৬
অনিমিখ চক্রবর্তীর
কল্পনাশক্তি : একটি পুনরাধুনিক উপন্যাস
অ নু প ম মু খো পা
ধ্যা য়
৬
পরের দিন সকালে উঠে অনিমিখ টের পেল নিজের কল্পনাশক্তির থেকে এতখানি
পিছিয়ে পড়া নিয়ে আর তার তেমন কোনো অস্থিরতা নেই। তার বদলে রয়েছে একটা গ্লানির ভাব। শরীর অবসন্ন হয়ে আছে এখনও।
মুখ টক হয়ে আছে। গতকাল সে যা করেছে, তারপরেও অন্বেষা তাকে ক্ষমা করতে সময় নেয়নি। তাকে অভুক্ত অবস্থায় ছাড়তে চায়নি। সে নিরাপদে বাড়ি ফিরল কিনা, খবর নিয়েছে। অন্বেষা নিজেও ওটাই চাইছিল, সেটা ভাবতে ভাল লাগছে না তার। সেটা হলে তার নিজের অপমান। কোনো মেয়ে তাকে যৌনসামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করে নিয়েছে, করতে চাইছে, এটা ভাবা সম্ভব
নয় তার পক্ষে। সে নিজেও একটি মেয়ের প্রতি ওই
মানসিকতা রাখতে চায় না। জীবনে কোনো একতরফা পর্নোগ্রাফি
অনিমিখ পছন্দ করেনি। হিন্দি সিনেমায় ধর্ষণের দৃশ্যে
চিরকাল অস্বস্তি বোধ করেছে, নায়ক দরজা ভেঙে ঢুকে এলে উল্লসিত
হয়েছে।
তবু ওটা ঘটল!
যা ঘটেছে, একটি মেয়েকে ঘরে একলা পেয়ে সে যা করেছে, নিজের কল্পনাকে অনিমিখ আর দেখতেই পাচ্ছে না আশেপাশে। ওই দৌড় প্রতিযোগিতা নিয়ে সে আর ভাবছে না, ভাবতে পারছে না। কল্পনার কাছে হেরে গেলে সেই বিস্ময়ে বা বিষাদে সম্ভবত কবিতার জন্ম হয়, সে ভেবেছিল। কিন্তু এমন বিশ্রীভাবে হারলে সেটা হয় কি! নিজেকে এত কম চিনলে কবিতা লেখার
অধিকারটাই তো থাকে না!
এরপরে অন্বেষা তাকে জীবন থেকে মুছে ফেলবে, একজন ধর্ষক হিসেবে দেখবে তাকে, সেটা সম্ভবত নয়। তবে সে যেটা করে এসেছে, আয়নায় নিজের চোখের দিকেই তাকানো মুশকিল হয়ে
গেছে। অন্বেষার মোচন অবধি তবুও ঠিক ছিল, কিন্তু তারপরের জান্তব আচরণটা… সম্ভবত এর পরে মেয়েটির কাছে অনিমিখ আগের মর্যাদায়
থাকতে পারে না। এখন একটি মেয়ের পক্ষে তাকে করুণা
করাই স্বাভাবিক। একমাত্র করুণা মেশানো শারীরিক কামনাই সে আশা করতে পারে ওর কাছে, একজন হ্যাংলা কামুক হিসেবে। ‘পাপ’ শব্দটার গরিমা ওই আচরণে নেই। নিজের চোখে অনিমিখ এখন একটা ফালতু লোক ছাড়া কিছুই নয়।
জ্যোতির্ময়বাবু ঠিক বলেননি। একটা স্তর পেরিয়ে গেলে কাম
মানুষকে আর সুন্দর থাকতে দেয় না। হিংসার আরেক নাম হয়ে ওঠে। উনি সেই স্তরের দেখা পাননি।
দুর্ভাগ্যক্রমে, অনিমিখ পেয়েছে।
এতগুলো বছর প্রতিদিন নিজের বৌয়ের দেহের আনাচে-কানাচে ঘোরার সুযোগ পেয়েও আরেকটি মেয়ের দেহকে সে ব্যবহার করতেই শিখল না! তাকে অসুস্থ করে ফেলল! ওটাকে তো একরকম
ধর্ষণই বলা চলে!
কিন্তু অন্বেষার শরীর কি খুবই খারাপ হল! কোনো খবর নেই কেন?
অনিমিখ নিজের উদ্বেগ বুঝতে চাইল। কিছুটা হলেও উদ্বিগ্নতা তার মধ্যে জেগে আছে মেয়েটির জন্য।
কিন্তু ফোন করা চলবে না।
স্কুল চলাকালীন একটা মেসেজ অবিশ্যি এল – aaj shorir vaalo aachhe aamaar. chintaa koro naa. phone baa
message koro naa. o baari-te aachhe. sujog pele aami jogaajog korbo.
তারপর প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেল, সেই সুযোগ এল না। এর মধ্যে অনিমিখ স্কুলে তো বটেই, নিজের বাড়িতেও একজন রহস্যময় মানুষ হয়ে উঠল। রিয়ার সঙ্গেও প্রয়োজন ছাড়া কথাবার্তা নেই। মেয়েকে কোলে বসিয়েও তার সঙ্গে খেলতে ভুলে যাচ্ছে। জ্যোতির্ময়বাবুর বাড়িতে একবারও যায়নি। উনি এলেও খুব উৎসাহ দেখায়নি আড্ডার।
কবিতা কি তার থেকে চিরবিদায় নিয়েছে? গত একমাসে সে একটা কবিতাও
লেখেনি। এখন সম্পাদকদের ফোন এলেও ধরে না। মেসেজের উত্তর দেয় না। ফেসবুকেও একই অবস্থা।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার উপর একটা গদ্য সে শুরু করেছিল, সুন্দর এগোচ্ছিল, কিন্তু জমা
দেওয়ার তারিখ পেরিয়ে গেল। অথচ ওই গদ্যটা নিজেই সে লিখতে
চেয়েছিল, ওটা লেখা জরুরি ছিল।
কী হল তার? সে কি প্রেমে
পড়ল নাকি! সে কি দেবদাস হয়ে গেল? ওই লোকটাকেও
শরৎবাবু লড়িয়ে দিয়েছিলেন তার নিজের কল্পনাশক্তির সঙ্গে। পার্বতী যে রাতে তার ঘরে আসবে এটা দেবদাস মুখুজ্জে ভাবতে পারেনি। তারপরে নিজের আচরণের উপরে তার আর কোনো হাত ছিল না। কিন্তু ২০১৪ সালে কোনো দেবদাসকে কি মানায়? এখন প্রেমের উপন্যাসগুলো হাস্যকর হয়ে উঠছে,
প্রেমের সিনেমাগুলো একের পর এক ফ্লপ করছে! একদিন
স্কুল থেকে ফেরার পথে এই প্রশ্ন তার নিজের মনেই জেগে ওঠায় হাসি পেল, নিজের মনেই হাসল। আবু সয়ীদ আইয়ুব মোক্ষম অনুবাদ
করেছিলেন মির্জা গালিবের লাইন দুটো –
প্রেমের কৃচ্ছ্রসাধকদের খবর আর কী শুনবে
তারা ক্রমশ আপাদমস্তক দুঃখের মূর্তি হ’য়ে গেল।।
পিপাসা বাড়ছে। সে নিজেই ইচ্ছে করে খুঁচিয়ে
খুঁচিয়ে বাড়িয়ে তুলছে। ইচ্ছে করেই বুক ফাটিয়ে ফেলছে অন্বেষার জন্য। একটা মেসেজ কি ও করতে পারছে না!
দুঃখের একটা মূর্তি স্কুলে ভূগোল পড়াচ্ছে, বাড়ি ফিরছে, বাজার করছে,
খাওয়াদাওয়া সেরে বৌকে আদর না করেই ঘুমিয়ে পড়ছে। তাহলে সে দুঃখের কবিতা লিখছে কখন?
কেন, পরের দিন! হা হা হা হা…
সাতদিন পরে ভোরবেলায় মেসেজ এল। ঠিক সকাল সাড়ে এগারোটায় অনিমিখকে পোড়া কোল্ড স্টোরের সামনে বাইক
নিয়ে পৌঁছতে হবে। এক মিনিট এদিক-ওদিক
হওয়া চলবে না। আশ্চর্য আস্থা তো মেয়েটার! সে যে যাবেই, এটা ও জানে, জানে নড়চড় হবে না! অথচ সাতদিন কথা হয়নি!
মাস্টারমশাইদের ছুটিছাটার ব্যাপারটা সহকারী প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জনবাবুই সামলান। অনিমিখ ওঁকে ফোন করল। উনি আঁতকে উঠলেন, ‘আজ ছুটি নেবেন! সেকি, গতকাল সেটা জানাননি কেন?’
‘একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে স্যার।’
‘এভাবে হয় নাকি! তাছাড়া আরেকজন ভূগোলের স্যারও আজ আসছেন না। স্কুল চালাব কী করে?’
অনিমিখের একটু মাথা গরম হল। এটার মানে এই ভদ্রলোক ধরে রেখেছেন তার নিজের এবং সেই অন্য স্যারের কয়েকটি মিলিয়ে তাকে আজ আটটার মধ্যে আটটা ক্লাসই করাবেন। এটা এর আগেও হয়েছে। সে বলল, ‘কিন্তু আমারও তো কাজ থাকতে পারে! আমারও তো ছুটি পাওনা আছে!’
‘সে তো আছেই স্যার! সেই ছুটি পেরিয়ে গেলে অন্য ছুটিও আছে। কিন্তু সমস্যাটা কী জানেন, আমরা আমাদের পেশাটাকে চাকরি ভেবে নিচ্ছি। এটা কিন্তু নিছক চাকরি নয়! এটা একটা সেবার কাজ। কিন্তু সে আর কে ভাবে বলুন? মাস্টারমশাইরা মাসের শেষের বেতনটার জন্যই স্কুলে আসেন, ডাক্তারবাবুরা ওষুধের নাম লেখার আগেই ভিজিটের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন… সব ব্রতই আজ চাকরি হয়ে গেছে এই বেতন আর ছুটির ছকে। ঠিক আছে স্যার, আপনি আপনার কাজ সেরে আগামীকালই আসুন। স্কুল চালিয়ে নিতে হবে যে করেই হোক।’
ফোন কেটে গেল। অনিমিখ অপ্রতিভ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। এই কথাগুলো নিরঞ্জনবাবু বলতে পারেন। উনি সকলের আগে স্কুলে আসেন। স্কুল শেষ হওয়ার অনেক পরে বাড়ি ফেরেন, এমনকি একেকদিন রাত্তির হয়ে যায়। স্কুলটির গড়ে ওঠার পেছনে নিরঞ্জনবাবুর বিরাট ভূমিকা আছে। সত্যিই ভালোবাসেন প্রতিষ্ঠানটিকে। অন্য স্কুলে প্রধান শিক্ষকতার সুযোগ পেয়েছিলেন, ছেড়ে যাননি।
সে যে মাস্টার হয়েও মাস্টার নয়, এমন একটা বিশ্বাস অনিমিখের আছেই। সেই বিশ্বাসের একদম দুর্বলতম স্থানটিতে আঘাত করলেন আজ নিরঞ্জন মাহাতো। রোমাঞ্চকর সকালটা তেতো হয়ে গেল। চাকরি ছাড়ার একটা সুযোগ কি এর বদলে উনি দিতে পারেন তাকে? পারেন না। একজন অসামাজিক মানুষের কিছু কি বলার থাকতে নেই? একটা টিউমারেরও কিছু ব্যথা থাকে, আত্মকাহিনি থাকে, টিউমার কাউকে সেটা শোনাতে পারে না, সবাই শুধু তার বিরুদ্ধে নালিশটাই করে, কেটে বাদ দিতে চায়, বা বাধ্য হয়ে মেনে নেয় তাকে নিজের শরীরে। অনিমিখ যে একজন শিক্ষকের যোগ্য করে তুলতে পারেনি নিজের স্বভাবকে, এ কি তার অপরাধ, না অপারঙ্গমতা? সে চেয়েছে কিনা, এই প্রশ্নও হয়তো কেউ করতে পারে না। তাকে চাকরি ছাড়ার পরামর্শটা অবিশ্যি দিতে পারে, কিন্তু … খাবে কী? তারপর সে খাবে কী? জীবনানন্দ দাশ হয়ে যাবে নাকি? কারুবাসনা তাকে অতখানি নষ্ট করতে পারেনি মনে হয়। এখন তো ছেড়েই গেছে।
বাড়িতে সে জানাল না আজ স্কুলের বদলে অন্য কোথাও যাচ্ছে। শুধু জানাল সে আজ খাবে না। কাজ আছে। রিয়া কোনো প্রশ্ন করেনি। গত কয়েকদিন খুব অল্পই কথা হয়েছে দুজনের মধ্যে। রিয়া কি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে? তার কি একটু সতর্ক হওয়া উচিত সম্পর্কটি নিয়ে? চাকরির মতোই কি সে দাম্পত্যেও ব্যর্থ?
দাম্পত্যের মতো তাহলে হয়তো লাম্পট্যেও একজন সফল মানুষ হতে পারবে না! অথচ অনেকেই তো পেরেছে, বাইরে গোপন মেয়েমানুষ রেখে বৌকে অগাধ সুখে ভাসিয়ে রাখতে! ঊনবিংশ শতাব্দীর বনেদি বাড়ির কোনো পুরুষের মতো … সে কি পারে না? অন্বেষার জন্য তো তার কোনো
খর্চাও হবে না। এমন গার্লফ্রেন্ড কটা বিবাহিত লোক পায়!
আজ কনকনে শীত। বাইক চালাতে চালাতে কাঁপছিল অনিমিখ। উইন্ডচিটার, দস্তানা, বডিওয়ার্মার, মোজা… সব কিছু পেরিয়ে শরীরে ঢুকে পড়ছে রাঢ়ভূমির নির্মম শীত। অন্বেষা তাকে বাড়িতে না ডেকে বাইরে ডাকল কেন?
হয়তো চায় না পাড়ার লোক তার আসা-যাওয়া খেয়াল করুক! হয়তো আজ অয়ন বাড়িতেই আছে, তবু অন্বেষা বেরোবে!
ঠিক এগারোটার সময়েই সে হাজির হল পোড়া কোল্ড স্টোরের সামনে, এবং বাসন্তী চুড়িদার ও কাশ্মিরী শাল পরিহিতা অন্বেষাকে তুলে নিল বাইকে। কেউ খেয়াল করল না, পৃথিবীর শীত কমে গেল।
অন্বেষা বলল, ‘জোরে চালাও। এই এলাকাটা পেরিয়ে যাও তাড়াতাড়ি। তবে সাবধানে চালাও। আমাকে নিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট কোরো না।’
‘কিন্তু যাবে কোথায়?’
‘যেখানে হোক চলো।’
‘কোনো … লজে যাবে কি?’ এটাই অনিমিখ ভেবে এসেছে। আর কোথায় যাওয়ার থাকতে পারে আজ, সেই ঘটনার পর? অনেকখানি শূন্যস্থান আজ ভরিয়ে ফেলা দরকার, একজোড়া মেয়েপুরুষ সেটা না ভরিয়ে যাবে কোথায় আজ?
একটু ভেবে অন্বেষা রুদ্ধ গলায় বলল, ‘তাই চলো। ইশ!’
‘কী হল?’
‘ভাবতেই লজ্জা করছে!’
বাইক ছুটে চলল প্রায় আশি কিলোমিটার বেগে। এত জোরে অনিমিখ জীবনে বাইক চালায়নি। এখান থেকে চল্লিশ-বেয়াল্লিশ কিলোমিটার দূরে একটা লজ আছে। এই অঞ্চলে কুখ্যাত লজ। সেখানেই যেতে চায় সে। অনেকদিন ভেবেছে একবার ওই লজে ঢুকবে, কোনো মেয়েকে না নিয়ে হোক, একলাই একটা ঘর নিয়ে একটা রাত কাটাবে, দেখবে ওখানে কেমন চলে মানুষের সঙ্গে মানুষের কারবার। সাহস হয়নি। কতকিছুই তো করেনি জীবনে শুধু সাহসের অভাবে! ‘সাহস’ – এই শব্দটা তাকে জীবনে এই প্রথম কিছু দিতে চাইছে, তাকে নিজের সীমা ভাঙতে উসকানি দিচ্ছে।
হে সাহস, তুমি কি ভারতীয় দন্ডবিধির সবগুলো ধারা জানো?
হেডমাস্টারের ম্যানুয়ালে কতগুলো পাতা আছে তুমি জানো?
লজের সামনে বাইক রেখে অন্বেষাকে সঙ্গে নিয়েই ঢুকল লজের মধ্যে। এখানে কেউ তাদের চিনবে এমন সুযোগ নেই। তবু অন্বেষা মুখ ঢেকেছে শালে। একটা অসুস্থ গন্ধ ছড়িয়ে আছে ভিতরে। দেওয়ালে বিশ্রী সবুজ রঙ। ম্যানেজার গোছের একজন লোক কাউন্টারে বসে আছে, আর এক ছোকরা কর্মচারী। তাদের পিছনে একটা বেমানান পাহাড় আর ঝরনার ছবি। তার পাশে সম্ভবত মালিকের
গুরুদেবের একটি ফোটোগ্রাফ ঝুলছে।
অনিমিখ গলার উত্তেজনা কমিয়ে জিজ্ঞাসা করল,‘একটা ঘর হবে?’
ম্যানেজার খুবই উদাসীন গলায় বলল, ‘হবে। কতদিনের জন্য?’
ছোকরা যে এই কথায় মুখ ফিরিয়ে হাসল, তার দিকে না তাকিয়েই অনিমিখ বুঝতে পারল। পরোয়া না করে বলল, ‘আজ বিকেল অবধি থাকব। একটা আত্মীয়বাড়িতে এসেছিলাম। দেখলাম ওরা বাড়িতে নেই। জানিয়েছে বিকেলে ফিরবে। ওরা ফোন করলেই ঘর ছেড়ে দেবো। ইনি আমার স্ত্রী।’
ঠান্ডা ভদ্র এবং ব্যক্তিত্বপূর্ণ গলায় ম্যানেজার, কিংবা সে-ই হয়তো মালিক, জানাল, ‘ঘন্টা পিছু আমরা হাজার টাকা নিই স্যার। সে এবার আপনি যতক্ষণ খুশি থাকতে পারেন। নাহলে যেমন নিয়ম, সারাদিনের ভাড়া চারশো টাকা। কিন্তু সেটার জন্য আপনাকে আপনার ভোটের কার্ড বা ড্রাইভিং লাইসেন্স বা অন্য কোনো পরিচয়পত্র আমাদের কাছে জমা রাখতে হবে। ঘর ছাড়ার পরেই ফেরৎ পেয়ে যাবেন।’
‘আর ওগুলো আপাতত সঙ্গে না থাকলে?’
‘ঘন্টা পিছু হাজার। কিছু করার নেই স্যার। আমাদেরও তো রিস্ক সামলাতে হয়! পুলিশ আজকাল খুব ট্রাবল দিচ্ছে। এসব ধান্দা আর ভালো লাগে না।’
শেষ অবধি আটশোয় রাজি হয়ে গেল। ছোকরা তাদের পথ দেখিয়ে দোতলায় নিয়ে এল। একটা ময়লা সবুজ রঙের দরজার সস্তা তালা খুলে দিল। চলে গেল।
ঘরের ভিতরে ঢুকতেই সেই অসুস্থ এঁদো গন্ধটা ঝাঁপিয়ে পড়ল। একটা মোটে জানলা। সেটা আদৌ খোলা হয় বলে মনে হয় না। একটা খাট। তাতে ময়লাটে বিছানা। এরা কি বিছানার চাদর বদলায় আদৌ? একটা প্লাস্টিকের চেয়ার ছাড়া ঘরে আর অন্য সামগ্রী বলতে একটা মাঝারি মাপের কমদামি আয়না। অন্বেষার দিকে না তাকিয়ে অনিমিখ দরজা বন্ধ করল। প্রায় সব জামাকাপড় খুলল। বাথরুমে গেল। সেখানকার অবস্থাও খুব সুবিধের নয়। অবিশ্যি একটা শাওয়ার আছে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখল মেয়েটা বন্ধ দরজার পাশে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। মুখ নত।
জড়িয়ে ধরতেই বলে উঠল, ‘না না ফিরে চলো! এখানে আমার ভালো লাগছে না!’
এটা না বললে অনিমিখ শুরু করতে পারত না। অনিমিখ কান দিল না। একটি শব্দও বলল না উত্তরে। শুধু অন্বেষার কাঁধ থেকে দামি ব্যাগটা নিয়ে মেঝেতে ফেলে দিল। তারপর মহার্ঘ্য শালটা, ধুলোর কথা না ভেবেই। অনেকক্ষণ চুমু খেল মুখে মুখ ডুবিয়ে। অন্বেষার মুখে সম্ভবত আলুপোস্তর মিষ্টি গন্ধ পেল। মাছের ঝোলের তীক্ষ্ণ গন্ধ পেল।
এখন শুধু একবার পাপের দেখা পেলে হয়। একটা হেস্তনেস্ত করা যায়। পাপের সঙ্গে একটা রেস যদি করা যায়!
অন্বেষার সর্বাঙ্গে সে সেই সুযোগ খুঁজল।
সেক্স হল প্রায় একঘন্টার উপর। অন্বেষার মধ্যে যে এতখানি চাহিদা আছে, এতরকমভাবে সে আনন্দ চাইতে পারে, যন্ত্রণা চাইতে পারে, অনিমিখ ভাবতে পারেনি। একটি বিবাহিতা স্কুলশিক্ষিকা যে এতদূর যেতে পারে একজন পরপুরুষের সঙ্গে এরকম একটা জঘন্য জায়গায়, অনিমিখ ভাবতেই পারেনি।
অবিশ্যি নিজের কল্পনার সঙ্গে দৌড়নো সে বন্ধ করে দিয়েছে।
শেষে শিথিল কিন্তু জোরালো গলায় অন্বেষা বলল, ‘ভিতরে নয়! প্লিজ...’
উন্মত্ত অবস্থাতেও অনিমিখ নিজেকে সামলে নিয়ে সেই অনুরোধ
রাখতে পারল।
জীবনে এই প্রথম, স্খলনের পরে তার বিরক্তির বদলে হেসে উঠতে ইচ্ছে হল।
অন্বেষা তার মুখের দিকে তাকাল না। মাতালের মতো উঠে গায়ে কিছু না জড়িয়েই বাথরুমে ঢুকে গেল। জলের আওয়াজ আসতে শুরু করল। ও স্নান করছে।
আগের দিনের গ্লানি অনিমিখের মনে আর লেগে নেই। এই দীর্ঘ সঙ্গম সেটাকে মুছে দিয়েছে। সেদিন কেন সে ওটা করেছিল? আরেকটু হলে সারাজীবনের মতো নিজের কাছে বেঁটে হয়ে যেতে হত। সারাজীবন ভাবতে হত সে কাউকে সত্যিই ধর্ষণ করেছে কিনা। প্রতিবারই উত্তত হত ‘না’, তারপর আবার প্রশ্নটা ফিরে আসত। আজকের দিনটায় এই অশ্লীল একটা লজে তার বিষক্ষয় হয়েছে, হয়তো আরো বেশি গ্লানির মূল্যেই। তবু, নিজের অহংকার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে অন্য লোকের বৌটা।
আগের দিন এই সুযোগই অনিমিখ হারিয়েছিল।
পাপ কি হল?
কে জানে?
শুধু এটুকুই যে, এই কয়েকটা দিন সে কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেনি। স্কুলের ছাত্রীদের দিকেও না। রিয়ার সঙ্গে চোখ মিললেই যেন শরীরে চাবুকের ঘা পড়েছে! আজও সে রিয়ার চোখের দিকে তাকাতে পারবে না। কিন্তু অভিনয়টা করতে পারবে, যে অভিনয় কিছু পুরুষ করেই থাকে মেয়েদের সঙ্গে।
যে অভিনয়টা আজ রাতে অন্বেষা করবে অয়নের সঙ্গে, সেটাও খুব কি আলাদা?
এতক্ষণ ধরে স্নান করছে মেয়েটা!
ওর গরম জলের অভ্যাস। একটা অসুখ বাধাবে শেষে।
অনিমিখ উঠে গেল বাথরুমের দরজায়, এখন তো সে যেকোনো অবস্থাতেই মেয়েটিকে দেখতে পারে, অন্তত এই ঘরে যতক্ষণ আছে।
শাওয়ার থেকে জল ঝরছে। অন্বেষা খালি গায়ে শুকনো শরীরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে কাঁদছে।
অঝোরে।
অনিমিখ বাধা দিল না। চুপচাপ লন্ডভন্ড বিছানাটাতে ফিরে এল। বসে রইল।
হঠাৎ টের পেল তার আবার খুব শীত করছে। এই বিছানায় কোনো কম্বল বা চাদর রাখা নেই।
এই লজে যারা আসে তারা কি শীতকালকে বাইরে রেখে ঢোকে, আর শীতকে সঙ্গে নিয়ে বেরোয়?
(
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন