একটি ছোট পত্রিকার প্রকাশ আজ এই ২০১৪-এ আর আগের মতো হতে পারে না। এই পরিসর আর আগের মতো নেই। এখন একটি ছোট পত্রিকা যদি প্রকাশিত হয়, প্রথম প্রশ্ন উঠবে জনসংযোগ নিয়ে। একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয় জনগণের কাছে পৌঁছনর জন্যই। এলিট পত্রিকাগুলো সাধারণ পাঠককে গুরুত্ব দেয় না। আজ এলিট পত্রিকাগুলো তাই মরণাপন্ন। তারা একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখার উন্নাসিক ও হাস্যকর প্রয়াস করে চলেছে। লেখক সাধারণ মানুষের হয়ে না-ও লিখতে পারেন, কিন্তু একটি পত্রিকার উপায় থাকে না সাধারণের দরবারে গিয়ে না দাঁড়ানোর। বর্তমান পরিসরে একজন লেখক একটি ছোট পত্রিকাকে লেখা দিয়ে প্রশ্ন যদি করেন সেই পত্রিকা কতজন পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে, তিনি কি অন্যায় করবেন? অনেকে বলবেন তিনি অন্যায় করছেন। কিন্তু কেন? একটি পত্রিকা তার আখ্যায় ‘লিটল’ আছে বলেই কি সংকুচিত রাখবে নিজের বিস্তারকে? কেন সে ছড়াতে চাইবে না, উদ্যোগী হবে না?
অবশ্যই এখানে বাজারের কথা ভাবা হচ্ছে না। আমাদের এখানে সাহিত্যের কোনো বাজার নেই। বড়ো কাগজ ততটা লেখার জোরে চলে না, যতটা বিজ্ঞাপনের জোরে। সৎ বিপননের কথা বলছি। কিন্তু লেখাটা যত বেশি লোক পড়বেন, লেখাটার প্রাসঙ্গিকতা ততই বাড়বে। বহু মূল্যবান লেখা বহু পত্রিকায় অপচয় হয় শুধু এই কারণে যে পত্রিকাটি হয়তো মাত্র একশ বা দেড়শ কপিই ছাপা হয়েছিল, এবং তার গরিষ্ঠাংশ সম্পাদকের বাড়িতেই পড়ে থেকেছে, তিনি প্রকাশ করেই সুখী। আলস্যবশে বা নিজ ব্যস্ততায় বিতরণ বা বিপননে মনোযোগ দেননি। এই সংখ্যার দিকে যথাযত দৃকপাত না করেই পত্রিকাটি পরের সংখ্যার দিকে এগিয়ে গেছে তার বদলে। এরকম ঘটনা বিরল নয়। অবশ্যই কোন সিরিয়াস লিটল ম্যাগ এরকম কদাপি করে না। কিছু পত্রিকা করে, তাদের বিশ্বাস করে লেখককে ঠকতে হয়।
এই আন্তর্জালের যুগে লিটল ম্যাগাজিনের সামনে এক অনন্ত সম্ভাবনা খুলে গেছে। আজ একটি লিটল ম্যাগাজিনের আদর্শ স্থান হল আন্তর্জাল। এ আমি বিশ্বাস করি। আমার যতদূর অভিজ্ঞতা, অর্থের কারণে বা দূরত্বের কারণে বা যোগাযোগের কারণে একটি আন্তর্জাল পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায় না, তার অকালমৃত্যু ঘটে না। যদি সে মরে, তাহলে পত্রিকার জন্মদাতাদের আগ্রহ, ধৈর্য, এবং অধ্যবসায়ের দৈন্য ছাড়া অন্য কোনো কারণ থাকে না। ঠিক ওই কারণেই অনেক কবিতালেখকও কবিতা লেখা ছেড়ে দিতে পারেন।
একটি লিটল ম্যাগাজিন, সে কাগজের হোক বা আন্তর্জালিক, একটি যুদ্ধের কাহিনি বলে। একটি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদককে অনেক অশ্রু-রক্ত-স্বেদের মোচন করতেই হয়। কোনো পরিসরেই এই ছবিটা বদলাবে না। কেউ কেউ বিনিময় প্রথার জন্য পত্রিকা করেন। বিখ্যাতদের লেখা ছেপে তাঁদের খুশি করা, অন্যের লেখা ছেপে নিজের লেখা ছাপা হওয়ার ধারাবাহিক সুযোগ তৈরি করা, আমাদের বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিন কাগজে বা আন্তর্জালে এই ধর্মগুলো পালন করেই। এটা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই।
লিটল ম্যাগাজিনের জন্ম হয় কবচ ও কুন্ডল সঙ্গে নিয়েই। কিন্তু ভাসতে হয় অনিশ্চিতে। ভাগ্য তার সাথ দেয় না। লড়াইটা থাকে প্রয়াসের। প্রয়াস প্রয়াস আর প্রয়াস। হয়তো রথের চাকাটা বসেই যায় শেষ অবধি, কিন্তু তাতে কোনো অগৌরব থাকে না। আমি একাধিক সম্পাদককে চেনার এবং তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সৌভাগ্য লাভ করেছি। দেখেছি তাঁদের জীবনে মালিন্যের কোনো অবকাশ নেই। তাঁদের সম্পাদিত পত্রিকা আর তাঁরা কখন যেন অভিন্ন হয়ে গেছেন। আজ তাঁদের পত্রিকার নামেই তাঁদের ডাকা যায়। আমি এমন সম্পাদককেও চিনি যিনি পত্রিকার জন্য নিজের লেখা ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ জিজ্ঞাসা করতে বলেছেন,‘আমি যদি লিখি পত্রিকার জন্য কিছু কম্প্রোমাইজ করতে হবে। যে কাগজে আমি লিখব, সেই কাগজের সম্পাদক যদি আমার পত্রিকায় লেখা পাঠায়, আমি যদি লোভ সামলাতে না পারি? তাই লেখা ছেড়ে দিলাম।’
এই লোকেদের আমি দেখেছি, তাঁদের স্নেহ পেয়েছি, এ ছাড়া আমার কোনো বিদ্রোহ নেই।
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুন