Pages - Menu

আনন্দ বাগচী

...আনন্দ বাগচী...
 (কাব্যগ্রন্থ-স্বগত সন্ধ্যা’” , তেপান্তর , ঊজ্জ্বল ছুরির নীচে ,
 বিস্মরণ, আড়ালে খেলছিল সে)


বাঁকুড়া থেকে ফোন এসেছিল অবনী নাগের। হ্যাঁ আনন্দ বাগচী সম্পর্কে সেই আমার প্রথম ও শেষ কারু সাথে কথা হওয়া। অবনী বাবু সেসময় স্মৃতিভ্রষ্ট পঙ্গু শয্যাশায়ী বিস্মৃত এক সাহিত্যিকের পাশে দাঁড়াতে আবেদন জানিয়েছিলেন। একটা সাংস্কৃতিক আলোচনাচক্রের মধ্যে দিয়ে যতটা পারা যায় অনুদান সংগ্রহ করে যাতে প্রকৃত চিকিৎসা শুরু করা যায় কবি সাহিত্যিক আনন্দ বাগচীর। কিন্তু তাতেও বাঁচানো যায়নি আনন্দ বাগচীকে। হালিশহরের বাড়ি থেকেই দীর্ঘ ছ বছরের শয্যাশায়ীতা ছেড়ে তিনি চলে গেলেন নীলচে সাদা উত্তরকালের কোনো এক দুষ্প্রবেশ্যতায়। যথারীতি শোকসভা স্মৃতিচারনে উঠে এল কবির সামাজিক ভূমিকা নিয়ে শতকথা, সাহিত্য নিয়েও পূর্ণমূল্যায়ন হল এবং তারপর তাঁর ছড়ানো ছিটানো লেখাগুলোকে জড়ো করে আমরা বললাম-ওই দ্যাখো ক্ষনজীবনের পাহাড়,ওইখানেই ছাপা হচ্ছে কবির পরিত্যক্ততা।

কিন্তু কেবল কবি কেন? ত্রিলোচন কলমচী বা শ্রীহর্ষ ছদ্মনামে যিনি লিখে গেলেন একের পর এক নিবন্ধ কিংবা কানামাছি, মুখোসের মুখ, বনের খাঁচায়, চকখড়ি র মত একাধিক উপন্যাস , এবং যিনি কৃত্তিবাস পত্রিকার অন্যতম কিংবা দীর্ঘদিন দেশ-এর মত বিপুল প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকায় যুক্ত ছিলেন সেই আনন্দ বাগচীকেও আমরা মিশে যেতে দেখলাম সমকাল থেকে শূন্যে। অর্থাৎ শাশ্বত বলে সত্যিই কিছু নেই। আগে ভাবতুম বিস্মৃতি নামের শব্দটা লিটিল ম্যাগের লেখক কবি কিংবা লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাওয়া অপ্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যিকদেরই একমাত্র ললাট লিখন কিন্তু আনন্দ বাগচীর মত প্রাতিষ্ঠানিক একজন বহুকলমীর ধীরে ধীরে একটানা জ্বলতে থেকে আকস্মিক ফুরিয়ে যাওয়া যেন বারবার মনে করিয়ে দেয় ক্ষণকালের জড়ত্ব অতিক্রমী কেউই নন। কিন্তু পুনরজ্জীবন ও পুনর্মূল্যায়ন অবশ্যই আছে এবং সেটা স্রষ্টার থেকেও সৃষ্টির, যা ভেসে থাকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের মাঝামাঝি কোনো এক ঘুরন্ত সময়চক্রে। না হলে আজ আনন্দ বাগচীর কবিতাগুচ্ছ বাকের হারানো কবিতায় সাজাতে সাজাতে যখন চোখে পড়ল কবি সেই কোন কালে লিখে গেছেন অনন্ত কালের ভাষা- জন্ম মৃত্যু নয়, শেষ কথা বুঝি চুপ করে থাকা- একদা বিস্মৃতপ্রায় কবিতাটির ওপরেই বসানো রয়েছে অবিকল একটি মহাকালীন অনুভবরঞ্জিত আদল। স্নায়ুমূর্চ্ছনার মত বিস্মৃতির অন্ধকার দরজা ফুঁড়ে যখন তার মধ্যে আমরা ফিরে ফিরে আসি তখন বুঝি এ গল্পটির যে পটভূমি তার কোনো শেষ ছিলনা, যিনি হারিয়েছেন তিনি আজ অন্ধকারে আর যিনি দেখছেন তিনি যেন আলোতে বসে দুজনে দুজনের ঋণ মেটাচ্ছেন শুধু।

পাবনা  জেলার স্বাগতা গ্রামে জন্ম তাঁর আর মৃত্যুর সময় ছিলেন এপার বাংলার হালিশহরে। আশি বছরের সামগ্রিক জীবনে এপার ওপার দু বাংলারই আজ হয়ত কেউ কেউ তাকে ঔপন্যাসিক কিংবা জমজমাট কিশোর সাহিত্স্রষ্ঠা হিসেবে কখনও সখনও স্মৃতিচারনা করেন, কিন্তু  কজন মনে রাখেন এই আনন্দ বাগচীর সাহিত্য জীবনের শুরু কবিতা দিয়েই ! চিরকালীন বাংলা কবিতার আলোচনাপ্রসঙ্গে কজনই বা উদ্ধ্বৃত করেন তাঁর অমোঘ পংক্তিদের! যেখানে আঁকা আছে একটি একা মানুষের ছবি , যে রাত জেগে পড়া করে লন্ঠনের স্তিমিত আলোয় আর পাখির বাসার মত ঘরে লুকিয়ে রাখে অস্তিত্বের চিরকালীন অনুনাদগুলি। এই একা মানুষের নাম কাউকে বলেননি আনন্দ, কোথাও লিখেও রাখেননি ,খালি আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে গেছেন সে তাঁর গোপণ কথা। এ গোপন কথা কি আমাদেরও নয়? আদিগন্ত জীবন মৃত্যুর খেলায় দাঁড়িয়ে আজও কি পৃথিবীর পথে পথে আমরা খুঁজি না সেই একা মানুষটিকে? হয়ত  হাজার লক্ষ্য নিযুত কোটি বছর পরে সে আমাদেরই সরল সন্তানদের ষড়রিপু বেয়ে বেয়ে উঠে আসবে একই স্বনন খুঁজে। আসলে এখানেই একটি কবিতার কবিতা থেকে কিংবদন্তী হয়ে ওঠা। স্বয়ং কবিতাটি নয় বরং তার মধ্যবর্তী ইমেজারি গুলোর সাথে কোথাও যেন এক ধরনের যুগোত্তীর্ণ টান এভাবেই ভেসে ভেসে ওঠে অতল থেকে। আনন্দ বাগচীর কবিতায় জীবনানন্দীয় ইন্দ্রিয়বেদত্তা লক্ষ্য করা গেলেও তাকে হয়ত সুররিয়ালিস্ট তকমা দেওয়া যায়না বরং বোধের চেয়েও সেখানে পংক্তির ফাঁকে ফাঁকে লেগে থাকা সচেতন চিত্ররূপময়তা মায়াবী জাদুবলে পাঠককে ধরে রাখে।ছবি প্রসংগে যামিনী রায়কে লেখা চিঠিতে একবার রবীঠাকুর লিখেছিলেন- ইন্দ্রিয়ের ব্যবহারে আমাদের জীবনের উপলব্ধি। এজন্য তার একটি অহেতুক আনন্দ আছে। চোখে দেখি- সে যে কেবল সুন্দর দেখে বলি, খুশি হই, তা নয়। দৃষ্টির ওপরে দেখার ধারা আমাদের চেতনাকে উদ্রেক করে রাখে। সে রূপের রেখা এড়াবার জো নেই। যা মনকে অধিকার করে নেয় কোন একটা বিশেষত্ব বশতঃ তা সুন্দর হোক বা না হোক, মানুষ তাকে আদর করে নেয়। তার তার চারদিকের সৃষ্টির ক্ষেত্রকে পরিপূর্ণ করতে থাকে।- আনন্দ বাগচীর প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই আমরা এমনই একটা করে দেখার প্রেক্ষাপট দেখতে পাই। তার চারপাশের সমস্ত পার্থিব সমস্ত প্রকৃতিকে কবি যে কেবল নিরীক্ষা করেছেন তা নয় বরং স্থল জল অন্তরীক্ষের একটা সম্পূর্ণ ক্যানভাস যেন তার বেশিরভাগ কবিতার পান্ডুলিপি হয়ে ঊঠেছে। এক একটা ছবি যার দৃশ্যগুন কেবল সময়ের নয় বরং আবহমানের দরখাস্ত জমা করে গেছে পাঠকের হাতেও। স্যানিটোরিয়ামের চিঠি কবিতায় আনন্দ বাগচী লিখলেন-   পনের নম্বর বেড খালি হল। আটমাস পরে আজ রাতে/ বিছানা সরানো হলো,চ্যাপ্টা, বেঁটে ওষুধের শিশি/ মেজার গ্লাসের পাশে সারি সারি সাজানো, শিয়রে/ রিপোর্ট টেবলখানা, এখনো রয়েছে, কাল ভোরে/ সমস্ত অদৃশ্য হবে, সাদা একটি চাদর বিছিয়ে/ মৃত্যুকে আবার ঢেকে দেওয়া হবে, নতুন মানুষ বাসা বাঁধবে ; আবার অন্যমনে কবিতায় তিনি লিখলেন- পড়েছ অস্ফুট ছায়া মুখে চোখে পিছল বুকের/ঘাটে ঘাটে, যৌবনের বেলা যাচ্ছে কাজলা দীঘির/ জল কাঁপছে থিরথিরিয়ে , জলে ঢেউ দিও না, দিও না,/ দোলন চাঁপার মত একটি সুখের /ছায়াকে ভেঙ্গো না তুমি এই পাতাঝুরির শিশির- জীবন থেকে মৃত্যু সমস্ত রংগুলোকেই যেন যত্ন করে অক্ষরে বিন্যাস করেছেন আনন্দ। তাঁর কাব্যের নিবিড় পাঠে আমরা একধরনের প্রতীকবাদ লক্ষ্য করতে পারি যেখানে কবি গন্ধকে স্পর্শে স্পর্শকে দৃশ্যে দৃশ্যকে শব্দে শব্দকে ধ্বনিতে পরিনত করেছেন অনায়াসে, যার ফলে অক্ষরের মাঝে উঠে আসে দৃশ্যের প্রত্যক্ষতা। প্রতীকের মধ্যে দিয়ে তিনি যে জীবনকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন সেখানে রয়েছে অনুভূতির বিপুলতা; আর এই দৃশ্যান্তরের শেষে এসে পাঠকও যেন জীবনের মধ্যে তলিয়ে যাওয়ার রসদ খুঁজে পায়; শুরু হয় কবিতার পুনরুজ্জীবন।

সেই যে মনীন্দ্র গুপ্ত বলেছিলেন না-উৎকৃষ্ট কবিতার দুর্মর জীবনীশক্তি অনেকটা যেন সেই বিশুষ্ক পদ্মবীজের মতো, যা হাজার হাজার বছর পরেও অনুকূল ক্ষেত্রে পুঁতলে আবার বেঁচে ওঠে, ফুল ফোটায়-হয়ত আনন্দ বাগচীর বিস্মৃতপ্রায় এসব কবিতার কাছেও যোগ্য পাঠক ফিরে ফিরে আসবে একদিন নতুন অনুসন্ধান নিয়ে নতুন পূনর্মূল্যায়ন নিয়ে। হয়ত সেদিন ভুল প্রমানিত হবে কবির নিজেরই পংক্তি- তোমার ভেজানো দরজা ঠেলে/ কেউ আসবে না,বোকা, কেউ কি নিজের কাজ ফেলে/ খেয়ালের কথা রাখে?” 

(ভাষ্য ও উপস্থাপনা : রমিত দে)
                                                                                 


গলি

হিংস্র অন্ধকারের জঠরে
পাক খায় অতটুকু গলি ; সেই গলির কোটরে
বন্দী এক পাখির জীবন !
ছোট পাখি । ডানা নাড়ে কোনমতে বাঁচার মতোন ।

আকাশে অনেক তারা। ঝিকিমিকি জোনাকি প্রহর !
এখানেও ছোট ঘর । আর সেই পাখিটার কেঁপে যাওয়া স্বর ।
অনেক আলোক বর্ষ ঘুরে
সময় উড়িয়ে যায় হিমঝুরি হাওয়া ফুরফুরে !
এ আকাশ উড়ে যায় সূর্য ছুঁয়ে আরেক সূর্যতে ;
ভাড়াটে খাঁচার কোণ হতে ;
পাখির চিকন ডাক নাম হতে নামে উড়ে যায় ।

গর্ভিনী গলিটা ঘামে হিমেহিমে শীতের সন্ধ্যায়
গুমোট গোঙানিটুকু ঝাপটায় ডানা
অবিকল ছোট এই পাখির মতোন রাতকানা !
আমি সেই পাখি,
বধির আস্বাদ বাঁধি একটি নিবিড় নীড় মনে মনে নাকি !


বকুল-জ্যোৎস্না

তারা শুধু ফিরবে না, শিলাবতী পৃথিবীর রাত
সময়ের শব-ছায়া বুকে বয়, জোনাকির পাখা
শোনা যায় জ্যোৎস্নায় পুড়ে গেছে, সুখচোরা হাত
অঘ্রাণের অন্ধকারে ঘেমে ঘেমে ফিরে গেছে ফাঁকা ।
কিছু সে পায়নি জানি, কিছু তার জমেনি সঞ্চয়
জীবনে বলার মত, রাত্রি জাগা বৃথা গেছে তার
এ রকমই মনে হয়, তবু সে নিজেকে করে ক্ষয়
বসন্তে শরতে হিমে ভরা-বাদরের রাতে আর ।

তারা শুধু ফিরবে না; বর্ণ-বৃত্তে ঘিরেছিল যারা,
গন্ধসুরা ওষ্ঠে তুলে ধরেছিল যারা কোন রাতে,
স্বাদিত সে সন্ধ্যারাগ আজ নেই, হল শ্রান্ত ধারা
শ্রাবণের মেঘ, জানি কেউ হাত রাখবে না হাতে।
সে-ফাল্গুনী মুছে গেছে, মাঘ-ম্লান কুয়াশার রাতে
তবু বুকে গান, কবি, বেঁধে নাকি বকুল-জ্যোৎস্নাতে ?                                         

তারা নেই

এই সব দ্রুতপদ পথের বিনুনি ভেঙে আমি
সারারাত ঘুরে ঘুরে দূরে কাছে অসংখ্য সর্পিল
স্নায়ুর ঝংকার-শ্লথ অলিগলি হেঁটে হেঁটে শুধু
আমার পিছনে এক বকুল-ব্যাকুল দীর্ঘশ্বাস
অনুভব করে গেছি, ছদ্মবেশ উন্মোচন কামী
অন্ধমীড়ে ভেঙে-পড়া শরীরের শিথিল আক্ষেপ
চোখ-ঠাসা ঘুম নিয়ে গ্যাসের পান্ডুর আলেয়ায়
সারারাত কাঁদে মন,কাঁদে রাত, ক্লান্তির করাতে
রক্তাক্ত প্রহর সব কৃষ্ণচূড়া হয়ে ফুটপাথে
ঝরে পড়ে রাতে ।।

দক্ষিণের বারান্দায় আসমানী শাড়ির আঁচল
আর নেই, মেয়েটার চুল গেছে কবে সময়ের
অন্ধকারে মিশে , আজ বাড়ির নম্বরে নেই প্রাণ
সময়ের সিঁড়ি বেয়ে ভাড়াটের দল নেমে গেছে
বিলুপ্তির গূঢ়-গর্তে। দ্বিপ্রহরে আজো ডাকে কাক
হয়ত বা ঠিক সেই নিমের ডালের পরে। রোদ
আশ্বিনে এখনো বুঝি গান হয়, ট্রামের লাইন
দাম্পতিক অবসাদে থেমে থাকে রাত্রির তলায়।
উত্তর চিৎপুরে এলে ঘুমছুট ত্রস্ত মাতালের
ক্লান্ত অসমাপিকা; দেয়ালে দেয়ালে
তান্ত্রিক যুবকের ইস্তাহার আঁটা হাত বুঝি
ক্লান্ত নয়, জানালায় আজো কোন কবি
কলমে গড়ায় কথা, ঘুম-কন্যা স্বপ্ন দ্যাখে রোজ !
(সব আছে, ঠিক আছে, তারা নেই । তারা শুধু নেই !)

কালিঘাটের পট

বাণিজ্যে ডুবেছে নৌকো; মাথা নিচু অন্ধকার ঘ এ
সমর্থ বধূর বুকে পিদিমের আলো এসে পড়ে,
অশ্লীল খেউড়ে ভাসে চতুর্দিক, ঘরের পিছনে
নোংরা পাক, কচুবন,বুনো মশা, প্রথম যৌবনে
ঝুঁকে পড়লে ছায়া পড়ে কুয়োতলায়; বুকচাপা জল,
মন্দিরে কাঁসর ঘন্টা, লম্পট কলকাতা কাছে এলে
বিষন্ন ছবিতে ভরে বলিরেখা, বিবর্ণ পীতল
দেখবে, আঁচলে কাঁচ, অসাবধানী সোনা গেছে ফেলে ।

পটের ঠাকুর মুছে নট-নটী,পদ্মের পাতায়
ঘরোয়া চোখের জল, খুলে দেখি দরজার খিল
ব্যঙ্গের পঞ্চম শর, দুঃসাহসী নগর-নকশায়
বিচিত্র সংলাপে বাঁধা দাঁড়ে টিয়ে, খাঁচায় কোকিল,
বাণিজ্যে ডুবেছে নৌকো। কেঁদে হেসে কিংবা ভালোবেসে
বস্তুত সবাই মূর্খ তমস্বিনী বেদনায় এসে ।।


তাসের কান্না

চারখানা সাদা তাস একটি ভয়ের গল্প নিয়ে
রোজ রাতে খেলা করে, যখন সবুজ আলোটাও
নিভে যায়, ছাপা সুখ-দুঃখ নিয়ে বইয়ের কপাট
বন্ধ হয়, অন্ধকারে , তখন একটি মেয়ে তার
খোলা বুকে হাত রেখে সোনালী সাপের কথা ভাবে।

মৃগয়ার মত তার মনে মনে সারারাত কার
অশান্ত পায়ের ধ্বনি নগ্ন বেদনায় খেলা করে,
আকাশে জ্বলন্ত চাঁদ লাল অঙ্গারের মত স্থুল,
প্যাঁচা ডেকে যায় দূরে সীমাহীন রোমাঞ্চিত স্বরে।
বিছানাটা দিশেহারা লবণসমুদ্র চারপাশে।
এই সমুদ্রের কূলে অমনস্ক আঠার চৈত্রের
একটি পিপাসা ছিল, দ্বীপের মতন এই ঘরে,
অরণ্যের সন্মোহন, তবু তার বেলা চলে গেল,
চারখানা সাদা তাসে জীবনের অনেক সঙ্কেত
চোরা আলো ফেলে গেল, বাইরে আঠারো অন্ধকার।
শুভ্র বুকে রাঙা নখ আপন আত্মার ছবি দেখে
চমকে গেছে, মনে মনে সরীসৃপ আত্মলুন্ঠনের
রমনীয় ব্যাকুলতা, কান্নার করুণ নদী লীন
তার ভীরু কটির প্রান্তরে । দুঃখ কী যেন না পেয়ে।
সোনালী সাপের কথা তাই ভাবে একা একা শুয়ে ।

এবং তারপর

জন্ম মৃত্যু নয়, শেষ কথা বুঝি চুপ করে থাকা ।

এবং তারপর আর কিছু নেই চিত্রাপিত ফাঁকা
কখনো আকাশ হয়, কখনো বা পৌত্তালিক মন,
একটি গল্পের শেষে আর একটি গল্পের বরণ,
জীবনের এই রীতি এক মহাশূন্য পটভূমি
তোমাকে আমাকে করে তোলে সেই প্রিয়তম তুমি ।

দুঁহু কোরে দুঁহু কাঁদি, অতলান্ত বিচ্ছেদের জ্বালা
একজন ছিঁড়ে ফেলে, আর একজন গাঁথে মালা ।

একজন অন্ধকারে ,অন্যজন আলোতে বসেছে
দুজনেরি রয়ে গেল দুজনের কাছে বহু ঋণ ;
মৃত্যু বারবার এই জীবনের মুখ চেয়ে বাঁচে
দিনের হৃদয়ে রাত্রি রাত্রির হৃদয়ে কাঁদে দিন ।



সাতটি তারার তিমিরে

একদিন এমন সময়
আবার আসিয়ো তুমি,- আসিবার ইচ্ছা যদি হয়।-

আসেনি সে। ভাবলাম , এই যে প্রতীক্ষা করে থাকা
বিপ্রলব্ধ বেদনায়, অলি-গলি গল্পের শহর-
অশ্রুলভ্য ছবিঘর, মৃত্যুর মতন এরা ফাঁকা
মৃত্যুর মতন এরা ম্লানকান্তি, কান্নার প্রহর ।

দোর ঠেলে দমকা হাওয়া, আসেনি সে, শহরের মন
কেউ ভেবে চমকালো, কেউ না,কিছু না, তবু যদি
আসতো সে, তার জন্যে এই ঝরা পাতার শ্রাবণ
বেদনায় দেউলে হয়, ল্যান্সডাউন রোড হয় নদী ।

মাঝরাতে মোম জ্বেলে জাগা পায়ে যে মানুষ পায়চারি করে
তার ছবি,
যার চোখে সারারাত্রি শিশিরের জল জমে মাঠের কান্নায়
তার ছবি,
পৃথিবীর অতি তুচ্ছ সামগ্রীতে লোভ যার গোপন বিস্ময়
তার ছবি ...
আজ বুঝি এত ছবি শেষ হলো, হাজার বছর ধরে কেউ
রাত্রির পৃথিবী দিয়ে হাঁটবে না, লবনাক্ত ঢেঊ
আর কারো রক্তের সমুদ্রে জাগবে না,
আর কেউ জেগে-জেগে দূর-অধ্যায়ী গান করবে না ।
আমার তো জানা নেই, কালের ভ্রুকটি ভঙ্গ করে
আর কোনো দুঃসাহসী আছে কিনা দুই চক্ষু ভরে
প্রাকৃতিক স্পর্ধা যার অফুরন্ত, অন্ধকার জলের মত্ন
স্নিগ্ধ যার মন ।
যেপারে হেলায়
নেমে এসে যোগ দিতে আদিগন্ত মৃত্যুর খেলায়।

আসেনি সে ।  ভাবলাম পাতার মর্মরধ্বনি শুনে,
সে আসে না তবু কাঁপে ল্যান্সডাউন রোডের আকাশ,
সবুজ গেলাস ধরে ঘাস,
পৃথিবীরা ঘরে ফেরে, নীল খেত ভরে থাকে তারার আগুনে ।

ভীরু

ছায়াভীরু সিঁড়িটার স্তব্ধবুকে পা ফেলে পা ফেলে
কোথায় পালাবে তুমি অন্ধকারে, বুকের ইজেলে
লুকিয়ে পুরোনো ছবি, বেদনার পরমায়ু, সুর ?
কালের পুতুল তুমি, পায়ে বাঁধা মৃত্যুর নূপূর।

ভালোবাসা দুঃখময়, তোমার ভেজানো দরজা ঠেলে
কেউ আসবে না, বোকা, কেউ কি নিজের কাজ ফেলে
খেয়ালে কথা রাখে? শুধু তোর পথে কাঁদে ধূলি,
ঘাসের চপ্পলে লাগে বিকেলের রোদ্দুরের তুলি !

ওপারেতে বৃষ্টি এলো, ঝাপসা গাছপালা, উপন্যাসে
দূরের অধ্যায় খোলা, এ-পারেতে কে-আসে কে-আসে
প্রতীক্ষার স্তব্ধছায়া। তোমার আশ্চর্য তাসঘরে
ব্যথার ভোমরা এলো কি গুনগুনিয়ে, ভয় করে !

আমি তো অসংখ্যাবার ভীরু, তাই তুমি তাকে বোলো
কেউ এলো, কেউ গেলো, চোখের জলের শব্দ হলো ।।

স্মৃতি

ছবি আঁকতে জানা থাকলে ভাল হত কিচ্ছু হারাতো না,
যে সব স্টেশন গুমটি, দূর জানালা ডাকঘরের মত,
চোখের সামনে দিয়ে ভেসে গেছে,হলুদ দুপুর-
জংশনের হিজিবিজি, শান্টিংইয়ের অদৃশ্য আওয়াজ
মফস্বল চিলেকোঠা, বুকখোলা আচমকা পুকুর ,
দূরন্ত পেন্সিল-স্কেচে ধরা পড়ত এরিয়ালের কাক
আকাশ উপুড় করা ঘনবর্ষা, ম্যাজিক লন্ঠন,
উনবিংশ শতাব্দীর স্মৃতিচিহ্ন পালকির বধূটি
চলচ্চিত্র হয়ে উঠত নোট খাতার গোপন পাতায়।

লেখার অভ্যেস থাকলে এসব ছবির টিপছাপ
কালিতে ফুটিয়ে রাখা চলত ঠিক শিলমোহর করে
প্রতিটি পৃথক দিন প্রতিটি পৃথক বেদনার,
গল্পের খামের মত, ধরে রাখতো রহস্য সকল,
স্মৃতির ভিতরে কারা আছে, কারা এসেছিল, গেছে ।
চশমার কাচের মধ্যে বিশাল দিগন্ত গলে যায়
দূরের দরজায় কার শেষবারের মত টোকা পড়ে
ট্রাফিক সিগন্যাল তার রং বদলায় ডাইনে বাঁয়ে
এক ফোঁটা জল পরে ঝাপসা করে দিতে সব পথ ।।

উত্তর

উত্তর পেয়েছি আজ, অন্ধকারে তাই একা দাঁড়িয়ে রয়েছি,
পৃথিবী এখন বড়ো ক্ষুদ্র নিঃশেষিত মনে হয়,
মানুষের শবযাত্রা চতুর্দিকে
                                                নিঃশব্দ রঙীন শেষ তাস
যাকে ভালোবাসা ভেবে বাঁ-হাতে রেখেছি সঙ্গোপনে
এতদিন পরে তাকে ফেলে যেতে হবে, নীচে
                                   লোকচক্ষু হুমড়ি খেয়ে আছে ।
নারী তৃপ্তিহীন জাগে পুরাতন আকাঙ্খার কাছে
দুরারোগ্য, মূর্খ আত্মঘাতী তার মনের অসুখ
স্বপ্নহীন অনিদ্রায় দ্রুত ঘোরে
                                   সব প্রতিশ্রুতি ফেলে যায়
সব স্মৃতি, সব গল্প,সমস্ত কাহিনী, নির্জনতা
ক্লান্ত লাগে, পৃথিবীতে শেষ বার বড়ো ক্লান্ত লাগে ।
হয়ত কালিন্দী কালো,রাত্রি কালো, যমুনার জল
কালো সবচেয়ে কালো কে যেন আমার পাশে
চোখের জলের মত ছিল,

যন্ত্রনার পরিভাষা গুটিকত অন্ধতম অন্ধকার রেখা
অভ্যস্ত শরীরে ঘোরে সারারাত্রি জন্মমৃত্যু নামে ।
কতবার রোমাঞ্চিত, কতবার স্তম্ভিত হয়েছি,কতবার
হাতের মুঠোর মধ্যে শূন্যতার রেখাচিত্র দেখে
ভাগ্যরেখা, আয়ূরেখা, আরো কত অর্থহীন রেখা ।
দিনের খাঁচায় রয়না নানা রঙের বিচিত্র দিনগুলি,
আকাশের রাশিচক্রে গুঞ্জরিত ভ্রমরের পাখা
লেগে থাকে । প্রেম কাকে বলে আজ কেউ তা জানে না,
ঈশ্বর ঠিকানাহীন,নিঃসঙ্গতা ঈশ্বরের মত
বুকের গভীরে যেন মাঝে মাঝে অনুভব করি।

                     ২
বহতা পৃথিবী তবু অন্তহীন নরনারী নিয়ে
আলোকিত অন্ধকারে প্রবাহিত হবে,হয়ত বা
ভাঙে না গল্পের ঘর চিলেকোঠা, সমস্ত রমনী,
সমস্ত বিশ্বাস, কিছু নষ্ট নয়
                                   পদ্মপাতার চঞ্চল স্মৃতি না ।
উত্তর পেয়েছি আজ । অন্ধকারে একা তাই দাঁড়িয়ে রয়েছি ।।







1 টি মন্তব্য:

  1. আনন্দ বাগচী কে তো হালিশহরে অপমানিত করা হয়েছিল ।।

    উত্তরমুছুন