অভীক দত্ত
(কবিতা সম্পাদকঃ বাক ৭৯)
মে, ২০১৪
অনুপম বলছি
বাংলা কবিতা ২০২০-কে ধরার আশা ছেড়ে ১৯২০-র দিকে যেতে চাইছে
? সেই প্রবণতা তো আছেই। থাকেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যেভাবে কবিতা পড়তে শেখানো হয়, অনেকে সেইভাবে লিখতেও শেখেন। ফলে ২০১৪ সালে বসে কেউ নজরুল
বা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর মতো করে কবিতা রচনা করবেন, এটা ঘটতেই পারে, সোশ্যাল
নেটওয়র্কিং সাইটে এই ২০১৪ সালে সেটা ঘটতে দেখছি, এবং তাতে হাততালিরও অভাব হচ্ছে
না। তবে তার সঙ্গে আমি যেটা বলতে চাইছি, সেই পুনরাধুনিকের কোনো যোগ নেই। বিশ শতকীয়
শিক্ষাব্যবস্থা এবং মেধাদমনের সঙ্গে যোগ আছে।
প্রকৃত কবিতাচর্চার খোঁজ আমাদের এখানে মুষ্টিমেয় মানুষরা
রাখেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁরা শুধু পাঠক নন, তাঁরা সকলেই কবি। এটা শুধু ২০১৪-র
ব্যাপার নয়। এটা চিরকাল ছিল। বাচ্যার্থপ্রধান কাব্য বা কবিতা চিরকাল ভিড়ের সামনে
হাততালির সামগ্রী। অনেক অভিমান নিয়ে ভবভূতি লিখেছিলেন পৃথিবী বিপুল এবং কাল
নিরবধি। গালিবও বলেছিলেন অনেক খুব ভাল ভাল কবিই তো আছেন, তিনি শুধু একটু অন্যভাবে কথা বলেন। এই অন্যভাবে
কথা বলা, মানে উচ্চারণের বক্রতা, তাতে কবিতায় নেমে আসে লাবণ্যের পাশাপাশি সৌভাগ্য,
কিন্তু জনগণ কোনোকালেই বরদাস্ত করেন না সমকালে। কবির সেটা ভাবলে চলে না। কবি তাঁর মতোই লিখবেন। তাঁর ‘সময়ের
মতো’ করে নয়। কবির কোনো ঘড়ি নেই। দেশ একটা অবশ্যই আছে। কিন্তু সেটা কই?
কিন্তু স্টাইল আর ফ্যাশনের ভেদ অনেকেই গুলিয়ে ফেলেন। তাঁদের
লেখালেখির সঙ্গে টাইম মেশিনের সম্পর্ক, আমাদের সে নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
পুনরাধুনিকের ছলে আমি বদল্যেরের কালে বা রবিঠাকুরের বা
জীবনানন্দের কালে ফিরে যাওয়ার কথাও বলছি না। শুধুমাত্র আধুনিকের কথাই বলতে চাইছি।
সেই আধুনিক, যার দিকে সকলেই আজ সন্দেহের চোখে তাকান। জেলফেরত আসামীর অবস্থা হয়েছে
আজ এই টার্মটির। সেই আধুনিক, যে কারও পাকা ধানে মই দেয়নি, পোস্টমডার্ণ ধারণার
সঙ্গে তার কোনো শত্রুতাও নেই, তবু তাকে গালমন্দ শুনতে হয়। তাকে পদে পদে বুঝিয়ে
দিতে চাওয়া হয় সে বাতিল হয়ে গেছে। তার মুখ দেখানোর দরকার নেই। কিন্তু আধুনিকের
তাতে কিছু আসে যায় না। শুধু তার নামটার উচ্চারণে জড়তা দেখা যাচ্ছে। কেউ আজ খোলামনে
‘আধুনিক’ শব্দটা কি ব্যবহার করতে পারছেন, একমাত্র কিছু সরলমতি স্বল্পশিক্ষিত মানুষ
ছাড়া ?
আমি বলছিই না ‘আবার আধুনিক’। আমি বলতে চাইছি ‘ফিরে ফিরে
আধুনিক’, ‘বারে বারে আধুনিক’। আমি বলতে চাইছি ‘চির-আধুনিক’।
এই পরিসরে অধুনান্তিক চেতনা দিয়ে নতুন আর কিছু হবে না। তার
চেয়ে অনেক দাবি নতুন আধুনিকের। হতে পারে সেই আধুনিকের চিরবিরাজমানতার সঙ্গে সময়ের
যোগ অছিলার চেয়ে বেশি কিছু নয়।
বাংলা কবিতায় অধুনান্তিকতার সূত্রপাত হয়েছিল জীবনানন্দ
দাশের ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থ থেকে। ওই কাব্যগ্রন্থ যখন রচিত হচ্ছিল
উপনিবেশ ফুরিয়ে আসছিল। আমাদের আধুনিক ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশের দান। উপনিবেশের সঙ্গেই
আধুনিকের একটা পর্যায় শেষ হচ্ছিল। সে অবিশ্যি শেষ নয়। সে পৌঁছতে চাইছিল আধুনিকের
অন্য এক স্তরে। এই অবস্থায় উত্তর-উপনিবেশ যে সংকর পরিসরের জন্ম দেয়, যে অনির্দিষ্টতার
সৃষ্টি করে, তাকেই অধুনান্তিক বলতে চাইব আমি। জীবনানন্দ তাঁর কাব্যগ্রন্থটিতে তার
সূত্রপাত করেন বাংলা কাব্যভাষায়। তারারও যে তিমির হয়, সে যে আসলে আমাদের যাপনের
কুহক, জীবনানন্দ তাকে টের পেয়েছিলেন। বাংলা কবিতায় প্রথম এসেছিল কেওস, মিশ্রতা, অনির্দিষ্টতা,
প্রলাপ।
জীবনানন্দর পরে এই কুহকের সঙ্গে যোগ হয় মলয় রায়চৌধুরীর এবং
অন্যান্য হাংরি কবিদের। হাংরি আন্দোলন আধুনিক আন্দোলন ছিল না। যে কোনো আন্দোলন
অধুনান্তিকের পরিসরে নিয়ে যায়। আধুনিকে শুধু বিপ্লব হতে পারে। বিদ্রোহ নয়। ওই
আন্দোলনের দিকে তাকালে এখন আমার মনে হচ্ছে পরে আলদা করে অধুনান্তিকের আন্দোলনের
প্রয়োজন কিছু ছিল না। অবশ্য চিন্তকরা হাংরিকে আধুনিকের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। হয়তো তার
পিছনে আছে বদল্যেরের জেনেটিক আবহাওয়াটির প্রতি অজানিত মোহজাত একটি অপব্যাখ্যা যে,
আধুনিক কবিতা একঘেয়েমি, অবসাদ, আর্তনাদ, পাপ, আত্মধংসের ধারাভাষ্যকে অবলম্বন করে
একমাত্রিকভাবে। সেটা হতেই পারে না। আধুনিক সর্বদাই
আলোর দিকে যায়, এবং অন্ধকারের সঙ্গে যুদ্ধ করে। সে তিনি রামমোহন হোন, লেলিন, টলস্টয়, বা
রেমব্রান্ট ... আলোর পিপাসা একজন আধুনিক মানবের থাকতেই হবে।
মলয় রায়চৌধুরীর ‘জখম’-ক আধুনিক নয়, অধুনান্তিক কবিতাই আমি
আজ বলতে চাইবো। যেমন আজ আমি বদল্যেরকে আধুনিকের প্রকৃত ব্যাখ্যা থেকে আধুনিক বলতেই
পারি না। র্যাঁবোকে তো একেবারেই না। প্রথম পর্বের টি এস এলিয়টকেও না। ওই কবিরা
দুই আধুনিকের সংযোগ রক্ষা করেছেন। এলিয়ট তাঁর শেষ পর্বে আধুনিক হয়ে উঠেছিলেন। বরং
ইয়েটস প্রথম থেকেই আধুনিক।
আধুনিক ... তার সঙ্গে ঐতিহাসিক যোগ নবজাগরণের,
আলোকপ্রাপ্তির, সমাজশোধনের। এই তিনটিকে এক শ্বাসে উচ্চারণ করলাম বটে, কিন্তু এদের
মধ্যে ফারাক বিস্তর। নবজাগরণের সঙ্গে সমাজশোধনের কোনো যোগ কি আছে ? লিওনার্দো দা
ভিঞ্চির সঙ্গে আপনি মার্টিন লুথার কিং-কে কী করে মেলাবেন ? আবার রামমোহনের
ক্ষেত্রে আমরা সতীদাহ রদ বা বাংলা গদ্যের প্রবর্তন ... আলাদা করতে পারি না। উনি
একাধারে নবজাগরণ এবং সমাজশোধনের অগ্রদূত। একজন সম্পূর্ণ মানুষ। একজন আধুনিক মানুষ।
এই সম্পূর্ণতার দিকে যাত্রা, যা কদাপি ফুরোবে না, কিন্তু এই যাত্রা, তার কোনো
উদাহরণ আমরা আমাদের অদূর সাম্প্রতিকে দেখতে পাচ্ছি না। আমরা খুব স্পষ্টভাবেই
আধুনিক নই, যদি ঊনবিংশ শতাব্দির আধুনিককে স্মরণ করি। আমরা আমাদের মধ্যে কোনো
রামমোহন বা বিদ্যাসাগর বা ডিরোজিওকে দেখতে পাচ্ছি না। এর ফলে ক্রমেই আমরা ওই
মহামানবদের দেবতা বানিয়ে রাখছি, যে দেবতাকে হয় আপনি পুজো করতে পারেন, বা অবজ্ঞা
করতে পারেন।
আইকনের অবশ্য প্রয়োজন আছে সমাজে।
বাংলা কবিতার প্রথম আধুনিক কবি শ্রী মধুসূদন আর শেষ আধুনিক
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মধুসূদন আলোর রাষ্ট্রদূত। বাংলার সবটুকু আলোকপ্রাপ্তি তাঁর
মধ্যে সংহতি পেয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ একটা নবজাগরণের সারাৎসার। তাঁর চেয়ে আধুনিক
কোনো দেশে কালে কেউ হবেন না।
আবার বিষ্ণু দে বা সুধীন্দ্রনাথদের আধুনিক ঈশ্বর চন্দ্র
গুপ্তর চেয়ে কিছু মূল্যবান নয় আমাদের পরিসরে।
আর জীবনানন্দ দাশ বাংলার প্রথম অধুনান্তিকের কবি। অধুনান্তিক...
যে পরিসরে একটি আধুনিক এসে ওভারল্যাপ করে আরেক আধুনিকে। আজ পড়লে মনে হয় জীবনানন্দর
‘সাতটি তারার তিমির’-এ বিশ শতকের শেষ বিশ্বযুদ্ধ অবধি টিকে থাকা আধুনিক হাত মেলাতে
চাইছে আমাদের তথ্যবিস্ফোরণের অর্গ্যাজম ঘটে যাওয়া আধুনিকের সঙ্গে। জীবনানন্দ দাশ
নিজে আধুনিক হতে পারেননি। কিন্তু আসন্ন অধুনান্তিককে সনাক্ত করা কবি হিসেবেই তিনি
মহামূল্যবান। তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম তাঁর ভাষায় সংক্রমিত হলেও তাঁর এই মূল্যায়ন
করেনি।
সত্তরের দশকের সূচণায় আমাদের এখানে অধুনান্তিক সবচেয়ে
স্পষ্ট হয়। কিন্তু তার কোনো ভাষ্যকার ছিলেন না বাংলা কবিতায়। বরং ‘যদুবংশ’-র মতো
সিনেমায় তা কিছুটা ধরা পড়েছিল। ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ সিনেমাতেও
তার আভাস ছিল। বরং অধুনান্তিকতার চেতনা বাংলা কবিতায় ছিল না। তা আসে বাইরে থেকে। ফুকো-দেরিদা-বদ্রিলারদের হাত ধোয়া হয়ে অনেক পরে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষে যখন তা
আসে, আমাদের এখানে তখন অধুনান্তিক পরিসর অন্য
আধুনিকতায় ঢুকতে চলেছে। সমীর রায়চৌধুরী, প্রভাত চৌধুরী এবং মলয় রায়চৌধুরীর
বিলম্বিত পর্য্যায়ের কবিতায় সেই চেতনা উপসংহার পায়, যার সূচণা ‘সাতটি তারার তিমির’
করেছিল। হ্যাঁ, আবার বলছি, ওঁরা শুরু করেননি। অসামান্যভাবে শেষ করেছেন। আর,
ঘোষিতভাবে না হলেও আজীবন ওঁরা অধুনান্তিক লেখালেখিই করেছেন।
এই পরিসর থেকেও, এই ২০১৪-র পশ্চিমবঙ্গের কথা বলছি,
অধুনান্তিক ফুরিয়ে যায়নি। তার রেশ রয়ে গেছে। এখনও আমরা মিশ্রতা এবং কেওস ছাড়া
বাঁচতে পারছি না। কেন্দ্রের শান্তি বা স্বস্তি চাইলেও মিলছে না। চিন্তাভাবনার
স্বকীয়তা হাঁফিয়ে উঠে পরিধির দিকে ছুটছে।
যে রাজনৈতিক পরিসরে আমরা বেঁচে আছি, তা অভিভাবকশূন্য। কোনো একজন বিরাট মানব আমাদের সামনে
আর বেঁচে থাকছেন না। একজন গান্ধিকে আমরা সমর্থন করি বা না করি, তাঁকে একজন পিতৃমূর্তি হিসেবে সামনে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের। তাঁরা নেতাজিকে পেয়েছিলেন। এমনকি হয়তো নেহরুকেও। আমাদের পূর্বপুরুষরা রাজনৈতিক
বিগ্রহকে দৃষ্টিপথে রেখে পথ বেছে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন এই দেশের বাসিন্দা হিসেবে। বেছে নেওয়া পথটি ঠিক বা ভুল যাই হোক, অসৎ হতো না। একটি ভুল কিন্তু সৎ পথে হাঁটাও এক যথার্থ রাজনীতি। আজ সেই রাজনৈতিক ইতিহাস উপন্যাস হয়ে গেছে।
ব্যক্তিকে সমষ্টির অন্তর্ভুক্ত করে
নেওয়া যেমন রাজনীতির কাজ, সমষ্টিও চায় একজন দীর্ঘ ব্যক্তিকে তাদের নেতা হিসেবে। তিনিই অবলম্বন, যদিও নালিশের অবকাশ তাঁর কাজকর্মে থেকে যেতে বাধ্য। তাঁকে ধমক দিতেও ছাড়ে না জনসাধারণ। সোজা চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকবে তারা। তিনিও চোখ সরাবেন না তাদের চোখ থেকে।
আমাদের সামনে সেরকম এক বা একাধিকজন কি রয়ে গেছেন! রাজনীতি এই মুহূর্তে আমাদের যতখানি হতাশ করছে, এর আগে কখনও করেনি বলেই মনে হয়। এর আগে ভারতীয় রাজনীতি লড়েছে উপনিবেশের সঙ্গে, দারিদ্রের সঙ্গে, অন্নাভাবের সঙ্গে, আগ্রাসনের সঙ্গে, কালোবাজারের সঙ্গে, এমনকি ভুল রাজনীতির সঙ্গেও। তার মধ্যে কিছু নেতা নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতেন। আজ সে শুধুই লড়ছে নাগরিকদের বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। আমাদের ধূসর পদার্থটির রংবদল যেন আজ একমাত্র লক্ষ্য। আবার আখের গুছিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনো লক্ষ্য নেতাদের সামনেও যেন দেখতে পাচ্ছি না। কেন তাঁরা রাজনীতি করেন, প্রতাপের লোভ ছাড়া অন্য কোনো উত্তর তো কেউই নিজেদের বিবেককে দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। তাঁরা অন্ধ, কাজেই ভারতবর্ষকে পথ দেখানোর সাম্প্রতিক পুরষ্কার তাঁরা লাভ করেছেন।
এই বন্ধ্যা রাজনৈতিক পরিসরে, যেখানে প্রতাপের হাত থেকে শুধুই কিছু সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন আছে স্থায়ী কল্যাণ নেই, আবার অন্যদিকে পথভোলা সন্ত্রাস আছে শুদ্ধ বিপ্লব নেই, আমাদের সামনে উপরের লাইনগুলো জ্বলে ওঠে। আমরা হয়তো রাজনৈতিকভাবে হিংস্র হয়ে উঠতে ভুলে যাচ্ছি, আবার ‘তথাস্তু’-ও
বলতে পারছি না। আমাদের সিদ্ধান্তগুলো অন্য কেউ নিচ্ছে, কিন্তু তাতে আমাদের সায় থাকছে কিনা সেটাও আমরা বুঝে নিতে চাইছি গণমাধ্যম খুলে। ক্রমাগত উৎপন্ন সংবাদের ভিড়ে আমাদের সামনে থেকে হারিয়ে গেছে সেই সটান তাকিয়ে থাকা চোখগুলো, তারা যেন চলে গেছে মরণের অন্তর্গত সেই অন্য রাজত্বে যেখানে আমরা কোনোদিন পৌঁছব না।
আজ ব্যক্তিগতভাবে কেউ রাজনৈতিক সততায় অবস্থান করতেই পারেন, কিন্তু একা সেই স্বর্গে পৌঁছনো যায় না।
মনীষীরা আমাদের মধ্যে আছেন, তাঁদের জীবনকাহিনি যতই অবিশ্বাস্য হয়ে যাক। তাঁদের চোখ আজও আমাদের উপরেই আছে, যতই তাঁদের রক্তমাংসের শরীরকে আড়াল করা হোক, বা করা হোক বেস্ট সেলার উপন্যাসের খোরাক। রবীন্দ্রনাথের একান্ত প্রেমকাহিনিগুলো নিয়ে আজ ব্যবসা হচ্ছে, তিনি যে সেগুলো জনসমক্ষে আনতে চাননি সেটা যেন মূল্যহীন। গান্ধির যৌনজীবন নিয়েও তো লেখা হল
কত বই। বিদ্যাসাগর কেমন গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তাঁর লিভারটি উলটে গিয়েছিল, সেদিন দেখলাম একজন তরুণ কবি সেই নিয়ে মজা করেছেন ফেসবুকে।
মৃত বা জীবিত কারো পক্ষেই জনমানসে আজ বিগ্রহ হয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠছে। আজ যেকোনো আইকনকে প্রশ্ন করা যায়। তাঁর নিহিত আইরনিকে নিংড়ে নেওয়া যায়, তাঁকে ছিবড়ে করে ফেলার মূর্খ প্রয়াসে। খুব স্বাধীনভাবেই আজ একজন সেটা করতে পারেন। অনেকেই উপভোগ করবেন। আপত্তি হাস্যকর হয়ে যাবে, যেন একজন পুজো করতে চাইছে, ফুলবেলপাতা দিতে চাইছে।
সেই চোখগুলো কি নেই? আমাদের সমবেত অচেতনে তো তারা হারিয়ে যায়নি, রয়ে গেছে। চায়ের দোকানের ক্যালেন্ডারে ক্যাটরিনা ফাইফের পাশেই যখন ঝুলতে দেখি অন্যমনস্ক রবীন্দ্রনাথকে, সেই অচেতন তরঙ্গায়িত হয়, মুখর হতে চায়। ইন্দ্রজালকে আমরা সহ্য করতে শিখি। সহ্য
করতে করতেই তাকে ছিঁড়ে ফেলতে শিখব। তখন ইন্দ্রজাল আর অলীক থাকবে না, কৌশলমাত্র হয়ে
যাবে।
আজ মহামানবের চোখ যেন বিয়াত্রিচের চোখ, দান্তের সেই কবিমানসীর চোখ। অনন্ত নক্ষত্র। অনেক পাতার আড়ালে ঢাকা গোলাপ। মরণের গোধুলিরাজত্বে সেই চোখ আমাদের সম্বল হতে পারে। অবশ্য এই বাক্যকেও বিদ্রূপ করার মানুষরা আমাদের মধ্যে আছেন। তবু মনে হয় আইকনগুলোকে রক্ষা করার চেষ্টা প্রয়োজন, তাঁদের নিজ নিজ কিংবদন্তির আড়াল থেকে আমাদের উপরে নজর রাখুন ওঁরা।
জীবনের নিষ্পাপ দিকগুলো তাহলে রোমাঞ্চশূন্য হবে না। সেই রোমাঞ্চেরও যে কিছু বানিজ্যমূল্য আছে, ‘লগে রহো মুন্নাভাই’ বা ‘ম্যায়নে গান্ধিকো নেহি মারা’-র মতো সিনেমা তার প্রমাণ। এই সিনেমাগুলো গান্ধিকে তাঁর শ্লেষ থেকে মুক্ত করে জনসাধারণের সামনে আইকন হিসেবে পেশ করেছে। আমরা জানি দেবতাদের জন্ম হয়েছিল জনসাধারণের স্বার্থেই। ফাঁপা মানুষদের সামনে মহামানবদের দেবত্ব বজায় থাকা জরুরি, তাঁদের জ্যোতির্বলয়টি অক্ষুন্ন রাখা জরুরি।
ওটুকুই একমাত্র আশা। হয়তো রবীন্দ্রনাথের ছবির সামনে একটি ফাঁপা মানুষ আরেকটি ফাঁপা মানুষকে ধর্ষন করবে না। তাঁর চোখ তাকে বিরক্ত করবে, বিরত করবে। আমরা যে সেটাকে ছিঁড়ে ফেলছি, এটা মঙ্গলজনক নয়।
জীবনটাই যদি এক রিয়ালিটি শো হয়ে ওঠে? এরকম একটা সিনেমা হয়েছিল হলিউডে, নায়ক ছিলেন
জিম ক্যারি, সিনেমার নাম ছিল ‘দ্য ট্রুম্যান
শো’। লোকটির সারাজীবন টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হচ্ছে, সে কিন্তু জানে না। ‘ট্রুম্যান’… নামটা লক্ষ্য করুন। লক্ষ্য করুন বাসেট্রামেট্যাক্সিতেহাটেবাজারেস্কুলকলেজঅফিসে
আপনার আশপাশের মানুষগুলোকে, বিশেষ করে চল্লিশের কমবয়সীদের। দেখুন সকলে কেমন টিভির পর্দায় হাঁটছে, ফিরছে, সরছে, কথাবার্তাও
বলছে সেই ভাষায়, সেই ভঙ্গীতেই কানে ধরে আছে সেলফোন। স্যাটিলাইট আর মাটির পৃথিবী ক্রমেই
একাকার হয়ে যাচ্ছে আমাদের চোখের সামনে। যেন সারা সমাজ হয়ে উঠছে ‘বিগ বস’-এর বাড়ি, প্রেমে
নেমে আসছে বাংলা সিরিয়ালের সংলাপবিধি, বিছানায় নেমে আসছে পর্ন
মুভির পোজিসনগুলো, তর্কে নেমে আসছে নিউজ চ্যানেলের কথাবার্তা।
একজন জীবনানন্দ দাশ তো আজ আমাদের মধ্যে নেই, যিনি বাংলার প্রধান কবি হয়েও একজন গ্রাম্য মানুষের পোশাকে হনহনিয়ে হেটে যেতেন কলকাতার রাস্তায় চীনেবাদামের মতো শুকনো বাতাসে। শিমূলপুরের বাসিন্দা একজন বিনয় মজুমদার এই পরিসরে বড্ড বেমানান।
এই হয়তো মরণের স্বপ্নরাজ্য। বা স্বপ্নের মৃত্যুরাজ্য। সেটা মনে
হতেই পারে। যদি আধুনিকের অমরত্বে আস্থা না রাখেন, আপনার মনে হতে পারে, মানবের আর
যাওয়ার নেই, তার যাওয়া ফুরিয়েছে।
আমি কি একটু ভেসে যাচ্ছি আবেগে? সেটাই কি মনে হয়? কিন্তু দেখুন, একবার যখন আইপিএল এসে পড়ে, আমাদের বুদ্ধিমত্তা কেমন চিয়ার লিডারদের পক্ষে এবং বিপক্ষে আত্মহারা হয়ে পড়ে। আমরা ম্যাচ ফিক্সিং নিয়ে ভাবতে থাকি, যেন ওই ব্যাপারটায় খাঁটি না থাকা মানবতার সবচেয়ে বড়ো সংকটটাকে দর্শাচ্ছে। ‘আমি আইপিএল দেখিনা’ – এটা বলাও হয়ে ওঠে এক ইন্টেলেকচ্যুয়াল অবস্থান। যেন নগন্য আমিশাষীদের পার্টিতে একজন এলিট বিনা নোটিশে জানালেন তিনি নিরামিষভোজী। সেটাকে সমর্থন যেমন করা যায়, সন্দেহও করা চলে। সন্দেহ
করে লাভ নেই। সমর্থণে শান্তি আছে।
তবু, শান্তিতে থাকার সম্ভাবনায় এখন আমরা আছি। শান্তির সঙ্গে
অসাড়তাকে গুলিয়ে না ফেলেই।
এবং আমরা বেঁচে আছি।
আমরা বেঁচেই আছি। প্রমাণিতভাবেই বাঁচছি আমরা। আমাদের বাঁচা
ঐতিহাসিকভাবেই কিছুমাত্র কম বা বেশি হচ্ছে না।
অবিশ্যি এখন সময় এসেছে তথ্যপ্রযুক্তির কুহকের সঙ্গে চরম বোঝাপড়ার। একটা হেস্তনেস্ত
করা এখন সম্ভব হয়ে উঠেছে। স্বপ্ন আর আলাদা করে কোথাও নেই। স্বপ্ন আর বাস্তব এখন
একাকার হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির কোনো নতুন দিগন্ত আর আমাদের হতবাক করে দিতে পারবে
না। খুব বেশি হলে আমাদের সন্তুষ্ট করবে ব্যবসায়ীকভাবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের
সংযোগের দিকে তাকান। দেখুন ফেসবুক আপনার পায়ের তলায় কুকুর ছাড়া কিছু নয়। সে আর
নিজেকে কোনো অন্যগ্রহ হিসেবে দাবি করার স্পর্ধা করছে না।
বিশ শতকীয় অধুনান্তিকের কেওসকে কবিতায় স্থান এখনও দিতেই
হচ্ছে। সে তো ফুরিয়ে যায়নি। তবে প্রতিধ্বনিতে ধ্বনিটিকে চিনে নেওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু, আমার বিশ্বাস, জন্ম নিয়েছে নতুন আধুনিক। তাকেই আমি
বলছি পুনরাধুনিক। নিজের কবিতায় তাকে রূপ দিতে চাইছি।
আমার মতে এই সময়ের কবিতায় এই গুণগুলি দেখা দিচ্ছেঃ
১। কবিতায়
যুক্তিরেখা আবার সংহত হচ্ছে। তবে জার্নিটা কেওস থেকেই শুরু হচ্ছে। কেওস থেকে
কসমসের দিকে। প্রান্ত থেকে কেন্দ্রের
দিকে। তবে কেন্দ্র সেখানে ঝড়ের শান্তবিন্দু। সে আধিপত্য করছে না। কেন্দ্রকে বাদ
দিতে চাওয়া জীবনবিরোধী ধারণা। জীবন কদাপি কেন্দ্রে পৌঁছয় না, কিন্তু কেন্দ্রের
দিকে যাওয়ার প্রয়াসরূপী কল্যাণ থেকে তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কোনো অর্থ হয় না। কিন্তু
কোনো আধিপত্যকে মেনে নেওয়া হবে না জ্ঞান ছাড়া, উৎকর্ষ ছাড়া। মহামানবের পথ চেয়ে না
থাকার ভুল আমরা করব বলে মনে হয় না। মহাসন্দর্ভের অপমান করার স্পর্ধাও কি আমাদের
হবে ? ফেসবুকে রোজ পোস্ট হওয়া কবিতার সঙ্গে তাকে গুলিয়ে ফেলার ভুল আমরা করব বলে
মনে হয় না।
২। বহুরেখায় ছড়িয়ে পড়া কবিতা, একরেখার আশ্বাস খুঁজছে। সে তা
পেতে পারে না। একটিমাত্র রেখা অসম্ভব। একটিমাত্র রেখা তাকে চাইলেও দেওয়া যাবে না।
আমরা জানি। তবু, একে শান্তির পিপাসা বলা যেতে পারে। যেমন আমরা মৃত্যুর দিকে একমুখী
ছুটে চলা এবং একঘেয়েমিকে ভুলতে চাই। ইউনিটি অফ ইম্প্রেসন থাকা চাই পুনরাধুনিকের
কবিতায়। তাতে কবির বহুত্বে খাদ পড়বে না।
৩। পুনরাধুনিকে কোনো বিষয় আলাদা করে নেই। কিন্তু অনেক
বিষয়ের আদল দেখা দিচ্ছে। এত সম্ভাবনায় মানুষ ইতিহাসে আগে কখনও পৌঁছয়নি। যাপন এখন
এক অর্কেস্ট্রা। এই ঐকতান একটাই ধারণা পাঠককে দিতে পারছে। পাঠক অনেক কিছু ভাববেন,
একটা ভাবনাকে বেছে নেবেন। কবি সেটা করছেন বিষয়ের অতীত হয়েই। একের বদলে একাধিক
বিষয়। তারা মিলে যাচ্ছে একটা সম্ভাবনায়, তাকে সনাক্ত করার ভার পাঠকের, তাঁর
কল্পনার। বিষয় তার অনেকত্ব লুকিয়েও যেন বিস্ময়ের সূচণা করে। অংশুমান দে-র
সাম্প্রতিক কবিতায় এই গুণ আমি দেখেছি। মুগ্ধ হয়েছি।
৪। আজ ‘আমি’-র উৎসব
দ্বিধাহীনভাবে কবিতায় দেখা দিচ্ছে। কবি ‘আমি’ লিখতে লজ্জা পাচ্ছেন না। একটা আমিকে
ঘিরে কবিতা তৈরি হচ্ছে না। সেটা হলে জীবনানন্দ-র চেয়ে আলাদা কী আর হবে? বিভিন্ন
সময়ে ও স্পেসে উনি আমি-র হদ্দ করেছেন না-ছুঁতে পারার দুঃখ এবং নস্টালজিয়া দিয়ে।
পুনরাধুনিকের আমি-র মধ্যে অনেকগুলো আমি দেখা দিচ্ছে। সেই আমিগুলোর মধ্যে কোনো
একটার সঙ্গে পাঠক নিজেকে মিলিয়ে নেবেন। এটা আধিপত্য নয়। নিজেকে চেনার চেষ্টা।
একাধিক আয়নায় নিজেকে দেখার পিয়াস। আয়নাটা একইসঙ্গে কবির এবং পাঠকের হবে কি? সমমন
হলে হতে পারে। তাহলেও ছবিটা মিলবে না। কিন্তু ছবি একটা আছে। সেটা জুড়ে জুড়ে
বানানোর ধাঁধা নয়। অমিতাভ প্রহরাজের কবিতা দেখুন। ওর আমি-তে আমি আছি, আপনিও কি
নেই?
৫। অনেক কন্ঠস্বরের যোগে একটি কন্ঠস্বরে কবি পৌঁছতে চাইছেন।
বহুত্বের অঙ্গনে নিজের ‘একমাত্র’-কে তিনি সন্ধান করছেন। আবার যাত্রাটা হচ্ছে
বিদিশা থেকে দিশার দিকে। এটা সেই কবিই পারছেন, যিনি বিদিশার সাধক, কিন্তু দিশার
প্রেমিক। ঘর ছেড়ে বনের দিকে নয়, বন ফেলে ঘরের দিকে। দীক্ষিত পাঠক তাঁর সঙ্গী হবেন।
৬।বাস্তব নিয়ে বা কুহক নিয়ে বাড়াবাড়ি পুনরাধুনিক কবি করছেন
না। ওই দুটি ধারণা এই পরিসরে আর আলাদা নয়। তারা আজ একটা মুদ্রার একটাই পিঠ।
ঠোঙাভরা বাদামভাজা আপনি খাচ্ছেন কি খাচ্ছেন না, গিলছেন কি গিলছেন না, পাঠক আপনার
মুখের মধ্যে উঁকি মেরে দেখবেন না। শ্রয়ডিঙ্গারের বিড়াল এখানে রুমাল হয়ে গেছে।
রঙ্গীত মিত্রর কবিতা দেখুন। রঙ্গীত এই ব্যাপারটাকে অটোগ্রাফ দেওয়ার জায়গায় নিয়ে
গেছে। ওর ‘রুমালে বিয়ারের গন্ধ’ পড়লে পুনরাধুনিকের ব্যাপারটা আপনাদের কাছে
স্পষ্টতর হবে।
৭। প্রগতির প্রতি আস্থা এবং আশা আছে কবির। যে সমাজে ধর্ষণ,
ঘুষ, স্ক্যাম, চিট ফান্ডের কেলেংকারি ভুরি-ভুরি, ডাক্তার যেখানে লোলুপ ব্যবসায়ী
মাত্র, শিক্ষক নিজেই অশিক্ষিত হওয়া সত্বেও কোটার ভিত্তিতে ছাত্রছাত্রীদের ‘গুরু’
হয়ে বসছেন, সেখানে প্রগতির ধারণাকে আপনি বাদ দেবেন কী করে? তবে এগিয়ে যাওয়া নয়,
পুনরাধুনিক কবি মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে চান। তিনি চান মানুষের মধ্যে পশুত্বর
সেই দিকগুলো চাপা পড়ুক, যেগুলো অন্যান্য পশুদের মধ্যেও দেখা যায় না, শুধু মানুষ
সেগুলো পারে। পুনরাধুনিকের কবি আইকনকে চুরমার করতে চান না। সাধারণ মানুষের মধ্যে
আইকনকে বাঁচিয়ে রাখতে তাঁর আপত্তি নেই। আইকনের আইরনিগুলো তিনি নিজে জানবেন, ও ধারণ
করবেন।
৮। সব ডিসকোর্সবিরোধী কথাবার্তার সারবত্তা মেনে নিয়েও একজন
পুনরাধুনিক কবি অন্তত জ্ঞানের আধিপত্যকে মেনে নিতে চান। জ্ঞানী মানুষরা আধিপত্য
করুন। অজ্ঞানীরা ব্যাকবেঞ্চে বসুক। সব অবিনির্মাণের পরেও একজন অজ্ঞানীকে সমাজে
সমমর্য্যাদা দেওয়া অনুচিত। এতে সমাযে অকল্যাণ ছাড়া কিছু হয় না। আজকের রাজনৈতিক
পরিসর তার প্রমাণ। অফিসে পিওন হতে গেলে যে জ্ঞান এবং বিদ্যা দাবি করা হয়, ভোটে
দাঁড়ানোর জন্য সেটা লাগে না। আর, রাস্তায় নামলে আপনি দেখবেন শিক্ষার কোনো মূল্য
নেই। সকলেই সমান। রাস্তায় আজ পন্ডিত আর পুজো পাননা। হ্যাঁ, পুনরাধুনিক কবি
বিদ্যাশিক্ষাজ্ঞানের নিরিখে উঁচু মানুষ এবং খাটো মানুষের বৈষম্যরক্ষার সমর্থক।
মূর্খতার প্রতি তাঁর সীমাহীন ঘৃণা।
৯। প্রতীককে অস্বীকার করার কোনো মানে হয় না, বিশেষ করে
আমাদের দেশে, যেখানে গাছের তলায় পাথর পেলেই শিবপুজো আরম্ভ হয়। ইউরোপেও তাই। যে
দেশে দেওয়ালের শ্যাওলায় দাড়িওলা মুখ ফুটে উঠলেই যিশুর মির্যাকল ভেবে নিয়ে হইচই
শুরু হয়, সেখানেও এর কোনো মানে হয় না। হিন্দু বা ক্যাথলিক ধর্ম যেখানে রমরমিয়ে
চলছে, সিংহভাগ মানুষের শরীরে তাবিজ বা সুতো, সেখানে প্রতীকের বিরোধীতার কোনো মানে
হয় না। এখানে জিনস পরিহিতা তরুণী মোবাইল সামলে কালীমন্দিরে মাথা ঠেকিয়ে সাইবার
কাফেতে ঢুকে গিয়ে প্রেমিকের, থুড়ি বয়ফ্রেন্ডের, ই-মেলের প্রিন্ট-আউট নেন। আর,
চাইলেও প্রতীককে আপনি বাদ দিতে পারবেন না। মনঃস্তাত্বিকভাবেই সেটা অসম্ভব।
বায়োলজিকালিও অসম্ভব।
১০। পুনরাধুনিকের কবি আদর্শে আস্থা রাখেন। ইডিওলজি তাঁর
কাছে হাস্যকর ব্যাপার নয়। তাঁর আদর্শ অনড় নয়। গোরা-র মতো গোঁড়া নয়। তিনি নিজের
আদর্শের পরিবর্তনশীলতার প্রতি সদয়, এবং সচেতন। কিন্তু ব্যক্তিআদর্শ না থাকলে একজন
কবিতা কেন লিখবেন? – এই প্রশ্ন তাঁর আছে। এর ফলেই তিনি প্রতিবাদে সদাপ্রস্তুত।
সমাজের প্রতি তিনি প্রখর। স্থিতাবস্থা যদি মঙ্গলজনক হয়, তা বজায় রাখতে তাঁর আপত্তি
নেই। না হলে তিনি পরিবর্তনের কথা বলবেন।
১১। পুনরাধুনিকের কবি নিজের স্টাইলের প্রতি সতর্ক নজর
রাখছেন। তিনি অন্যের আদলে কবিতা লিখবেন না। অন্যকেও নিজের আদলে কবিতা লেখার
প্রশ্রয় দিচ্ছেন না। স্টাইল তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের ছাপ। সেটার কোনোরকম নকল তাঁর
জিভকে বিপন্ন করতে পারে। অনেকে মিলে
একইরকম কবিতা লেখায় পুনরাধুনিকের কবি আস্থা রাখেন না। সব্যসাচী হাজরার কবিতা
দেখুন। সব্যসাচীর কবিতাকে একমাত্র সব্যসাচীই নকল এমনকি অনুসরণ করতে পারে, আর কেউ
না।
১২। পুনরাধুনিকের কবিতা সাজানো বাগান নয়। আবার সে ঘাসজমিও
নয়। সে একটি বনস্থলী রচনায় উৎসুক। সেখানে ওষধি আছে, ফুলগাছও আছে, আবার
ক্ষুধা-পিপাসার নিবৃত্তিও সেখানে হবে। সাপ বা শ্বাপদও কী আছে? থাকলে তা পাঠকের
উপরে নির্ভর করে। পাঠকের কল্পনাশক্তি দীন হলে এই বনস্থলীতে পারিজাতের বদলে কাঁকড়া
বিছে বা স্পিটিং কোবরার দেখা মিলবে।
১৩। আজ এক নতুন মানবের জন্ম হয়েছে। সে নিছক হোমো
স্যাপিয়েন্স নয়। সে তথ্যপ্রযুক্তির
সন্তান। ফেসবুকে যে লোকগুলোর দেখা আপনি পান, তাদের আইডেন্টিটি সম্পর্কে আপনি পাশের
বাড়ির রঞ্জনবাবুর মতো নিঃসন্দেহ হতে পারেন না। আজ ফোনে ‘কেমন আছেন?’ কেউ প্রথমেই
বলে না, আগে বলে ‘কোথায় আছেন?’ আজ আমরা সকলেই গেছোদাদা। আমাদের এ এক নতুন প্রজাতি।
আমাদের আধুনিকও তাই নতুন হবে। কবিতাও হবে একেকবারেই নতুন। সেই অর্বাচীন কবিতা
পুনরাধুনিকের কথা বলবে। আধুনিকের নতুন জন্ম, যেহেতু আধুনিকের মৃত্যু নেই। যে
মানুষটি আগুন আবিষ্কার করেছিল, সে ছিল আমাদের চেয়ে ভিন্ন প্রজাতির, কিন্তু সে ছিল
এক আধুনিক মানুষ। প্রাচীন বা মধ্যযুগ বলে তো কিছু নেই। সবই আধুনিক যুগ। এবং
প্রতিটি আধুনিক মিশতে চায় আরেক আধুনিকে, জন্ম হয় কেওসজাত অধুনান্তিকতার।
১৪। পুনরাধুনিক কোনো আন্দোলন নয়। কবিতার আন্দোলন... আসলে
একটি অধুনান্তিক ঘটনা। আধুনিকে কোনো আন্দোলন নেই, বিদ্রোহ নেই, আছে বিপ্লব, সশব্দ
বা নিঃশব্দ।
১৫। পুনরাধুনিকে কাগজের পত্রিকার চেয়ে আন্তর্জাল পত্রিকার
অবদান বেশি হবে। এটা অবিশ্যি বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রেমের কবিতার নামে প্রেমপত্র
সেখানে অচল। যেটা ফেসবুকের স্ট্যাটাস, সেটকে কবিতা ভাবার কোনো মানেই হয় না।
নিসর্গের পুলক বা হাহুতাশ পুনরাধুনিকে হাস্যকর। অন্ত্যমিল ইয়ার্কি হিসেবে চলতে
পারে, কেউ সিরিয়াস হয়ে গেলে নিজেই ইয়ার্কি হয়ে যাবেন।
অক্ষরবৃত্ত-মাত্রাবৃত্ত-স্বরবৃত্ত বাংলা অনার্সের সিলেবাসে বেঁচে আছে, বেঁচে থাক,
আপত্তি নেই।
১৬। পুনরাধুনিক কবিতায় অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের প্রগাঢ় অবদান
থাকবে। কবি তাঁর কবিতার এলাইনমেন্ট নিয়ে পরীক্ষা করবেন। এর ফলে সংলাপের সুযোগ
বাড়বে। স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই স্তর এবং কৌণিকতা বাড়বে। সেইসঙ্গে সরাসরি ইমেজ ব্যবহার
করবেন কবি। নিজের তোলা ফোটগ্রাফি হতে পারে। অন্যের চিত্রকলা ঋণস্বীকার করে কপি-পেস্ট
করা হতে পারে। চিরায়ত ছবি হতে পারে। সেই ইমেজ কখনো কবিতার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে
মাত্রা বাড়াবে, কখনো কবিতায় প্রয়োজনীয় ব্রেক এবং রিলিফ আনবে, যার ফলে পাঠকের সামনে
দিগন্ত ফুটিফাটা হয়ে যাবে। সরাসরি সঙ্গীত বা ভিডিও ব্যবহার করা হবে। এই মিশ্রতা
কবিতাকে সর্বজনীন করবে। যারা কবিতার বদ্ধতা থেকে মুখে ফেরাচ্ছেন, তাঁরা ফিরবেন।
নতুন প্রজন্মের পাঠকের কাছে কবিতা জ্যান্ত হবে।
১৭। পুনরাধুনিকে কবিতা-উৎসব নামক মোচ্ছবগুলো এবং কফিহাউস বা
নন্দন চত্বর নামক স্থানগুলো তাদের প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে। তার বদলে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো কবির সঙ্গে কবির মেলবন্ধন ঘটাচ্ছে। কবিরা আজ কুটুম হতে
কোনো অস্বস্তি বোধ করছেন না, কারণ ঘাম এবং পেচ্ছাপের গন্ধ নেই। কিন্তু সোশ্যাল
নেটওয়র্কিং সাইট কবিতা প্রকাশের স্থান হবে না। সেটা হলে অধুনান্তিক প্রবণতার ঝোঁক
বাড়বে। কবিতা ব্যাপারটা সাময়িক হয়ে যাবে। প্রতিদিনের হাততালির জিনিস হয়ে যাবে
কবিতা। লাইক এবং কমেন্ট দিয়ে কবিরা নিজেকে মাপছেন, তাহলে আর ভোলা ময়রা বা
যজ্ঞেশ্বরীকে বাংলা প্রসিদ্ধ কবি ভেবে নিতে সমস্যা কোথায় ? পুনরাধুনিক বিলম্বিত
হবে সকলেই কবি হয়ে গেলে। সকলে কবি হতে পারেন না। যেমন কবিও যে কোনো লোক হয়ে উঠতে
পারেন না। সকলে কবি হয়ে গেলে সবার আগে যেটা হয়, কেউ কবি থাকেন না। কবিতা লেখা কোনো
শখ নয়, হবি নয়, বাগান করা নয়, শেয়ার মার্কেট নয়।
১৮। কবি নিজেকে এলিট ভাববেন না। নিজেকে জাহির করবেন না।
কবিতা লিখে কেউ দেবতা বা রাজা হয় না। আবার নিজেকে সাধারণ মানুষও ভাববেন না। একবার
ঠিক করে কবিতা লেখার চেষ্টা করার পর কেউ আর সাধারণ মানুষ থাকতে পারে না। যেমন একজন
হত্যাকারী পারে না নিজের চোখকে আর স্বাভাবিক করতে। কবি নিজের মুদ্রাদোষেই আলাদা।
তার জন্য তাঁর বেশভূষা চলনবলন বা হাবভাবে বদল আনার দরকার নেই। কবি-কবি ভাবের যুগ
ফুরিয়েছে। কবিকে ছদ্মবেশ ধরতে হবে। সাধারণের মধ্যে তিনি মিশে থাকবেন যেমন খড়গাদায়
সূচ।
উপরের ১৮টি পয়েন্ট নিয়ে
১৮টি বা তার বেশি প্রবন্ধ হতে পারে, হওয়া উচিত।
ঋদ্ধ হলাম
উত্তরমুছুনঋদ্ধ হলাম
উত্তরমুছুন