[গল্পের প্রাচীনত্বে ফিরে গিয়ে লেখিকা
নীতিকাহিনীর ধারায় লিখন-জীবন, আধ্যাত্মসাধনা এবং প্রকৃতিলোকের সংযোগসূত্র থেকে ত্রিবিধ
এক আঙ্গিক তৈরি করেছেন যা তার সাবলীল পুরাতনত্বে গল্পনায় এক নতুন মাত্রা যুক্ত
করবে, আশা করা যায়। ]
একজন সাধুর গল্প
নভেরা হোসেন
ন
কর্মণামনারম্ভানৈষ্কর্ম্যং পুরুষোহশ্নুতে।
ন
চ সংন্যসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি।।
একজন
সাধুর গল্প। এখন
তাকে সাধু বা সন্ন্যাসী যে নামেই ডাকা হোক না কেন এটা তার পিতৃপ্রদত্ত নাম নয়। সে নাম এখানে উহ্য থাকল।
প্রতিদিন
ঘুম থেকে জেগে নিখুঁতভাবে আহ্নিক করার পর সাধুজী প্রাতঃভ্রমণে বের
হন। গ্রামের আলপথ ধরে মাইলের পর মাইল পথ
হাঁটেন তিনি। এসময়
তার চোখ জোড়া তরুণ উদ্ভিদের জেগে ওঠার দৃশ্য অবলোকন করে। বিষয়টি খুব সাধারণভাবেই ঘটে। এজন্য তাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে নবীন
কিশলয়দের লক্ষ্য করতে হয় না। বহু বছরের
অভিজ্ঞতায় সাধুজী বুঝতে পারেন বর্ষা অত্যাসন্ন, তারই চিহ্ন ফুটে উঠেছে
প্রান্তরে।
দ্বিপ্রহরের
প্রারম্ভে সাধুজী সবুজ গাছপালাবেষ্টিত গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। সেখানে বয়োজ্যেষ্ঠ একজন নারী তাকে ফল,
দুধ দিয়ে আপ্যায়ন করে। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলার জন্য তিনি কুয়োর ঠাণ্ডা জল দিয়ে স্নান সারেন। অতঃপর শুরু হয় নাম, জপ, তপ। এসময় সাধুজী কারো সাথে দেখা করেন না। শুধুমাত্র মধ্যাহ্নের সূর্য কিছুটা
পশ্চিম দিকে ঝুঁকে পড়লে- ধ্যান ছেড়ে আমিষ-বর্জিত আহার গ্রহণ করেন। এরপর কিঞ্চিৎ বিশ্রাম শেষে
শুরু হয় দর্শনার্থীদের আনাগোনা, আনুষ্ঠানিক
পর্ব।
শোনা
যায় সাধুজী যৌবনকালে একজন প্রতিভাবান লেখক ছিলেন। এখনও পাঠকরা এখানে সেখানে
তার লেখা দেখতে পায়। লেখক
জীবনের এক পর্যায়ে ভোগের চূড়ান্ত শীর্ষে আরোহণ করার পর হঠাৎ একদিন তার মনে হয়,
এর সবটাই যেন অর্থহীন,
দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর
পুনরাবৃত্তি। উপভোগ
তাকে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলেছে যার পরিণতি একমাত্র ধ্বংস। নিজেকে এই আত্ম-বিধ্বংসী প্রবণতা থেকে
রক্ষা করার জন্য তিনি বস্তু ও অ-বস্তুগত যাবতীয় সম্পর্ক ছেদ
করে সন্ন্যাস দর্শনে দীক্ষা নেন। যদিও এসময় তার মন মারাত্মক সব
ধ্বংসাত্নক প্রবণতায় আচ্ছন্ন ছিল। সাধুজী কঠোর
হাতে বিষবৃক্ষগুলোর উৎপাটন ঘটান। নিজ
হাতে জমি তৈরি করে রোপণ করেন অশ্বত্থ, বিল্ব।
এভাবে
কিছুদিন জ্ঞান, ধ্যান করার
পর সাধুজী পরিভ্রমণে বের হন। মন্দির,
মসজিদ, আশ্রম সর্বত্রই তার পদচারণা। কিন্তু কোথাও গিয়ে তিনি শান্তি পান না। সর্বক্ষণ তার মনে হতে থাকে একমুহূর্তের
জন্যও তিনি লোভমুক্ত, শূন্যকামী
হতে পারেননি। আপাতভাবে
তার শিরা-উপশিরায়
কোনো মেদবহুলতা না দেখা গেলেও সারাটি সময় যেন কাটছে অবদমনের মধ্যে। মন থেকে বিষ-বৃক্ষের উৎপাটন ঘটলেও শরীরে
তার চিহ্ন রয়ে গেছে। সাধুজী মনে
মনে ভাবেন, এত
সহজ নয়, যে
বস্তু তোমাকে জ্ঞানশূন্য করে তুলেছে তার তেজ তো সহজে মরবে না, তাই রোজ রাতে আফিমের কড়া নেশায় ঘুমিয়ে
থাকেন। কোনো সুস্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন এসে যেন তাকে
দিগভ্রান্ত না করে সেজন্য তিনি নিজেকে আত্ম-সম্মোহনের মাঝে নিমগ্ন রাখেন। কিন্তু বিধি বাম। কিছুতেই যেন ইপ্সিত বস্তুর
সন্ধান মেলে না। তার
জন্য চাই পরিশ্রুত জল কিন্তু কোথায় পাবেন সে
অমৃত ধারা? জীবন তো তাকে শুধু নিতেই শিখিয়েছে,
ভাণ্ডার যে শূন্য। রুক্ষ উষর প্রান্তরে যত নিড়ানিই দেয়া হোক কোনো
উদ্ভিদ সেখানে জন্মায়না । অবশেষে
তিনি তার
সাধুত্বও ঘুচালেন। প্রাত্যহিক
জীবনের টানাপোড়েন তাকে যেমন অসহিষ্ণু করে তুলেছিল, তা থেকে বের হওয়ার চেষ্টাটিও তেমনই
ক্লান্তিকর হয়ে উঠল।
সাধুজী
জীবনের ঘন আবেশিত পর্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন, হয়তো তিনি সে অবস্থা থেকে কিছুটা সরেও
গিয়েছিলেন।
অন্তত লোকসাধারণ তো
তাই মনে
করত। এমন কী সাধুজী নিজেও তেমন ভাবতে শুরু
করেছিলেন। কিন্তু তিনি হয়তো জানতেন
না জীবনের প্রাত্যহিকতা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেই বস্তু লাভ হয় না, সেজন্য কোনো কৌশল অবলম্বনেরও প্রয়োজন
নেই। হয়তো সুরটি সাধকের মনেই প্রোথিত
রয়েছে। আর যদি তা না থাকে তাহলে, পাথুরে ভূমিতে যত খননই করা হোক, জলের দেখা কখনও মিলবে না।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন