সাক্ষাৎকার : সুমন
১)।
সুমন , তুমি একজন
অধ্যাপক, প্রতিষ্ঠিত
কবি , লেখক
, সব
বিগ হাউসে তোমার লেখা। তোমার এত ফ্যান, এত ছাত্র-ছাত্রীদের ভালোবাসা – এককথায়
তুমি সফল একজন মানুষ। তো নিজে কেমন উপভোগ কর এই ব্যাপারগুলো? তুমি কি
খুশি তোমার প্রাপ্তি নিয়ে?
সুমন - আসলে,
সাফল্যের তো কোনও স্তব্ধতা নেই। তুমি এই মুহুর্তে যে-শীর্ষে পৌঁছলে, সেটাই
যদি তোমার শেষ গন্তব্য হতো, তাহলে তো আর তথাকথিত সাফল্যের ধারণাটাই তৈরি হতো না।
সফলতার ব্যাকরণে কোনও পূর্ণযতি নেই। কমা-সেমিকোলন ইত্যাদি আছে। যখনি তুমি সফলতার
হিশেব মেনে নিলে, তখনি তোমার থামবার অধিকারটুকু হারিয়ে গেল। তুমি আমায় সফল বলছ,
ঠিক-ই, সেই অর্থে সাফল্যের একটা
সেমিকোলনের আওতায় আমি এখন আছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো, দেশ বিদেশে গিয়ে বলা, পদ্য
পড়া, ছাত্র ছাত্রীদের দাক্ষিণ্য --- এইসব নিয়ে মন্দ কাটছে না। আর বিগ হাউসে লেখার
ব্যাপারে বলি, একটা সময় ছিল, ঐ ধরো আশির দশকে মূলত, যখন প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার একটা
জোরালো পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। তার একটা বড়ো
কারণ ছিল এই যে, তখন ছোটো পত্রিকাগুলোর মধ্যে একটা ছোবল থাকত। তারা, ওইসব কাগজের ছিপছিপে সম্পাদকেরা, বড়ো কাগজের বিরুদ্ধে মাথা তুলে কথা বলবার স্বাধীনতা
পেত। আমিও সেই আয়োজনে ছিলাম তখন। ব্যাপারটা পালটে গেল নয়ের দশক থেকে। তখন থেকেই
বাংলা কবিতার একটা অংশে ওপরচালাকির রমরমা শুরু হয়েছিল। সেই ধারাটা এখনও
যথেষ্ট প্রবল। চটজলদি গানের টানে লেখা কবিতা, ভাষায় বানানো স্মার্টনেস, ছন্দ-মিলের ঝাঁকুনি --- এইসব নিয়ে কিছু
লেখা অনেককে বশ করে ফেলল। তাদের প্রশ্রয় দিলেন সত্তরের এক গোঁসাই কবি। এঁরা সবাই মিলে বাংলা কবিতার জল পুরো ঘেঁটে
দিলেন। তাদের মাথার ওপরে থাকলেন পঞ্চাশের কোনও কোনও মধ্যমণি। এঁদের অনেকের সঙ্গেই
আমার সখ্য ছিল । কারও কারও সঙ্গে এখনও আছে। কিন্তু আমি এই ঘরানার মই ধরে ‘সাফল্য’,
বা ধরো ঐ ‘বিগ হাউস’, পাইনি। এটা
ঘটনাচক্রে হয়েছে। গীতিকবিতাসুলভ এইসব লেখাকে নিয়ে কৌতুক করে আমি কবিতাও লিখেছি।
একটা তোমায় পড়াই ।
শনিবাসরীয়
নরম কবিটি খুব নিচুস্বরে কবিতাসভায়
কাব্যপাঠ করে, চারপাশে
বন্ধুরা এ ওর দিকে চাপা হাসি লুকিয়ে তাকায়
সন্ধ্যা আরও ঘন হয়ে আসে।
পঞ্চাশের মধ্যমণি মাঝে মাঝে সর্বজ্ঞ তাকান
দেশ বিদেশের নানা বাতাশা ছড়িয়ে
যাদেরকে বশ করে বাজারে পূজিত হতে চান
এ বাসর তাদেরকে নিয়ে।
অবশ্য শুধুই তারা নয়, অনেকেই আছে যারা
লাইনচ্যুত হয়ে যাবে ভেবে
তাড়াহুড়ো করে আসে, দরজায় কুশলী পাহারা---
সদ্যপুরস্কৃত কবি সব মেপে নেবে।
নরম কবিটি বেশ গীতিকারসুলভ মুদ্রায়
একের পর এক পদ্য মাথা নেড়ে নেড়ে পড়ে যায় ।
হলো?
২)।
এখন কবিতায় যেমন একটা অন্য ধারা
দেখা দিয়েছে , তুমি
সেই ধারায় লেখো না । তুমি কি এই অ্যাবস্ট্রাকট কবিতায় ভরসা করতে পার , নাকি পার
না ? তোমার
মতামত কি ? এই
কবিতার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তুমি কি ভাব কিছু ?
সুমন - তুমি কোন
ধারার কথা বলছ, ঠিক ধরতে পারছি কি না জানি না। ‘অ্যাবস্ট্রাকট
কবিতা’ বলতে আমি যা বুঝছি, তা তো
বাংলায় আগেও নানাভাবে লেখা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। কোনও বিশেষ ধারার ধরনে তো কেউ আর
লেখে না, লেখা আসে ভেতরের গরজ থেকে। সচেতন নির্মাণে তাকে এদিক ওদিক করা যায়। আমার
লেখার ব্যাপারে বলতে পারি, আমি যখন লেখালিখির আওতায় প্রথম আসি, তখন
শব্দের গোপন দেবনাগরী নিয়ে মজে থাকার আহ্লাদ কবিতায় ধরে দিতে চেয়েছিলাম। এখন
যে-সরলতার দিকে আমি নাছোড়ভাবে সরে আসছি, তার ঠিক উলটো জটিলতার দিকে আমার মন ছিল।
আমার সেই সময়ের কবিতার দিকে মাঝে মাঝে তাকাই, যেভাবে এই সেদিন বিক্রি করে দেওয়া
আমার পুরনো বাড়ির দিকে মনে মনে চেয়ে থাকি।
আমার প্রথম
কবিতার বইটি বেরিয়েছিল, সম্ভবত, ১৯৯০ সালে। ‘কলি, নুনদুপুর’ নামে এই বইটি বের
করেছিলেন অমিতাভ গুপ্ত, তাঁর আন্তরিক আর আর্থিক সমর্থন ছাড়া বইটি বের হবার কোনো
সম্ভাবনা ছিল না। বইটি নিয়ে লিখেওছিলেন তিনি তাঁর সুখ্যাত ‘উত্তর আধুনিক কবিতা’
বইটিতে। সেই বইয়েই ছিল আমার সেইসব কবিতা, যা শুধুই গুটিয়ে যেতে চায় ভেতরের দিকে।
যেমন :
যে-নিঝুম পড়ে রইল,
ঘন উঠছে গরীব সন্ধ্যার
কত টিপ,
মুদিসকালের
ভুল, এই রাগ
আর
আলোর দোতলা,
গোলটেবিলের ঘোর
কিংবা, এক
লাইনের এই কবিতাটি :
উৎপন্নকোল,
পাশে হাতল। সুখরঙ, ক্ষয় উঠছে ভুলের
এই ধরনের
কবিতায় পরিমিতির যে-রসায়ন, তার মধ্যে একটা উত্তেজনা আছে, চাপা আহ্লাদ আছে। নিজেকে
নিয়ে ভোর হয়ে থাকার মধ্যে যে-আশ্লেষ, তা টের পাওয়া যায় এই কবিতা নিয়ে পড়ে থাকার
সময়। এখনো আমার অনুচ্চ সমর্থন আছে এই ধরনের প্রতি। কিন্তু ক্রমশ আমি টের পেলাম আরও
ছড়িয়ে বলার একটা তাগিদ তৈরি হচ্ছে ভেতরে ভেতরে, একটু খুলে কথা না বললে হচ্ছে না।
আমি যদিও পুরো বিবৃতির টানে লিখতে পারিনি কখনও, ভেতরের দিকে, নিজের দিকে, আত্ম-র
দিকে একটা টান থেকেই গেছে। তবে যত দিন যাচ্ছে, সব কথা সরাসরি বলে দেবার ইচ্ছে পেয়ে
বসছে ।
৩)।
অনেকদিন আছ এই লেখালেখির জগতে ।
ঠিক কিভাবে শুরু করলে ? শুরুটা কি সেই প্রথম প্রেমে পড়ে যেমন সব বাঙালি কবিতা লিখে
ফেলে , সেভাবেই
হয়েছিল , নাকি
আরো আগে থেকে হয়েছিল
,
নাকি
আরো আগে থেকে লিখতে শুরু করেছ ? সেই প্রথম দিককার লেখা এখন পড়লে তোমার কি মনে
হয় ?
সুমন
- হ্যাঁ , কবিতা আমি একেবারে ছোটবেলা থেকেই লিখছি।
হঠাৎই কোনও একদিন লেখা শুরু হয়। তার একটা পারিবারিক সুত্রও ছিল। আমার বাবা ছিলেন
নাটকের মানুষ। বাংলা একাংক নাটকের একসময়ের নামী ব্যক্তিত্ব। আমার খুব ছোটোবেলায়
তিনি মারা যান। বাড়িতে তাঁর রেখে-যাওয়া বইগুলো সব ছিল। সেগুলো গোগ্রাসে পড়ে
ফেলেছিলাম। বিশ্বের নানা ভাষার ধ্রুপদি লেখা --- নাটক, উপন্যাস, খুব বিখ্যাত কিছু
প্রবন্ধের সংকলন, কিশোর বয়সেই আমার হাতে এসে যায়।
সেসবের একটা প্রভাব নিশ্চয়ই কাজ করেছে। আর ছিল মূল্যবান সব বামপন্থী রচনার
সংগ্রহ। আমার মনে যে বামপন্থার একটা স্থায়ী স্পর্শ রয়ে গেছে, তার কারণও এটাই। তবে
আমার বাবার পরিশীলিত আদর্শবোধের কোনও উত্তরাধিকার আমি অর্জন করতে পারিনি, এটা
স্বীকার করা উচিত। নানা সুবিধেবাদী দৌত্যে দৌড়তে দৌড়তে জীবন কাটিয়ে দিলাম। আমার
কবিতাপ্রবণতার জন্য যে-দৈব ঋণ আছে পূর্বপুরুষের কাছে, তা এই জন্মে আর শোধ দেওয়া
গেল না।
তোমার
প্রশ্নের শেষ অংশের উত্তর আমি আগের প্রশ্নের জবাবের সঙ্গে দিয়ে দিয়েছি।
৪)। তোমার মহিলা ভক্তের সংখ্যা অনেক । আবার এও
শোনা যায় , তুমি নারী-ভক্ত । এই বিষয়ে তোমার নির্ভীক
বক্তব্য শুনতে চাই একটু ।
সুমন - আমার মুশকিল
হচ্ছে, আমি আমার কোনও আসক্তি লুকিয়ে রাখতে পারি না। মেয়েদের প্রতি আমার একটা নাছোড়
আসক্তি আছে। কোনও মেয়ের চোখ, ভুরু, চিবুক --- এইসব নির্দোষ পরিসর যেমন আমায় কাহিল
করে দিতে পারে, তেমনি সেই মেয়ের নানা গোপনাঙ্গের জন্যও আমি দিগ্বিদিক ভুলে ঝাঁপিয়ে
পড়তে পারি। এসব তুমি জান বলেই খুলে বলতে পারছি। তুমি না হয়ে অন্য
কেউ এই সাক্ষাৎকার নিলে এতটা বলা যেত কি না জানিনা। আমার একটা
কবিতার কথা বলি তোমায়। আমার এই নারীপ্রবণ
চরিত্রের অনেকটাই এতে ধরা আছে। পড়ো : “কলকাতায়
বেশ কয়েকবছর আমরা নারীমাংসের খোঁজে রাতদিন ঘুরতাম। তিন-চারজনের দল ছিলাম আমরা, কেউ একা খেতাম না। অন্তত, প্রথমবারের পর যাতে বাকিরা পায় সেটা
মেনে চলতাম। কখনো বন্ধুর বউকে সপ্তাহান্তে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে ওর ফাঁকা ফ্ল্যাটে, কখনো ট্যাক্সিতে বাড়ি ফেরার পরে যেটুকু হয়, নন্দন-ময়দানের
ঝোপঝাড়ে অগ্নুৎপাতের চর্চা তো ছিলই। বেহালায় একটা বাড়ি তো ভাড়াই নিয়েছিলাম, যেখানে
মন্দ আলোতে একজনকে দু’তিনজন মিলে, কখনো
পাশাপাশি ঘরে দু’জনকে --- কত কি করেছি আমরা! একবার তো এক
এলানো মধ্যবয়সিনী একই ঘরে উদ্যত আর অপেক্ষারত তিনজনকে পেয়ে হাসি চাপতে না পেরে
বলেই ফেলেছিল : ‘যা তা, কাউকে
গল্প করেও বলতে পারবো না!’'
আমি তো এখন বাইরে বাইরেই থাকি
বেশি। আমার বন্ধুরা অভ্যাস পাল্টায়নি এখনও, খবর
পাই।নারী শরীরের আহ্বান আমার কাছে কোনওদিন পুরনো হবে না। এটা
কিন্তু, আমি মনে করি, আমার মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল একটা স্বভাব। কারণ,
বয়স তো হচ্ছে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই যৌন আহ্লাদে তো অল্পসল্প পলি পড়ে যাবার কথা।
তা যে পড়েনি, এতে আমি নিজেই বেশ পুলকিত বোধ করি। আমার নানা বয়সের সঙ্গিনীরা আছেন।
তাদের সঙ্গে গোপনে বা প্রকাশ্যে, স্বাভাবিক বা বিকৃত নানা যৌনাচারে আমার দিন বেশ
ভালই কেটে যায়। প্রার্থনা করো, এই স্বভাব যেন আমি শেষদিন পর্যন্ত ধরে রাখতে পারি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন