• কবিতা সুর্মা


    কবি কবিতা আর কবিতার কাজল-লতা জুড়ে যে আলো-অন্ধকার তার নিজস্ব পুনর্লিখন।


    সম্পাদনায় - উমাপদ কর
  • ভাবনালেখা লেখাভাবনা


    কবিতা নিয়ে গদ্য। কবিতা এবং গদ্যের ভেদরেখাকে প্রশ্ন করতেই এই বিভাগটির অবতারণা। পাঠক এবং কবির ভেদরেখাকেও।


    সম্পাদনায় - অনিমিখ পাত্র
  • সাক্ষাৎকার


    এই বিভাগে পাবেন এক বা একাধিক কবির সাক্ষাৎকার। নিয়েছেন আরেক কবি, বা কবিতার মগ্ন পাঠক। বাঁধাগতের বাইরে কিছু কথাবার্তা, যা চিন্তাভাবনার দিগন্তকে ফুটো করে দিতে চায়।


    সম্পাদনায়ঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়
  • গল্পনা


    গল্প নয়। গল্পের সংজ্ঞাকে প্রশ্ন করতে চায় এই বিভাগ। প্রতিটি সংখ্যায় আপনারা পাবেন এমন এক পাঠবস্তু, যা প্রচলিতকে থামিয়ে দেয়, এবং নতুনের পথ দেখিয়ে দেয়।


    সম্পাদনায়ঃ অর্ক চট্টোপাধ্যায়
  • হারানো কবিতাগুলো - রমিতের জানালায়


    আমাদের পাঠকরা এই বিভাগটির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন বারবার। এক নিবিষ্ট খনকের মতো রমিত দে, বাংলা কবিতার বিস্মৃত ও অবহেলিত মণিমুক্তোগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে আনছেন, ও আমাদের গর্বিত করছেন।


    সম্পাদনায় - রমিত দে
  • কবিতা ভাষান


    ভাষা। সে কি কবিতার অন্তরায়, নাকি সহায়? ভাষান্তর। সে কি হয় কবিতার? কবিতা কি ভেসে যায় এক ভাষা থেকে আরেকে? জানতে হলে এই বিভাগটিতে আসতেই হবে আপনাকে।


    সম্পাদনায় - শৌভিক দে সরকার
  • অন্য ভাষার কবিতা


    আমরা বিশ্বাস করি, একটি ভাষার কবিতা সমৃদ্ধ হয় আরেক ভাষার কবিতায়। আমরা বিশ্বাস করি সৎ ও পরিশ্রমী অনুবাদ পারে আমাদের হীনমন্যতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরটি সম্পর্কে সজাগ করে দিতে।


    সম্পাদনায় - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
  • এ মাসের কবি


    মাসের ব্যাপারটা অজুহাত মাত্র। তারিখ কোনো বিষয়ই নয় এই বিভাগে। আসলে আমরা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কবিকে নিজেদের মনোভাব জানাতে চাই। একটা সংখ্যায় আমরা একজনকে একটু সিংহাসনে বসাতে চাই। আশা করি, কেউ কিছু মনে করবেন না।


    সম্পাদনায় - নীলাব্জ চক্রবর্তী
  • পাঠম্যানিয়ার পেরিস্কোপ


    সমালোচনা সাহিত্য এখন স্তুতি আর নিন্দার আখড়ায় পর্যবসিত। গোষ্ঠীবদ্ধতার চরমতম রূপ সেখানে চোখে পড়ে। গ্রন্থসমালোচনার এই বিভাগটিতে আমরা একটু সততার আশ্বাস পেতে চাই, পেতে চাই খোলা হাওয়ার আমেজ।


    সম্পাদনায় - সব্যসাচী হাজরা
  • দৃশ্যত


    ছবি আর কবিতার ভেদ কি মুছে ফেলতে চান, পাঠক? কিন্তু কেন? ওরা তো আলাদা হয়েই বেশ আছে। কবি কিছু নিচ্ছেন ক্যানভাস থেকে, শিল্পী কিছু নিচ্ছেন অক্ষরমালা থেকে। চক্ষুকর্ণের এই বিনিময়, আহা, শাশ্বত হোক।


    সম্পাদনায় - অমিত বিশ্বাস

যশোধরা রায়চৌধুরী

৫। তুমি এবার তোমার কবিতার কথা বল। তোমার গোড়ার দিকের কবিতার থেকে এখনকার কবিতা কতটা বদলেছে?

এই প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া যতটা সোজা ততটাই কঠিন। বলতে পারি আমূল পালটে গেছি গত বাইশ তেইশ বছরে। আবার একইসঙ্গে , এখনো নিজের ভেতরের কিছু অভ্যাস, ধরতাই হয়ত একই আছে।  আমার মনে হয় ভাষার অভ্যেস পালটায় না। কলম শক্ত হয়ে যায়। নিজের ভাষাকে পালটানো তাই সবচেয়ে কঠিন। তবে মনটা পাল্টেছে। ধাক্কা বা চার্জের রকম পাল্টেছে। আমূল পাল্টেছি মানুষ আমি। তাই আমার কবিতাও।

দেখেছি, আমার বদলগুলো অনেক সময়ই একটা বই থেকে আর একটা বইতে যাবার সময়ে প্রকট হয়ে উঠেছে, কেননা আমি বই সাজাই থিম বা একটা আলগা ধারণা মাথায় রেখে। অন্যদিকে, হয়ত ২০০৫ এর একটি বই আর ২০১৫ র একটি বইয়ের মূলগত ভাবটা এক। সেটা পরে উপলব্ধি করেছি।
জীবনের বাঁকবদলের সঙ্গে সঙ্গে বিষয় পাল্টেছে আমার কবিতা। এটা বহিরঙ্গিন একটা বদল।
তবে এই সেদিন কবি সংযম পাল বলছিলেন একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা। একজন কবি যখন লিখতে শুরু করেন তখন বোঝা যায়না তিনি কী। তাঁর ক্রমাগত লেখার মধ্য দিয়ে আসল কবিটা ধরা পড়ে লেখা শুরু করার ২০ বছর পরে হয়ত বা!
সেটাই। আমরা ভাবি , নতুন লেখার জাঁকজমক, নতুনত্ব, ঝলসে দেওয়া আলো থেকেই, যে এই বুঝি আমি। আমার কবিতা এইরকম।  কিন্তু যে মুহূর্তে আমি লিখছি সেই মুহূর্তে কিন্তু আমি বুঝতেই পারছি না আমি কী লিখছি। পরে, অন্তত এক দুবছরের লেখা যখন গুছোতে শুরু করি বই করার জন্য, তখন বুঝি এই দিক, এই বাঁক আসছে আমার কবিতায়। সে পর্বটাও খুব বিভ্রান্তিকর। যেমন সম্প্রতি আমি দেখছি আমার তিনটে গোটা পান্ডুলিপি রেডি হয়ে গেল, মাতৃভূমি বাম্পার বইটি করার সময়ে। থিম্যাটিকালি তিনটে সম্পূর্ণ আলাদা পান্ডুলিপি। একটা আর একটার গায়ে গায়ে লেগে থাকলেও, মূলগতভাবে যাচ্ছে না পরস্পরের সঙ্গে।
মাতৃভূমি বাম্পার এর লেখাগুলি বাছার সময়ে কাজ করছিল, নারী-দেশ-মা এই থিম। মেয়েদের সম্বন্ধে লেখার কোন শেষ নেই, তাই লিখেই চলব হয়ত আজীবন। আমার মায়ের মৃত্যুর পর , ২০০৮ সালের পর , আমার ভেতরে কনটিনেন্টাল শিফটের মত একটা কিছু ঘটেছিল। সেই সময়ে মাকে নিয়ে যে লেখাগুলি সেগুলি এই বইতে রেখেছি। কিন্তু পরে দেখছি, কনটিনেন্টাল শিফট, জীবনের অনেকগুলো পর্বভাগ সম্পূর্ণ অন্য একটা ভাবে এসেছে আমার কবিতায়। সেই অন্তর্মুখী , আনস্মার্ট লেখাগুলোকে লেখার মুহূর্তে আমি একেবারেই চিনতে পারিনি। এমনকি কবিতা বলেও ভাবতে পারছিলাম না।
এখন সে কবিতাগুলি , তাদের সংখ্যাধিক্যের কারণেই হোক, বা বেজায় মন খারাপ করে দেওয়ার কারণেই হোক, আমাকে আক্রমণ করছে, আমাকে বলছে, আমরা আলাদা, আমাদের ফেলে দিও না, রেখো।
অন্যদিকে একটা বিপুল পরিমাণ কবিতা আলাদা করে তুলে রেখেছি, এগুলো সব প্রেমের কবিতা। প্রেমের কবিতা লেখার অদ্ভুত একটা বায়োলজিকাল জোয়ার এল পঁয়তাল্লিশ উত্তর  আমার জীবনে , হা হা, শুনতে জৈবিক মনে হলেও, এই যে মিড লাইফ ক্রাইসিস, হর্মোনের প্রভাব বা দ্বিতীয় বয়ঃসন্ধি, যেভাবেই বল, এই বয়সটা যে কী বিপুলভাবে আমার মনের তটভূমিতে আছড়ে পড়েছে, তার সমস্ত বিভ্রান্তি, প্রেম-যৌনতা-আকাঙ্খা সব কিছু সহ, তা বলার নয়। সেই জোয়ারটা এখন চলে গেলেও, কিছু কবিতা রয়ে গেছে, যেগুলী সাঙ্ঘাতিকরকমের আকুলতাময়, শরীরীও কিছুটা। যে যেভাবে সেই জোয়ার ট্যাকল করে আর কি, অনেক কবির লেখাতেই তুমি এই রকম এক একটা ফেজ পাবে। 



৬।  এই পরিবর্তনটা, যেটা তুমি বললে, তার সঙ্গে কি ভাষা পরিবর্তনেরও সম্পর্ক আছে?

এইবার তুমি প্রসঙ্গটাকে একটা সরু মোহনার মুখ থেকে একেবারে মহাসমুদ্রে এনে ফেললে যে!!!
কবিতার ভাষা। হ্যাঁ। এই বিষয়টি এত বড়। ভাষাতাত্ত্বিক আমি নই, তবে এটুকু জানা আছে যে ভাষাতাত্ত্বিকদের বহু কাজ এখন হয়ে চলেছে কবিদের ভাষা ব্যবহারের ওপরে। আমি চমস্কি আওড়াব না, এটাও বলব যে যে মুহূর্তে আমার লেখালেখির শুরু সেই মুহূর্তে আমার ভেতরে একজন ভাষাতাত্ত্বিক নয় একজন কবিই বসে থাকে। সব কবিরই প্রথম লাইনটি লেখা হয় অন্য কোন চার্জ থেকে, কিন্তু তার টুলস বা উপকরণ তো ভাষা।
কাজেই ভাষার ব্যবহার অনিবার্য, আর ভাষা-র সঙ্গে সঙ্গম বা রতিক্রিয়া বা যাই বল, সেটা করতে করতেই কবির কবিতা লেখা। আমি একথা জোরের সঙ্গেই বলব যে সত্যি জীবনে যৌনতার চার্জ কোনভাবে ব্যবহার করতে পারেন নি যে কবি তাঁকে কবিতায় সেটা মোক্ষণ করতে হয়েছে, যে কোন শিল্পেই এই জৈবরসের মোক্ষণ আসে। ক্যাথারসিস আসে। ভাষা এখানে কবির একমাত্র মাধ্যম। একজন নাট্যকারের আছে মানুষের শরীর, ডায়ালগ, মঞ্চ, আলো। একজন ফিল্ম ডিরেক্টরের আছে সিনেমাটোগ্রাফির হাজারো জিনিশ। যার সঙ্গে ডায়ালগের ভাষাও হয়ত আছে।
কবির আছে, একমাত্র, ভাষাই।
তো এই অর্থে, আশির থেকে নব্বই দশকের সেই টিপিকাল কবিতাগুলোকে আলাদা করে নেবার একমাত্র লক্ষণীয় পরিবর্তন ভাষার ব্যবহারে। অনেক বেশি ধৃষ্টতা , রিস্কি এই ভাষা। বাংলা কবিতা খুব রিস্ক নিতে শুরু করল নব্বই থেকে এটা আমি দাবি করতেই পারি। রাণা রায়চৌধুরী, রূপক চক্রবর্তী, শিবাশিস মুখোপাধ্যায় এদের কবিতায় এই ভাষা বদলটা পরিষ্কার ধরা পড়েছিল। একটা কবিতায় রাধা আর শ্যারোন স্টোন এক সঙ্গে , এটা নব্বইকে একটা ডিভাইডারের ওপাশে দাঁড় করায়। সময়ের ছাপ এভাবে কবিতা শরীরে আসে, এই জিনিশটা আমাদের থেকে অনেক বড় যাঁরা বয়সে, তাঁদের কাছে প্রায়শ উটকো স্মার্টনেস, বাংলাভাষাকে দূষিত করে দেওয়া। অথচ মুখের ভাষার অনেক কাছাকাছি কবিতার ভাষা এই সময়েই চলে আসে।
এইবার আসি আমার কবিতায়। আমি নব্বইতে ভাষা নিয়ে যা-তা করায় বিশ্বাসী ছিলাম। তখন আমার একটা দীর্ঘ কবিতা ছাপা হয় রেডিওবিতান নামে, দেশ পত্রিকায়, সেটা পড়ে একজন পরিচিত রাগি যুবক , কবি নয়, পাঠক , সে বলেছিল, যশোধরা ওটা কী করেছে? বাল ছিঁড়েছে? এখন অবিশ্যি সরল সাদামাটা ভাষায় লিখলে উলটে শুনতে হয়, আপনার অন্য লেখাগুলো ভাল হয় এইসব রচনা রচনা মার্কা লেখা লিখবেন না।
তো, আমার ওইসময়ের ভাষার চয়ন খুব সচেতন। কারণ আমি জেনেবুঝেই ইংরিজি শব্দ বসাচ্ছি কবিতার গায়ে। একটা চোখা, তুখোড় ভাষাভঙ্গির জন্য, হাইলাইটিং করে ধারালো করে তুলতে কবিতাকে। যেমন সেক্রেটারি নামে একটা কবিতায় ছোট স্কার্ট পরা একটি মেয়ের কথা ছিল, সে বলছে, একটা ছেলে আমার দিকে বেশি মন দিচ্ছে, বেশি জেদাজেদি করলে বলে দেব আমার আর ইন্টারেস্ট নেই
এই ইন্টারেস্ট শব্দটা ইচ্ছাকৃত। এটা দিয়ে আমি একটা প্রজন্মের মুখের ভাষাকে বোঝাতে চাইছি। বিজয়া মুখোপাধ্যায় , অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ষাট দশকের কবি, আমাকে এত স্নেহ দিয়েছেন বলার নয়। তিনি আমাকে একটা করে লেখা পড়লেই ফোন করতেন। এই সব শব্দের ব্যবহার দেখলেই ফোন করে বলতেন, করেছিস কী? এরকম কেন লিখেছিস? তখন উত্তর দিতে বেশ রাগই হত, অকপটে বলছি। কিন্তু এখন বুঝি এই ঘাতপ্রতিঘাতগুলো লেখক জীবনে খুব জরুরি। বিজয়াদিই, বেশ অনেক পরে, একটা প্রেমের কবিতায়, সেই কথা পরের দিন কান্না আর হ্যাংওভারে খোলসা করে বলা পড়ে আবার ফোন করে বলেছিলেন, বাঃ হ্যাং ওভার শব্দটার ব্যবহার ভাল লাগল। আসলে ১৯৯৬-৯৭তে যে শব্দগুলো বেশি বেশি মনে হত, ২০০৬-০৭ এ সেই শব্দগুলো কবিতার শরীরে খুব স্বাভাবিক।
অন্বয় বা ব্যকরণ, মানে শব্দগুলো একটা অপরের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত থাকবে কবিতার লাইনে, সেটার বিষয়ে বলতে পারি, শুরুর দিকে এই গ্রামার ভাঙতে আমার উৎসাহের প্রাচুর্য ছিল অন্তহীন। কিন্তু একটা সময়ের পর থেকে, হয়ত সচেতনে সরল হতে চাইলাম।  ভাষার দিক থেকে পরীক্ষা নিরীক্ষা গুলো থাকলেও, ভাষাকে নিয়ে ফেরেব্বাজি, উদ্ভট কাজকর্ম এবং গ্রামার, বা গঠনগত ভাংচুর একেবারে কমে এসেছে।
আসলে প্রথম যখন লিখতে শুরু করি, ভাষাই ছিল আমার মুখ্য প্যাশন। বিষয়ের চেয়েও, আসল ভরকেন্দ্র ছিল শব্দ।  ভাষার ভেতর দিয়ে যা কিছু করা সবটাই করতে চাইতাম। সুতরাং,  তোমাদের উপদেশে, তোমাদের উপমহাদেশে বা আমি বামী আমি ডাইনি-র মত লাইনের অবাধ্যতা/চটক/শব্দখেলার ঝোঁক থেকে শুরু হয়েছিল রাস্তা হাঁটা। তখনকার গদ্যগুলিও এই ভাঙচুরের সাক্ষী, যেগুলোর কয়েকটা পাবে সৃষ্টিসুখের নতুন বইটিতে, বিশাল ভারতীয় লঘুগল্প ( ২০১৫)।
তখন আমি সে অর্থে দুর্বোধ্য এবং জটিল লিখে অসম্ভব সুখ পেতাম। এই জটিলতা বোধ হয় যে কোণ তরুণ কবির খুব প্রিয় খেলা। নিজেকে এক্সপ্রেস করব আমার নিজের টার্মসে। পাঠক যেভাবে পারে সেই কোড ডেসাইফার করবে। এটাই ছিল পাঠকদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ।

কিন্তু ধীরে ধীরে আমি পালটে গেলাম। আমার মা, আমার সবচেয়ে বড় ক্রিটিক।  তাঁর অপছন্দটা ধীরে ধীরে পছন্দে পাল্টাল , তার মানেই আমার ভাষা অনেক সুবোধ্য হল। আর তারপর , নীরব ক্রিটিক আমার বর, তৃণাঞ্জন, যে নিজেই একজন ভাষাবিদ। খুব ভাল বোঝে কবিতা, লেখেও। কিন্তু সে লেখা অসম্ভব এক্সপেরিমেন্টাল।
আমার মা ৯৫-৯৬ তে , প্রথম প্রথম যখন দেশ পত্রিকায় বেরোচ্ছে কবিতা, বলতেন, তুই কি লিখিস বোঝা যায় না। আর বলতেন, তোর লেখা অশ্লীল। আমি খুব তেড়িয়া হয়ে বলতাম,  ওটা তোমাদের সময়কার কবিতা না। তুমি তো শুধু রাবীন্দ্রিক কবিতা বোঝ
কিন্তু বিয়ে-সন্তান ইত্যাদির মোচড় জীবনে কোথাও একটা বীক্ষণে বদল আনল, বা আমি ওই ঘুরিয়ে লেখা লিখে লিখে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম।  আমার লেখাও সরল হতে শুরু করল। আমি আমার সন্তানজন্ম, অন্তঃসত্তা অবস্থা ইত্যাদির একটা রিপোর্টাজ বা বয়ান লিখতে শুরু করলাম অদ্ভুত অবজেক্টিভিটি নিয়ে, আপাত সরল ভাষায়। মানে, আমি বলব , আমার লেখায় এবার বিষয়গুলো ডিটারমিন করতে লাগল ভাষা কেমন হবে।
পিশাচিনী কাব্য অব্দি, রেডিও বিতানেও, আমার ভাষা চাতুরালি, ধাঁধা, পুরানো সব প্রতীক ভাঙাচোরা এসব নিয়ে মত্ত ছিল। আবার প্রথম থেকে পড়ো থেকে আমি সরল হয়ে উঠলাম। একদম সোজাসাপটা ভাষা।
দুটো উদাহরণ দিচ্ছিঃ
পিশাচিনীতে একটি কবিতা এইরকমঃ
রাজকীয় সেই সৎ ভ্রমণের থেকে
রোজ একটু রোজ একটু রোজ একটু
আবেগ জন্মায়।
এইভাবে ক্রীড়াতুষ্ট ভাঙানখ জতুতৃপ্ত থলি ভরে হায়।

তোমাদের খাওয়াই এখন, মূঢ়মন।
যে জানে সে জানে এই লজ্জার ব্যাপার।
এই আদেখলামো আর এই অন্ধকার।

এই সময়ে আমার কবিতা ভেতরের কথা বলত। আপাত সরল ভাষায় বললেও। যেমনঃ
আমি আজ তোর জন্য সময় বানাই , আর রাত বানাই
মাদুর পেতে তার উপরে রাখি অন্ধকার আর
অন্ধকারের ভেতর রগড়ে দিই আলো
...

কিন্তু এর পর আমি লিখলাম বাইরের কথা। নিজের কথা ছেড়ে অন্যদের কথা। পরিবারের কথা। সমাজের কথা।
টেনশন জননীর মত সরল কবিতা, যাতে বহিঃপৃথিবী আসছে, আমি একটা মেসেজ ও দিচ্ছি, শ্লেষার্থে ব্যঙ্গার্থে , কিন্তু মেসেজ দিচ্ছি। টেনশন জননী আমার সৌভাগ্য এক মনস্তাত্বিক মোহিত রণদীপ ছোট ছেলেমেয়েদের বাবা মায়েদের শুনিয়ে থাকেন, কাউন্সেলিং করতে, শুনতে পাই!!!
আমি লিখলাম, বিবাহবিচ্ছেদের মত সরাসরি কবিতা। বাবা মা-র ছাড়াছাড়ি রোগ/ বন্ধ হোক।
মেয়েদের প্রজাতন্ত্র, কুরুক্ষেত্র অনলাইন, একেবারে সদ্য বেরোন বই মাতৃভূমি বাম্পারেও এই ডিরেক্ট নেস আছে। আসলে নিজের সঙ্গে পাঠকের আড়াল আমি হয়ত সচেতনে হয়ত অবচেতনেই ঘুচিয়ে ফেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি সততা থেকেও সরতে চাইনি, ছড়াও লিখতে চাইনি, চটুলতাও করতে চাইনি। আমি চেয়েছি আমার কাব্য ভাষা যেন এক্সট্রিম সারল্য নিয়ে এক্সট্রিমলি সত্যি , বেদনার, অথবা স্পর্শকাতর বিষয়ে নিয়ে লেখে। কিন্তু শ্লেষ বা ব্যঙ্গ আমার লেখার ভেতরে সবসময় থেকে গেছে। আর থেকে গেছে এই সময়টার প্রতি, বদলে যাওয়া  , ট্র্যানজিশনে থাকা বাঙালি বা ভারতীয় বাস্তবতার প্রতি একটা ব্যাঁকা মনোভঙ্গি। যা আকর্ষণ বিকর্ষণ দুইয়ের মিশ্রণ।
এরপর একটা সময় এটা আরো ব্যপ্ত হয়ে রাজনীতিকে ছুঁয়ে ফেলল। যেখানে আমি নন্দীগ্রাম সিঙ্গুরের আন্দোলনের সময় অনেক আমার সমসাময়িকদের মতই অসম্ভব তীব্র একটা উদ্দীপনা অনুভব করলাম, একাত্ম হয়ে গেলাম বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদে। সে অর্থে পিতিবাদী হলাম ( এই কথাটা আমাদের বাড়ির কাজের মহিলার কথা। সে সময়ে পঞ্চায়েত প্রধান কাম জোতদারের কাছে জমি জমা বেচে গ্রাম থেকে শহরে আসার কথায় মেয়েটি বলেছিল, আমি রাজি হইনি, আমার শ্বশুর বলেছে, তুই পিতিবাদী হবি নাকি? )
সেই মুহূর্তে আমার লেখা অন্য একটা সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ব্যাপ্তি ছুঁয়েছিল। প্রসারিত করেছিল নিজেকে, এখন বুঝি।
তারপর আবার সে , নিজের কাছে ফিরে আসছে। ওই যে একটা পান্ডুলিপির কথা বললাম যেটা তৈরি হয়ে আছে, যেটার নামকরণ হয়নি। সেটা আমার ভবিষ্যতের কবিতা বলে মনে হয়, যখন বিষাদ-অন্ধকারের ভেতর খুঁজতে খুঁজতে  কবিতার চুঁইয়ে পড়া সামান্য আলো আসে। যখন সামনে শুধু দেওয়াল , সকাল! এই গোত্রের কবিতা। আমি এখনো খুব দ্বিধাগ্রস্ত বেশ কিছু লেখা নিয়ে। যেগুলো আপাত সরল হলেও ভেতরের দিকে পথ খুঁড়ছে ।
আর , সত্যি বলতে কি, এখন আমি একটা ফেজে আছি যখন সে অর্থে প্রতিবাদী কবিতা, বহিঃপৃথিবীর , রাজনৈতিক-সামাজিক কবিতা লেখার অধিকারী বলে নিজেকে মনেই হয়না। মনে হয়, এই ফেসবুক জমানায়, প্রতিবাদী কবিতা লিখলে সেটা একধরণের তাৎক্ষণিক উত্তেজনা দেবে আমাকে, তার বেশি কিছু নয়, কোন লাস্টিং ভ্যালু আমি পাচ্ছি না । এই ধরণের প্রতিক্রিয়া দেওয়ার কবিতা আমার কাছে সফট অপশন।  বরং চুপ করে ঘরে বসে নিজের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করাটা কঠিনতর চয়েস।



৭। তোমার লেখার ভেতরে কোন জিনিশটি তোমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়?

চার্জ। তাগিদ। অনুভব। সেদিন জয়া মিত্র একটি সভায় অসাধারণ বললেন। মহাভারতের সময়ে গণেশ যখন শর্ত দিয়েছিলেন ব্যাসকে, আপনি থামতে পারবেন না , ব্যাসও শর্ত দেন, আপনিও না বুঝে একটি শব্দও লিখতে পারবেন না। জয়াদি বলেছিলেন, যা দেখেছি, যা বুঝেছি তাই লিখতে পারি । গণেশের মত আমরাও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, যা অনুভব করিনা, মর্মে মর্মে বুঝিনা, তা লিখতেও পারিনা।
আমাদের সময়ে অনেক কবিকেই দেখেছি নিতান্ত অভ্যাসবশে, ভাল ভাল কিছু সামাজিক বক্তব্য সুন্দর ভাষায় লিখে চলেছেন। বিশ্বাস করেন কি তিনি সেই সব শব্দকে? শব্দের ভেতরে সততা আছে কি নেই, একবার পাঠ করলেই কিন্তু পাঠক বুঝতে পারেন। এই অসৎ লেখা কিন্তু কবিতাই নয়। এই সব লেখাকে পাশে সরিয়ে রাখলে খুব কম লেখাই আমরা পাই যেগুলি সত্যি আমাদের ছোঁয়।
আজকাল , দুঃখের বিষয়, তাগিদ খুঁজে না পাওয়ার সময়ই আমার জীবনে বেশি। তাগিদ পাই খুব কম জায়গা থেকেই। আর তাই, দিনের পর দিন কবিতা লেখাও হয়না। 

৮। তোমার কাছে কোন কবিরা শ্রদ্ধেয় বা অনুসরণ যোগ্য?

প্রথমেই বলব কবিতা সিংহের কথা। তাঁর আমিই সেই মেয়েটি কবিতাটি ভাষার দিক থেকে সরলতম , একটা পোস্টারের মত, অথচ আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি এই কবিতাটি আমার জীবনকে পালটে দেয়। আমি আমার অনেক না বলা কথা কীভাবে বলব সেই পথ তিনি দেখিয়েছিলেন। পরে তাঁর অন্যান্য কবিতা পড়ে মনে হয়েছে, আজো আমরা সেইভাবে এগিয়ে থাকার সাহস দেখাতে পারিনি। তিনি অন্তত দু প্রজন্ম এগিয়ে থেকে লিখেছিলেন।
কবিতা সিংহ তাঁর সময়ে অত্যন্ত প্রধান হওয়া সত্ত্বেও, বলতে বাধ্য হচ্ছি তিনি তাঁর সমসাময়িক পুরুষদের ঈর্ষ্যাসঞ্জাত একরকমের উপেক্ষার ফলে সরে যান, এবং পরবর্তীতে তাঁর নাম কদাচ উচ্চারিত হতে দেখেছি। তাঁর কবিতা, তাঁর গদ্য আমাকে আজো অসম্ভব প্রেরিত করে।
এই সময়ে সবচেয়ে শ্রদ্ধেয়, সবচেয়ে অনুসরণীয় অগ্রজ কবি শঙ্খ ঘোষ, যিনি আমাদের ওপরে একটি ছত্রছায়ার মত। তাঁর প্রতিটি লেখায় এখনো অনেক চিন্তার সূত্র পেয়ে যাই, আবার নতুন করে ভাবতে পারি কবিতা বিষয়টিকে। মনে হয় জীবনের সঙ্গে কতটাই না যুক্ত , কতটাই না তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে কবিতা !
মণীন্দ্র গুপ্ত আমাদের এখনো আলো দেন। তাঁর লেখার সারল্য সমানুপাতী বোধের গভীরতার সঙ্গে। তাঁকে পড়তে পড়তে অন্যরকম একটা ট্র্যান্স হয়। দেবারতিদির কবিতাও তাই। বিজয়াদি, শরৎদা, এঁদের লেখা আমাকে উদবুদ্ধ করে। শরৎদা লেখা ছেড়ে দিয়েছেন ঘোষণা করে। তাঁর মিনিমালিস্টিক, আপাত গদ্যধর্মী কবিতাগুলি আমার অত্যন্ত প্রিয়।
নবনীতা দেবসেন কবি হিসেবে থেকে খুবই উপেক্ষিত, তাঁর কবিতা আমরা সেভাবে পড়িনা, যতটা তাঁর গদ্য। গদ্যে মেধার অসম্ভব  প্রচন্ড ক্ষমতা ও ঝলক তাঁর গদ্যকে এত সামনে এনেছে, যে তাঁর কবিতা পেছনে চলে গেছে। অথচ কী অসাধারণ কবিতাই না তিনি লিখেছেন। অনুবাদও করে আমাদের উপহার দিচ্ছেন সব অসামান্য কবিতা। গুজরাতি নারী কবির পাকশালা পদ্য পড়ে চমকে উঠেছি। শ্রদ্ধা যদি বলো, এই সব মানুষ আমাদের কাছে ধ্রুব তারার মত । পরবর্তী কবিদের মধ্যে জয় গোস্বামী, শ্যামলকান্তি দাশ এবং রণজিৎ দাশ আমার প্রজন্মের কাছে খুবই অনুসরণীয়। শুরুর দিকে বলা হত আমরা জয় গোস্বামীর লেখা কপি করি। আমি এমন অনেক কবিকে জানি যাঁরা রণজিৎ দাশের মত করে লেখেন। সুবোধ সরকারের মত করেও অনেকে লেখেন। সরাসরি কথা বলা, অ্যান্টিপোয়েট্রির যে মোহহীন সাররিয়ালিস্টিক একটু টকে যাওয়া , একটু ইয়ার্কি ময় ভাষাটি সুবোধ দা বাংলা কবিতায় চালু করেছেন, সেটি পরবর্তী অনেককেই ওভাবে লিখতে উশকে দিয়েছে।
আটের দশকের কবিরা আমাদের খুব কাছের। আমার কাছে নারী কবিদের মধ্যে, সংযুক্তাদি সুতপাদি চৈতালীদি সবচেয়ে প্রিয়। সুতপা সেনগুপ্ত অসম্ভব শক্তিশালী কবি। সংযুক্তাদির কবিতাও ধ্যানের বৈভবে ভরা। এরা একটা আলাদা বাচন তৈরি করেছেন, মেয়েবাচন মেয়েদের কথনবিশ্ব।  আটের দশকের কবিরা খুব খুব শব্দমনস্ক, এবং সত্তর এবং আশি দুই দশকই অন্ধকার অবচেতনকে তুলে এনেছেন।
নব্বইয়ের প্রথমদিকে অবচেতনকে অবহেলা করেছি, বলেছি প্রকাশ্যে এখন আর অবচেতনের কবিতা হবে না, এবং বকাও খেয়েছি, এমনকি তর্কেও প্রবৃত্ত হয়েছি। কিন্তু আজ, আমার অবচেতনের দিন সমাসন্ন। টের পাচ্ছি!!!






My Blogger Tricks

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন