১৩) তুমি
বলেছ, তোমার
অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে কবিতা উঠে আসে। অবচেতনের কবিতাগুলো মুখচোরা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে কবিতাকে তুমি
স্মার্ট বলছ, তাদের
অবস্থান কোথায়? তারা
কী দেখনদারীর জন্য?
বাজারে
কাটবার জন্য? নাকি
একটা অন্য স্বাদ নিয়ে আসতে চাও নিজের লেখার মধ্যে?
অনেক দিন আগে জয় গোস্বামী আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, আপনি যখন প্রথম
লিখতেন তখন আপনার সামনে কোন মুখ থাকত না। যত পাঠক পেতে থাকবেন, দেখবেন, আশে পাশে সামনে পেছনে সারি সারি মুখ,
অন্যদের মুখ। তারা কী বলছে, কী করছে।
চাইছে। সেগুলো ভেবে আপনি লিখছেন।
নেগেটিভ ভাবে, কিছু লেখা আমার হয়ত সেনসরড ও হয়ে যেতে পারে , “কে কী বলবে” এইটা ভেবে। আমার
লেখায় কিছু এলিমেন্ট আসছেই না হয়ত আর। আমি সামাজিকভাবে বয়স্ক , প্রতিষ্ঠিত,
সম্মানিত, উচুঁতলায় উঠে গেছি, এখন কি আর প্রেম লেখা মানায়, যৌনতা লেখা মানায়?
বা কঠোর রাগের কবিতা লিখতে গেলে মনে হবে কে কী ভাববে। প্রতিষ্ঠান
তো শুধু পরিবর্তনের বা অপরিবর্তনের সরকার নয়, শুধু হিন্দু
বা মুসলিম মৌলবাদ নয়। আমাদের অনেক সরকার, অনেক মৌলবাদ।
ইন্ডিভিজুয়াল রাই সবচেয়ে বড় বড় মৌলবাদী। সবচেয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠান। আমার কাছের লোক
হয়ত একদিন নাক শিঁটকে বলল, এসব কী লেখা? এর থেকে কেন আঁশটে গন্ধ আসছে। আমার খুব প্রিয় কবিবন্ধু হয়ত একদিন বলল,
তোমার লেখাটা বেশ একই ধরণের, সেই তো
মেয়ে মেয়ে করে যাচ্ছ। খুব সংকীর্ণ লেখা তোমার। এসব মন্তব্য ক্যাজুয়ালি করা হলেও,
তোমাকে খতম করে দিতে পারে। তোমার লেখার মুখ বন্ধ করে দিতে পারে।
হয়ত একজন কবিতা চেয়ে ছাপল না। বলল হারিয়ে ফেলেছি। তুমি বুঝতে পারলে আসলে হারায় নি।
আসলে চেপে দেওয়া হল তোমায়। তুমি এত হতোদ্যম হয়ে গেলে যে দু তিন বছর আর কোথাও লেখাই
পাঠালে না।
আবার পাঠক তোমার কোন কবিতাকে খুব ভাল বলে তোমাকে আকাশে তুলে দিল। তারপর
তুমি সমানে নিজেকে রিপিট করলে। তোমার ছন্দের হাত ভাল বলে তুমি ছন্দে লিখে চললে।
নিজেকে নিয়ে আর নাড়াচাড়া করলে না পরীক্ষা নিরীক্ষা করলে না। এসবই সমস্যা করতে
পারে।
হ্যাঁ, আমার ক্ষেত্রে এগুলো কি আর হয়নি? হয়েছে। তবে
হঠাৎ কিছুদিন পর চড়াৎ বিদ্যুতে আমার মাথার মধ্যে নেমে এসেছে অন্ধকারের প্রবাহ,
আর এসব ভুলে গিয়ে নিজের লেখাটি লিখতে বসেছি। নিজের লেখাটি আমি
যদি আর না-ই লিখি, কার কাছে, কার
হাতে ছেড়ে যাচ্ছি তাকে?
যা যা লেখা হলনা তা আমার নিজেরই অপরাধ।
সেদিন আবার সংযম পালের সঙ্গে কথা হল। বড় সুন্দর, ডাইড্যাক্টিক কথা
বলেন সংযম। কিন্তু ওঁর কথা ঘন্টার পর ঘন্টা শুনলেও একটুও মাথা ধরে না। উনি বলছিলেন, নির্বাচন এড়াতে হবে। নির্বাচন
, পজিটিভ অর্থে। “আমি এই এই রকম লেখা
লিখি” লিখি
, কারণ আমার ওগুলো ভাল কাটে। বা আমার ভাল লাগে। বা আমাকে
সবাই ভাল বলে। নির্বাচন, নেগেটিভ অর্থে। আমি ঐ ঐ লিখব না।
সবটাই ভুল হয়ে যায়। সচেতনে নির্বাচন করা ভুল। নিজের ভেতর থেকেও নির্বাচন
আসে অনেক সময়। নিজের অজান্তে। সেটাও ভুল। অনেক কবিতাকে আমরা আড়াল করে দিই।
আমি তো দেখেছি কাঁচা ভেবে কোন কোন লেখাকে ফেলে দিয়েছি। কোন বড় কবি পড়ে
বললেন, এটাই
আসল, নিখাদ লেখা।
আবার আমার বেশি শব্দঘাঁটা লেখা পড়ে, বিশাল শ্রদ্ধেয় কেউ বললেন এতো দারুণ
লেখা। আমি কিন্তু বক্তব্যপ্রধান নির্বাচন করে বসে আছি। শব্দঘাঁটা লেখাগুলো সব গেছে
ফাইলের তলায়। বইতে দিই-ই নি!!!
১৪) তোমার ভেতর আর বাইরের জগতের বিবাদে তুমি নিজেকে
নিরপেক্ষ রাখতে পেরেছো? নাকি একবার এ পক্ষে, আর একবার ও পক্ষে... ব্যালেন্সের
খেলায় কতটা দক্ষ তুমি?
ব্যালান্স আর কই করতে পারলাম । সব সময় গুবলেট পাকিয়েছি।
যাক গে। ছাড়ো।
ভেতর আর বাইরের বিবাদ থাকা ভাল, মাঝে মাঝে মনে হয়। সংঘর্ষ না থাকলে
কিছু ঘটে ওঠে না।
বাইরের জগতকে আমি শ্রদ্ধাও করি। কারণ ওই জগতটা আসলে আমাকে চালায়, আমাকে জাগিয়ে
রাখে। মনস্ক রাখে। স্মার্ট রাখে। ওই জগতটা আমাকে তৎপর রাখে।
বাইরের জগত মানেই খারাপ না। ওটামাত্রেই “বানানো, সাজানো” কবিতার পথ না। ওটা আমাদের বোধ বুদ্ধিকে শানিত রাখার একটা পথ।
ভেতরের জগতে উলোঝুলো এলেবেলেদের বাসা। তারা অন্ধকার খায়, অন্ধকারে আত্মা
লালিত করে তারা শুয়ে বসে আলস্যে কাটায়। জাবর কাটে।
সেখান থেকে কবিতা আসে। বাইরের শনশন হাওয়ায় ওভারকোট মুড়ি দিয়ে কবিতা হাঁটে।
সংঘর্ষ তৈরি হয়। আমি , আমার কবিসত্তা বেঁচে থাকে।
১৫) ফেসবুকে তোমাকে বেশ সক্রিয় দেখতে পাওয়া যায়। কোনরকম আরোপিত ভারিক্কিপনায়
আক্রান্ত হতে দেখি না তোমায়। বেশ একটা ক্যাসুয়াল ভাব। এবং নিজের লেখা হোক বা
অন্যের শেয়ার করতে পিছপা হও না। আমি বলতে চাইছি, তুমি কি প্রচারে বিশ্বাসী?
ফেসবুক নিয়ে আমি শতমুখে বলব। প্রচার তো হয়। এই প্রচারে তো খারাপ নেই।
কবিতাই তো। কবিতা নিয়ে কথা বলছি। পবিত্র কবিতার বিভা বা কবিতার গাছ কমিউনিটিতে
কবিতা পোস্ট করে সেই নিয়ে আলোচনা করেছি। অনেক মনস্ক পাঠক অনেক ভাল কবি অনেক
সমালোচক, সুতার্কিক
কু তার্কিক এর দেখা পেয়েছি। কিন্তু সবটাই তো কবিতা ঘিরে হচ্ছে।
আমি তো চুলের কলপ , তাও আবার ভাঁওতা বাজি করে খারাপ উপাদানে তৈরি করে তাকে
আয়ুর্বেদ বলে চালিয়ে, বিক্রি করছি না।
ফেসবুকের এই সব ফোরাম না থাকলে অন্তত এক ডজন ভাল বন্ধুকে পেতামই না। যারা
এখন আমার লাইফলাইন।
কত সদর্থক ভাল পড়ুয়া, ভাল চিন্তার মানুষকে পেয়েছি। তাদের মননের অনেকটা মধু
আমাকে তারা দিয়েছে ।
ক্যাজুয়াল থাকাটা এখন বাপু ইন থিং। ক্যাজুয়াল থাকার চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে
অবশ্য খুব রাগ হয়। যখন দেখি আমার পরবর্তী প্রজন্ম, মানে তোমরা, মাত্রাছাড়া খিল্লি করছ সবকিছু নিয়ে। মনে হয় ফেবু ছেড়ে পালাই। আবার কেউ
কেউ প্রচন্ড সিরিয়াস হয়ে গেলেও রাগ হয়। হোলিয়ার দ্যান দাউ অ্যাটিচিউড আমি দেখতে
পারিনা। খুব আঁতেল আর হজম না হওয়া পন্ডিতদের একদম ভাল্লাগে না। আমি একটুও পন্ডিত
হতে চাইনি। মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টায় আঁতেল হওয়াটা ফ্যাশন ছিল, চশমা চোখে ন্যাতানো শাড়ি পরে, বড় টিপ পরে
ঘোরাঘুরি করা, মোটা মোটা সার্ত্র কাফকা কামু নিয়ে
ঘোরাঘুরি। সেসবের যুগ গেছে। কিন্তু আমার ভেতরে আবার একটা নরম স্পট আছেই ওই সব
ছেলেপিলেদের জন্য। ছেলেদের ঝোলা, খদ্দরের পাঞ্জাবি আর
দাড়িগোঁফ। এখনো দেখলে হেব্বি লাগে কিন্তু।
বাচ্চারা অনেকে ওরকম হচ্ছে, দেখলে বেশ আশ্বস্ত বোধ করি।
১৬) এই ফেসবুক প্রসঙ্গে আরও একটা বিতর্ক তোমার সম্বন্ধে
প্রচলিত আছে। এই যে তুমি নতুনদের কবিতা নিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ কর, তাদের লেখা পাতে
দেওয়ার মত নাহলেও তুমি তাদের ‘মাথায় তোল’,
এর পেছনে নিজের একটি উদ্দেশ্য সাধন করে থাকো। অর্থাৎ কিনা, তোমার তাঁবেদার একটি দল
তৈরি কর। কী বলবে এবার তুমি!
এই প্রশ্নটা যে আসবে তা আমি জানি, তুষ্টি... কারণ নানা ফর্মে এই কথাগুলো
এসেছে আগেও। এবার তোমাকে একটা গল্প বলি শোন। ২০০৬ -০৭ নাগাদ অর্কুট জয়েন করি। ২০০৮ নাগাদ দিশা নামে একটি সাহিত্য
পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে লিখি, বিষয় অর্কুটের নতুন কবিতা। এই
যে অর্কুটের কবিতা, আদরের নৌকা, কূটসাহিত্য, আরো কত কত গ্রুপ ( না, ওখানে বোধ হয়
কমিউনিটি বলা হত) থেকে, ওপেন স্ক্র্যাপবুক থেকেও, কত যে নতুন ছেলেমেয়েদের কবিতা
পড়েছিলাম, বলা মুশকিল। সেই সব কবিতা আমাকে স্পর্শ করেছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই
আনকোরা, নতুন। রাকা দাশগুপ্ত, সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবায়ুধ চট্টোপাধ্যায় দেবর্ষি
সরকার সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায় এদের কবিতা আমার এতটাই ভাল লেগে যায়, যে ওই
প্রবন্ধে এই এই কবিদের কবিতা তুলে তুলে দিয়েছিলাম। তাছাড়া বেশ কিছু ই পত্রিকা
ওয়েবজাইনের নাম করেছিলাম। সৃষ্টি ( রোহণ কুদ্দুস) বা এবড়োখেবড়ো রঙ, আদরের নৌকা এমন
অনেকের নামই করেছিলাম। সেসব কিন্তু আমি আমার ফলোয়ার গোষ্ঠী বানানোর তাগিদে করিনি।
বাংলা কবিতার প্রতি দায়বশতই করেছিলাম। কারণ আমার মনে পড়ে, ওই সময়েই আমার সমবয়সী ও
সমসাময়িকদের মধ্যে একটা “হায়-হায়” শুরু হয়ে গেছে যে ইন্টারনেট আসায় বাংলা সাহিত্য জলে গেছে, মুড়িমিছরির এক
দর হয়েছে, আর তার আগে থেকেই তো কথাটা বাজারে আছে যে বাংলা ভাষার পড়ুয়া ও লেখক
দুটোরই বাড়বাড়ন্ত নতুন প্রজন্মে। যাদের বয়স পঁচিশের নিচে, বা বলা ভাল, যারা পঁচাশি থেকে পঁচানব্বই সালের মধ্যে জন্মেছে
তারা সবাই ইংরিজি মাধ্যমে পড়েছে, কেউ কবিতা পড়েনা, কেউ কবিতা কেন, বাংলা সাহিত্যের
কোন ধারাতেই কোন আগ্রহ পায়না, শুধুই হ্যারি পটার ইত্যাদি পড়ে। এই গেল গেল বা হায়
হায় রব আমার খুব নেগেটিভ বলে মনে হয়। আমার মনে হয়, নেট যুগে, এবং সোশ্যাল
নেটওয়ার্কিং যুগে আমি আশ্বস্ত হবার মত অনেক নতুন কবিকে দেখেছি। সেটাই দিশা-র ঐ
লেখাটায় লিখেছিলাম।
ফলটা জানো ?
ফল এই, যে বিভাব পত্রিকার সম্পাদক সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত ফোন করে আমাকে বলেন,
এই সব নতুন কবিদের কোথায় পাব? ওদের কবিতা ছাপতে চাই বিভাবে। সেই সমরেন্দ্র যিনি
কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর অন্যতম। সেই সমরেন্দ্র যাঁরা পঞ্চাশের কবি এবং জীবনের শেষ দিন
অব্দি কবিতার জন্য দায়বদ্ধ। কতটা ওপেননেস থাকলে এই কথা বলা যায়, কন্যাসমা কবিকে
ফোন করে। যে , নতুন এইসব কবিদের সঙ্গে আমার তো পরিচয় নেই, তুমি দারুণ একটা কাজ
করেছ ওদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে। আমি জানতামই না এত ভাল লিখছে এখনকার
ছেলেমেয়েরা।
দেখো, তুষ্টি, উন্মুক্ত মানসিকতা, ওপেন নেস, এগুলো এখন রেয়ার কমোডিটি। সবাই
সবাইকে ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত। আমি কিন্তু আমার অগ্রজদের মধ্যে এই বিরল গুণাবলী দেখেছি,
লেখার উৎসাহ পেয়েছি। আমার এখন খুবই মনে হয় যে বহু সম্পাদক এখনো চোখ বুজে জোর করে
প্রিন্ট মিডিয়ার মধ্যেই থাকতে চান কোন এক যুগ যুগ বাহিত অন্ধবিশ্বাসের বশে, যে
যাকিছু নতুন এবং যাকিছু টেকনোলজি সম্পর্কিত তাই খারাপ। ইউরোপ আমেরিকা উত্তর
পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশের নানা লেখক পাঠকের সঙ্গে যে হারে আমরা এখন যুক্ত শুধু অর্কুট
ফেসবুকের মাধ্যমে তা কিন্তু দশ বছর আগেও ভাবা যেত না। এই অদ্ভুত পৃথিবী আমাকে অনেক
কিছু দিয়েছে। আমি কথাটা খুব আবেগ দিয়েই বলছি। তরুণদের লেখা আমাকে প্রণোদিত করে।
অনেকসময় তরুণদের আমার অতিতরল, অতি তাৎক্ষণিক, শুধু একটু “অসাম-অসাধারণ” শোনার সাময়িক বিলাসে
লিখে যাওয়া বলে মনে হয়নি তা নয়। কিন্তু তার বাইরেও অনেকেই রীতিমত সিরিয়াসলি
লেখালেখি করছে। আর তাদের প্রতি আমার পক্ষপাত থাকবেই।
তবে হ্যাঁ, ইনবক্সে কবিতা পাঠানো ভীষণ অপছন্দ করি। জোর করে দৃষ্টি আকর্ষণ
করার প্রয়োজন নেই, যদি ভাল লেখা হয়, আপনি চোখে পড়বে, হ্যাঁ ক্রাউডিং একটা আছে বটে।
কিন্তু সেটা এমন নয় যে ভাল লেখা দেখতে পাব না।
আর একটা কথা বলি, ঠিক সাফাই নয় । আমার মধ্যে চিরদিন একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব
আছে। আমি একজন একাকী মানুষ, লোনার। খুব কাছের বন্ধুদের সঙ্গেও একটা দূরত্ব মেনটেন
করি। আত্মকেন্দ্রিক ও ইন্ট্রোভার্ট বলতে যেটা বোঝায়। যেটা আমার বন্ধুরা বলত, স্টিলের বলয়। আমি আপনাতে
আপনি মস্ত থাকি। আসলে আমি খুবই আনসোশ্যাল।
আসলে ভার্চুয়ালে আনসোশ্যালদের ভিড় কেন জান? এখানে মুখ দেখাতে হয়না। এখানে
ব্যক্তিগতর গন্ডি না পেরিয়েই সোশ্যাল থাকা যায়। খুব আলগোছে আলটপকা কথা বলে পালিয়ে
আসা যায়।
আর, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এ আমি যে
এতটা অ্যাক্টিভ সেটা আমার কলকাতা থেকে দূরে পোস্টিং এর ফলে বেশি করে হয়েছিল বলে
মনে করি। তা ছাড়া, কবিতার সঙ্গে, সাহিত্যের সঙ্গে একটা কনট্যাক্ট থাকা দরকার, নিজের
এত শত সরকারি কাজের সময় খেয়ে নেওয়ার ফাঁক গুলো লেখালেখির অনুষঙ্গে ভরাট করতেই আমার
ফেসবুক করা। অনেকে যেমন ফিল্ম চর্চা বা গান চর্চা করেন ফেসবুকে।
ব্যক্তিগতভাবে, আমার কাছে নিজের
সঙ্গে নিজে থাকাটা বেশি আকর্ষণীয়।
যারা এসব ভাবেন বা বলেন, তাঁরা ভুলে যান, যে আমার কোন পত্রিকা নেই। আমি কোন
সম্পাদনা করিনা। কাজেই সেই অর্থে আমার চারিদিকে কবিগোষ্ঠী রচনা করার দরকারও নেই।
আমাদের এখানে গোষ্ঠী দরকার হয় বেশিটাই পত্রিকা চালাতে। আজকাল দাদা ও দিদি খুব
ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট। আমি কারুর দিদি হতে চাইনি। অন্তত সচেতনে। তবে হ্যাঁ, রাকা
বা সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে আমার হটলাইন তৈরি হয়ে গেছে। এখন ওরা যদি দিদি বলে মানে, কী
করা যাবে।
১৭) তা,
ভবিষ্যতে কোন সম্পাদনা করবে নাকি? আমরা কিন্তু চাইছি তোমার সম্পাদনায় একটা পত্রিকা হোক।
সম্পাদনা যদি কখনো করি, পত্রিকা নয়, কবিতার সংগ্রহ একটা আধটা করার ইচ্ছে
আছে। একটা ইচ্ছে তোমাকে আমি আগে বলেছি। রান্নাঘর নিয়ে লেখা যত কবিতা পড়েছি, সব
একজায়গায় আনতে চাই। আমাদের পরিচিত অপরিচিত কত কবি, এই রান্নাঘরের থিম নিয়ে লিখে
চলেছে। জ্যান্ত, গরগরে সব কবিতা। এমন সব লেখা, যে পড়লেই মনে হয় ওয়াহ্ মজা আ গিয়া।
অথচ, এই সব লেখার কোনটা মৃদুল দাশগুপ্ত বা শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা,
কোনটা লিখেছ তুমি , বা সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়। কোনটা গুজরাতি বা কোরিয়ান কোন
কবি। অদ্ভুত সাযুজ্য আছে কোথায় সব লেখায়।
আমার খুব ইচ্ছে মেয়েদের নিজেদের শরীরী উদ্ভাস নিয়ে একটা কবিতা সংকলন করার।
কেউ এগিয়ে এলে করা যায়। প্রকাশকদের কথা বলছি। সেনসেশনাল, কাটতির জন্য বইটা করতে
চাইছি না। বেশ কিছুদিন ধরে তো পড়ছি। বাংলায় মেয়েদের লেখা কতটাই এগিয়ে এসেছে। মেল
গেজ থেকে বেরিয়ে ফিমেল গেজ কতটাই যে তৈরি হয়েছে। জানান দিতে ইচ্ছে করে। গর্ব হয়।
দেবারতি মিত্র থেকে আজকের সদ্য লেখা কবিতা অব্দি একগোছায় বাঁধতে পারলে দিব্য হত।
দেখা যাক। সময়, সুযোগ, সব কিছু দরকার। সঠিক পারস্পেকটিভে কাজটা না করলে
আবার সেই রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেচ্ছা সংকলন টাইপ হয়ে যাবে। সেটা তো আর হতে দিতে
পারা যায় না।
১৮) এই সাক্ষাৎকারের শেষ প্রশ্নে আসি এবার। এই যে তুমি
শরীরী উদ্ভাসের উল্লেখ করলে, অথচ চাইছো রঞ্জন বন্দ্যো না হতে, খুব কনফিউসিং
ব্যাপারটা। একজন মহিলা হয়ে শরীরী উদ্ভাসের আলোচনা শুরু করলেই, বেশ একটা ‘গেল
গেল’ রব উঠবেই। সে তুমি যতই সঠিক
পারস্পেক্টিভ নিয়ে আসো না কেন! আর তাতে যশোধরা রায়চৌধুরী হয়ত এক স্ক্যান্ডেল
সৃষ্টির উদ্ভাবক হয়ে গেলেন ইতিহাসে। এই জগতে এতদিন থাকার পর সুনাম নষ্ট হওয়ার ভয়
হয় না?
হয়ত থাকে। তবে অভিপ্রায় যদি স্পষ্ট ও সৎ হয়, যদি বাজার কাড়া নয়, অন্য কোন
আদর্শ সামনে থাকে, তাহলে বোধ হয় কেউ ভুল বোঝে না। মানুষ অতটা নিরেট নয়, যতটা আমরা
ভাবি। একজন পরিচালক কাদম্বরীর ওপর ছবি বানালেন, সেটা না হল ঝাঁঝাল গসিপ কলাম, না
হল ইতিহাস। এসব করে কী লাভ হয় বুঝিনা। তবে শিল্প এখন যা খুসি নিয়েই হতে পারে । বোধ
হয় সব শিল্পকেই আমরা এভাবে নামিয়ে আনছি বলে, এই প্রশ্নটা করার সুযোগ হচ্ছে। কিন্তু
ভাল কাজ, জরুরি কাজ, গবেষণামূলক কাজ কি হচ্ছে না? কবিতা তো শেষ পর্যন্ত কবিতাই।
শুধু তার মধ্যে একটা বিশেষ অংশকে আমি সম্পাদনা করে আলো ফেলতে চাই। যেভাবে অমিতাভ
দাশগুপ্ত “পৌরুষের কবিতা” সম্পাদনা করেছিলেন প্রতিভাস থেকে।
আর হ্যাঁ, নারীদের কবিতার দিকে আলো ফেলতে যেমন চাই, তেমন পুরুষের কবিতার
পৌরুষের দিকেও আলো ফেলা দরকার। লালনের এই সংখ্যায় অরিন্দম এই বিষয়ে আমাকে একটা
লেখা লিখতে বলেছিল। সেটার বিষয়ই এই। পুরুষের কবিতায় এখন মেয়েরা কী ভাবে আসছে?
একটা কথা বলি, এখন ম্যাচোদের যুগ শেষ, মেট্রোসেক্সুয়ালদের যুগ। এসব বলা হয়।
ফ্যাশন জগতে। কবিতা জগতেও পৌরুষ নেই। পৌরুষ এখন ইন থিং নয়। মাঝে মাঝে মনে হয়,
নস্টালজিয়ার বিষয় হয়ে যাবে পৌরুষের কবিতা। যেমন নস্টালজিয়ার বিষয় বাঙালির ছাত,
বারান্দা আর দুপুরের ভাতঘুম।
‘বাক’এর তরফ থেকে অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। এতদিন
আমাদের সাথে চলার জন্য। আমি এবং যাঁরা পড়লেন তাঁদের প্রাপ্তির ঝুলি ভরে উঠল,
নিশ্চিত। তোমার চলার পথ মসৃণ হোক, এই কামনা রইল। আর একটা আবেদন রাখি। নতুনদের
মাথায় তোমার হাতটা রেখো এভাবেই।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন