........অরুন
মিত্র.......
(১৯০৯-২০০০)
(কাব্যগ্রন্থ- ‘প্রান্তরেখা’, ‘উৎসের দিকে’,’ঘনিষ্ঠ তাপ’, ‘মঞ্চের বাইরে মাটিতে’,’শুধু রাতের শব্দ নয়’, ‘প্রথম পলি শেষ পাথর’ ,’খুঁজতে খুঁজতে এত দূর’ ,’যদিও আগুন ঝড় ধসাভাঙা’,’এই অমৃত এই গরল’ ,’টুনি-কথার ঘেরাও থেকে বলছি’, ‘খরা-উর্বরায় চিহ্ন দিয়ে চলি’ ,’অন্ধকার যতক্ষন জেগে থাকে’, ‘ওড়াউড়িতে নয়’ ,’ভাঙনের মাটি’...)
.........কিন্তু কোনো সৌরভে আমি ভিড়লাম না
কোনো কুয়াশা আমাকে স্তিমিত করল না
কারন আমার বিশ্বাস ন্যাস্ত ছিল পাথরে
এক অনমনীয় পাথরে.....
চল্লিশের কবিতার
দিকে তাকালে আমরা দুটো বিশেষ ধারা দেখতে পাই, একদিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ,মন্বন্তর
উদ্ভূত সামাজিক প্রেক্ষাপটে কালনির্ভর সামাজিক প্রতিবাদী কবিতা, ফ্যাসিস্ট বিরোধী
লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা আবার অন্য দিকে আত্মমনোগত সজীব নির্সগনিসৃতঃ
সাহিত্যচর্চা যা মূলত বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ বা সঞ্জয় ভট্টাচার্যের’পূর্বাশা’ জাতীয় পত্রিকাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল। চল্লিশের কবিদের মধ্যে
সমীহ জাগানো নাম অরুন মিত্র, তাঁর কবিতায় একাধারে সামাজিক আবার সাশ্রয়ী ধাঁচের
লক্ষন দেখা যায়। ফরাসী ভাষা সাহিত্যের বিদগ্ধ অরুন
মিত্র মাত্র ষোলো বছর বয়সে প্রথম কবিতা লেখেন সেসময়কার বিপ্লবী দল কর্তৃক পরিচালিত
‘বেনু’ পত্রিকায়। আবার ১৯৪৩ এ প্রথম
কাব্যগ্রন্থ ‘প্রান্তরেখা’ তে ‘লাল ইস্তেহার’ বা ’কসাকের ডাক’ কবিতায় দেখা যায় সাম্যবাদী বার্তালাপ। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে
দাঁড়িয়ে সাধারন মানুষের অস্তিত্বের সংগ্রামকেই তিনি তাঁর কবিতার প্রাথমিক উপজীব্য
করেছিলেন। পরবর্তী অধ্যায়ে কবিতায় এনেছেন টানা গদ্য, পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন
মানুষের অন্তর্জগত নিয়ে, যাপনের গোপন সংজ্ঞা নিয়ে। চল্লিশের দশক থেকেই অরুন
মিত্রের এই চলপথের কবিতা বিশেষ হয়ে আছে যেখানে সমাজমনস্কতার সাথে সাথে সাশ্রয়ী
অনুভূতিও উঠে এসেছে তার দুর্লভ কাব্যপ্রতিভায়। ‘ এ জ্বালা কখন জুড়োবে’ কবিতাটির মধ্যে দিয়ে তাকে চিনে নেওয়া
যায় স্বতঃস্ফূর্ত রেখালেখ্যে। -“ এ জ্বালা কখন
জুড়োবে?/ আমার এই বোবা মাটির ছাতি ফেটে চৌচির/ উঠোনের ভালোবাসার
ভোর এক মুঠো ছাই হয়ে ছড়িয়ে যায় শুকনো লাউডগার
মাচায়,/ খড়ের চালে কাঠবিড়ালীর মতো পালায় অনেক দিনের আশা,/ শুধু ভাসা-ভাসা কথার শূন্যে লেগে থাকে এক
জলমোছা দৃষ্টি দুপুরের সূর্য হয়ে।/ কোথায় সে আকাঙ্খাকে
পোষবার সংসার/ ভবিষ্যৎকে আদর করবার
সংসার।/গড়বা্র আদর করবার,/ফুলে ফুলে কাকলিতে মিলিয়ে দেবার।/ মিলিয়ে গেল তা এই
ক্ষোভে।/ এ জ্বালা কখন জুড়োবে?” আসলে প্রথম
থেকেই মার্কসবাদী সাম্যবাদে আস্থাশীল কবি অরুন মিত্র।তাঁর কবিতায় তাই উঠে এসেছে
জীবনতত্ত্ব , মানুষের কবিতা। মানুষের প্রতি ভালবাসা এবং চিরকালীন মানুষের হাত
ছুঁয়েই গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতার অপূর্ব সংকলন। -“ অরুণ মিত্র
মনে মনে, পায়ে পায়ে ঘোরেন সেই রহস্যময় রাজপথে, গলিতে যেখানে নিঃশ্বাস, সেখানে এক
অলৌকিক মাদারিওলা রাত আর দিনের, দৃশ্য আর অদৃশ্যের সীমারেখা তুচ্ছ করে দেয়। অথচ
তিনি কোনো আধিমানসিকতার কাছে গিয়ে হাত পাতলেন না। সত্বর এবং অনুচ্চকিত; অনাসক্ত আর
কৌতুহলী, পদাতিক আর নীড় সন্ধানী- অরুণ মিত্র এর সবথেকে বস্তুবাদী কবি এই অর্থ যে
বস্তুর অশেষ সম্ভাবনাকে তিনি বুঝে নিতে চান”। জন্মের দেশ
পৌঁছে যেতে তাঁর এই অক্ষরের দেশে ভ্রামমণতায় কোথাও হয়ত তাঁর ব্যক্তিগত সুখ স্বপ্নও
জড়িত ছিল। আসলে প্রত্যক্ষভাবে তিনি দেশভাগের শিকার হয়েছিলেন, হয়েছিলেন উদ্বাস্তু।
তাই বারবার মূর্ত হয়ে উঠেছে আঙিনার প্রতি তাঁর আকর্ষণ। “সাদা ভাত মুঠোয়” কবিতায় আমরা দেখছি অরুণ মিত্র লিখছেন- “ আমি সাদা ভাত
মুঠোয় তুলেছি/ আর আমার ওপর অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ছে/তর্জনগর্জন মাঠ থেকে ছুটে এসে
ঘরের মধ্যে/ আমি হাত ওঠাচ্ছি ঝড়ে/ আমি ভাবছি ঝিরঝিরে বাতাসটা আমার/পালকগুলো
আমার/ঝাউয়ের ঝারি আমের বোল আমার/ভাবতে ভাবতেই আমি ডুবছি চোরা টানে”।– এভাবেই বারবার দেশ থেকে দূরে যাবার যন্ত্রনা তাঁকে আর্ত করেছে। পাশাপাশি কবিতা বিষয়ক দুর্লভ গবেষনা, ফরাসি ভাষার প্রতি অনুরাগ লক্ষ্য করা যায় তাঁর
বিশুদ্ধ ফরাসী কবিতার অনুলিপিতেও। এমনকি কলকাতার
অ্যালিয়াস ফ্রাঁ তে সহকারী গ্রন্থাগারিক হিসেবে কাজও করেছিলেন বেশ কিছুদিন।রিপন
কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পরে আনন্দবাজারে যোগদান করেন ১৯৩১ এ আর পরবর্তী কালে অরনি
পত্রিকায়। ‘খুঁজতে খুঁজতে এতদূর’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্য আকাদেমিতে তাঁকে ভূষিত করা হ্য়
১৯৮৭ তে। চল্লিশের যে সহমর্মি কবিতার মধ্যে দিয়ে অরুন মিত্রের শুরু তা ক্রমশ
বৈদ্যগ্ধমণ্ডিত হয় তাঁর নিজস্ব বীক্ষনগত একটা ভিত্তিভূমি তৈরির মধ্য দিয়ে, যেখানে
গভীর সত্যদ্রষ্টা অরুনকে আমরা দেখতে পাই; .....” কত বড় এই কলকাতা শহর! মাইলের পর মাইল,
নদীর পর নদী, মাঠঘাট, ক্ষেতের পর ক্ষেত। এত বড় শহর, নাকি এ বাংলাদেশ? আমি হাঁটছি
হাঁটছি।।......আলোর ফোয়ারা উঠছে আমাকে ঘিরে। এই আমার নতুন জন্ম। আবার যাত্রা শুরু”.....আর এভাবেই মানুষের প্রতি তাঁর সুগভীর
আস্তার বানীগুলোকে জোড়া লাগিয়ে লাগিয়ে বালি ছাপিয়ে ক্ষয়
ছাপিয়ে নব অরুনোদয়ে জীবন ও সৃষ্টিকে নিয়ে হেঁটে চলেছেন কবি অরুন মিত্র....
বাগান
এক বাগান ধুতরো
নিয়ে বসে আছি
পোস্টারও লাগিয়ে
দিয়েছি
অক্ষরগুলো জোর
গলায় হাঁকছে;
‘যদি মরন চাও এসো
যদি স্মরন চাও এসো’ ।
অনেকেই আসছে,
আসবেই তো,
বাঁচার হ্যাপা কি
কম?
খিদেতেষ্টা আছে
প্রেমপীরিত আছে
ধুতরো খেলে সব
জ্বালাযন্ত্রনা জুড়োবে,
অবিশ্যি তার আগে
একটু ছটফটানি আছে
তবে সে আর কতক্ষনই
বা
জীবনের চক্কর তার
চেয়ে ভীষনরকম বড়।
কিন্তু ধুতরো
বাগানে অনেকে আবার আসছেও না
তারা চলে যাচ্ছে
অপরাজিতার কাছে
বিড়বিড় করে বলতে
বলতে
‘ও বড় মধুর মরন’।
তা যদি মনে করো,
তবে অমনভাবেই মরো
তোমরা মধুরে মরো
অপরাজিতায় মরো।
কিন্তু একবার
ধুতরো বাগানে এলে পারতে
রূপলাবণ্য নেই
বটে, তবে ধুতরো খেলে
সোজাসাপটা মরণ আছে
ধিকিধিকি জ্বলা নয়
রূপসুবাসের জ্বালা নয়
দেখতে দেখতে ঢলে
পড়া,
মরণ এবং বাঞ্ছা
থাকলেও স্মরনও ।
ভালোবাসাবাসি
এই রকমই চলুক-না।
সাপে নেউলে খুব ভাব। কুকুর বেড়ালেও। সাপের যদি পাঁচটা না হোক দুটো পা-ও বেরোত আর
অন্যদের চার পা আলাদা নড়াচড়া করত, তালে গৌরনিতাই দৃশ্য হত। প্রেমের জোয়ারে ভাসছে
ঘরবার চরাচর। দুপায়ে হাঁটা জন্তুরাও আলতো নেই, ছোঁয়াচেই আছে। শত্রু-মিত্র ভেদ মুছে
গেছে। তুমি আমার মাথায় কাঁঠাল ভাঙো, আমি ভাঙি তোমার মাথায়। রস তো বেরোবে, তুমিও
খাবে, আমিও খাব । রসের কোনো জাতবিচার নেই। রসিকরা তা ভালোই জানে।
আমদরবারে
বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন এখন স্থগিত থাক। মনে মনে প্রদর্শন করো যত ইচ্ছে। কোনো
ক্ষতি নেই। কিন্তু সামনাসামনি খালি প্রেম। যদি কোনো হতচ্ছাড়া গজগজ করে; ‘বেহায়া বজ্জাত’ , হাসিমুখে থেকো,
শুনেও শুনো না । যা মারবার মেরে যাও । আর প্রেম করো। প্রেমের বন্যায় ভাসি দাও
আমদরবার। শত্রুমিত্র ভেদ নেই। লাভ-লাভ-লাভ-লাভ-লাভ মঁসিয়ে ভেরদু।
মধুবন্তী
আমাকে ছিঁড়ছে
কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলছে মধুমন্তী,
আমি শব্দ করতে পারছি না
আমার সব শব্দ গ্রাস করছে মধুমন্তী,
শব্দের যন্ত্রনা এক সুখ থেকে আরেক সুখে লুটিয়ে পড়ছে।
আমি কান পেতে শুনছি
কিন্তু কোথায় আমার কান,
কোন টুকরোয় জ্যোৎস্না হাসছে কোন টুকরোয় রোদের চিৎকার ?
আমাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে কুরে কুরে ছড়িয়ে দিচ্ছে মধুবন্তী,
আমার লোমকূপগুলো খুলে যাচ্ছে ঘুরনস্রোতে
ধুয়ে যাচ্ছে তছনছ মুখ কপাল
থুতনির ঢাল বেয়ে অমৃতফোঁটা
ঝরে পড়ছে আমার জামাকাপড়,
আমি জিব বাড়িয়ে চাটব কিন্তু জিব কই?
আমি টেরও পাচ্ছি না কোন রন্ধ্রে আমার নিঃশ্বাস,
আমার ধুকধুক মীড়ে হলকতানে এলিয়ে পড়ে লাফিয়ে উঠে লণ্ডভণ্ড ।
এই মরণ, অথচ আশ্চর্য শোনো শোনো
মধুবন্তীর তুরপুন জড়িয়ে
গান গাইছে গুঁড়ো গুঁড়ো অরুণ
আমাকে নিয়ে কী জাদুগিরিতে যে মেতেছ তুমি মধুবন্তী !
কামিলার সময়ের ভিতরে
সকাল হতেই দেখি
গরল ফেনিয়ে উঠছে,
তাহলে শিশির
মাড়ায়নি আমা কামিলা,
ওর কপালই এমন।
কোনো চাপা গোঙানিও
আমাকে পাঠায়নি,
যেমন ছিল রাত তেমন
ভোর।
আমাকে এখন অপেক্ষা
করে থাকতে হবে,
কিন্তু কোথায়, কবে
পর্যন্ত ?
আমার চারদিকে
আওয়াজ শুরু হয়েছে
আমি টের পাচ্ছি
হাড় ভাঙছে কলযে ছিঁড়ছে
আর মেশিনের
জোড়দাঁত খুলছে বন্ধ হচ্ছে
ঠিক আমার সামনে ।
এ হল কামিলার সময়
আমাকে উপহার দেওয়া
আমার নেওয়া।
ও যখন ফিরবে তখন
কি ধুলো হয়ে ফিরবে
আর-এক ধূলোয় ?
একজন নিশ্চয় দাঁড়িয়ে
ট্রামবাসের ঝড়
এইরকমই বয়,
ভোররাতের কুঁড়িটা
মরে
আর আমি টলতে টলতে
তারস্বরে ঘন্টি
লাগাই,
থামো,
বুঝি থামলেই আমি
জমি পাব ।
ওলটপালট হুহু পথ,
দোকানঘরের আগুন
দুই ধারে ছড়িয়ে
যায়,
রাস্তার কোণগুলো
গনগন করে।
আমার শিরার সব ঢেউ
চোরা পাথরে লাগে
আর আমাকে অস্থির
করে,
এই থামো,
আমি এখানেই
ঝাঁপিয়ে পড়ব
যেখানে রাশ রাশ
মানুষ ঘুরপাক খায়।
একসঙ্গে অন্ধকারে
যাব
মাটির উপর দিয়ে
হেঁটে
কখনকার সেই কথা
আমি আঁকড়ে আছি।
আমার জন্যে একজন
দাঁড়িয়ে রয়েছে।
চৌরাস্তার কাছে
যেখানে ভীষন
এলোমেলো টান
যেখানে সমস্ত মুখ
ঘুরেযায়
আর অপেক্ষা করার
জায়গাগুলো
হলকার ভিতরে
কাঁপতে থাকে,
কাউকে ঠাওর করতে
পারি না,
থামো, আমি এখানেই
ঝাঁপিয়ে পড়ি,
আমার জন্যে একজন
নিশ্চয় দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ন্যাতাপরা ছেলেমেয়েরা
ন্যাতাপরা
ছেলেমেয়ে গলির এখানে-ওখানে এসে জড়ো হয়। আমার সঙ্গে তারা সোজাসুজি কথা বলতে পারে
না, যদিও কথা তাদের বুক ঠেলে আসে। আমাকে দেখে তাদের ঠোঁট একটু খোলে, গোল হয়, ছড়িয়ে
যায়। একটা নাম সেখানে পরিষ্কার আঁকা হয়। কোনো ঝড় ওঠে না, নিঃশ্বাসের বাতাস তাকে
জড়িয়ে ধরে সমস্ত গলিটা পারাপার করে।
বারান্দা থেকে এখন
কেউ আর হাত নাড়ে না। তবু রাস্তার আওয়াজ একবার সামনে এসে একটু থেমে পড়ে। যেন আশার
বীজ এখানকার ধূলোতে বোনা হয়েছে। ফটকখোলা বাড়িটা বন্ধুতে জারিয়ে আছে। যে-ভয়গুলো
প্রথমে জ়েঁকে থাকতে, বুলা তাদের হেসে হেসে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তার হাসির টানে
মানুষের চোখমুখ কোনো পাঁচিলে আটকা থাকতে পারেনি।
এক গাদা ছেলেমেয়ে
আদুড়গায়ে ধূলো মেখে তাদের মিতালিকে কেবলই জিজ্ঞাসায় তুলে ধরে। তারা জানে না, এই
ছোট উৎস থেকে বেরিয়ে ভালোবাসা পৃথিবীর চওড়া মোহনায় বিস্তৃত হয়েছে।
বাসে
সব আশ্চর্য বিষয়
থেকে আমি সরে আসি
সরে আসতে বাধ্য
হই।
কারন?
সে তো এক অনন্ত
সংখ্যা,
আপাতত দুটোই
প্রত্যক্ষ ;
একটা বাজারের
খোকাথলি
আমা এক হাত আঁকড়ে,
আরেকটা বাসের হাতল
হয়ে
আমার অন্য হাতে
ধরা।
খোকা যদি হাতে
পিছলে পড়ে যায়,
সর্বনাশ ;
ঈড়া পিঙ্গলা
সুষুম্না এবং তাদের
ছোট ছোট ভাইবোনেরা
ডুকরে উঠবে,
হাহাকারে ভরিয়ে
তুলবে
আমার মগজের একশ লক্ষ
কোষ ।
আর হাতল যদি শত্রু
হয়ে
অন্য হাতকে ঠেলা
দেয়
ঠেলতে ঠেলতে চাকার
রহস্যে নিয়ে যায়
তাহলে বাস আর
গুমটিঘর
বাজার শাকপাতা
রূপোলি আঁশ
আমার জন্যে ঘুরতে
ঘুরতে
পৃথিবীর অপরিমিত
অন্ধকার হয়ে যাবে।
সাধে কি আমি ঝকঝকে
দিনটার মধ্যে
খুব একলা নিবিড়
নিবিষ্ট রয়েছি
বাসে?
আর একটু থাকো
তোমাকে এই
স্বরব্যঞ্জনে রেখেছি,
তুমি তো মাঠের
মেয়ে
খঞ্জনার নাচের
মেয়ে,
তুমি ডানা
ঝাপটাচ্ছ অনবরত ।
আর কতক্ষনই-বা
তুমি থাকবে এখানে
আমার এই কলমের
নীচে?
তোমাকে ডাকছে
রোদের আকাশ
ঝরন্ত ঘামের মাঠ,
এত ভালোবাসতেও
তুমি পারো তাদের !
তবু বলছি তুমি
আমার আঙুলের ডগায়
এই লাল বিন্দুতে
একটু থাকো
আমাকে একটু শেখাও
কী করে রক্তলিপি
লিখতে হয়
তারপর সেই ছাপ
মাঠময়,
ভরা রোদের আকাশে
তোমার সঙ্গে
জ্বলন্ত নাচের বর্ণমালা
আর আমাদের ওড়া একসঙ্গে ।
ডাকছি
পুরোনো কথা ঝলমলিয়ে ওঠে। সেই সময় আমি খুব উজ্জ্বলের মধ্যে প্রবেশ করেছিলাম
যেমন হয় দেয়ালায়। তোমার দু চোখ ছেঁকে নিয়েছিল হীরেচুর, সে এক ভেলকি আলো আলোর ঢেউয়ে
ভাসছিল আমার রক্তমাংসের শরীর ইটকাঠ গাছপালা-পশুপাখি আঃ কী ঝলক , আমার ঠোঁটে সেই
স্বপ্নহাসি যেমন ফুটত শুনি খুব কচি বয়সে । কোনো ভাবনা কি কাছে ঘেঁষতে পারে তখন? তা
তখনই পর্দা নামল ঝপাং। আর না, ইবার ফেরো হে জ্যান্ত শহরে।
সাঁকোটা ভিড়সুদ্ধ মড়মড় ভেঙে পড়ে । আমি ছিটকে যাই পাতালের দিকে। নামছি তো
নামছিই আর মুঠো করে ধরছি ঝুরঝুর বালি পিছল নুড়ি। পড়তে পড়তে ভাবছি পুরোনো কথা আর
তোমাকে ডাকার জন্যে ঠোঁট খুলছি। কী নাম যেন তোমার? কঙ্কাবতী? কাঞ্চনমালা? না, অমন
রূপকথার মতন নাম কি তোমার হতে পারে কখনো? তবে কী? মুখে না আসুক, মনে মনে তার সঙ্গে
কত যে মিল আসছে। পা হড়কায় না এমন সমতলের। পাপড়ি মেলেছে এমন ভুঁইচাঁপার। সোনালি হয়েছে এমন ধানের, আর তাপজুড়োনো গানের,
ভয়তাড়ানো চোখের, ঘুমের দাওয়ায় বিছোনো শীতলপাটির । না, রূপকথা না, জলমাটিমানুষের
সত্যিকারের জায়গা চেনার মতন। তোমার সেই নাম ঘুরছে আমার শিরা উপশিরায়, লাল
কণিকাগুলো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে। শুনতে পাচ্ছ না? গলার আওয়াজ যদি মরে মরুক, তাতে
কী? তুমি সাড়া দাও। আমাকে পা ফেলবার জমিতে টেনে তোলো।
রাস্তা
রাস্তার কথা
ছাড়া কী আছে আর?
ঘরগুলোই তো
রাস্তায়
উনুনের ধোঁয়ায় কচি
আওয়াজ ঘুরছে,
জাদুখেলা চলছে
পুঁতির মালা পুতুল
আর রঙিন ছবির,
ছাইগাদার স্বপ্নের
চারা
ছোট ছোট পাতা
নাড়ছে
খুকীর হাতের লাল
রুলি
খোকার ধরা
ঘাড়বাঁকানো ঘোড়া
বাতাস মজিয়ে
দেখছে,
ক্ষুদে ক্ষুদে
পাগুলোর শব্দ ঠিক গানের মতো।
অনন্ত নীল থেকে
অনন্তপ্রসাদের গলা;
হেই রাত্রি হেই
দিন
পাহাড় থেকে নদী
বইয়ে দাও,
জলছপছপ ঘাসের ওপর
দিয়ে খোকাখুকুরা
বড়োদের নিয়ে যাক
গেরস্থালিতে,
রাস্তারা পড়ে
থাকুক রাস্তায়।
এই আমি
আমি কতবার যে
নিজেকে বলি তুমি ‘ধন্য ধন্য হে’ । এটা আত্মনির্ভরতার যুগ। সুতরাং আত্মপ্রচার করতেই হয়।
অবিশ্যি নেপথ্য ব্যবস্থাও আছে, কিন্তু তার কোনো প্রয়োজন আমার নেই। নিজমুখে বলাটাই
আমি বেছে নিয়েছি।
আমি একজন অতি
উৎকৃষ্ট (সর্বোৎকৃষ্টও বলা যায় হয়তো) অভিনেতা। যাঁরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে নাটক করে হৈ চৈ
লাগিয়ে দেন, অনেক সময় বিশ্বজয় করেন, আমি তাঁদের দলে পড়ি না। আমি তৈরি-করা
মঞ্চটঞ্চের ধার ধারি না। জীবনটাই আমার মঞ্চ। আমার অভিনয়কে তা থেকে পৃথক করা যায় না।
এই মূর্হুতে যখন
আমার হৃদপিণ্ড ফাটব-ফাটব করছে, তখন আমি তারুন্যের জয়গান গাইছি। আর যদি তার
দুর্বলতার কথা ওঠে, তাহলে বলতে হয় হৃদয়দৌবর্ল্য আমার আজন্মর ব্যাধি। সেজন্যে
মেয়েদের কাছ থেকে আমি স্বান্তনা পেয়েছি বরাবর। কিন্তু এখন যদি তারা জেনে যায় যে ,
আমার দু পাঁজরার মধ্যে ঘুরনকাঁটাটা বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম করেছে, তাহলে সর্বনাশ।
তারা আর আসবে না। কাকে স্বান্তনা দিতে আসবে? সেজন্যে তারুন্যের কথাই বলে চলব আমি।
বলব অভিযানের কথা । বলব চাঁদসূর্য নিয়ে খেলা করার অতিমানবিক অভিজ্ঞতার কথা। এবং
তারই ফাঁকে একটু চুপ করে শুনে নেব ঘড়িটার টিকটিক। কারো বোঝার সাধ্যি নেই আমি অভিনয়
করছি। জীন-অভিনেতা আমি। আমার আসল নকল তফাৎ করবে কে?
ঘাসফড়িং
একটা ঘাসফড়িং এর সঙ্গে আমার গলায় গলায় ভাব হয়েছে,
ভাব না করে পারতামই না আমরা।
ঝিরঝির বৃষ্টির পর আমি ভিজে ঘাসে পা দিয়েছি
অমনি শুরু হয়ে গেল আমাদের নতুন আত্মীয়তা।
সবুজ মাথা তুলে কত খেলা দেখাল ঘাসফড়িং,
তার কাছ থেকে চলে আসার সময় আমার কী মনখারাপ
বলে এলাম আমি আবার আসব,
আমার ঘরের দরজা এখন সবুজে সবুজ।
এই আবার ঝিরঝির বৃষ্টি
আমি কথা দিয়ে এসেছি
ভিজে ঘাসের ওপর আমাকে যেতেই হবে আবার।
********************************
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন