আফ্রিকান জনজাতির সদস্য বেন ওকরি ১৯৫৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন নাইজিরিয়ায়। উচ্চশিক্ষার জন্য তার বাবা সপরিবারে লন্ডনে চলে যান বেন-এর দু’বছর বয়সে। ১৯৬৮তে জীবিকার জন্য ফিরে এসে লাগোস-এ থাকতে শুরু করেন। বেন-এর স্কুলে যাওয়া লন্ডনে প্রথমে, তারপর লাগোস-এ। লাগোসে শিকড়ের পরিচয়, গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, সংস্কৃতির মিশেল ভবিষ্যতে বেন-এর রচনায় প্রাণ সঞ্চার করতে থাকে। স্কুল পেরিয়ে চোদ্দ বছর বয়সে কলেজে প্রবেশাধিকার না পেয়ে কবিতা রচনা শুরু করেন কিন্তু প্রকাশক পাননি সেসবের। তখন ছোট গল্প লিখতে শুরু করলে সেসব প্রকাশিত হতে থাকে এবং কালে কালে গল্পকার হিসেবে বিখ্যাত হন। উপন্যাস লেখেন অনেক এবং প্রবন্ধ। ‘নবীন সময়বাদ’, ভৌত-বাস্তবতা, যাদু-বাস্তবতা, অতিপ্রাকৃত বাস্তবতা, অস্তিত্ববাদ, ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে নানা প্রবন্ধের বই আছে। কিন্তু সাহিত্য রচনায় তার মূল আকর্ষণই ছিল কবিতা। সারাজীবনে এত পুরস্কার আর সম্মান পেয়েছেন পৃথিবী জুড়ে যে তালিকা সুদীর্ঘ। কবিতা আর গল্প-উপন্যাসের চাকায় তার তুলনা আমাদের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো খানিকটা।
কবিতায় বেন ওকরি’র প্রাণের কথা সুখে দুঃখে টগবগ করে ফুটতো। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত তার “একটি আফ্রিকান শোকগাথা” নামের কবিতার বই থেকে তিনটি বিভিন্ন মুডের কবিতা বেছে বাক-এর জন্য অনুসৃজন করেছেন বারীন ঘোষাল।
বেন ওকরি-র কবিতা
(এক)
আমাদের লালটেনে কাঁপা চৌরাস্তা।
পথের পাথরমুর্তি আর তাতে পরকাশিয়া পাগল
শহর সরে উগরিয়ে যায় দূষণ তো।
ঘুপচি কোণেও ময়লা কুঁড়ো দেখে
অনেকেই রাগবো রাগবো করেও রাগে।
দেশে নাদেশে উদ্ভট বহুতলগুলো ছাড়িয়ে
অ্যাসিডের ট্যাসিড হয়ে ফোটে যেন আশের পাশে
যেখানে ক্ষমতার বমনদানী বমিকোরিয়ামে রাজনীতিকরা
গড়িয়ে দেয় আমাদের জীবন।
আমরা ছুটি দিন-জঞ্জালে উত্তেজনায়
চটাচটি করি ক্লান্ত চোখের ভয় তড়াসে
ক্ষয়া বসতিগুলোর সব্বাই
নিরীহ হোক, অপরাধী হোক, এক আগুনে জ্বালাই
দুপুরে। কোনাচের মুখরা চায়
বাঁকাচোরা ধন্য জীবনীর উলট বন্য
কটু কৌতুক মিশিয়ে খেয়ে ফেলছে,
নাকি অর্থশকুন বেদনা জর্জরণে
উড়িয়ে সময়ঝান্ডা হৈ ঐ ঘোষণা শোনো
নিংড়োতে হলে জীবিত, জীবিতদেরই হে
প্রায়ান্ধকারে লালটেনরা কাঁপে দেখে
শহুরে আঁধারে লালটেনগুলো লন্ঠন হয়ে যায়
আমাদের আলোছাড়া খুনী ক্ষমতা ওগো।
(দুই)
নির্মোক এই সুরের শহর এলোমেলো ঘুর্ণনে
আগুন, বিষফোঁড়া, অশুভিতার মৃত্যু তায়
আমাদের হাজির কর – অভিনিষ্ক্রমনে মনে
কেঅসের গভীরে আরো কাছে যাই। আমরাই তাপাঙ্কের জ্বর।
স্বার্থের বহু বহুতলে আমাদের স্বপ্নরা লটকে আছে দেখি
জাঁকিয়ে গোপন দৃশ্য ফুটিত। রোজ বিস্ফোরণ।
আমাদের দাগিও হে, ওহে, বিশ্বাসঘাতক বলেই না হয়।
ঠেকনা দিয়ে হালত আর নিরাপত্তাকে আমরা বাতিক বলে ঠ্যাকাই
লন্ঠন কুঁকড়ে উঠে শহরকে প্রকাশ করে ক্ষাপা ঋতু না কি ?
(তিন)
চটা আয়নার শহর
আকুল আকাঙ্খার শহর
পরস্পর জড়িয়ে আছি
নিবু নিবু শিখার ভেতরে সাঁড়াশির আক্ষেপে
মেঘ তুমুল ভেঙ্গে পড়লে মাথায় আমরা আগুন সঞ্চয় করে রাখি
গানের সময় আর সময়ের ছাই তুলে রাখি আগামী স্বচ্ছতায়
আমাদের শিকার-পাখিদের ওপর হামলার জন্য
আমাদের সবার এই প্রেম-আঁধারিয়া শহরে
এলোমেলো আবেগের ছবিতে একটা ছায়া পচে মিলিয়ে যাচ্ছে দ্যাখো
আতঙ্ক খোদাই করা তাতে কেবল কাঁপন
একটি আফ্রিকান শোকগাথা
আমরাই নাকি সেই অবাক কান্ড ভগবানে গড়া
সময়ের কটু ফল টল খাবো বলে
আমরা মহার্ঘ ; এবং একদিন
আমাদের যন্ত্রণার ফুল ফুটে উঠবে
পৃথিবীর আশ্চর্য হয়ে।
কয়েকটা ব্যাপার আমাকে জ্বালিয়ে খেয়ে
যা সোনালী হয়ে যায়, যখন খুশি হই।
আমাদের ব্যথার রহস্য তুমি দেখতে কি পাও
যে আমরা দারিদ্র্য বয়ে চলেছি গান গেয়ে গেয়ে
আর স্বপ্নে দেখি তারই মধ্যে মধুর জীবন।
বাতাস তপ্ত হলেও দুষি না তাকে
অথবা যেই ফল স্বাদু হয়
আলো যখন আস্তে লাফায় জলে
হাজার ব্যাথা পেরিয়ে সবকিছু মহিমাময় দেখি
আমরা সবার ভাল চাই যে নিরবে।
তাই তো আমাদের গানগুলো এত মধুর।
বাতাসকে তা স্মরণ করায়।
কাজের বেলায় আশ্চর্য আড়াল থাকে অনেক,
সময়কালে প্রকাশিত হয় তারা,
নিজেও তো আমি মৃতদের গান গাইতে শুনেছি
আর তারা আমাকে বলেছে যে
এই জীবনটাই ভাল
তারা আমাকে শান্ত থাকতে বলে
আগুনের মধ্যেও, শুধু এই আশায় যে
এর মধ্যেই আছে সেই অলৌকিক প্রাণ
বিস্ময় আরও আছে
সবকিছুর ভেতরে আছে অদৃষ্টের খেলা
সাগর তো গানে গানে ভরা
আকাশটা শত্রু কেন হবে
আমাদের বন্ধু নিয়তি তো