাম যে... অরুণকাকুর সঙ্গে আমার একটু প্রাইভেট কথা আছে। আমি ওনার লাইব্রেরি ঘরে গিয়ে কথা বলব, তুমি বাইরের ঘরে ওয়েট করবে। ওকে?
-    ওকে। ইউ ক্যান কল মি বিবি।
-    বিবি?
-    ইয়াপ। শর্ট ফর বিদ্যুৎলতা বটব্যাল। বি। বি। ইনিশিয়ালস।
নীল কলিংবেল বাজিয়ে কেসের ডিটেলস ঝালাচ্ছিল। হঠাৎ চমকে উঠে খেয়াল করল, সেও মেয়েটাকে তুমি বলে ফেলেছে। 

(ক্রমে আসিতেছে)




My Blogger Tricks

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন