সঞ্জয় ভট্টাচার্য
(১৯০৯-১৯৬৯)
(কাব্যগ্রন্থ- ‘সাগর ও অন্যান্য কবিতা’, ‘পৃথিবী’, ‘সংকলিতা’, ‘নতুন দিন’, ‘অপ্রেম ও প্রেম’ , ‘উর্বর উর্বশী’, ‘অনুসৃতি’, ‘সবিতা’ , ‘উত্তরপঞ্চাশ’...)
“ সৎ কবি বৈচিত্র্যের সমম্বিত রূপ। বিশ্বচিত্র যেমন চাঞ্চল্য
নিয়েও স্থিরতায় আসীন, সৎ কবির
মানস-লোকও তেমনি চাঞ্চল্য ও স্থিরতা সন্ধানী। কিন্তু সন্ধান করলেই কি মানুষ
বিশ্বরূপের সঙ্গে এক আসনে গিয়ে দাঁড়াতে পারে ? নিত্যের সঙ্গে অনিত্যের গাঁটছড়া বাঁধা হতে পারে কিন্তু যা নিত্য থেকে যায়, অনিত্য ঝরে পড়ে- মানুষ তাঁর মন নিয়ে বিশ্বচিত্র থেকে ধুয়ে মুছে যায়। আবার অবশ্য অনুরূপ
সন্ধান নিয়ে মানুষ আসে... সৎ কবি হয়ত এই মানস-সরসীর মালিক যে কিনা মনকে আবৃত রাখতে
নারাজ”- “আধুনিক কবিতার ভূমিকা’য় কবি প্রাবন্ধিক সঞ্জয়
ভট্টাচার্যের এ সামান্য কয়টি কথাতেই তাঁর সামগ্রিক সৃজনের নেপথ্যবার্তা পাওয়া যায়।
তিনি যেন এক সময়প্রতিনিধি, জীবন পরিক্রমায়
দাঁড়িয়ে বারবার যিনি উপনীত হতে চাইছেন প্রতিটি পথের প্রতিটি পরিক্রমের দুপাশের
দীর্ঘ ছায়া অবধি। ১৯৩৫ থেকে ১৯৬৮ প্রায় দীর্ঘ তিরিশ বছরের তাঁর সাহিত্যকর্মকে
বিশেষত কবিতাকে অনেকেই হয়ত কেবল স্বপ্নাশ্রয়ী বা জীবনানন্দীয় ছায়াবলম্বনের অনুপাতে
মাপতে চাইবেন কিন্তু তা তাঁর কবিতার সামগ্রিক আলোচনার পরিধিতে অমার্জনীয় অন্যায়
হবে।
তাঁর কবিতা জীবন্ত তাই কোনো
একরৈখিক বিশেষত্বের বেড়া দিয়ে বেঁধে রাখা যাবে না তাঁর ভাবনার ভাস্কর্যকে বরং
অনায়াসেই তাঁকে আমরা আবিষ্কার করতে পারি বহুরৈখিক দৃষ্টির ব্যাখানে। প্রথম
কাব্যসংকলন “সাগর ও অন্যান্য কবিতা” প্রকাশ পেল ১৯৩৫ এ, অর্থাৎ কবির বয়স তখন ছাব্বিশ, উত্তুঙ্গ যৌবনে
শূন্যতার পংক্তি কিংবা সত্তার শেকড়ে ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন নয় বরং তখন তাঁর কল্পলোকে
পাকিয়ে পাকিয়ে ফুলে ফুলে উঠছে প্রতীকি বুনট, চোখে তাঁর সাবিত্রী ঊর্বশী মেঘকুমারী কিংবা নীলামার নীল ছায়া । তখন বয়সের
সূর্য যে বিষম ও ভয়ংকর।ফলের প্রেমের রূপটি স্পষ্টতর , বিরহের কাঠামোটিও সুগঠিত। “সাগর ও অন্যান্য কবিতা”-র প্রায় সমস্ত কবিতাই
প্রেমের,
প্রভাতে কিংবা নিশিরাতে কবির প্রেয়সীদের সেখানে অনায়াস
যাতায়াত। নরম ঘুমের মত সেসব কবিতার কোনো দীর্ঘকালীন অভিঘাতের সম্ভাবনা হয়ত নেই
কিন্তু প্রতীকের এক আশ্চর্য্য স্বরভঙ্গি লিরিকের পূর্বসংস্কারকে ছিঁড়ে বেরোতে
চাইছিল পংক্তিতে পংক্তিতে। কবি লিখলেন- “ আছে কি
মেঘকুমারী/ আকাশে যারা শুকায় চুল/ আর চাঁদের কাছে এগিয়ে যায় চুপিচুপি/ সাগরে নেমে
মেঘেরা যখন করে স্নান/ জল কি ওঠে না সাপের মতো ঝিলকিয়ে?/ঢেউ তো ওরা নয়/ হয়তো ওরাই মেঘকুমারী।/ ওরা কি নেমে আসে না
মাটিতে/আকাশে যদি না থাকে চাঁদ?” ” কিংবা “ রাত্রিতে জেগে
ওঠে যে সাগর/ অন্ধকারের সাগর/ তুমি তাতে স্নান করে এস, নীলিমা,/তোমার চোখ হোক
আরো নীল,/চুল হোক ধূসর ফুলের মঞ্জরির মতো।“-এসময়ের কবিতায় কিছুটা
জীবনানন্দীয় রূপকল্পের আভরণ থাকলেও স্বর থেকে স্বরান্তরে তাঁর নিজস্ব এক দেখাও
স্পষ্ট হয়ে ওঠে।প্রতীকের বাঁধ ভাঙা তরঙ্গ নয় বরং লিরিকের সজল নিটোল রঙে
অবচেতন মনের সংরক্ষিত ছবিগুলোকে শব্দের অন্ত;শরীরে মিলিয়ে মিশিয়ে দেওয়া- স্বকীয় রহস্যের এ এক অন্য জগত গড়ে তোলা।তাঁর সারাজীবনের কাব্যেই এই লিরিক ঘুরে ফিরে এসেছে , কবিতার প্রতিন্যাসে একজন স্রষ্ঠার আত্মমুক্তির অপরিহার্য
অঙ্গ হয়ে উঠেছে।এমনকি কবিতায় ছন্দ রস ও সান্দ্র স্বরের প্রসংগ উঠলেই সঞ্জয়
ভট্টাচার্যের লিরিক কবিতা হয়ত বাংলা সাহিত্যের চিরকালীন সংগ্রহ হয়েই থেকে যাবে এবং
সেক্ষেত্রে প্রতীকের বহুবিধ যোজনাটি যথেষ্টই মূল্যবান। তাঁর কবিতায় প্রতীক-ছবির এই
আলাদা জগত প্রসঙ্গে আলোচক সুশান্ত বসু বলছেন-“ রসেটি, সুইনবার্ন, উইলিয়াম মরিস
প্রমুখ প্রি-র্যাফেলাইট কবিগোষ্ঠীর যে কবিরা কল্পপ্রতীকের বর্ণময় স্বপ্নছবি
এঁকেছেন তাঁদের কবিতায়, তাঁদের মধ্যে তখন কবির একান্ত প্রিয় কবি ছিলেন উইলিয়াম
মরিস। সেই প্রি-র্যাফেলাইট কবির মতো দূরযানী মগ্নচৈতন্যের কল্পছবি কোথাও ফুটে
উঠেছে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের এই প্রথম কাব্যগ্রন্থেও। প্রাচী এবং প্রতীচীর যে
পুরাকল্পকথার নায়ক নায়িকারা অবিরলভাবে নানা তির্যক অনুষংগে আর অনুভাবনায় বারবার
ফিরে আসবে তাঁর উত্তরকাব্যে সেই দুষ্মন্ত শকুন্তলা, উমা,ঊর্মিলা,ঊর্বশী,সাতভাই-চম্পা আর পারুল বোন, ডিডো,
হেলেন অ্যাডোনিস, সাইকি,কিউপিড আর ইউসুফ জুলেখার নানা
স্মৃতিসূত্রের উচ্চারণও শুনতে পাওয়া যাবে এই কাব্যে। তাই তো “জ্যোৎস্নায়”কবিতায় আমরা দেখি-
“ ......
.........
সেদিনো এমনি ছিল স্বচ্ছ জ্যোৎস্নারাত-
ট্রয়ের পাষাণপুরী পরিশ্রান্ত পশুর
মতন
ঘুমায়ে পড়েছে; শুধু জেগে আছে হেলেনের চোখ-
জেগে আছে- দ্রুতগতি সমুদ্রের
পাখির পালকে,
জেগে আছে- দূরান্তের অর্ধস্ফুট
ঢেউয়ের সংগীতে !
......
......
ঘুম ! আজ না-ই হল ঘুম ! থাকো জেগে
।
এই রাতে ঘুমায়নি ইসুফ জুলেখা ।
নেমে এস অবিশ্রান্ত জ্যোৎস্নার
বর্ষণে ;...”
কোথাও যেন কবির এ সময়ের কবিতা
একদিকে যেমন পরম অস্তিভরা তেমনি তার ভেতর কোন দূর অজানার আয়তন,অথচ ১৯৩৯ এ তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “পৃথিবী” প্রকাশের সাথে
সাথে দেখা গেল সর্বোতভাবে একজন প্রেমের কবিতার লেখক তাঁর কাব্যশরীর থেকে খসিয়ে
দিলেন অনুরাগের অমরতাগুলো। “পৃথিবী”র নামকবিতা থেকে প্রায় প্রতিটি কবিতার নামকরণেই ( মূমূর্ষ, ভাঙ্গা বন্দর, শহর,মাটি, অনাগত ইত্যাদি)
আমরা আবিষ্কার করব নতুন এক সঞ্জয়কে যিনি প্রভাতের প্রপাত আকাশ থেকে এক ঝটকায় নেমে
এলেন বস্তুবিশ্বের অনির্বাণ শূন্যে।কিন্তু কেন? আসলে দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি এই সেই আয়ু যেখানে একজন কবি অস্তির
অনিশ্চিতবিধিতে জড়িত হতে বাধ্য।তাঁর শব্দ শুদ্ধ ধ্রূপদী কবিতা গঠনের থেকেও তখন
পরিবৃত হয়ে সময়ের এক সন্ধিক্ষণে, সেখানে দেখাটা
ধীরে ধীরে নির্মমভাবে ভারী হতে থাকে কালের অনিশ্চয়তায় অসহায়তায়। বিচ্ছিন্ন পরিধির
মধ্যে সময়ের দীর্ঘ ঢেউগুলিকে ছুঁতে ছুঁতে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতার অভিক্ষেপ
পালটাতে দেখি আমরা ঠিক এমন সময়েই। কবির উত্তরভাবনায় তখন আর কোনো নিশ্চিত ভূবন নেই, ক্ষণবাদী প্রেমের বিরহ নেই কেবল পৃথিবীর আদি আর্তনাদের
সামনে দাঁড়িয়ে আর্থসামাজিক হাহাকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে কবির দীন কন্ঠ উচ্চারণ করে-
“ ভাঙা বন্দরে আমরা করেছি ভীড়;
এখানে জাহজ নেই
দিগন্ত পারে নেই সমুদ্রতীর ।
সবাকার সাথে শেষ তার লেনদেন
বুঝি দূরে দুর্যোগ
সমুদ্রে শুধু কালোজল আর ফেন
ভবিষ্যতের পথ আরো অস্থির।
ভাঙা বন্দরে আমরা করেছি ভীড়”-
যে শান্তিময় স্বপ্নময় করুণা মাখা
একটা বড়ো সংগীতের কানায় কানায় রবীন্দ্রনাথ ভরে তুলতে বলতেন কবিতাকে কিংবা নিভৃত
সৃষ্টিশীলতার মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ যে ভেতরের প্রেরণা বা অনুধ্যানের কথা বারবার
বলতেন,
সঞ্জয় ভট্টাচার্য্যের চল্লিশ পঞ্চাশের কবিতায় আমরা সেই “শ্রবণসুভগ” থেকে বেরিয়ে আসা
এক কবিকে খুঁজে পাই, যিনি নাইটার
গন্ধক গ্লিসারিনে মাখা মানুষটির সাথে জীবনমিছিলে নেমেছেন। অথচ তিনি তো ছিলেন
স্নিগ্ধতার সৌন্দর্য্যের সহজ উত্তরাধিকারী। আসলে যাপনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এভাবেই
হয়ত কবির মননমুদ্রা চুপচাপ বদলে যেতে থাকে আর এই বদলে যাওয়া বসবাসের মাঝেই একজন
পূর্ণ কবির সক্রিয়তা সমকালীনতা লক্ষনীয় হয়ে ওঠে।সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতায় আমরা
বারবার যে অন্বেষণ লক্ষ্য করি তাতে দেখা যায় প্রথম যৌবনের রোমান্টিকতা ধীরে ধীরে
পরিনত হয়েছে পীত ভীত মৃত মানুষের হিম ভাষ্যে। কবির মসৃন মৃদুতার স্বপ্ন ধীরে ধীরে
ব্জমা হয় ভীড় জীবনের কাছে এসে। ১৯৪৭ এ “নতুন দিন” প্রকাশের পরেও
আমরা রক্ত মাংসের মানুষের কাছে ক্যারাভান আর লাঙলের ভেজা মেটে পথের কাছেই ফিরে
আসতে দেখি কবিকে। “যুদ্ধোত্তর” কবিতায় যখন সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য লেখেন –“ মেরুর বরফ-দিন আবার ওখানে ফিরে আসে/ ওদের পৃথিবী ভেঙে যায়,/ মুছে দিয়ে যায় ধূধূ সাদায় আকাশ-/ওদের তাসের দেশ বরফের কঠিন
কফিন।/ কফিন মোমের সারে ঘেরা-/পথ খোঁজে কফিনের সাদা মানুষেরা,/কথা কয় , কানাকানি করে;/ ‘এবার ফুরোলো বুঝি পৃথিবীর
দিন।‘-তখন মনে হয় যে
পৃথিবীর বাইরে থেকে তিনি কথা বলছিলেন তাঁর প্রথম কাব্যসংকলনে সেই পৃথিবীর ভেতরেই
কোথাও যেন ক্রমে ঢুকে পড়ছিলেন চুপিসারে।
বাংলা সাহিত্যে তৃতীয় ও চতুর্থ
দশকের দুটি বিশেষ পত্রিকার সম্পাদনায় সুদীর্ঘকাল যুক্ত ছিলেন সাহিত্যব্রতী কবি
সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য।দীর্ঘ আটত্রিশ বছর কুমিল্লা থেকে কলকাতায় “পূর্ব্বাশা” পত্রিকা
সম্পাদনা করেন এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে যুগ্মভাবে “নিরুক্ত” কবিতা পত্রিকাও
সম্পাদনা করেন ১৯৪০-১৯৪৩। তিরিশ চল্লিশের দশকগুলিতে “পূর্ব্বাশা” বা “নিরুক্ত”-র পাতায় পাতায় রোমান্টিক
কবিতার রূপকল্প বা অমরত্ব চেতনার থেকে বেরিয়ে এসে দুই বিশ্বযুদ্দোত্তর পৃথিবীর
রূঢ়তা যে কবিদের নতুন পংক্তিস্পন্দন হবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই এবং সঞ্জয়
ভট্টাচার্য্যের মত আপাদমস্তক স্বপ্নাশ্রয়ী কবিকেও এসময় আমরা শব্দের বোধের “সজীব মৃদুতার সীমান্ত” ভাঙতে দেখি
অনায়াসে । আসলে তিনি তো নিজেই বলতেন-“কোনো সময়কে
অবাস্তব ও বাস্তব ভাবার বা বানিয়ে নেবার কর্ত্তা কবির মন। কবির হৃদয় বলে মনের থেকে
আলাদা কিছু আছে কিনা জানিনে। মন হারিয়ে যায় বিষাদে ও নৈরাশ্যে, আবার তা ফিরে ফিরে আসে হর্ষে, আশায়,
স্থৈর্য্যে। এই চাঞ্চল্যকর অবস্থায় কবির মন যেতে বাধ্য।
অবস্থা বিপরীত হয়েই তরঙ্গায়িত করে মন। দ্বৈতবাদ বা দ্বৈধভাব বড়ো চমৎকারভাবে বসবাস
করে কবি-মনে সবসময়-সর্ব্বকালে,সর্ব্বদেশে।
কালজড়িত মনই হৃদয়ের চেহারা দেখায়, দেখায় মননের
ছবি।“-
হয়ত এই পরিক্রমণই একজন কবির
প্রকৃত আশ্রয় ! তিনি কেবল হাঁটতে থাকেন পৃথিবীর পরমায়ূ ধরে ধরে আর দিন আর রাত্রির
হাত ধরে ধরে ইতিহাস পেরোতে পেরোতে খুঁজে ফেরেন একধরনের স্নায়ুর পিপাসা একধরনের
আলোকের ঋণ। সঞ্জয় ভট্টাচার্য্যের নাম উঠলেই জীবনানান্দের নাম উঠে আসে, তাঁর শব্দের কাছে বসলেই বিগলিত হয়ে ওঠে জীবনান্দের বর্ণিল
তুলি। আসলে জীবনানন্দীয় মনোগহিনতা সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সামগ্রিক কাব্যজীবনকে এক
মসৃন সন্মোহনে বেঁধে রেখেছিল। তিনি নিজেও এ ঋণ স্বীকার করে গেছেন। তাঁর আলোচনায়
প্রবন্ধে সম্পাদিত পত্রিকায় বারবার অকপটে দ্বিধাদন্ধসমাকুল জীবনানন্দের প্রতি তাঁর
গভীর আগ্রহ ও ঔৎসুকতা প্রকাশ পেয়েছে। “নিরুক্তে’র সর্বশেষ সংখ্যায় “এ যুগের কাব্য বিচার” প্রবন্ধে
বলেছিলেন- “ বাংলা কবিতায় এমন একজন কবির অন্তত সন্ধান পাওয়া যাবে যিনি
কবিতাকে সাহিত্য-সৃষ্টির বাহন রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চান; যুগের মননের ও হৃদয়ের প্রত্যেকটি তরঙ্গকে যিনি কবিতার ভাষায়
প্রকাশ করতে চেষ্ঠা করেছেন”- জীবনানন্দের ওপর একটি মহামুল্যবান গ্রন্থও রচনা করেন
সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য। গ্রন্থটির নাম “কবি জীবনানন্দ দাশ”। এমনকি অনেকক্ষেত্রে জীবনান্দের কবিতার প্রভাব এত ব্যাপক যে কবির নাম না বলে
দিলে আমাদের জীবনানন্দের কবিতা মনে হওয়াও স্ব্বাভাবিক। কিন্তু এর বাইরেও এক
অন্য সঞ্জয়কে আমরা খুঁজে নিতে পারি তাঁর ‘উত্তরপঞ্চাশ” গ্রন্থের ও
অগ্রন্থিত একাধিক কবিতায়। প্রকৃতি প্রেম ইতিহাস সময়ের আবহমান রূপচিত্রের বাইরে এক
অন্য ভূমিকায় দেখি কবিকে।কোনো শাশ্বতে পৌঁছোনো নেই সেখানে বরং সৃষ্টির গভীর
বিচিত্র কুড়োতে একেবারে মুখের ভাষার কাছাকাছি এসে গেছেন কবি। বৈশাখ ১৩৭৫ এ “না” কবিতায় তিনি
লিখছেন- “ গাছে ফুল ছিল/
এবং আকাশে রোদ, উড্ডীন কপোত,/ কিন্তু তুমি কোথাও ছিলে না।/ টেবিলে তোমার কাজ ছিল/ সেখানেও
না।“ কিংবা ২০০০ এ প্রকাশিত তাঁর কবিতা “ আলো নিবলেই ভয়
করে” তে
যখন লিখলেন- “ আলো নিবলেই ভয়
করে/ অন্ধকার মস্ত এক ছায়ার মতন/ পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রাখে, বলে/ “আলো তো নিবল।“/ আলো তো নিবল, তারপর?/তারপর আমি যেন তার !”- এই সব কবিতার কাছে এসে
কোথাও যেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য নতুন করে আবিষ্কার হতে থাকেন। কি সেই নতুনত্ব? কৈশোরের প্রানচঞ্চলের স্ফূর্তি বা প্রতীকের রূপোলি আঁশ তো
নেই কিংবা যৌবনোত্তর শাহরিক সুবাস থেকেও তাঁর শব্দরা তখন ফিরে গেছে বহদূরে, কিন্তু কবি কোথায় চললেন? একি চেতনার প্রৌঢ়তা যা বারবার সৃজনের রসায়নে ধাক্কা দিচ্ছে ! আসলে নিছক শব্দ
নিয়ে তাঁর কবিতা নয় সেই শব্দের মধ্যে এক ধরনের মানসপ্রক্রিয়ার ব্যঞ্জনাময় বিস্তার
ও একাধিক পরিব্যপ্ত অভিজ্ঞতাই টান দিচ্ছে বারবার। কেবল প্রতীকি রূপকল্প বা
অবচেতনার চাঁদোয়ার নিচে চাঁদ দেখা নয় বরং তাঁর কবিতার পরতে পরতে লেগে আছে
দীর্ঘলালিত স্মৃতির চুনবালি। জীবনের শেষ কুড়ি বছর ভালোবাসার নারীর অকালমৃত্যু
কিংবা সাহিত্য পত্রিকা‘পূর্বাশা’কে ঘিরে তাঁর স্বপ্নভঙ্গের বেদনা তাঁকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে, আত্মহত্যার চেষ্টা করেন কবি , এমনকি লুম্বিনি পার্ক হাসপাতালে কিছুদিন তাঁকে চিকিৎসার জন্য রাখাও হয়।ফিরে
এসে লেখেন “উত্তরপঞ্চাশের কবিতা” গুলি। লেখেন-
“ বর্ষার বিষন্ন রোদে বাড়িঘর প্রৌঢ় হয়ে গেছে
আমার মতন।
আমি তুলে নিই বেছে-বেছে
ক্লান্ত পায়ে ওখানে যে কারা কাজ
করে।
তাদের অনীহা-ভরা মন
ছোঁয়াচ লাগায় মনে, বসে থাকি ঘরে।
রুগন বুকে কী আলস্য বাসা বাঁধে
আজ-
মেঘে রৌদ্রে চেয়ে থাকি, তার কারুকাজ
আমাকে ভাবায় শান্ত জীবন-মরণ-।
কবে তুমি, কন্যা, সব ভেঙে দিয়ে পণ
আমাকে ভাসাও-
অনির্দেশে, সেই অনির্দেশে তুমি আজো নিয়ে যাও!...”
আমরা জানিনা কে সেই কবির
ভালোবাসার জন , জানিনা তাঁর এমনতর ধূসর
মনোসিজাগুলি, ঠিক যেরকম জানিনা একজন কবির
নিঁখুত ভাবের বিন্যাসের ভেতর পড়ে থাকা অভাবগুলিকে , তবু আমরা ফিরে ফিরে আসি একজন কবির রেখে যাওয়া জীবাশ্ম জগতে।হ্যাঁ সঞ্জয়
ভট্টাচার্যের কবিতার জগত সে অর্থে বাংলা সাহিত্যে আজ অতীত , সেখানে হয়ত স্মৃতির হাড়টুকুই পড়ে আছে অপরিচিতের মৃদু সুরভির
মত। তবু কোন অন্তর্লীন নশ্বরতার টানাপোড়েনে আজও খুলে যায় তাঁর ছেড়ে যাওয়া চেতনার
অর্গল!
কেন তাঁর কবিতাগুলির পাশে এসে বসলে স্বীকার করতে সন্দেহ হয়
না কোনো এক নিভৃত প্রবহমানতা আমাদের খুব কাছের সমস্তটার হয়ে আছে। হয়ত এ সেই
অনির্দেশ,
যে অনির্দেশে কবি তাঁর সমস্ত জীবন জুড়ে কালি ও আকরে আপনের
যাপনের প্রেক্ষিত সন্ধান করে গেছেন , হয়ত এ সেই অনির্দেশ যে অনির্দেশে দেশকালসময়ইতিহাসপ্রকৃতিপ্রেম-র বাইরে শুধু
লেগে আছে একটি ‘প্রাণের রং’-যে প্রানের রং নিয়ে রবীন্দ্রনাথও বলেছিলেন- “ প্রাণের একটি রঙ
আছে। তা ইন্দ্রধনুর গাঁঠ হইতে চুরি করা লাল নীল সবুজ হলদে প্রভৃতি কোনো বিশেষ রঙ
নয়;
তা কোমলতার রং”- হয়ত সঞ্জয় ভট্টাচার্যের স্রোতসবুজ ওই “প্রাণের রঙ”টুকুর কাছেই ওই কোমলতাটুকুর কাছেই আমরা ফিরে ফিরে আসি। কবি নামের কিছু
জ্যান্ত অনুপস্থিতির উপর চড়িয়ে দিয়ে তাঁরই কবিতার মসলিন, উচ্চারণ করি- “আমরা এসেছি আজ নূতন মানুষ/
তোমার পুরোনো প্রেমে”...
হৃদয়
যেতে পারো জীবনের খানিক গভীরে ;
(বালিয়াড়ি পার হলে আছে এক জলের
ইশারা)
কোলাহল থেকে ফিরে
যেতে পারো হৃদয়ের কাছে।
সেখানে তাদের ভিড়
কোলাহলে আসে নাই যারা ;
আছে কথা আরেক রকম
ছবি আছে জীবনের ব্যবহৃত পুরোনো
ছবির ব্যতিক্রম;
আকাশের অন্য কোনো মানে,
সময়ের অন্য কোনো স্রোত
শোনা যায় হয়তো সেখানে।
সেই সব কথা , ছবি, আকাশ, সময়
একদিন কবে যেন হারিয়ে ফেলেছি,
দাঁড়িয়েছি জীবনের রৌদ্রের ভিতর;
রৌদ্র আছে, আছে ঝিলিমিলি
তবু মনে হয়
ছিল যেন জীবনের অতলে কোথায়
কত কত ছায়া!
সে ছায়ার কথা, ছবি, আকাশ, সময়
কোলাহল থেকে ফিরে
হৃদয়ের কাছে দেখা যায় ।।
অবিচ্ছিন্ন
অনেক বছর পরে যদি দেখা হত
যখন আরেক মেয়ে তুমি,
তোমার চোখের থেকে যত কালো-আলো ঝরে
গেছে
আবার নিবিড় হত তারা,
অনেক দূরের রাত দূরের ঢেউয়ের মতো
এসে মিশে যেত
এই চুলে-
করাত কালোর স্নানে-
সময়ের সব গাঢ় ঘ্রান
আমাদের চারদিকে,
আবার মনের এই চুপ-করে-থাকা
কথা ভুলে যাওয়া,
আবার আকাশ ভরা হাওয়া,
আবার আবার এই সব।
খুঁজে পেত পৃথিবীর পুরোনো বিভব
হয়তো হৃদয় আর হৃদয়ের বিদায়ী জীবন;
সেই সব নীল নদী ছায়া-ভেজা বন
সাগরের নাটে নটরাজ আকাশের কলরব
অপরিচিতার মৃদু সুরভির মতো,
অনেক বছর পরে আবার তোমারি সাথে
যদি দেখা হত ।
যাত্রাশেষ
আরো কিছু দূর যেতে হবে
সে কি জীবনের, না কি মৃত্যুর সৌরভে,
মৌমাছির মতো, জানা নেই ।
জেনে যেতে হবে যেন ফের জানাকেই
আকাশের মতো এক প্রশান্ত আলোতে।
কতদিন হতে
সে-মন চেয়েছি আমি যে-মনে প্রেমের
চেয়ে গাঢ়
আছে কিছু ; প্রমা । আর পেয়েও যে আরো
পাবার প্রত্যাশী নয় ; কামিনী-কাঞ্চন ।
যতটুকু যেতে হবে সঙ্গে যদি থাকে
সেই মন
মনে হবে জীবনের পূর্ণ ঘটখানি
মৃত্যুর দুয়ারে রেখে মঙ্গলে
মুছেছি তার গ্লানি।
তারপর
এখন আকাশ হতে
মৃত্যুবীজ আসে
জীবনের দীর্ঘ কোলাহলে।
নদী হতে মুছে গেল গান-
অন্ধকার স্রোত হয়ে চলে,
সমতলে নেই ধান-
এলোমেলো সেখানে কবর।
তবু এর নেই কিছু মানে ;
শুধুই হাওয়ায়
এসে ভেসে যায় ঝড়,
তারপর
পাখি বাঁধে নীড় ।
আকাশ আবারো হবে নীল,
দূরে উড়ে যাবে চিল-
ছায়া তার মিশে যাবে
মাটির সবুজ ঘন ছায়াতে কোথায় !
পৃথিবীর স্বপ্ন আছে,
তার মৃত্যু নাই,
জীবনের পরমানু বেঁচে থাকে তাই ।।
আসন্ন
সে পৃথিবী কতদূর
আমরা শুনেছি যার কথা?
পথিকেরা পার হয় সময়ের তীক্ষ্ণ
মরু-পথ-
পেছনে তাদের কারো পড়ে আছে শব,
মন হতে কেউ বুঝি হারায়েছে সুর
তপ্ত বালু নিয়ে শুধু যাদের মদির
কলরব,
তবু বহু পথিকের রথ
এল আজ সময়ের ঊর্ধ্ব সীমায়,
এখানে সজল আকুলতা
মেঘের মতন এক পৃথিবীর ছায়া দেখা
যায়।
সেই পৃথিবীকে বুঝি দিতে পারি পেশী
হতে মানুষের শ্রম,
মন হতে স্বপ্ন সীমাহীন,
নিতে পারি যতটুকু চাই।
সেখানে সীমার পরাজয়;
আপন সীমারে শুধু করে যাওয়া
মূর্হুতে-মূর্হুতে অতিক্রম,
শুধে যাওয়া ইতিহাসে মানুষের ঋন ;
সমুদ্র সীমান্ত নয়,
সেখানে মাটির সীমা বিষুবরেখায়
লেখা নাই।
সে-পৃথিবী কাছে এল, মনের অনেক সন্নিকট,
যবনিকা অন্তরালে শোনা যায় তার কন্ঠস্বর,
উঠবে এখনি বুঝি পট
এই দৃশ্যে শেষ হোক ঝড় ।।
আশ্বিন ১৩৪৬
যে আকাশে রঙ নেই, ওড়ে শুধু কালো এরোপ্লেন-
বিষের ধোঁয়ায় যার ছায়া আজ মৃত্যুর
মতন-
যেখানে হয়েছে মেঘ আগুনের শিখার
শরীর-
আমাদের রক্তে নেই ব্যথা, ভ্য় সেই পৃথিবীর !
নয় ম্লান আমাদে আশ্বিনের আকাশের
দিন
নীলের শয্যায় আছে ফেনায়িত
শ্বেতালস মেঘ-
বাতাসে পেয়েছি মৃদু সুরভিত
শেফালিকা-স্বাদ-
আমরা কি বুঝি কোথা পৃথিবীর আদি
আর্তনাদ?
কোথায় জ্বলেনি বাতি ভয়ের ছায়ায়
অন্ধকার-
মাটির সোনালি শস্য ভস্ম হয়ে ওড়ে
অহর্নিশ-
সহস্র মায়ের চোখ সন্তানের
মৃত্যু-স্বপ্নময়-
কোথায় মানুষে আর মানুষের নেই
পরিচয়।
আমরা দেখিনি সেই মারনের মরনের পণ-
অশ্রুজলে পরিপূর্ণ প্রতি
মূর্হুতের ইতিহাস!
আমাদের রাত্রি আসে সুপ্ত আর আ
স্বপ্নে সুমধুর-
বিনিদ্র যাদের চোখ তারা বুঝি যাবে
বহুদূর !
ঘাম
আর ফুলের গন্ধ নয়, পৃথিবী,
ভালো লাগে এবার
ঘামের গন্ধ-
তোমাকে পীড়ন করে
মানুষের দেহের যে পুলকাশ্রু!
ঘামের রুপালি জল
তোমার জলের চেয়ে ঠান্ডা, আকাশ,
ঠান্ডা, সুন্দর আর পবিত্র ।
জন-সমুদ্রের লোনা জল
প্রচুর তার দূরন্ততা, সাগর,
তোমার উত্তাল লোনা ঢেউয়ের চেয়ে।
ঘামের দামে আমরা পেয়েছি
অজস্র সবুজ শস্য
অফুরন্ত সূর্যময় কয়লা
আর শক্তিময় শ্বেত ইস্পাত।
জীর্ন পৃথিবীর দেহ কুঁদে
ঘর্মাক্ত শিল্পীর হাতুড়ি
তৈরি করে পৃথিবীর
নূতন প্রতিমা।
সবুজ মেয়ে
সবুজ মেয়েরা আসে বারেবারে এখনো
আষাঢ়ে
সবুজ মেয়েরা দলে দলে।
সবুজ ফলের রঙ গালে
কচি চুল সবুজের ছায়া
সবুজ মেয়েরা আসে-
আলিসায়, জানালায়, আরো যে কোথায় !
কোথায়-কোথায় আসে !
জুঁইফুলে?
কাচা রোদে? মাঠভরা ঘাসে?
একটি সবুজ মেয়ে ভেঙে গেছে কাচের
মতন
জানিনে কখন।
সবুজ আলোর কাচ মিশে গেছে আষাঢ়ের
রোদে।
তারপর সেই আলো এখন অনেক-
অনেক সবুজ মুখ জানালায়, আলিসায়, মাঠে
আকাশের তাকায় একা, একা-একা হাঁটে ।।
নদীর মতো
ভোর।
আমার চারিদিকে ভিজে করগেটেড টিনের
চালা ছুঁয়ে
উনুনের মিহি ধোঁয়া উড়ছে।
আমি যেন এক বাষ্পঘরে আছি। রোগী।
রোগের মৃদু যন্ত্রনা আনন্দের মতো
সেই শীতল ভোরে
আমাকে আচ্ছন্ন করল!
তোমাকে যদি একটি ডাকে চৈত্র-ভোরে
জাগাতে
পারতাম!
তুমি নেই অনেক দিন হয়ে গেল।
ভুলে-যাওয়া এক নদীর মতো তোমাকে আজ
মনে পড়ে-
যে-নদীর তীরে বসেছিলাম!
এখন এই শীতলতায় আমি আবার সেই নদীর
সময়
শুনছি।
সম্ভোগ
তারা-ভরা আকাশের তলে
আত্মা আজ দাঁড়ায় একাকী
স্তব্ধ হয়ে গেছে সব পাখি
পৃথিবীও অন্ধকার জলে
চিহ্নহীন , প্রাংশু আত্মা শুধু
স্তম্ভের মতন আর সবি ছায়া ধূ-ধূ
যেন প্রেতচ্ছবি।
নক্ষত্রের আলোর সুরভি
পেয়েছে আমার আত্মা তার সত্তাময়
তাই তার অপূর্ব উদয়
তার রাত্রি সম্মোহিত নারী
আমি বুঝি আজ তাকে বুকে নিতে পারি।
অপ্রেম ও প্রেম
১০
সব দিয়ে গেল।
প্রীতির পৃথিবী ঢেলে রেখে গেলে
হৃদয়ে আমার
আকাশের অবকাশ রেখে গেলে মেখে নিতে
চোখে।
সকালের মদালস মন
তারার আগুন-ঝরা রাত্রির প্লাবন
তোমার এ উপহার
পারিনি এখনো ফেলে দিতে।
এখনো হয়তো কোনো বসন্ত-বিকেলে
হৃদয়ের শীতে
পেতে চাই তোমার আলো-কে
যেতে চাই তোমার ছায়ায়
হৃদয়ের জ্বরে।
তুমি নেই-নেই-আর সবই থেকে যায়
মনের, প্রানের খেলাঘরে।
মাটি
মাটি হতে নিয়ে গেছে যাযাবর
মানুষেরা যব আর ধান
কিছু তার ফেলে গেছে পথে কিছু
সমুদ্রের জলে,
তারপর মরুভূমি বেয়ে চলে মানুষের
ক্লান্ত ক্যারাভান
কোথায় কুমারী মাটি ভারাতুর আসন্ন
ফসলে।
প্রাচীন মাটিতে আজ ভাঙা হল, ভুসি আর পশুর কঙ্কাল
হে রাজা, তোমার আয়ু নিভে যায় আগন্তুক ঝড়ে,
শতচ্ছিন্ন উত্তরীয় ওড়ে, ম্লান উষ্ণীষে পড়েছে ঊর্ণাজাল
তোমার সীমান্ত ছেড়ে যায় প্রজা
বিদেশী নগরে।
নগরের দীর্ঘদেহ আকাশে পাঠায় বুঝি
আলোর সঙ্কেত
মাটির ছেলেরা আসে পতঙ্গের মতো
প্রলোভনে
বহুদূরে ফেলে স্তব্ধ অন্ধকার আর
বন্ধ্যা ফসলের ক্ষেত
যেখানে অনেক রাজা বসেছে সোনার
সিংহাসনে।
এ নূতন রাজধানী- ধমনীতে চলে তার
বিদ্যুতের স্রোত
লোহার ফসল হয় রক্তে আর ঘামে শুধু
বোনা,
বন্দরের ঘোলা জলে কোলাহল করে বহূ
বনিকের পোত
এখানে খনির মাটি ইন্দ্রজালে হয়ে
যায় সোনা।
তবু কোনো রাত্রিশেষে যখন তরুন
সূর্যে দিকপ্রান্ত লাল
তারা কি দেখেনি স্বপ্ন মাটি ছেড়ে
এল যারা চলে-
উর্বর করেছে মাটি তাদের দেহের
স্তুপ বুঝি কতকাল
তারপর পৃথিবীকে পেল তারা মাটির
বদলে ।
তারা
মৃত্যু এল রাত্রির ছায়ায় ।
সেই গন্ধকের ঝাঁঝ
আগুনে সেই ঝাঁঝ
যেমন নিশ্চল মৃত্যু আনে কাচপোকার
পাখায় ;
যেন মৃত্যুর ঘ্রাণ শিশুদের ঘুমে,
ছায়া হয়ে ভেসে যায়
যেমন মেঘের মৃত্যু কোনোদিন
সাহারায় সিসার আকাশে –
সেই সব মৃত্যুরা কখন
এসে গেছে রাত্রির ছায়ায়।
এখনো যাদের চোখে পৃথিবীর ভয়
শরীরে শবের স্মৃতি
পুড়ে-যাওয়া রক্তের অঙ্গার
তারা তো হাওয়ার কাল করেছিল ভীড় ;
তাদের হিমের ভিড়ে
নিশ্বাসের ক্লান্ত ভিড়ে
রাত্রি ছিল একা ।
অনেক দেহের হাড়
কোনো দীর্ঘ ধোঁয়াটে প্রান্তরে
পুঁতে গেছে ট্যাঙ্কের চাকায়
শোলের চিতায় পোড়ে ছেঁড়া মাংস এখনো
কোথায় ।
বহুদূরে মৃত্যু রেখে
মৃতেরা কি এসেছিল এখানের সবুজ
বাতাসে ?
এখানে অনেক ফুল
নরম ঘাসের ঢেউ
মাটি বুঝি শীতল নিটোল ।
তারা চেনে মেয়েদের চোখে আর শস্যে
কোনো নিবিড় পৃথিবী
তার ঘ্রাণ নিয়েছে আব্বার
সেই স্বাদ নিয়ে গেছে তারা
দেখে গেছে রক্তমাংসে পৃথিবীর
দীর্ঘ পরমায়ু ।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
আমার'ভোর'কবিতাটা চাই
উত্তরমুছুনঅনেক পথ খুলে যায় - এটা কি এনার ই রচনা? অনেকদিন আগে পড়েছি, এখন মনে নেই।
উত্তরমুছুন