'জুস্তিন' নামে আমার একটি লেখা কালিমাটির নভেম্বর সংখ্যায় ঝুরোগল্প হিসেবে বেরিয়েছিল। সেই লেখা পড়ে অর্জুন 'জলৌকা' নামক একটি লেখা লেখে এবং আমায় পাঠায়। আমি অর্জুনের লেখার আলোয় আমার লেখাটাকে বেশ খানিক অদল বদল করেছি। আমার লেখাটির আগের নাম ‘জুস্তিন’ পালটে ‘মেঘাংশিক’ করা হল। পাঠকদের জন্য এ এক নতুন স্বাদের জোড়া গল্পনা হবে আশা করি। দুটি লেখার এই দ্বিবিধ আলাপচারিতা পাঠকদের ক্যামন লাগে তা জানার আগ্রহ রইলো।
— অর্ক চট্টোপাধ্যায়
মেঘাংশিক
অর্ক চট্টোপাধ্যায়
আলোর উপর নীচে রাত্রিপোকা আর মধ্যরাতের পিছন পিছন পিছল-পথ। বর্ষাতি যখন বেদম হাওয়ায় জলৌকা হবে বলছে আর মেরুদন্ড থেকে উল্টে উল্টে পাল্টে পাল্টে বেরিয়ে আসছে অন্ধকারের ছাঁট, সটান সরলরেখার পথে এগিয়ে চলা। নিরবচ্ছিন্ন সাইডওয়াক। কিছুদূর পর পর হলদেটে একেকটা লাইটপোস্ট। বাকিটা ছোপ ছোপ অন্ধকার। একে জনবিরল দেশ তায় আবার মধ্যরাত; অতএব গভীরতর জনবিরতি এবং নীরবতা। মাথার ওপর ছাতার স্ট্রাগল বিরামবিহীন আর চোখের সামনে গাছে ঢাকা আবছা আবছা সাইডওয়াক; সেও বিরামবিহীন। আগামী এক কিলোমিটার এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে! নিজের দেশে সাইডওয়াকের নামে এমন নিপুণ বি-লাইন অকল্পনীয়। শেষ বাসটা মিস করলেও আজকাল আর খারাপ লাগেনা তন্ময়ের। হাঁটলে আধ-ঘন্টা! অব্যর্থ সরলরেখায় হাঁটবার উত্তেজনা আর জনহীনতা ঘিরে ধরে লোভ দ্যাখায়। তার ওপর আজ এমন খাশা ঝড়-বৃষ্টি।
তন্ময় সাইডওয়াক বরাবর সামনে তাকায় আবার। এক্কেবারে নির্মেদ একটি সরলরেখা। যেখানে তার দৃষ্টি মিলিয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে ডানদিক ঘুরলেই আস্তানা তার। দেখতে অমন লাগলেও ঐটুকু যেতেই পাক্কা ২৫ মিনিট। তন্ময় হাঁটা শুরু করে। সমান্তরাল সরলরেখার পথ দিগন্তের অন্ধকারে মিশে বৃত্ত হয়ে উঠবে; কিন্তু গল্পের সেই অনন্তকামী বৃত্তায়নের আগেই তাকে ডানদিকে বাঁক নিতে হবে আস্তানার পথে। মধ্যরাতের পিছনে ওই পিছল-পথ আর আলোর উপর নীচে রাত্রিপোকা। জলৌকা। গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে হেঁটে চলেছে তন্ময়।
"কখনো মেঘ প্রাচীন রাগে গান শোনা।
কখনো মেঘ বেসুর তোলা যন্ত্রণা।
কখনো মেঘ ঘর ছাড়ার হাতছানি।
কখনো মেঘ ঘরে ফেরার হয়রানি"
মেঘ মৃত্যুহীন; সম্বোধন থেকে সম্মোহনে সর্বত্র। আজকাল পেছন ফিরলে অন্ধকারটাকে কিউমুলো নিম্বাসের মতো মনে হয়। হাওয়ায় ভর করে বিন্দু বিন্দু হয়ে ওঠা এসে ভিজিয়ে দ্যায় মুখ। এভাবেই একদিন ইতিহাস শব্দটা জাঁকিয়ে বসে। মেঘে ভর করে এগোতে এগোতে বাঁকটার কাছে চলে আসে তন্ময়। হাওয়ার শনশন আর তার পদচালনা, এছাড়া কোথাও কোনও শব্দ নেই। তন্ময় ছাতাটা বন্ধ করে; বৃষ্টিটা আপাতত থেমে গ্যাছে। ছাতাটা বন্ধ করতে করতে দ্যাখে যেখানে দাঁড়িয়ে পড়েছে ঠিক সেইখানে তার মাথার ওপর এসে একটা মেঘও দাঁড়িয়ে গ্যাছে। এক চুলও নড়ছে না আর তার কল্যাণে বাঁদিকের লাইটপোস্টটাও খানিক ম্রিয়মান। খানিকক্ষণ মেঘটার দিকে মায়াভরে তাকিয়ে থেকে যেই এক পা এগিয়েছে, ডানদিক থেকে একটা কুকুরের গর্জনে রাস্তাটা যেন তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে। ডানদিকে দেওয়ালের নিচ দিয়ে ভেজা মাটির ওপর ওপর একটা কুকুরের চোয়াল বেরিয়ে রয়েছে । তন্ময় যত বাঁদিকে সরে সরে পা টিপে টিপে এগোতে থাকে, দেওয়ালের নিচ বরাবর চোয়ালটাও গুটি গুটি এগোতে থাকে; ক্ষণে ক্ষণে ওঠানামা করে শব্দ উৎপাদন করতে করতে। তারপর একসময় দেওয়ালের চৌহদ্দি শেষ হলে চোয়াল আর ডাক দুটোই থেমে গিয়ে নিরবতা ফিরিয়ে দ্যায়। তন্ময় ভাবে, আহা বেচারা যদি জানত সে কত বড় কুকুরপ্রেমিক তাহলে নিজেই দুঃখ পেতো নিজের আচরণে। যাক কি আর করা! গন্ধ-শব্দে প্রেম-অপ্রেম বোঝা ভার হয়তো।
তন্ময় আকাশের দিকে তাকায়। টুকটুকে কালো মেঘখানা আবার তার মাথার ওপর এসে দাঁড়িয়ে গ্যাছে। পেছনে তাকিয়ে দ্যাখে বাড়ির দেওয়াল যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে অমন করেই মাটির ঠিক ওপর বরাবর বেরিয়ে রয়েছে নিসঙ্গ চোয়ালখানা। মুখ আঁটো সাটো করে বন্ধ আর নাকের ওঠানামায় আদুরে খুনসুটি! তন্ময়ের মনে হয়, কুকুরটা উবে গিয়ে শুধু চোয়ালটাই যেন রেখে গ্যাছে; দেওয়াল সরিয়ে দিলেই দেখা যাবে ওপাশে আসলে কেউ নেই। কুকুরটার শরীরহীন চোয়াল নিঃসঙ্গ ভস্মের ভেতরে খুঁজে পাওয়া আরো নিঃসঙ্গ নাভিকুন্ডের মতো দেখাচ্ছিল। আর তন্ময়ের শরীর জুড়ে এক অজানা উত্তেজনা দানা বাঁধছিল সেই দিনটার দিকে মুখ করে যখন ভস্মের ভেতর খুঁজলে নাভিকুন্ড নয়, পাওয়া যাবে তার অদাহ্য যৌনাঙ্গ।
আজকাল পেছন ফিরলে অন্ধকারটাকে কিউমুলো নিম্বাসের মতো মনে হয়। হাওয়ায় ভর করে বিন্দু বিন্দু হয়ে ওঠা এসে ভিজিয়ে দ্যায় মুখ। এভাবেই একদিন ইতিহাস শব্দটা জাঁকিয়ে বসে। আর মেঘটা ঠায় দেখে যায়, রাস্তাটা যেখানে বৃত্তের আশা ছেড়ে ডানদিকে বাঁক নিচ্ছে।