........লোকনাথ
ভট্টাচার্য.......
(১৯২৭-২০০১)
(কাব্যগ্রন্থ- ‘মই ময়ূর মন’,‘হাঁটুতে
হাঁটুতে নহবৎ, ’ঘর’,‘ গোধূলিতে জ্যামিতি’,‘ খুনের শিল্পের ঢাকবাদ্যি’,‘অতি বিশিষ্ট অন্ধজন’)
“ব্যক্তিগত হওয়ার অধিকার আমায় দাও। তুমি
হও আমার ব্যক্তির অন্তর্গত”...
এ সামান্য কথাই
বোধহয় একই সাথে কবি লোকনাথের সামগ্রিক অন্বেষন ও আর্তির সমর্থন করে। ‘লোকনাথ ভট্টাচার্য’-নামটার সাথেই উচ্চারিত হয় তাঁর বাঙময় ও
বহুমাত্রিক উপন্যাস ও প্রবন্ধের কথা এমনকি নাটকেরও (১৯৬৯ এ শম্ভু মিত্রের সাথে
পরিচয়ের পর থেকেই যার আগ্রহ জন্মায়)। কিন্তু তাঁর কবিতা সম্পর্কীয় গবেষনা যত কম
হয়েছে এ দেশে তার চেয়েও কম তাঁর কবিতা নিয়ে স্থানিক আলোচনা অথবা পত্রপত্রিকায় তাঁর
কবিতার ভাষা নিয়ে বিশ্লেষন।আর এর কারন বাংলা কবিতার গতানুগতিক বুদ্ধিজীবিতার
নিঃশব্দ তর্জনী,যার ফলে কবিতার কাঠামো সংক্রান্ত পন্ডিতির চাপে অচিরেই সেমিকোলন
পড়ে গেছে একাধিক উপলব্ধি ও কল্পনার সাহসে। বু ব-এর আমলেও এ থেকে নিস্তার ছিলনা। একদিকে
লোকনাথ পারী প্রবাসী অপরদিকে ‘ভোরবেলা ধীর এক আগ্রহে সম্পন্ন হয়ে আমরা
পৌঁছবো আশ্চর্য নগরীতে”র মত র্যাঁবোর নতুন আলোকপ্রাপ্তিতে জারিত যার ফলে র্যাঁবোসহ তাঁর কবিতায় এসে পড়েছে পল ক্লোদেল, সাঁ জঁ
পের্স, অঁরি মিশো ও রনেশার গদ্য কবিতার প্রভাব। না , একে প্রভাব বলা ভুল হবে বরং
বলা যেতে পারে ফরাসী সাহিত্য বিশারদ লোকনাথ প্রথম থেকেই ফরাসী গদ্য কবিতার আঙ্গিকে
খুঁজে নিয়েছিলেন তাঁর কথনের অতিবিশিষ্ট ভঙ্গিমাটি অথচ পরোক্ষভাবে এ কারণেই একদিকে
যেমন বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতা পত্রিকায় লোকনাথের কবিতাকে আশ্রয় দেননি তেমনি
দলবদ্ধভাবে বাংলা কবিতা পত্রিকাগুলি কিংবা বাংলা কবিতার আলোচনায় লোকনাথ
ভট্টাচার্যের কবিতাকে শনাক্ত করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি কেউই। আশ্চর্যভাবে দেখলে
১৯৫৪ তে “নরকে এক ঋতু”( র্যাঁবো অনুবাদ) কিন্তু লোকনাথ উৎসর্গ করেছিলেন বুদ্ধদেব
বসুকেই এবং উৎসর্গ পত্রে লিখেছিলেন-“ যাঁর পরামর্শে র্যাঁবো পড়ার প্রেরনা
পেয়েছিলাম”। বুদ্ধদেব বসু নিজেও র্যাঁবোর গদ্যকবিতায় আবিষ্ট ছিলেন। সেসব অন্য কথা।
কিন্তু কাব্যসাহিত্যের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা
যাবে সম্পাদকীয় দাদাগিরি কিংবা পত্রিকা ও পাঠকের মৌন ডিপ্লোমেসিতে আখেরে ক্ষতি
সাহিত্যের সার্বিক পরিধিটির। যে লোকনাথ
ভট্টাচার্যের কবিতা সেভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছালো না সেই লোকনাথের কবিতাতেই কিন্তু
রয়েছে সময়ের সঞ্চার থেকে তুলে আনা একাধিক স্বরায়ন। বাংলা সাহিত্যের পরিসরে লোকনাথ
ভট্টাচার্য এক “সকলকলাপারঙ্গম” প্রতিভা বলা চলে। তাঁর কবিতাতেও আমরা
দেখতে পাই একই উত্তরণ,কেবল ছন্দমুক্তিকে আত্মস্থ করেননি তিনি বরং জীবনব্যাপী গদ্যছন্দে
লিখিত কবিতায় লোকনাথ মাটির সাথে যোগসূত্রটিকেও বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর
সাথে সাথেই যেন চিরন্তন চলেছে আরও এক উৎকন্ঠিত অবহেলিত চেতনা বাংলা সাহিত্যচর্চা
যাকে নির্জনতম নির্বাসনে পাঠিয়েছে বারবার। এলিয়ট যেমন বলতেন –“ Who is the third who walks always beside you? When I count, there are only
you and I together/ But when I look ahead up the white road/ There is always
another one walking beside you/….who is that on the other side of you?” ঠিক তেমনি লোকনাথকে তাঁর সামগ্রিক ভাষাদেহলি তে বারবার আমরা বলতে শুনি- “ আমারও যে একটা
সঙ্গী আছে, ঐ যাকে ঘরে ঢোকার আগে রোজই বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখি,আজও রেখেছি- মুড়ি
দেওয়া জবুথবু পিন্ডের মতো, তবু পিন্ড নয়, সে এক শুদ্ধ শুভ্রকান্তি দুঃখ, যে-ও
সূর্যের আলোয় খোলস ছাড়াতে চায়,তবু বুক যার জ্বলে যায় কী অনন্ত অসহ্য অভিশাপে,
মিলনের,প্রকাশের অক্ষমতা যাকে দেশে দেশান্তরে তাড়িয়ে বেড়ায় বন্য সারমেয়ের মতো –“। হ্যাঁ ,লোকনাথের
ভাবনার চয়ন ও প্রতীকীচূড়ায় আমরা বারবার দেখতে পাই অন্তরঙ্গ স্বভূমির প্রতি একধরনের
আবেগ, একধরনের অনতিক্রমনীয় অবসাদ ,অভিমান। তৃতীয় ব্যক্তির মত সে যেন জরিপ করছে
কবিকে, ছুঁতে চাইছে গৃহহীন ছায়াহীন ভূমিহীন কবিতাসত্তাকে। সীমার বাইরে দাঁড়িয়েও
নিছক মায়া থেকেই যেন হাঁটুর মাংসপেশীতে টান ধরছে বারবার আর বারবার তিনি ফিরে আসছেন
বাংলার চিত্রে, ঘাস ঘ্রাণ মাটির দূরদূরান্ত পবিত্রতায়, ফিরে আসেন দূর কোনো
ধানখেতের ঘাঁড় বেঁকিয়ে তাকানো সচকিত ময়ূরের কাছে কিংবা সন্ধ্যার ছলছল রূপ ধরা
সোনাবউয়ের কাছে। র্যাঁবোর গদ্য কবিতার তর্জমা বা ক্লদেলের কাব্যনাটকের বাকরীতি
লোকনাথের প্রবাসী কাব্যভাষার ভূমিকা গড়ে দিলেও লোকনাথের কবিতায় আমরা প্রথম দিকে
যেমন লৌকিক উপকরনের চিত্রন পাই তেমনি পরের দিকের কবিতায় দেশজ উপনিষদীয় আলোক প্রসুত
রং। তিনি পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন তাঁর ভাষা নিয়ে চিন্তা অভিজ্ঞতা নিয়ে; লোকনাথের
ভাষা কোনো নিটোল প্রস্তুতিহীন ভাষা নয় বরং বারবার তা নতুনের নির্ঘন্টে অপেক্ষারত।“অতি বিশিষ্ট
অন্ধকার” কাব্যগদ্যে তিনি যখন বলেন –“ ঘরে আছেন,বাইরে আছেন,আছেন কথা বলায়, কথা
না বলায়/ যাত্রা চলে , হাওয়া চলে ......যাকিছু আছে ,ও নেই, যা কিছু ছিল ও থাকবে,
বা ছিল না থাকবে না, তা সব আপনিই ছুঁয়ে আছেন, আপনি ধরে আছেন/ ......শুরু করি ঝাঁট
দিতে, ঝেঁটিয়ে বিদায় দিতে, সব ধূলো, সব কঙ্কাল; কী উড়ল শূন্যে, কিছু ঊড়ল কি না,
দেখা যায় না- অন্ধকার।/ কী রইল, কে রইলেন ?... আপনি?/অন্ধকার।/যাত্রা চলে, হাওয়া
চলে।/অন্ধকার ...”...তখন নিশ্চিত হয় চারলাইনের মিতালেখ্য কবিতা বা রিদিমিক
প্রোজ তাঁর গদ্যকবিতার বিষয় নয় বরং জীবনদর্শনের ব্যখা ও বিশ্লেষনে তিনি খুঁজে
চলেছেন শূন্যতার পংক্তিটিকে।
না, কোনো অথেনটিক
একজিসটেন্স বাংলা কবিতা দেয়নি লোকনাথ ভট্টাচার্যকে। তাঁর প্রবন্ধ নিয়ে গদ্য নিয়ে
যতটা আলোচনা হয়েছে তাঁর কবিতা ততটাই অব্যক্ত ডাকের কাছে পড়ে থেকেছে, বাংলা কবি
সাহিত্যিকদের ভিড়ে প্রেতচ্ছায়ার মত বারবার অবহেলিত হয়েছে তাঁর পরিশ্রমের ব্যঞ্জন ।
এ বিষয়ে অঁরি মিশোর সাথে লোকনাথের সাক্ষাৎকারের শেষ অংশটি ব্যক্তিগত প্রস্বর
হিসেবে ভেসে ওঠে অনায়াসে।–“ প্রশ্নটা ওঠে পাঠক থাকা না থাকা নিয়ে।
আমার নিজের ভাষায় আমাকে কতো জন পড়ে, তিনি জানতে চান। বলি, তেমন কেউ আমাকে পড়ে বলে
জানি না। তাঁকে বলি আমার প্রথম যৌবনের কথা, যখন ইতিমধ্যেই লিখতে আমি শুরু করেছি,
এবং যখন কলেজে পড়তে যাওয়ার জন্য এক দোতলা বাস ধরে কলকাতার এক প্রান্ত হতে অন্য
প্রান্ত আমাকে অতিক্রম করতে হতো। পথে যাত্রী উঠতে থাকে, এতো যাত্রী, ক্রমশই এতো
যাত্রী, যাদের মাত্র কয়েকজন ভাগ্যবান বসে, অন্য সবাই দাঁড়িয়ে, অনেকে ঝুলতে ঝুলতে
পর্যন্ত, যে সে বাসে তিলধারনের স্থান থাকতো না। এবং তা দেখে নির্বোধ সরলের মতো মনে
মনে আমি তখন কতোবার বলেছি , হে ঈশ্বর, হে ঈশ্বর এ বাসে যতগুলো যাত্রী , ততগুলো
পাঠক যদি আমি একদিন পাই, কোনোদিন পাই ! কিন্তু হায় , ততো পাঠক আমি কোনোদিন পাইনি,
আজও পাই নি।“-
কার ব্যর্থতা !
লোকনাথের ! নাকি বাংলা সাহিত্যের ! যে বাংলা সাহিত্য বইয়ের সংস্করন সংখ্যা এবং
পাঠক সংখ্যার নিরীখে কবির কাঁধ ও কলমের মাপজোপ সারে সেই আবহমান মোনোপলিতে এটাই তো
স্বাভাবিক মৌন মধুর ও মারাত্মক হয়ে আদি লিপি হিসেবে পড়ে থাকবে লোকনাথ ভট্টাচার্যের
মৌলিক কবিতারা ...
সে আমায় দিয়েছে
সে আমায় দিয়েছে এক
আশ্চর্য আগুন-আমায় দিয়েছে সেই আগুনে অনির্বাণ জ্বলার
মত তেমনি বিরাট এক
অন্ধকার। তাতে প্রতি মুহুর্তেই খুলে গেল পথ, জ্বলে গেল
বুক। তবু তাও শেষ
নয় ।
আমি বলি তাই তারই
কথা কখনো চুপ করে, কখনো গুমরে গুমরে,কখনো মরতে মরতে, জ্বলতে জ্বলতে। এই পাথেয়
অশেষ, আমায় মুক্তি দিয়েছে, দাস করেছে অসহ্য নিয়তির, এ আমার মস্তিষ্ককে চিরবিমূঢ়
করে দিয়েছে একেবারে জন্মের মূহূর্তেই, অবাধ্য আভায়, অকাট্য আঁধারে।
আমি কেবল ছুটব,
হাঁপাব,মুঠো-মুঠো ভরব অন্ধকার, ছুঁড়ে দেব আগুনে। আর আগুন লেলিহান হয়ে শত শত
প্রসারিত করে তাকে গ্রাস করবে অট্ট হেসে।
এই পোড়া মাটিতে
যে-ফুল ফোটাই আমার বেদনায়, সে আগুনের ফুল- টেক্কা দেয় কোটি
যোজন দূরের তারার
সঙ্গে । আকাশ তাকে দেখবার জন্যে হয়েছে পাষাণ-শতদল-মুখ ঘুরিয়ে বিস্ফারিত সে চেয়ে
আছে তলার দিকে, বোঁটা তুলে অদেখা শূন্যে।
যাকে বাঁধতে
চাই,ভালোবাসতে চাই, যার রূপ গড়ে তুলি মনে-মনে, তাকে বৃথাই ডাকতে চাই একটু মূহূর্ত
ধরে, এই অনন্তে জ্বলন্ত রাতের কারখানায়।
আমার বলার সময়
আমার বলার সময় হল
।
আমার হাড় থেকে
,লিঙ্গ থেকে, মেদ-মজ্জা-রাত্রি হতে, প্রিয়া খসে গেছে। চূর্ণ বিচূর্ণ হয়েছে শিশুর
মুখ, পদ্মের রক্ত পাপড়ি, নির্মম শিলায়
জীবন মুছে গেছে,
মৃত্যু ধুয়ে ভেসে গেছে বন্যায়
এই হালকা শরীরে,
এই হাওয়াহীন অন্ধকারে, আমি উড়ে যাব ।
কার ছিল , কারা
নেই । শাণিত বিদ্যুৎ চড়ুইপাখির মতো খেলা করে নীরবতার আকাশে-আকাশে।
এমন একা, ভীষন
একা- কে আমায় দেখবে? আমিও দেখছি না নিজেকে। সব চোখ হয়ে বসে আছে, তাকিয়ে আছে ।
দেখার কিছু নেই ।
ভেঙে পড়েছে সব
প্রাসাদ, হাহাকার স্তব্ধ হয়েছে। স্বপ্ন ছিল কিনা , সে -স্মৃতিও নেই।সবই পথ, এত পথ
, কোথাও যাওয়ার নেই। আর বাজে না কাঁকন, নাচে না নূপূর ।
পৃথিবী পড়ে আছে
জলেতে-বায়ুতে-অন্তরীক্ষে । শাণিত বিদ্যুৎ ।
পাখনা গজালো
শরীরে। এবার আমি উড়ব।
আমার বলার সময় হল
।
যা ঘটবে
কথা নয়, কথার ধ্যান – তুমি নও, তোমার কল্পনা ।
এই নিয়ে আছি চমতকার, যখন আগলে রয় নীরবতা কোন বিস্মৃতা স্নেহময়ীর মতো, ফিরে
গেছি আমার ভ্রূণাবস্থার জোনাকি জ্বলা রাত্রে,
স্পন্দিত হতে অরণ্যের অন্ধকার নিশ্বাসে-নিশ্বাসে,
আর কী এক মধুর নিবিড় আলস্য সারা দেহে চন্দন মাখায়, হাতটা –কনুইটা শুঁকতে ঘাড়
নোয়াই।
অচিরেই, অনন্ত কৌতুকে মইটি কেড়ে নেবে চতুর, নেবেই, হবে ধ্যানেরও নির্বাসন এ
দেয়াল থেকে, শুধু রইবে বিবাহের শুভদৃষ্টিতে মুখোমুখি যে দুজন,
তাদের একজন আমি, অন্যজন আমার ক্ষণ।
কোনো ইচ্ছা নয়, অপেক্ষা নয়, আক্ষেপ তো নয়ই, আনন্দও নয় – বলছি একটা ঘটনা,
যা ঘটবে ।
কৌটোর গল্প
ভ্রমণের পথ যেহেতু
একই, রোজই, এভাবে যাত্রার বর্ণনা দিই কেন বার বার – এই তো প্রশ্ন?
উত্তর হল,সংখ্যার
প্রতি আমার প্রেম ।
যেন গম্বুজটা
তিনবার আওড়ালেই তিনটে গম্বুজ হল, বা তিন কনে-দেখা আলোয় তিনটে ময়ূর হল, তিনটে তুমি
হলে ।
যেটা বলি না ,
কোনোদিনই না, সেই মনের গহনে সযত্নে বহন –করা কৌটোর ভীষণ অন্ধকারটাও তিনগুন হল ।
আমি যে আজো আশা
করে আছি, হে সুডৌল স্তনের মহিমা, আমরা ব্রমণে চির-সঙ্গিনী, একদিন নিজেই তুমি
উদ্ধার করবে আমায় বার-বার এই একই ইঁটের সাজানো পিরামিড হতে ,
অবশেষে ঐ কৌটোর
গল্পটা শুনতে চেয়ে।
পরিচিত বেহালা
ভিড়ের আবেশ মিলিয়ে
যায়, অরণ্য ফিকে হয়ে আসে। এবার সুরু হবে প্রান্তর, এপার-ওপার-না-দেখতে-পাওয়া
পদ্মার মতো আকাশ ।
আমার সময় নামে
সূর্যের, উপল ভূমির বুকে একলা আছাড় পড়ার।
ভিতরে যে
মণি-মুক্তা-পান্না জমিয়ে তুলেছি, তার কতটা গুঁড়ো হবে কতটা হবে না, সেটা নির্ভর করবে
ধূলার প্রতি তার আগ্রহের তীব্রতার উপর। যত এগোই, নাসারন্ধ্রে ঘনিয়ে ওঠে গন্ধ সেই
গেরুয়াবসন।
কাঁচা-সোনা-গায়ের
রঙ আগন্তুকের- ধূলার !
তবু যতক্ষণ না
পৌঁছোই কলহাস্যময় গোধূলির গ্রামে আবার,অর্থাৎ যদি পৌঁছোই-ই, এই হেরফের নিছক
নির্সগের-মানুষটা আমি এক,এবং মানুষইঃ সেই প্রতীতির বিজ্ঞপ্তিরই এ-মূহূর্ত ,
যখন না দেখা গেলেও
জানি যথাস্থানে বিরাজমান ছায়াপথের ছড়ানো-ছিটানো নক্ষত্রপুঞ্জের মতো অগণন বন্ধুজন ;
আমার স্মৃতির
কামরায় তাদের সমানই গুঞ্জন ধ্বনি-প্রতিধ্বনি, পরিচিত বেহালা !
অন্য রঙ
আমি ক্ষীণকন্ঠ
বহুদূর হতে, সঙ্গী তোমার । যেন যা বলছি শুনতে পাও;
হে সন্ধ্যার
মানুষ, আশা রাখো এই বিধ্বস্ত প্রান্তরে, যেখানে প্রাণ বলতে তুমিই আজ- একটি ফুলও
জীবন্ত নেই, একটি শিশুও না, হাওয়া কাঁদে গুমরে-গুমরে কত মানসীর স্মৃতিতে।
তবু যতক্ষণ আছ,
জেনো আকাশ দেখছে তোমায়- আকাশেরই মতো বড় তুমি আজ, হঠাৎ- সারা রাত ধরে দেখবে
অরুন্ধতী,কালপুরুষের বিস্মিত নয়ন। এত আকর্ষণ কখনো ছিল না তোমার- জেনো যা বাজছে শেষ
নয়, শুধু আবার আরম্ভ্বেরই গৌরচন্দ্রিকা অনাগত আসরের বীণায় ।
আততায়ীরা গেছে
যাক, সমাপ্ত তাদের কর্তব্য- তবু নিশ্চিত জেনো ওদের দলেরই কোনো প্রেয়সী যৌবনে
সম্বিৎ হারাবে, কাঁপতে কাঁপতে পথ চিনে ঠিক আসবে একদিন সুরভিত অন্ধকারে।
প্রেমোন্মাদ সে-উন্মুক্তযোনিকে ইতিহাস বলে দেবে বলে দেবে তোমার ঠিকানা স্থির
তর্জনীতে ।
প্রতিশোধের
পালাবদলে সেদিন আকাশ ধরবে অন্য রঙ, এ-বিধ্বস্ত প্রান্তরে উঠবে দালান,মমতার
পাতায়-ছাওয়া কুটীর- আবার শিশু হামাগুড়ি দেবে। কলগুঞ্জন তুলে চাকা চলবে ।
আশা তুমি রাখবেই
হে সন্ধ্যার মানুষ- আমি ক্ষীনকন্ঠ আজ বহুদূর হতে, সঙ্গী তোমার ।
যারা আছে, যারা নেই
যারা আছে, তারা
আছে। যারা নেই, তারাও আছে ।
কোথায়?
এই ঘরে ।
কারা আছে?
তালিকা হবে একগাদা
গদ্যের, তুচ্ছের, জড়ের। কখনো রকমারি কিছু, কিছু দেখতে মোটামুটি সুন্দরও, যদিও
ধূলোর কাপড় পরা। এই যেমন হাতপাখা, যা ছবির মতো পেরেকে লটকানো দেয়ালে, বা মাটিতে
পাতা আসন, যেখানে মনে হয় অনেকদিন কেউ বসেনি। বা কুলুঙ্গিতে অনিবার্য কৌটো , যা খুব
কাছে না গিয়েও বলা যায় খোলা হয়নি জানিনে কত মাস ধরে এবং চাইলেও মরচের কল্যাণে আজও
খোলা সহজ হবে না। কৌটোতে রয়েছি যখন, বলা উচিত ওটা একটা নয়, বহু জিনিসের সমষ্টি,কাণ
গা-ভর্তি তার কাঁচের টিপও আছে, যার মধ্য দিয়ে আলো ঠিকরায়, কিন্তু সকল কিছুর মতোই
যে প্রতিভাত আলো আজ ধূসর, রুগ্ন ও যার ফলে কৌটোটাকে কুষ্ঠরোগী মনে হয়। একটা বইয়ের
তাক, যার উপর কিছু বইও। একটি ফুলহীন ফুলদানিও।
আর হ্যাঁ, সব
ছাড়িয়ে কান পেতে শোনার মতো নিস্তব্ধতা আছে।
এবার ,কারা নেই?
অর্থাৎ না থেকেও কারা কারা আছে?
প্রথমেই, ফেলে
এলাম যাদের বাইরে। আমার মুদ্রিত নয়নে তাদের বর্ণনা আছে। আমার নিশ্বাসে এখনো তাদের
ঘামের গন্ধ, আমার হাতের চেটোয় তাদের আকুল আকাংখার গোটা একটা পৃথিবী । মন জুড়ে বসে
আছে একটা অপর্যাপ্ত আয়ুব আকাশ যেখানে তাদেরি দুঃখের স্বপ্নের রঙে শাশ্বত গোধূলি, ও
যে-আকাশের তলায় গঙ্গাতীরের নিসর্গ, সারি-সারি ভাঙা মন্দির, অন্য কোন জন্মের শৈশব
স্মরনের মতো।
দ্বিতীয়ত, রয়েছি
আমি নিজেও। অর্থাৎ নিজের যতখানি দেখা যাচ্ছে না, জানছি না, যে স্ফুলিঙ্গ থেকে থেকে
ঝলক মারে কোন মণিকোঠার গুহায়, হৃদয় ঘনঘটার রাত, দূর দূর অরণ্যে উল্কি আঁকা কত
বর্বর দামামা বাজায়। আছে নিজের মধ্যে নিজের এই প্রশ্নটাও – কেন ঢুকেছি ঘরে,
কে ঢোকালো ? কী দেখব এখানে, কী দেখতে চাইব আমি? ও তাই জল্পনা কল্পনার নিরবিচ্ছিন্ন
মালা,লাফ দিয়ে সামনে আসা কার বিচিত্র মুখ, ভ্যাংচানি,ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হো হো
হাসি, পরেই ,নিমেষেই, এসবের অন্তর্ধান । অথবা সহসা কী এক সুখকর চেতনা, যেন নদীর
দেহের মতো নারীর সঙ্গে সঙ্গমের, চোখে মুখে তুরীয় মুহুর্তের পুষ্পবৃষ্টি । কিম্বা
নেহাৎই ক্ষুধা, খাদ্যের, বা প্রেমের, বা ঐক্যের ।
এইবার , যারা আছে,
তারা তো যেহুতু আছেই, এবং যারা নেই, তারাও যেহুতু আছে, এদের দুই দলকেই, মেলাই অন্য
এক অভিনব অস্তিত্বের রসায়নে – হয়তো একই কথা,আমি মেলাই বা তারা নিজেরাই
মিলছে, বা আমি কিছুটা মেলাই, তার কিছুটা নিজেরা মিলছে ।
হচ্ছে কী , সার
বস্তু সেটাই ।
কী হচ্ছে?
ঐ দ্যাখো, কী
আশ্চর্য, রোজ আমি এই একই প্রশ্নে এসে থামব, অথচ যারই উত্তর একমাত্র ইপ্সিত বক্তব্য
আমার চিরকালের, তবু যেটা জানি কখনো বলা যাবে না, অন্তত আমার দ্বারা না। আমি থাকব
পড়ে যে-প্রকাশ নিয়েই, তার নিয়তি গদ্যের, তুচ্ছের, শবের চোখে পিচুটি পড়া ব্যাখ্যার,
অর্থাৎ আমার বর্ণিত সেই প্রথম দলটি ।
অন্য দলটি স্বপ্ন,
দুঃখ, যা-ও নয় সত্যের সম্পূর্ণ নাম ।
আভাসেও বুড়ী
ছোঁওয়া হল না, রোজকার মতোই – তবু যেটূকু বলেছি, তাও ছোট মুখে বড্ড বড়
কথা। স্পর্ধার টানে তার ছেঁড়ে-ছেঁড়ে । মুখের চেহারা পালটে যায় যখন, তখন
আত্মসমর্পণের এই প্রণাম অতএব- বুঝছি রক্ত চড়ছে মাথায়, এবার ঘর থেকে বেরোনো ভালো ।
কারণ আবার, বারবার,ফিরে আসতে তো চাই- আসতে তো হবেই ।
মধ্যরাতে কবির উক্তি
আমরা সেই তারা, গত
সূর্যাস্তের উল্কি ছিল যাদের গায়ে ও যাদের কোন ভ্রমে পারদর্শী নট ভেবে রাজার
প্রহরী ধরে আনে দরবারে –ঝাড়লন্ঠন জ্বলে ঊঠেছিল তখনই, কারণ সন্ধ্যা হয় হয় ।
রাজা বসেছিলেন
ফ্রেমে-আঁটা ছবির মতো, ঢুলু ঢুলু চোখ, গোঁফে আঙুল চালিয়ে বলে ওঠেন, কী পার দেখি,
কিছু তামাশা হোক ।
দলের এই অধমই সেই
সর্দার, অসভ্য অশোভন উক্তির সাহসে যার জুড়ি নেই, বলে উঠি,খেতে দাও-একবার , দুবার,
পর পর তিনবার, তৃতীয়বার এত চেঁচিয়ে , হুমকি দিয়ে, যে হয়তো
নিজেও চমকে ঊঠি, নাই বললাম মণি-মুক্তার পাখি বসানো সে মসৃণ মর্মর দেয়ালের
বিড়ম্বনা।
রক্তচক্ষু
রাজাঃ- ‘তবে এই
বুঝি তামাশা তোমার?’ দে ছুট, দে ছুট, সঙ্গীদের নিয়ে, প্রহরীরা জাগবার আগেই-ফটক পেরিয়ে মাঠ, মাঠ
পেরিয়ে বন, বন পেরিয়ে এখন এই অন্ধকার অরণ্যের গহনে, হন্যে হয়ে মধ্যরাতের দূরশ্রুত
হায়েনার হাসির হাহাকারে হঠাৎ-হঠাৎ -কে কার খাদ্য কে জানে।
প্রহরীরা
পিছু নিয়েছেই। জানি এবার যদি ধরে, আর দরবারের জন্য নয়, তা হবে রাষ্ট্রের শত্রু বলে
কারাগারেই পুরতে।
সূর্যাস্তের
উল্কি ছিল গায় । ভোরহীন গ্রামহীন হে অরণ্য এই, হে মধ্যরাত, আমাদের এই এক কবিতার
সময় ।
ছায়া
মুখোমুখি মৃত্যুর,
মুখোমুখি রক্তের, মুখোমুখি জীবনের । আমারি মৃত্যুর, আমারি রক্তের, আমারি জীবনের ।
আর এই
দিগন্ত,দিনান্ত,বনান্ত ।
আর এই কে বলে গেল
স্বপ্নের কথা, ফিসফিস করে, খোলা হাওয়ায়? বলে গেল হঠাৎ। যেন আরো আছে এসব ছাড়িয়ে,
আরো হাহাকার আনন্দের ও বেদনার, ও ব্যর্থতার- মধুর,মধুর ব্যর্থতার। যেন একটি
অপেক্ষার, নিরীক্ষার প্রান্তর, যে চেয়েছে হতে ধানখেত অনাগত অন্য এক সূর্যাস্তের
সুষমায় ।
শুনলে কি গঙ্গা
ধমনীতে? শুনলাম কি ?
বন রইল বাঁ হাতে,
মাঠ রয়েছে সামনে- যে আরো আছে ছাড়িয়ে এসব, তারি মধুর, ব্যর্থ,অনিবার্য পান্ডুলিপির
মত। মাথার উপরে আকাশ হতাশার, আশার,দুরাশার। চোখে আমার দূর সপ্তর্ষির ঘ্রাণ,ইতিমধ্যেই
। প্রিয়া তার যর্থাথ অন্তঃপুরে,অর্থাৎ অন্তরে আমার । বিহ্বল , বিলীন ,অথচ জাগ্রত ।
আমি এক মানুষ
নামহীন, ক্ষীণকায় – তবু এই অল্প আলোয় আমার ছায়াও পড়ে গেল পাশের ভাইয়ের উপর,
সেও চলেছে ।
********************************
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
এমন একটি লেখার প্রয়োজন অনুভব করছিলাম ।রমিতকে ধন্যবাদ ।
উত্তরমুছুনপ্রভূত উপকৃত হলাম লেখাটা পড়ে। ধন্যবাদ লেখককে। লেখার কবিজনের লেখা খুঁজছি ।তার উপন্যাস ও কবিতার বইয়ের পিডিএফ কি পাওয়া যায়?
উত্তরমুছুনচুদাচ্ছিস?
মুছুন