........
কামিনী রায় .......
(১৮৬৪-১৯৩৩)
(কাব্যগ্রন্থ - ‘আলো ও ছায়া ’,’নির্মাল্য’,
‘মাল্য ও নির্মাল্য’,’দীপ ও
ধূপ ‘, ‘ জীবনপথে’ , ‘অশোকসংগীত
‘ অম্বা(নাট্যকাব্য),
সিতিমা (গদ্যনাটিকা) )
কে কামিনী রায়? একজন বিস্মৃত কবি!ভারতের
প্রথম মহিলা অর্নাস গ্র্যাজুয়েট! নাকি বাকেরগঞ্জের বাসন্ডা গ্রামের সেই কিশোরী যে
কিনা এন্ট্রাস পরীক্ষা দেবার ছয় মাস পূর্বে লিখে গেলেন- “ পরের কারনে মরনেও সুখ/
‘সুখ’ ‘সুখ করি কেঁদ না আর,/ যতই কাঁদিবে, যতই ভাবিবে/ ততই বাড়িবে
হৃদয়-ভার।/....../সকলের মুখ হাসি-ভরা দেখে/ পার না মুছিতে নয়ন-ধার?/পরহিত-ব্রতে
পার না রাখিতে/ চাপিয়া আপন বিষাদভার?/ আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে/ আসে নাই কেহ অবনী
পরে,/সকলের তরে সকলে আমরা,/ প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।“-হ্যাঁ, এভাবেই আমাদের
প্রত্যেকের সাথেই শৈশবের স্কুলপাঠ্যেই হয়ত কামিনী রায়ের পরিচয়। ‘আলো ও ছায়া’
কাব্যসংকলনের ‘সুখ’ কবিতাটার সাথে আমরা প্রায় সবাই অল্পবিস্তর পরিচিত। না, এর
বাইরেও কামিনী রায়ের বৃহত্তর সাহিত্যমূল্য অনস্বীকার্য। আঠারোশো আশি নব্বইয়ের যে
সময় তিনি লিখতে আসেন সে সময় বাংলা সাহিত্যে একচেটিয়া পুরুষতন্ত্র , এমনকি মহিলা
কবির কবিতা প্রসঙ্গে মুক্তকন্ঠে প্রশংসা করতেও দ্বিধা বোধ করতেন পুরুষ কবিরা। যেমন
মোক্ষদায়িনী মুখোপাধ্যায়ের বন-প্রসূন কাব্যের সমালোচনায় বঙ্গদর্শন পত্রিকায় আমরা
পাই – “ স্ত্রীলোকের কবিতার বেশি প্রশংসা করিতে আমরা বড় ভয় পাই- পাছে উৎসাহ দিলে
গৃহিনীর দল, গৃহকর্ম ছাড়িয়া সকলেই কাগজকলম লইয়া বসেন। তাহা হইলে গরীব পুরুষের দল এক
মুঠা অন্ন পাইবেনা” । কিন্তু এসবের তোয়াক্কা না করে সৃজনীক্ষেত্রে নারী পুরুষের
সম্মিলিত কন্ঠকেই বারবার বিশিষ্ট করে গেছেন কামিনী রায়।এমনকি নারী হিসেবে তিনি
অধিক প্রশংসা পেতেও আগ্রহী ছিলেন না ; তাই তাঁর নিজের নামের আগে ‘শ্রীমতী’ বিশেষণ
ব্যবহার না করে ‘শ্রী’ লিখতেন। আবার ‘সুখ’ কবিতাটি আর্য-দর্শণে পাঠিয়েছিলেন বিভূতি
গুপ্ত নামে। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে তিন বছরের ছোট ছিলেন কামিনী রায় অথচ
রাবেন্দ্রীক যুগেও তাঁর চিন্তার পরিধি পূর্বতন কবিদের চেয়ে স্বতন্ত্র্য ছিল।
হেমচন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথের যুগের সন্ধিক্ষণে কামিনী রায়ের আবির্ভাব; রবীন্দ্রনাথকে
সুন্দরতর নতুন যুগের প্রথম লক্ষণ মেনে নিয়েও এবং তাঁর সর্বতোমুখী প্রতিভাকে
স্বীকার করেও মন্মথ ঘোষকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রকাব্য সম্পর্কে কামিনী রায়কে লিখতে
দেখি- “ ছন্দ-সুর-নিঁখুত মিল’ সবই আছে কিন্তু কেবল এইগুলো দিয়ে হৃদয় পরিতৃপ্ত
হয়না, সুখ দুঃখ আশা আকাঙ্খা ক্ষুধাতৃষ্ণা এই নিয়ে যে মানবজীবন এমন একটা জাগ্রত
অস্তিত্বও চাই”। কেবল রচনার বাহ্য
শিল্পরূপ নয় বরং ভেতরবাড়ির জীবনের উত্তরাধিকারই খুঁজেছেন তিনি। তাঁর কবিতা বিকাশের
কবিতা, চিন্তার কবিতা, মননশক্তিসম্পন্ন জীবরূপে মানুষের অধিকার অনুশীলনের কবিতা।
তাঁর কবিতায় ও দর্শনে নারী নামের ছায়ালতা মাথা তুলে দাঁড়ায় , আলোকের দিকে মুখ
বাড়িয়ে চলে। নারী শিক্ষা থেকে শুরু করে
নারী স্বাধীনতা-উন্নততর তরুরূপে বিকাশের শতসহস্র নারীজাতীয় চিন্তাবীজ ছড়িয়ে গেছেন
কামিনী রায়। তাঁর এজাতীয় ব্যক্তিচরিত্র
গঠনে মা বামাসুন্দরীর দৃঢ় মানসিকতার প্রভাব অস্বীকার করা যায়না। নারীর ন্যায়
সুপ্তশক্তির জাগরণে যা তাকে জীবনভর লিখিয়েছে- “ নারী-আত্মা এইবার জাগে,/প্রলয় আগুন
বুঝি লাগে!/রেখেছিল যারে অন্ধকূপে,/জগদ্ধাত্রী জন্মদাতা রূপে/দাঁড়াবে সে সন্তানের
আগে,/এই বার নারী আত্মা জাগে!/ দাসত্বের ভেঙে হাত কড়া/শাসনের ছিঁড়ে
দড়ি-দড়া/ছুটিয়াছে মুক্তি-অনুরাগে/যজ্ঞের বেদির পুরোভাগে।“ “আলো ও ছায়া”, ‘মাল্য ও নির্মাল্য” বা ‘ দীপ ও
ধূপ’ কবির পরিচিতি হলেও ‘অশোক সংগীত’ কোথাও কামিনী রায়ের জীবনের অপর একটি দিক
উন্মোচিত করে। স্বামী-পুত্র-কন্যার অকালমৃত্যু-একের পর এক স্বজনশোক কবিকে বেঁচে
থাকার স্পন্দন পেরিয়ে কোথাও যেন বিশ্রামের সায়াহ্নভাষার সামনে দাঁড় করায়। শোক পেয়ে
মুক্তি খোঁজেন কবি! নাকি সত্য জানতে বিধাতার দিকে খুলে দেন বুকের পাঁজর?- “ তুমি
শক্তিমান/ দিতে পার, নিতে পার;-দিয়াছিলে তাই/ অতুল সৌভাগ্য মম । তবু দুঃখ পাই/
কেরে নিলে বলে মোর; হে ঐশ্বর্যবান,/ সর্বশ্রেষ্ঠ দান তব- প্রাণের সন্তান।“
কামিনী রায় বিস্মৃত কবি। হয়ত রচনার
দুষ্প্রাপ্যতা অথবা ভুলে যাওয়ার স্বাভাবিক রীতি। এবছর ১২ই অক্টোবর কবির জন্মের
সার্ধশতবৎসর , অর্থাৎ তাঁকে নিয়ে নানা প্রকারে ব্যস্ত থাকার সম্ভাবনা বাংলা
সাহিত্যের। কিন্তু এই ক্ষণিক খেলার মধ্যে কাকে খোঁজা! কার পুনরাবিষ্কার! সাহিত্যের
শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিতে খালি পায়ে ছুটে যাওয়া কোন জলের সন্ধানে ! দেড় শতক আগে যিনি
প্রশ্ন তুলে গেলেন –‘ এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে আমাদের ব্যক্তিগত জীবন কতটুকু!”-তার
কাছে জীবন তো আদতে এক অকথিত ভাষা,এক প্রতীক্ষা। মহাশিল্পীর পরমেশ্বরে মানসস্থিত
প্রকৃতিকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন যিনি, তাঁর কাছে পাওয়া না পাওয়া মনে রাখা না রাখা
এসব নিতান্তই যুগযুগান্তের অন্তঃসারশূণ্য শিল্পের আঁতুর অভ্যেস ব্যতীত কিছুই নয় ।মৃত্যু
দিয়ে যে স্থানটুকু শূণ্য করেছেন তিনি তা যে কারও দ্বারাই পূর্ণ হবার নয়। আবহমান
কাল এই শূণ্যস্থান পূরণ করে থাকবে প্রাণস্বরূপ শক্তিস্বরূপ কেবল একটি অযুত কাব্যিক
আয়ু ...
কোথায়
হিয়া রে, কোথায় নিতে চাহিস আমারে হায় ?
আকুল, অধীরপারা ছুটেছিস দিশাহারা,
ধাস বুঝি মরুভূমে হেরি মৃগতৃষ্ণিকায় ।
আর না, আর না, হিয়ে, ফিরে আয় ফিরে আয় ।
কি জানি শুধাই কারে, কোথায় যে যেতে চাই
!
কি জানি কোথা কে ডাকে, ছুটেছি পাগল তাই;
কি জানি নূতন ভাষা প্রাণের ভিতরে ভাবে,
কি মধুর আলো এক আঁখির উপরে হাসে ;
ভাষা সে মধুর ভাষা, আমিই বুঝি ন ভালো ;
আমি অন্ধপ্রায় , কিন্তু আলো সে উজ্জ্বল
আলো ।
তাই তো গো অবিরাম চলিয়াছি দিশাহারা ;
তাই তো গো দিশি-দিশি ছুটেছি পাগলপারা ।
অকুল অতল ঘোর এ সংসার পাগলপারা ।
অকুল অতল ঘোর এ সংসার পারাবারে
ভাসাইয়া ক্ষুদ্র তরী, দিবালোকে,
অন্ধকারে,
অবিরাম, অবিশ্রাম মানব চলিয়া যায়,
নাহি জানে কোথা যাবে তরঙ্গের ঘায়-ঘায়,-
অদৃশ্য যে কর্ণধার কাটায়ে তরঙ্গগ্রাস,
চালাল তরনী তার; ভেদিয়া আঁধার রাশ,
উজ্জ্বল নক্ষত্র সব যাঁর নয়নের ভাতি
সম্মুখে দেখায় পথ আসিলে তামসী রাতি ;
শুধিতে মানস-স্বর্ণ অনলের মাঝ দিয়া
যাঁহার অদৃশ্য বাহু মানবেরে যায় নিয়া;
সুখের মধুর স্বাদ করিতে মধুরতর
দুঃখের বিধান যাঁরা; তাঁহারি স্নেহের কর
সঙ্কট কন্টকারণো, মরুভূমে,অন্ধকারে
যাবে না কি লয়ে মম দুরবল হাত ধরে?
ডেকে আন
পথ ভুলে গিয়াছিল, আবার এসেছে ফিরে,
দাঁড়ায়ে রয়েছে দূরে, লাজে ভয়ে নত শিরে ;
সম্মুখে চলে না পদ, তুলিতে পারে না আঁখি
,
কাছে গিয়ে, হাত ধরে, ওরে তোরা আন ডাকি ।
ফিরাসনে মুখ আজ, নীরব ধিক্কার করি,
আজি আন স্নেহ-সুধা লোচন-বচন ভরি ।
অতীতে বরষি ঘৃণা কিবা আর হবে ফল ?
আঁধার ভবিষ্য ভাবি হাত ধরে লয়ে চল ।
স্নেহের অভাবে পাছে এই লজ্জানত প্রাণ
সঙ্কোচ হারায়ে ফেলে- আন ওরে ডেকে আন ।
আসিয়াছে ধরা দিতে, শত স্নেহ-বাহু-পাশে
বেঁধে ফেল ; আজ গেলে আর যদি না-ই আসে !
দিনেকের অবহেলা , দিনেকের ঘৃণাক্রোধ ,
একটি জীবন তোরা হারাবি জনম শোধ ।
তোরা না জীবন দিব? উপেক্ষা যে বিষবাণ ,
দুঃখ-ভরা ক্ষমা লয়ে, আন, ওরে ডেকে আন ।
মুগ্ধ প্রণয়
সে কি কথা – যারে চেয়েছিলে
পাও
নাই সন্ধান তাহার ?
কারে বলে কার গলে দিলে
প্রণয়ের
পারিজাত-হার ?
মুগ্ধ নর; আঁখি ছলে মন ;
কল্পনা
সে বাস্তবেরে ছায় ;
চারুমূর্তি করিয়া গঠন,
শিল্পী
ভালোবেসেছিল তার ।
স্বরচিত প্রতিমার তরে
উন্মত্ত
হইল যবে প্রাণ,
দেবতারে কহিল কাতরে –
পাষাণে
জীবন কর দান ।
প্রেমময় বিধাতার বরে
সে
বাসনা পূর্ণ হল তার –
অনুভূতি কঠোর প্রস্তরে,
প্রতিমায়
জীবন-সঞ্চার ।
পাষাণের প্রতিমাটি যবে
প্রাণময়ী
নারীরূপ ধরে,
নারী তবে পারে না কি তবে
দেবী
হতে বিধাতার বরে?
যত যায় দিন
যত যায় দিন, মোরে ঘিরে অন্ধকার ,
না হেরি সে দিবা জ্যোতি, না শুনি সে
বানী !
শৈশব কল্পনা, স্বপ্ন ভাবি কতবার
সে –সকলে; ইচ্ছা হয় সত্য বলে মানি
বর্তমান দশা মোর, অনেকের মতো
চলি ফিরি করি কাজ;- হায় কাজ মোর
ভেবেছিনু আর কিছু মহৎ উন্নত,
চেয়ে দেখি হাতে মোর শৃঙ্খল কঠোর ।
অক্ষমতা এ জীবন করি অধিকার,
নিয়ত রাজত্ব করে, বিন্দু শক্তি নাই
যুঝিবারে তার সাথে; হাহাকার সার,
প্রাণের মাঝারে বসি নৈরাশ সদাই।
বাহ্যিক বিষাদ-চিহ্ন ঘুচায়েছি সব,
রোধিয়াছি নেত্রবারি, নিঃশ্বাস, বিলাপ ;
হাসি, যবে হাসে সবে; কিন্তু অসম্ভব
নিত্য আত্ম-বিস্মরণ; কোন গূঢ়-তাপ
আমারে জাগায়ে রাখে; সাগরের জলে
তপ্ত অন্তঃস্রোত সম গোপনে অন্তরে,
বহিঃশান্ত জীবনের আনন্দের তলে
বিষাদ-প্রবাহ এক বহে বেগভরে ।
ভুলচুক
এই মায়াময় পুরে কত কেহ মরে ঘুরে
আজীবন বিরাম না পায়
সলিল আছিল কাছে ছুটে মরীচিকা পাছে,
পথ ভুলি অপথে বেড়ায় ।
চোখে কিবা আবরন চেনে না আপন জন
আত্মীয় ঠাহরে বিদেশীরে,
ফুল দেখি আসে ছুটে, সুতীক্ষ্ণ
কন্টক ফুটে,
শূন্য হাতে ব্যথা লয়ে ফিরে ।
যাহাদের আঁখি আছে অনুদিন
কাছে-কাছে
অন্ধদের দৃষ্টি হয়ে থেকো ;
ভুলে যে ফেলিয়া যায়, ভুলিতে দিয়োনা তায়
কাছে গিয়ে নাম ধরে ডেকো ।
স্নেহেতে পুরিয়া বুক ক্ষমা কর ভুলচুক
কোরো না কোরো না অভিমান
এত বড় এ ধরায় যে-জন হারায়ে যায়
আর তার মিলে কি সন্ধান ?
হয়তো তোমারি প্রতি প্রীতি পরিপূর্ণ অতি
চলিয়াছে তোমারি উদ্দেশে
কাছ দিয়া যবে যায়, তোমা না দেখিতে পায়
খুঁজিয়া বেড়ায় দেশে-দেশে ।
দেখো না হৃদয় তার হের শুধু ব্যবহার
অভিমানে দাঁড়াও আড়াল ,
আজ যে ঢলিয়া যায়, পাবে কিনা পাবে তায়
খুঁজিতে ফুরাবে আয়ুষ্কাল ।
সৌন্দর্য ও ভালবাসা
বহুদিন এ জগতে আসিয়াছি দুই জনে,
কোথা ছিনু, কোথা ছিলে,- জীবনের শুভক্ষণে
সহসা দাঁড়ালে আসি বিস্মিত নয়নে মম,
শত-শত জনমের সুকৃতির ফল সম ।
নয়ন চাহেনি যবে শান্ত মুখ পানে তব
এমন সুন্দর বুঝি আছিল না বিশ্ব ভব ।
এ আকাশ, এ বাতাস, উষার সন্ধ্যার রবি
তটিনী-তরঙ্গ-লীলা, সুপ্ত নিশীথের ছবি,
ইহাদের সাথে প্রেম এতটা কি ছিল আগে
রঞ্জিত ছিল না আঁখি যবে তব অনুরাগে ?
তরী বয়ে লয়ে যায় কত না অচেনা মুখ ,
তীরে বসি ভাবি আমি কার কিবা দুঃখ সুখ ;
আঁধার হিয়ার মাঝে আলো হয়ে প্রবেশিতে
সাধ যায়,- চিরদিন এ সাধ কি ছিল চিতে ?
কি আছিল, কি না ছিল, আজ নাহি পড়ে মনে,
জীবনের পুনর্জন্ম তব দরশন সনে ।
সংগীতে গগন পূর্ণ, বুঝিতে না পারি ভাষা,
দুটি কথা বুঝি শুধু – সৌন্দর্য ও
ভালোবাসা ।
আমাদের কেহ তুমি নও
ধীরে-ধীরে কাছে এসে , তোমারে বুঝেছি শেষে,
জানিয়াছি
আর যাই হও-
কবির কল্পনা-ছবি, কিবা দেবী ,কি মানবী,
আমাদের
কেহ তুমি নও ;
ও-আননে খেলা করে আলো ছায়া থরে-থরে,
দু-নয়নে
ইন্দ্রজাল রেখেছে বাঁধিয়া ,
হৃদয় করুণাময় তাহে
প্রতিভাত রয়,
স্নাত
যেন মনে হয় অশ্রুবারি দিয়া;
সে অশ্রু পড়ে না ভুঁয়ে পরের শ্রবণ ছুঁয়ে
হাসি
ডরে, পাছে তার মলা লাগে গায়,
তাই অধরের তীরে উঁকি দেয় ধীরে
ধীরে
হৃদয়ের
অন্তঃপুরে আবার লুকায় ।
আমাদের
অশান্ত হৃদয়
তৃষা ব্যাকুলতা ভরা, আবর্ত-তরঙ্গময় ;
নিরাশা ঝটিকা বহে, অশ্রুজলে নদী হয় ;
আমাদের
উন্মত্ত প্রণয়
দিতে চায়, নিতে চায় তনু, মন, সমুদয়-
নেহারি জাগে কি ঘৃণা ? কিবা মনে লাগে ভয়
?
গিরিদেশ বর্ষা
ধীরে ধীরে অতি ধীরে বহিছে শীতল বায়,
কাঁপে শ্বেত উত্তরীয় সূদূর গিরির গায়;
কোথা হতে ধীরে-ধীরে অতি শুভ্র ধূমরাশি
সম্মুখের তরুরাজি ছাইয়া ফেলিছে আসি;
সহসা এ কোথা হতে আসিতেছে অন্ধকার,
ভাসায়ে সংকীর্ণ পথ বহিছে বরষা ধার,
ঝম-ঝম গৃহ চূড়ে নাচিতেছে শিলাগুলি,
ধূম নির্গমন পথে কাঁদে বায়ু পথ ভুলি ।
বায়ু বহে অতি শীত,ঘন বরিষার ধারা,
গিরি-গিরি মেঘমালা ছুটে উন্মাদিনী পারা,
চপলা চমকি যায় এদিক ওদিক দিয়া
মাতিয়াছে গিরিদেশ উন্মাদক সুরা পিয়া ;
গুরু-গুরু ঘনধ্বনি সূদূরে থামিয়া যায়,
মহাশিলা খন্ড ঝাঁপি পড়িল গিরির গায়;
চারিদিক আঁধারিত শব্দিত মথিত করি,
ছুটিতেছে মহারঙ্গে জীবনের কি লহরী !
থামিয়াছে বর্ষা বায়ু জীবন জাগায়ে দিয়া,
উদ্যমে ছুটিছে হের শত নিঝরের হিয়া ।
যাত্রা
কোন দিকে মহাবেগে বায়ু বহমান
ক্ষুদ্র পালকের মতো উড়িয়ে আমায় ;
কোন স্রোত ভাসাইয়া তৃণের সমান
জন্মতীর ক্রোড় হতে দূরে লয়ে যায় ?
শারদ গগনে স্থির স্বর্ণ মেঘ ছবি,
বহে কি না বহে বায়ু, নিদ্রা বিচেতন,
পূরব-দক্ষিন-মুখী কালিন্দী, জাহ্নবী,
উজানে টানিছে মোরে শকতি নুতন ।
দূর কর পুঁথিপত্র, অসিত অক্ষর
গুনি গুনি অহরহ ব্যথিত নয়ন,
বিশাল প্রকৃতি-গ্রন্থ, প্রাণ তৃপ্তিকর,
উজ্জ্বল বরণ, চল, করি অধ্যয়ন ।
চারি প্রাচীরের মাঝে অবরুদ্ধ প্রা,
ধরিয়া রাখিতে তারে পারিনাকো আর;
বাহিরের মুক্ত বায়ু করিবারে পান
কাটিয়া শৃঙ্খল পাখি ছুটিল এবার ।
উৎকন্ঠা
দাঁড়ায়ে কি আছে তারা মোর প্রতীক্ষায়,
ওষ্ঠাধার মাঝে হাসি আধ পরকাশ ,
স্নিগ্ধ দৃষ্টি ধুয়ে অশ্রু বাহিরিতে চায়,
আধ রুদ্ধ , আধ স্ফুট কুশল সদ্ভাব ?
আঁখি পাশে শ্রান্তি রেখা হেরি ভীতিভরে
‘ভালো ছিলে?’ জিজ্ঞাসিলে, কি দিব উত্তর
!
কি দেখাব , ‘কি এনেছ আমাদের তরে?’
বলি, হেসে বাড়াইলে সুকোমল কর ?
ভালো ছিনু, সুখে ছিনু, তোমাদেরি তরে
মনটা চঞ্চল হত কোন-কোন দিন,
তহি পিঞ্জরের পাখি এনেছি পিঞ্জরে
আর-আনিয়াছি গল্প ঝুড়ি দুই-তিন ।
দাঁড়ায়ে কি আছে তারা? যতগুলি মুখ
রেখে গেছি, ততোগুলি দেখবি নিশ্চয় ?
সহসা ভাবনা ঝড়ে কেন কাঁপে বুক ?
হায়রে পাগল প্রাণ, কেন এ সংশয় ?
স্থবিরা
সামর্থ্য আমার যেদিকে যা ছিল তার কিছু
নাই ।
নবীনেরা হোথা করে কত কাজ, দূরে বসি দেখি
তাই ।
ওদের বিপুল বলে-ভরা বাহু দ্রুতচ্ছন্দে
যত চলে,
আনন্দের ঢেউ নেচে-নেচে উঠে আমার
হৃদয়তলে।
নূতন ভাবুক চিন্তায় তার দুঃসাধ্য সাধনে
রত,
মরুর মাঝারে নন্দন বন রচিছে মনের মতো ;
বায়ুতে ভাসায় তার কল্পনার বিচিত্র
অম্বর-যান,
তাহারি উপরে স্বপ্নতরী মোর নীরবে লইছে
স্থান ।
যাহা করি নাই, ওরা করে যাক। স্বপ্নে
কিবা চিন্তায়
পাই নাই যাহা, বড় ভাগ্য মানি, দেখি যদি
ওরা পায় ।
বীজের বপন যেই করে থাক শুভ চিন্তা
কামনার,
পালিয়া তরুরে যে ফলায় ফল, সমস্ত গৌরব
তার ।
ওদের কন্ঠের উদাত্ত সংগীত বহে মধু
মূর্ছনায়,
আমার অন্তর যাহিরিয়া আসি তারি স্রোতে
ভেসে যায়।
এপারের গান ভরে লই প্রাণে য-দিন এপারে
আছি,
ওপারের গানে কন্ঠ মিলাব ওপারের
কাছাকাছি।
আজিকার মতো
আমার এ গান বিত্ত হবে নিত্য কালের তরে,
এত বড় আশা তো ভাই পুষি না অন্তরে ।
আপন দেহ আড়াল রাখি
গায় সে যখন বনের পাখি,
চেয়ে চকিত হৃষ্ট পথিক চলে যায় ঘরে,
দাঁড়ায় যদি দাঁড়ায় শুধু ক্ষণিকের তরে ।
ফুটছে ফুল হাসি-মুখে
সুবাস লয়ে কোমল বুকে,
সেও তো ভাই শুকায় রোদে, ঝরে দু-দিন পরে,
সেও তো নয় নিত্য কালের তরে ।
আজকের মতো গাইরে যেন ক্ষণিকের এ গান,
আমার প্রাণের হর্ষ যেন স্পর্শে অপর
প্রাণ ।
আশাহত যে মনখানি
শুনায় তারে আশার বানী,
লুপ্ত সংকল্পেরে যেন বারেক সজাগ করে,
দু-দন্ডের তরে রে ভাই দু-দন্ডেরি তরে।
আর যদি তা না-ও করে খেদ নাহি রে তায়,
গেয়ে যাক কন্ঠ আমার হৃদয় যাহা গায় ।
উঠে, পড়ে, ফোটে ঝরে,
যত জন্মে যত মরে,
সাগর-বুকে ঢেউরা যেমন ঢেউ ডিঙায়ে যায় ।
আমার পরে উঠবে কেহ, অন্যে তাহার পরে,
নয় গো কিছু নয় গো কেহ নিত্য কালের তরে ।
নিশানা
ধীরে-ধীরে বাও মাঝি, ধীরে-ধীরে বাও,
বলে দেব কোন ঘাটে লাগাবে এ নাও ।
দিকে-দিকে গেছে খাল, দেখি নাই কতকাল
নিশানা যা ছিল জলে ভেসে গেছে তাও ।
ধীরে ধীরে বাও, মাঝি, ধীরে-ধীরে বাও ।
গাছে ভরা দুই কুল, দিনেতে না হত ভুল,
দেখা যেত ফাঁকে ফাঁকে আমাদের গাঁও;
চতুর্থী চাঁদের আলো ঠাহর হয় না ভালো,
সুধাব এমন জন দেখি না কোথাও ।
ছিল লোক যত চেনা, কেহ পথ চলিছে না,
ধীরে যাও, দুই পারে চেয়ে-চেয়ে যাও ।
দেখ তো কেয়ার ঝাড়, আর পূর্বদিকে তার
বড় শিমূলের দেখা পাও কিনা পাও ।
সর্বাঙ্গ সাজায়ে ফুলে হিজল দাঁড়ায়ে কূলে
ঝূঁকে মুখ দেখে জলে? ভাল করে চাও ,
বাঁকা হিজলের মূলে বাঁধিবে এ নাও,
এ আঁধারে ধীরে, মাঝি কিছু ধীরে বাও ।
********************************
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন